01/10/2025
আমার আম্মা – কিংবদন্তির আম্মাজান
ভূ-স্বামী বাবার ঘর হতে কনিষ্ঠ কন্যাটি যখন মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফের অসাধারণ একটি সাংসারিক কাঠামোতে প্রবেশ করলো তখনও তাঁর চমকিত হওয়ার বাকি ছিল। সম্পূর্ণ দুনিয়াবিমুখ আপন ভোলা মগ্নচিত্ত একজন পুরুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে আবিষ্কার করাটা তাঁর জীবন এবং জীবনবোধকে আমূল পাল্টে দিয়েছিল নিঃসন্দেহে। এই অসাধারণ জীবনের বৃত্ত সম্পূর্ণ করা সম্ভব কিনা এ বিষয়ে তাঁর পরিবার দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও আমরা বিস্ময়চিত্তে লক্ষ্য করি যে মোসাম্মত মুনাওয়ারা বেগম ইতোমধ্যে এই মগ্নচিত্ত পুরুষটি এবং এই অসাধারণ পরিবারটির জমিনে তাঁর মনের নোঙরটি শক্ত করে গেঁথে নিয়েছেন নির্দ্বিধায়। এই নোঙরটি, যতই দিন গিয়েছে, মাইজভাণ্ডারীয়া ত্বরিকার শিক্ষা, আদর্শ, সংস্কৃতির সাথে আরো নিবিড় হয়েছে, যা তিনি আমৃত্যু ধারণ করেছেন। সন্তানরা যে যার মতো জীবনের পথে চলে গিয়েছে, কিন্তু তিনি একদিনের জন্যও দরবারের জমিন ছেড়ে অন্য কোনখানে যাওয়া বা থাকাকে পছন্দ করেননি। কোথাও যেতে হলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যেই তিনি আবার ফিরে এসেছেন 'হক মঞ্জিলে'।
স্নেহ নিম্নগামী, পড়েছি, শুনেছি, বুঝিনি। সন্তানের অদর্শনে হৃদয়ের খাঁ খাঁ করা হাহাকার, আদর স্নেহ দেয়ার দুর্দমনীয় লোভ কেমন তা বুঝিনি। যখন আমার রক্তধারা প্রবাহিত হলো, ভবিষ্যতের পানে তখন সেই হৃদয়ে মোচড় দেয়া রক্তের ডাক, স্নেহের অনুভূতির দেনা-পাওনার সেই নাগাল পেলাম। এমন সময়ে একদিন হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকানির মতো ভাবনায় এসে গেল, আমার আম্মাতো এই শূন্যতা মেনে নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন অবলীলায়। নিজের স্নেহের ধন যারা, তাদের সাথে থেকে স্বর্গীয় আনন্দের ধারায় স্নাত করার অপার্থিব মায়াকে ত্যাগ করেছেন। চিরাচরিত এই মানবিক অনুভূতিকে বিসর্জন দিয়ে দরবারের খেদমতের নৈতিক, আধ্যাত্মিক চেতনাকে অগ্রগণ্য করেছেন।ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে দরবারের প্রয়োজনে তুচ্ছজ্ঞান করে আমার আম্মা হয়ে উঠেছেন 'আম্মাজান'। নিজের স্বার্থ,
নিজের সাধ, নিজের প্রয়োজন, নিজের স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দেয়া, পরিত্যাগ করাটা তাঁর জীবনে সহজাত হয়ে উঠেছিল। ত্যাগের এই শক্তি ছিল তাঁরই স্বামী সর্বস্বত্যাগী খোদাপ্রেমে বিভোর শাহানশাহ্ বাবাজানের রূহানী তাসারুফাত-এর প্রতিক্রিয়া।
ভক্তি, ত্যাগ, নৈতিকতা, সংগ্রাম, সরলতা, কর্তব্যনিষ্ঠার এক বিরল উদাহরণ আম্মার জীবন। তিনি সেই ব্যক্তিত্ব যিনি কৃষ্ণতা সাধনের প্রয়োজনে সন্তানদের মাছ এবং মাংস একবেলায় পরিবেশন করতেন না। আবার দরবারের প্রয়োজনে আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর পূর্বেও আড়াই লাখ টাকা দরে পুকুরের অংশ কিনতে দ্বিধা করেননি। দরবারের ভবিষ্যতকে নিরুপদ্রব করার জন্য সদর-অন্দরের সমস্ত সমস্যাকে সমাধান করেছেন অপরিসীম ধৈর্য্য সহকারে। পতি-অন্তঃপ্রাণ আম্মা নিজের সমস্ত দুঃখ ও চাওয়া-পাওয়াকে চাপা দিয়ে হাসিমুখে সন্তানদের প্রতি সমস্ত দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। মন্জিল গঠনের প্রতিটি কাজে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন। অক্লান্তভাবে দরবারে আগত মেহমানদের খেদমত করেছেন। দরবারের জন্য নিঃস্বার্থ আত্মবিলয়ের ক্ল্যাসিক, ঐতিহাসিক উদাহরণগুলোর মধ্যে এটি মহাগুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। সহজাতভাবে তিনি সহজ সরল ছিলেন,
