08/07/2025
রুয়েটের বিদায়ী ব্যাচ আবাবিল'১৯ কর্তৃক ২৪ সিরিজ সহ সকল জুনিয়র সিরিজদের প্রতি উপদেশ, অনুরোধ ও আহ্বান :-
প্রিয় ভাইয়েরা, সময়ের পরিক্রমায় আমাদের চলে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। একদিন আমরা কাঁচা মনে , বহু ছোট ছোট স্বপ্ন নিয়ে এই রুয়েট ক্যাম্পাসে এসেছিলাম, হাটিহাটি পা করে মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। এখন আমাদের যাওয়ার পালা। একদিন তোমাদেরও যাওয়ার সময় হয়ে যাবে। কিন্তু এই মধ্যবর্তী সময়টা অনেকক্ষেত্রে তোমাদের জীবনের গতিপথ বদলে দিতে পারে। রুয়েট ক্যাম্পাসে এই দীর্ঘ সময় থেকে আমাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে তোমাদের প্রতি আমাদের আহ্বান, উপদেশ ও অনুরোধ নিয়ে কিছু বলে যেতে চাই।
১. সব সময় মনে রাখবে রুয়েটে তুমি কি কারণে ভর্তি হয়েছো। নিজের উদ্দেশ্য ঠিক রাখবে সব সময়। রুয়েটে তোমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লেখাপড়া। লেখাপড়ার সাথে কখনো কম্প্রমাইজ করবে না৷ যদি তোমাদের উদ্দেশ্য ঠিক রাখতে না পারো তাহলে সহজেই হোঁচট খেয়ে যাবে৷ আর, এটা তোমার সারাজীবনে একটা দাগ হয়ে থাকবে। তাই এমন কোনো কাজ করবে না যেন সেটার গ্লানি তোমাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। তোমার পড়াশোনার মাঝে কখনো অন্যকিছুকে স্থান দিবে না। মনে রাখবে রুয়েটে ভর্তি হওয়া মানে যে শুধু তোমার নিজের উপর সবকিছু তা কিন্তু না, তোমার বাবা মা, আত্মীয়স্বজন এমনকি এই দেশের সাধারণ মানুষের ও দাবি আছে তোমাদের উপর , যেহেতু পাবলিকের টাকায় তোমরা পড়াশোনা করছো।
২. এডমিশনের এই প্রতিযোগিতার পরে রুয়েটে ভর্তি হয়ে স্বাভাবিকভাবেই আমরা অনেকে মনে করি আমার কাজ শেষ। সত্যি কথা বলতে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পরে যখন সিটি, ল্যাব রিপোর্ট, ভাইভা সব কিছু দেখে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ি। সব সময় মনে রাখবে কখনো হতাশ হওয়া যাবে না৷ হতাশ, গ্লানি, ব্যর্থতা আসাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা পড়ে থাকা যাবে না। ধৈর্যের সাথে এই হতাশা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এই রুয়েটের অনেক ফুল ফুটার আগেই কুড়ি অবস্থায়ই ঝড়ে গিয়েছে এই হতাশার জন্য৷ মানুষের জীবনের হতাশা ব্যর্থতা থাকবেই। এটাই মানুষের জীবন। আল্লাহ্ মানুষকে পরীক্ষা করেন বিভিন্ন বিপদ, দুর্দশা, জান ও মালের ক্ষতি দিয়ে, আর সুসংবাদ তো ধৈর্যশীলদের জন্য। হতাশায় পড়ে হয়ত তোমার কাছে মনে হতে পারে এই জীবনটা একদমই শেষ হয়ে গেলো, কিন্তু কে জানে যে সেই তুমিই হয়ত ১০-১৫ বছর পরে এই সময়ের কথা মনে করে হাসবে। জীবনে যারা সফল হয়েছে তারা সবাই এর মধ্যে দিয়েই অতিক্রম করেছে৷ সুতরাং, সব সময় মনের রাখবে যে মানুষকে সবসময় লড়ে যেতে হয়।
৩. তোমার বাবা -মা, শিক্ষক, সিনিয়র বা কারো সাথে কখনো বেয়াদবি করবে না। কাউকে ভালো নাই লাগতে পারে কিন্তু বেয়াদবদের কিন্তু কেউই পছন্দ করে না। বেয়াদবরা মানুষের অন্তরে একটা দাগ কেটে দেয় যেটা কখনো মিটে না। কোন একসময় বেয়াদবি ট্রেন্ড ছিল, বেয়াদবি কে পশ মনে করা হতো কিন্তু যখন মানুষের বয়স বাড়ে তখন আস্তে আস্তে নিজের ভুল বুঝতে পারে , তখন আর কিছুই করার থাকে না । মনে রাখবে মানুষের সময় বা শক্তি সব সময় একই রকম থাকে না। সব সময় চেষ্টা করবে বিনয়ী হয়ে চলতে। শেষ হাসি কিন্তু তারাই হাসে। ম্যাকানিকালের রফিকুল আলম বেগ স্যার বলতেন " শিখতে হয় মাথা নীচু করে আর চলতে হয় মাথা উঁচু করে"
৪. ছাত্রজীবন থেকে ইনকাম করার বা এক্সট্রা স্কিল শিখার চেষ্টা করবে। তোমার পড়াশোনা রিলেটেড কোন ইনকাম সোর্স যেমন ফ্রিল্যান্সিং বা ব্যবসা ইত্যাদিতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবে , তবে সেটা যেন কোনোভাবেই তোমার পড়াশোনা বা রেজাল্টকে হ্যাম্পার না করে । গৎবাঁধা নিয়মে চলার থেকে যদি তুমি ছাত্রজীবন থেকেই ইনকাম শুরু করতে পারো অথবা প্রয়োজনীয় স্কিল গুলো শিখে রাখতে পারো , গ্র্যাজুয়েশন শেষে দেখবে যে তুমি অনেক পথ হেঁটে চলে এসেছো যেখানে অনেকে শুধু যাত্রা শুরু করেছে। তবে সেই ইনকাম টা হতে হবে হালাল পথে। মনে রাখবে আমাদের রিজিক নির্দিষ্ট। তোমার রিজিকে যা লিখা আছে তা তোমার কাছে আসবেই , কিন্তু হালাল নাকি হারাম উপায়ে সেটা তোমার উপরে নির্ভর করবে।
৫. বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তচর্চার জায়গা বলা হয়- মানে, যা খুশি তাই করার অনুমতি? আসলেই কি তাই? আমরা কি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি? যদি তাই হতো, তাহলে আমাদের আর পশুর মধ্যে কি কোনো পার্থক্য থাকতো?
