06/08/2025
আমেরিকান প্রথম বৌদ্ধ হেনরি অলকট
ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
বৌদ্ধ ধম্মের মহান প্রচারক ও বিশ্ব বৌদ্ধ পতাকার অন্যতম রূপকার মহান মনীষী কর্ণেল হেনরি স্টীল অলকটের স্মরণে আজ এ আলেখ্য উপস্থাপন করছি।
কর্ণেল হেনরি স্টীল অলকটের জন্ম ২রা আগস্ট ১৮৩২ সালে আমেরিকার ন্যু জার্সি রাজ্যের অরেঞ্জ কাউন্টিতে। তিনি ছিলেন মূলত: একজন আমেরিকান সৈনিক, সাংবাদিক, উকিল এবং থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা।
বৌদ্ধ ধম্ম গ্রহণ
————————
১৮৮০ সালে তিনি শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি নিজেকে একজন বৌদ্ধরূপে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম আমেরিকান, যিনি স্বীয় আধ্যাত্মিক সঙ্গী হেলেনা ব্লাবস্কীর (১৮৩১-১৮৯১) সঙ্গে ত্রিরত্নের শরণ (Three refuges) এবং পঞ্চশীল (Five precepts) গ্রহণ করে বৌদ্ধ ধম্মের দীক্ষা গ্রহণ করেছেন।
কর্ণেল হেনরি স্টীল অলকট শ্রীলঙ্কার বরপুত্র অনাগারিক ধম্মপালের সাথে একত্রিত হয়ে বৌদ্ধ ধম্মের পুনরুদ্ধার এবং শিক্ষা প্রসারে প্রমুখ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৮৮৫ সালে তিনি বিশ্ব বৌদ্ধ পতাকা (World Buddhist flag) নির্মাণে ডিজাইন করতে সহযোগিতা করেছেন, যা বর্তমানে বৈশ্বিক বৌদ্ধ প্রতীকরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্ত পর্যন্ত বৌদ্ধদের ঐক্যতার কোনো প্রতীক বা পতাকা ছিলনা, যাতে বৌদ্ধরা নিজেদের পরিচয়কে দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত করতে পারে। বৌদ্ধদের ঐক্যতার প্রতীক দিতে, গৌরব দান করতে, পরিচয় তুলে ধরতে এবং সংগঠিত শক্তি প্রদান করতে একটি পতাকার অতীব প্রয়োজন ছিল। পতাকার আবশ্যকতা ও গুরুত্ব সকলকে বুঝানো হয়েছে এবং ১৮৮৫ সালে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে বৌদ্ধ পতাকা নির্মাণ করা হয়েছিল।
Theosophical Society’ র নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যার প্রমুখ সদস্যগণ ছিলেন-
১) কর্ণেল হেনরি স্টীল অলকট (১৮৩২-১৯০৭)
২) বোধিসত্ব অনাগারিক ধম্মপাল (১৮৬৪-১৯৩৩)
৩) হিক্কাদুবে শ্রী সুমঙ্গল নায়ক থেরো (১৮২৭-১৯১১) এবং
৪) মিগেত্তুবত্তে শ্রী গুণানন্দ নায়কথেরো (১৮২৩-১৮৯০) সহ অন্যরা।
ষড়রশ্মি যুক্ত পতাকার ডিজাইন বিশেষত্ব
————————-
১) নীলবর্ণ-ধ্যান এবং করুণা
২) পীতবর্ণ-মধ্যম মার্গ বুদ্ধত্বের জ্যোতি
৩) লোহিতবর্ণ-বুদ্ধের মহাশক্তি বা তেজ
৪) ওদাত বা শ্বেতবর্ণ-শুদ্ধতা বা শান্তিপূর্ণ বিচার
৫) মঞ্জিষ্ঠবর্ণ-জ্ঞান এবং সমর্পণের প্রতীক
৬) প্রভাস্বর বর্ণ-উপরিউক্ত পাঁচ প্রকার বর্ণের মিশ্রিত বর্ণ, যা বুদ্ধের অনন্ত প্রভাকে (Aura) দর্শিয়ে থাকে।
এ ষড়রশ্মি বুদ্ধের ‘জ্ঞান-জ্যোতি’ হতে প্রকাশিত, যা বুদ্ধগয়ার বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির পরে চতুর্থ সপ্তাহে রতনঘর চৈত্য স্থানে ধ্যানমগ্ন থাকার সময় তাঁর শরীর হতে নির্গত হয়েছিল।
কর্ণেল অলকট এবং অনাগারিক ধম্মপালের ধম্মকার্য