দুনিয়া তাঁর ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। ততটুকুই দুনিয়া করেছেন, যতটুকু দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজন। এমনকি কারো জন্য ক্ষতির শিকার হলেও কখনো কারো সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য, কটু-কাটব্য করতে আমরা শুনিনি। শাহানশাহ্ বাবাজানের উপর অগাধ ভক্তি বিশ্বাস তাঁকে সমস্ত আপাত সাধ্যাতীত কাজ সমাধানে শক্তি যুগিয়েছে।
দুনিয়াবী অর্থে মুরুব্বিহীন হয়েও মুরুব্বিয়ানা করেছেন অত্যন্ত কুশলতার সাথে। সন্তানের পড়ালেখা, সুযোগ-সুবিধা, বিয়ে-শাদী সবকিছুই দরবারে অবস্থান করেই অত্যন্ত নিপুণতার সাথে সম্পাদন করেন। অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েও তাঁর এই কর্তব্যনিষ্ঠ অবদান অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মরণ করতে হবে সকলকে সারাজীবন।অছিয়ে গাউসুল আযম শাহ্ সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীর নৈতিক জীবনকে, তাঁর আধ্যাত্মিকময় দুনিয়াবী কর্মকান্ডকে আম্মাজান গভীরভাবে অনুসরণ করতেন। তিনি দুনিয়ার হায়াতে থাকাকালীন সময়ে তাঁর পরামর্শে এবং আদর্শেই সমস্ত কর্ম সম্পাদন করেছেন। অছিয়ে গাউসুল আযম যে সংগ্রামশীল সুনেতৃত্বের সফলতার পয়গাম আমাদের দিয়েছেন তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ আম্মাজান।
অপার্থিব ঐশি আলোর জীবনসঙ্গিনীও আলোকস্নাত হবেন তাই স্বাভাবিক – আম্মাজান ছিলেন তাই।
আলোকস্নাত এই অন্তর্জগতের কারণে শাহানশাহ্ বাবাজানের পার্থিব জীবন সমাপনীর জন্য আম্মাজানের কাছ হতে অনুমতির অলৌকিক প্রয়োজন হয়েছিল। শাহানশাহ্ বাবাজানের বেচালের একমাস পূর্বে তিনি স্বপ্নে দেখেন, এক অলৌকিক পুরুষ এসেছেন তাঁর কাছে তাঁর অনুমতির জন্য। শাহানশাহ্ বাবাজানকে পারলৌকিক জগতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই ঘটনা তিনি পরিবারের সবাইকে বলেন এবং আমাদেরকে বাবাজানের বিদায়ের জন্য প্রস্তুত করেন।
আম্মাজানের খেদমত যে দরবারে কবুল হয়েছে তা ২৬শে আশ্বিনের নিকটবর্তী সময়ে তাঁর ওফাতের ভেতর দিয়ে এবং লক্ষ আশেক-ভক্তের রোনাজারিপূর্ণ উপস্থিতির মধ্যে দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। কোন মহিলার এতবড় জানাযা স্মরণকালে কেউ দেখেনি। ফেরেস্তারাও নিশ্চয় সামিল ছিলেন সেই জানাযা শরিফে।
আমরা জানি আম্মাজানের বিদায়ে মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফের ইতিহাসে একটি যুগের সমাপ্তি ঘটেছে। তাঁর পথ ধরে অসংখ্য আশেক-ভক্ত এই পৃথিবীকে আলোকময় স্থানে পরিণত করুন এই কামনা করছি।
----
উম্মুল আশেকীন-এর জগৎ সমাদৃত সন্তান ও রাহবার, আল্লাহর মহান বন্ধু রাহবারে আলম হযরত মওলানা শাহসুফি
সৈয়দ মোহাম্মদ হাসান মাইজভাণ্ডারী (ম.)'র লিখনীতে "আম্মাজান"