মনে রাখবে, সমাজে অনেক ট্রেন্ড চলবে, কিছুদিন পর ক্ষ্যাত হয়ে যাবে, আবার নতুন ট্রেন্ড আসবে। কিন্তু তোমার বিবেক, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ চেঞ্জ হবে না। সমাজের ট্রেন্ডের সাথে যদি কেউ নিজেকে চালিয়ে দেয় তাহলে সে তো সেই নদীর স্রোতে বয়ে চলা কচুরিপানার মতো। যে স্রোতের সাথে ভেসে যায়। তার কাছে নদী ও যা , ডাস্টবিনও তা। কেউ যদি স্রোতের বিপরীতে না চলতে পারে , ভালো মন্দের পার্থক্য না করতে পারে তাহলে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হবে কীভাবে ? মনে রাখবে সমাজের পরিবর্তন কিন্তু হয় স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষদের মাধ্যমেই যদিও সেটা পজিটিভ হোক না নেগেটিভ। মনে রাখবে বিবেক বিসর্জন দিয়ে স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে দেয়াতে কোন কল্যাণ বা সফলতা নেই। মানুষের পরিচয় তার শিরদাঁড়ায়।
৬. এই জগতে আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালো চান আমাদের বাবা মা। তাদের মনে কষ্ট দিবে না কখনো। আমাদের রক্তের সম্পর্কের বাহিরেও অনেকেই আমাদের ভালো চান কোন প্রকার পার্থিব লাভ ছাড়া। এই সকল মানুষদের সংস্পর্শে থাকবে। ভালো মন্দের জ্ঞান তোমাদের আছে । তোমাকে যদি কেউ খারাপের দিকে আহ্বান করে সেটাও তুমি বুঝতে পারো আবার ভালোর দিকে আহবার করলে সেটাও বুঝতে পারো। কিন্তু শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু । দেখা যায় যারা আমাদের খারাপের আহ্বান করে তাদের প্রতিই আমাদের আকর্ষণ বেশি হয় , তাদেরকেই আমাদের ভালো লাগে বেশি। আমরা যেমন রুয়েট লাইফ থেকে চলে যাচ্ছি একদিন এই দুনিয়া থেকেও চলে যেতে হবে। এটাই বাস্তবতা। রুয়েটের জীবন হয়ত ৪ বছরের , মানুষের জীবন হয়ত ৭০-৮০ বছরের , কিন্তু একটা সমাপ্তি আছে। যেখানে মৃত্যুর পরের জীবন আখিরাতের কিন্তু কোন সমাপ্তি নেই।
সেই জীবন যেখানে শেষ বলতে কোন কনসেপ্টই নেই, সময়ের কোন সমাপ্তি নেই, যেখানে কোন মৃত্যু নেই, সেই জীবনের কথা ও মনে রাখবে। সেই অনন্ত জীবনে যারা আমাদেরকে আগুনের দিকে আহ্বান করে , যারা আমাদের কে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যেতে চায়, তাদের থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। এই রঙিন সময় আর ফ্যান্সি টার্ম কিন্তু একসময় শেষ হয়েই যাবে, কিন্ত এই কাজের প্রতিফল কিন্তু অনেককাল থাকবে। মনে রাখবে জান্নাতের অধিবাসীরা আর জাহান্নামের অধিবাসীরা কখনো সমান হবে না। আর , জান্নাতিরাই সফলকাম।
যারা তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুনের দিকে পঙ্গপালের মতো প্রবেশ করাতে আহ্বান করছে , এদের থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করো। তোমার সময় , তোমার অর্থ, তোমার শ্রম যেন নিজেকে ও মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিতে ব্যয় না হয়। যেন এমন না হয় যে আমাদের জীবনের শেষ সময়ে গিয়ে আফসোস করতে হয় যে , হায় আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম !
সময়ের এই ছোট্ট অধ্যায়টাই তোমার জীবনের দিক ঠিক করে দিতে পারে। ভালোবাসো নিজের স্বপ্নকে, সম্মান করো নিজের পরিচয়কে, আর দায়িত্বশীল হও নিজের ভবিষ্যতের প্রতি। একদিন আমরাও ছিলাম তোমাদের জায়গায়—আজ তোমরা আমাদের জায়গায় আসছো।
আমরা আবাবিল ’১৯, বিদায়ের আগে তোমাদের কাছে শুধু দোয়া চাই। যেন আমরা জীবনের পথে সত্যিকারের সফল হতে পারি ।
আবাবিল '১৯ বিদায় নিচ্ছে—কিন্তু রুয়েটিয়ান পরিচয়টা আজীবনের। ভালো থেকো, এগিয়ে চলো, পথ হারিয়ো না।