————————————-
অলকটের ভূমিকা: কর্ণেল হেনরি স্টীল অলকট শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধদের মধ্যে শিক্ষা এবং সংগঠনে নতুন দিশা এবং প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। ধম্ম পতাকার ডিজাইনের মধ্যে তিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ এবং প্রতীকাত্মকতা যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কার সাথে সাথে বিশ্ব বৌদ্ধদেরকেও একত্রিত করণের দৃষ্টিকোণ হতে পতাকার ডিজাইন করা হয়।
অনাগারিক ধম্মপালের ভূমিকা: ধম্ম পতাকাকে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে অনাগারিক ধম্মপালের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। তৎকালীন সময়ে ব্রাহ্মণ্য দখল হতে বুদ্ধগয়া মুক্তি আন্দোলন, শিকাগোতে বিশ্ব ধম্ম সংসদ (১৮৯৩) সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এ পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। অনাগারিক ধম্মপালের মাধ্যমে এ পতাকা মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান, ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থান লাভ করেছে।
অনাগারিক ধম্মপাল ইহাকে ‘ধম্মের বিশ্ব ভাষা’ রূপে আখ্যায়িত করে বলেছেন-‘ইহা হল এমন এক প্রতীক, যা দেশ, জাতি, ভাষার ঊর্ধে উঠে সকল বৌদ্ধদের যুক্ত করেছে।’
বৈশ্বিক মান্যতা: ১৯৫০ সালে কলম্বোয় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সঙ্ঘ WFB (World Fellowship of Buddhists) দ্বারা এ ধম্ম পতাকা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ ধম্ম পতাকা রূপে মান্যতা লাভ করেছে। আজ এ পতাকা বিশ্বের সর্বত্র বৌদ্ধ বিহার সমূহে, সংস্থায় এবং বিভিন্ন উৎসবে শ্রদ্ধা এবং মর্যাদা সহকারে উত্তোলন করা হয়।
অনাগারিক ধম্মপাল এবং কর্ণেল হেনরি স্টীল অলকটের মত বৌদ্ধ মনীষীগণ কেবল বৌদ্ধধম্মের পুনরুত্থানই করেননি, বরং তাঁরা সংবিধান এবং প্রতীকাত্মকতার মাধ্যমেও বৌদ্ধ জাগরণের এক ঢেউ খাঁড়া করেছিলেন। বৌদ্ধ পতাকা হল সে আন্দোলনেরই অমর ঐতিহ্যপূর্ণ পতাকা, যা কেবল এক ধম্মের প্রতীক নয়, বরং শান্তি, করুণা এবং জ্ঞানের বৈশ্বিক ভাষারূপেও বিদিত।
কর্ণেল হেনরি স্টীল অলকট শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধদেরকে খৃষ্টান ক্যাথলিক মিশনের আগ্রাসন হতে রক্ষার উদ্দেশ্যে অনেক বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে জনগণকে মার্গ দর্শন দিয়েছেন। তাঁর দ্বারা স্থাপিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে আনন্দ কলেজ, ধম্মরাজা কলেজ, নালন্দা কলেজ প্রভৃতির নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিহারে বিহারে রবিবাসরীয় ধম্ম স্কুলের প্রচলন করে তিনি সদ্ধম্মের পূনর্বাসন জাগরণ এনে দিয়েছেন।
শিক্ষা এবং লেখন
————————
১৮৮১ সালে তিনি Buddhist Catechism নামক পুস্তক লিখেছিলেন, যা এখনও অনেক বৌদ্ধ বিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। Theosophical Society প্রতিষ্ঠা করে তিনি ধম্ম, দর্শন, বৌদ্ধ শিক্ষা এবং আধ্যাত্মিক সাধনকে নবরূপে পাশ্চাত্যে প্রসারের দরজা খুলে দিয়েছিলেন।
