07/10/2025
১। অতঃপর রাজা মিলিন্দ আয়ুষ্মান নাগসেন সমীপে উপনীত হইলেন এবং তাঁহার সহিত অভিনন্দন ও যথাযোগ্য সম্ভাষণ সমাধা করিয়া এক প্রান্তে বসিলেন। আয়ুষ্মান নাগসেনও প্রত ̈ভিনন্দন দ্বারা রাজা মিলিন্দের চিত্ত প্রসন্ন করিলেন।
তখন, রাজা নাগসেনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভন্তে! কি প্রকারে আপনি পরিচিত হন, আপনার শুভ নাম কি? মহারাজ! নাগসেন নামে আমি পরিচিত হই। আর আমার সব্রহ্মচারিগণ আমাকে ঐ নামে ডাকেন। মহারাজ! যদিও মাতা-পিতা নাগসেন, শূরসেন, বীরসেন কিংবা সিংহসেন এই জাতীয় কোন নাম রাখিয়া থাকেন, কিন্তু সেই নাগসেনাদি কেবল ব্যবহার করিবার নিমিত্ত আখ্যা, সংজ্ঞা, প্রজ্ঞপ্তি নাম মাত্র; কেননা, ইহাতে কোন পুদগলের (আত্মার) উপলব্ধি হয় না।”
২। তখন রাজা মিলিন্দ কহিলেন, “হে পঞ্চশত যবনগণ, অশীতি সহসধ ভিক্ষুগণ! আপনারা শুনুন, এই নাগসেন বলিতেছেনÍ‘এই স্থলে কোন পুদগলের (আত্মার) উপলব্ধি হয় না’ ইহা অভিনন্দের যোগ ̈ কি?”
তখন রাজা নাগসেনকে বলিলেন, “ভন্তে নাগসেন! যদি কোন পুদগল বা আত্মা না থাকে তবে কে আপনাদিগকে চীবর, ভোজন, শয়নাসন ও রোগ প্রত্যয়ভৈষজ ̈ উপকরণ দেয়? কে উহা পরিভোগ করে? কে শীল রক্ষা করে? কে ধ্যানসাধনায় নিযু৩ হয়? কে আর্য ̈মার্গ- ফল নির্বাণ সাক্ষাৎ করে? কে প্রাণীহত্যা করে? কে পরদ্রব্য ̈ হরণ করে? কে ব্যভিচার করে? কে মিথ্যা বলে? কে মদ ̈পান করে? কে এই পঞ্চ আনন্তরীয় কর্ম করে? যদি তাহা হয় তবে পাপ নাই, পুণ ̈ নাই, পাপ পুণ্যকর্মের কোন কর্তা বা কারক নাই, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের কোন ফল-বিপাক নাই। ভন্তে নাগসেন! যদি কেহ আপনাকে হত্যা করে তবে তাহারও প্রাণীহত্যা হইবে না। ভন্তে নাগসেন! তবে আপনাদের কেহ আচার্য ̈ নাই, উপাধ্যায় নাই, আপনাদের উপসম্পদাও নাই। আপনি যে বলিতেছেনÍ‘মহারাজ! সবধহ্মচারিগণ আমাকে নাগসেন নামে সম্বোধন করেন’ তবে এখানে নাগসেন কে? ভন্তে! আপনার কেশ কি নাগসেন?”
“না, মহারাজ!”
“লোম কি নাগসেন?”
“না, মহারাজ!”
“নখ, দন্ত, ত্বক, মাংস, স্নায়ু, অস্থি, অস্থি-মজ্জা, বক্ষ, হৃদয় যকৃৎ, ক্লোমা, প্লীহা, ফুসফুস, অন্ত্রবন্ধনী, উদরীয় (উদরস্থ্য ’ খাদ্য ̈), বিষ্ঠা, পিত্ত, শ্লোষ্মা, পূষ, রক্ত, মেদ, অশ্রু, বসা, থুথু, সিকনি, লালা, মূত্র অথবা মস্থকস্থ্য’ মগজ কি নাগসেন?”
“না, মহারাজ!”
“ভন্তে! আপনার রূপ কি নাগসেন?”
“না মহারাজ!”
“আপনার বেদনা কি নাগসেন?”
“না, মহারাজ!”
“আপনার সংজ্ঞা কি নাগসেন?”
“না, মহারাজ!”
“আপনার বিজ্ঞান কি নাগসেন?”
“না, মহারাজ!”
“তাহা হইলে কি রূপ বেদনা সংজ্ঞা সংস্কার ও বিজ্ঞান নাগসেন!”
“না, মহারাজ!”
“রূপ-বেদনা-সংজ্ঞা-সংস্কার -বিজ্ঞান ব্যতীত আর কিছু নাগসেন?”
“না, মহারাজ!”