বৈশ্বিক প্রভাব
———————
বৌদ্ধ ধম্মকে পাশ্চাত্য বিশ্বে প্রচারে কর্ণেল অলকটের অবদান অনস্বীকার্য। বুদ্ধ শিক্ষার উদার আত্মবিশ্বাস, ভ্রাতৃত্ব এবং স্বাবলম্বীতা পাশ্চাত্য বিদ্বানদের বুঝাতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি অনাগারিক ধম্মপালের মত বৌদ্ধ মনীষীর নিবেদিত কর্মের সমর্থন ও সহায়তা প্রদান করেছিলেন এবং ধম্মপালকে বৈশ্বিক যাত্রা এবং বুদ্ধগয়া আন্দোলনের সর্বাঙ্গীন সহযোগিতা করেছিলেন।
নিধন এবং ঐতিহ্য
————————-
কর্ণেল হেনরি স্টীল অলকট ১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯০৭ সালে ৭৬ বছর বয়সে ভারতের মাদ্রাস (চেন্নাই) দেহ ত্যাগ করেছিলেন।
শ্রীলঙ্কায় এখনও কর্ণেল হেনরি স্টীল অলকটকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। রাজধানী কলম্বোর অন্যতম প্রধান সড়কের নাম হল ‘Olcott Mawatha’, অর্থাৎ অলকট সড়ক। সেখানে তাঁর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে এবং সরকার কর্তৃক স্মারক ডাক টিকেটও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ভাষণ, লেখনী, সংস্থা এবং ধাম্মিক প্রতিষ্ঠান সমূহ এখনও তাঁকে অমরত্ব দান করে রেখেছে। তিনি তাঁর আদর্শ, শিক্ষা এবং নি:স্বার্থ কাজের মাধ্যমে সকলের নিকট চিরঞ্জীব হয়ে আছেন।
তিনিই ছিলেন আমেরিকার কোনো বিদ্বান, যিনি সর্ব প্রথমে সার্বজনিকরূপে বৌদ্ধ ধম্মকে গ্রহণ করে প্রচার করেছিলেন। ১৮৮৫ সালে বিশ্ব বৌদ্ধ পতাকা নির্মাণে গঠিত কমিটির তিনি ছিলেন অন্যতম মুখ্য সদস্য, যা আজ বৈশ্বিক মর্যাদা অর্জন করেছে। তাঁর রচিত ‘Buddhist Catechism’ নামক পুস্তক শ্রীলঙ্কার অনেক বৌদ্ধ স্কুল-কলেজে পড়ানো হয়। বৌদ্ধ ধম্ম, দর্শন এবং আধুনিক যুগোপযোগী করে রচিত তাঁর পুস্তকের মাধ্যমে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীগণ অনেক উপকৃত হয়েছে।
কর্ণেল হেনরি স্টীল অলকট ছিলেন একজন পাশ্চাত্য বৌদ্ধ মনীষী, যিনি ছিলেন একাধারে পণ্ডিত, প্রচারক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, বৌদ্ধ পতাকার ডিজাইনার এবং বৈশ্বিক সংযোগ সংস্থাপক। তিনি বৌদ্ধ ধম্মকে আধুনিক, সুস্পষ্ট এবং সার্বভৌমিক রূপে স্থাপন করেছেন, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কায়। তাঁর প্রচেষ্টার মাধ্যমে অনাগারিক ধম্মপালের মত প্রাচ্যের ধম্ম প্রচারকের যাত্রা আন্তর্জাতিক মান্যতা প্রাপ্ত হয়েছে এবং বৌদ্ধ ধম্মের পুনরুত্থানকে নতুন দিশা প্রদান করেছে।
শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধম্ম এবং পুনরুত্থান
———————————
শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধম্মেপ পুনরুত্থান এবং শিক্ষা প্রসারে কর্ণেল হেনরি স্টীল অলকট মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর মহৎ জীবনের প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধার্ঘ্য।