“ভন্তে! প্রশ্ন করিতে করিতে নাগসেনকে ত দেখিতেছি না। তবে নাগসেন
শব্দ মাত্রই কি নাগসেন? শেষ পর্যন্ত এখানে নাগসেন কে? ভন্তে! আপনি মিথ্যা বলিতেছেন। নাগসেন কেহ নাই।”
৩। তখন, আয়ুষ্মান নাগসেন রাজা মিলিন্দকে কহিলেন, “মহারাজ! আপনি ক্ষত্রিয় সু-কুমার, দেহ অতি সুকোমল। এই মধ্যাহ্ন সময়ে তপ্তভুমি, উষ্ণ তপ্ত বালুকা ও পখ্র র কাঁকর-পাথর মর্দন করিয়া পদব্রজে আসায় নিশ্চয় আপনার পা ব্যাথা করিতেছে, দেহ ক্লান্ত হইয়াছে, মন অবসন্ন হইয়াছে, দুঃখ-যুক্ত, কায়-বিজ্ঞান উৎপন্ন হইয়া থাকিবে। আপনি কি এখানে পদব্রজে আসিয়াছেন অথবা কোন যানবহনে আসিয়াছেন।”
“ভন্তে! আমি পদব্রজে আসি নাই। রথে চড়িয়া আসিয়াছি।”
“মহারাজ! যদি আপনি রথে করিয়া আসেন তবে আপনার রথ কি আমাকে বলুন! মহারাজ! ঈশা দন্ড কি রথ?”
“না, ভন্তে!”
“অক্ষ কি রথ?”
“ না ভন্তে!”
“চক্র কি রথ?”
“না ভন্তে! ”
“রথপঞ্জর কি রথ?”
“না, ভন্তে! ”
“রথদন্ড- কি রথ?”
“না, ভন্তে! ”
“রথযুগ কি রথ?”
“না ভন্তে! ”
“রথরঞ্জু কি রথ?”
“না, ভন্তে!”
“চাবুক কি রথ?”
“না, ভন্তে! ”
“মহারাজ! তবে ঈশা অক্ষ চক্র পথপঞ্জর রথদণ্ড রঞ্জু চাবুক একত্রযোগে কি রথ?”
“না, ভন্তে!”
“মহারাজ! ঈশা অক্ষ পথপঞ্জর রথদন্ড রঞ্জু চাবুক ব্যতীত অন্য কিছু কি রথ?”
“না, ভন্তে! ”
“মহারাজ! আপনাকে প্রশ্ন করিয়া করিয়া রথ কোথায় দেখিতে পাইলাম না ত? রথ শব্দই বা কি তবে রথ? প্রকৃত পক্ষে এখানে রথ কি? মহারাজ! আপনি মিথ্যা কথা বলিতেছেন। রথ নাই। মহারাজ! সমগ্র জম্বু দ্বীপে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা, কাহার ভয়ে আপনি মিথ্যা বলিতেছেন? হে পঞ্চশত যবনগণ, অশীতি সহসধ ভিক্ষুগণ! আপনারা শুনুন! রাজা মিলিন্দ বলিতেছেন ‘আমি রথে করিয়া আসিয়াছি।’‘যদি মহারাজ! আপনি রথে করিয়া আসেন, তবে রথ কি আমাকে বলুন।’ এই কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি রথ নির্ণয় করিতে পারিতেছেন না। তাঁহার কথা অভিনন্দনযোগ্য কি?”
৪। এইরূপ কথিত হইলে পঞ্চ শত যবনগণ আয়ুষ্মান নাগসেনকে সাধুবাদ দিয়া রাজা মিলিন্দকে কহিলেন,
“মহারাজ! আপনি সমর্থ হইলে এখন উত্তর দিন।”
তখন, রাজা মিলিন্দ নাগসেনকে কহিলেন, “ভন্তে নাগসেন! আমি মিথ্যা বলি নাই। ঈশা অক্ষ চক্র পথপঞ্জর রথদন্ডাদির এই আখ্যা, সংজ্ঞা, প্রজ্ঞপ্তি ও নাম কেবল ব্যবহার বচনেই প্রচলিত হয়।”
“উত্তম মহারাজ! আপনি রথ কি জানিয়াছেন। এই প্রকারেই মহারাজ! কেশ
ইত্যাদিকে আশ্রয় করিয়া কেবল ব্যবহারের নিমিত্ত ‘নাগসেন’ এই এক নাম কথিত হয়। কিন্তু পরমার্থ হিসাবে এখানে কোন পুদগল (আত্মা) বিদ্যমান নাই। মহারাজ! বজিরা ভিক্ষুনী ভগবানের সম্মুখে বলিয়াছিলেন :
“অঙ্গসমূহকে আশ্রয় করিয়া যেমন ‘রথ’ এই নাম ব্যবহৃত হয়, সেইরূপ পঞ্চস্কন্ধকে উপলক্ষ ̈ করিয়া সত্ত্ব (জীব) এই ব্যবহার প্রযুক্ত হয়।”
“ভন্তে নাগসেন! বড়ই আশ্চার্য! বড়ই অদ্ভুত! আপনি অতি বিচিত্র উপায়ে গভীর প্রশ্নের উত্তর দিলেন। যদি এই সময় বুদ্ধ থাকিতেন তবে আপনাকে এই ভাবে সাধুবাদ দিতেন ‘সাধু, সাধু, নাগসেন! অতি বিচিত্র উপায়ে তুমি গভীর প্রশ্নের উত্তর দিয়াছ’।”