04/08/2025
#মুক্তিযুদ্ধ
#বাংলাদেশেরইতিহাস
ছবিতে মাঝের ছেলেটির নাম মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ। ঢাকার ইস্কাটনের ভীষণ ধনী পরিবারের ছেলে ছিলো আজাদ। তাঁদের ইস্কাটনের বাড়িটা ছিলো দেখার মতো। পৌনে দুই বিঘা জমির উপরে বাড়ি। আজাদ একাধারে ছিলেন ভীষণ ফ্যাশনেবল এবং পড়াশোনায় দুর্দান্ত মেধাবী।
সিনেমার পোকা ছিলেন আজাদ। ছিলেন এলভিস প্রিসলির ভীষণ ভক্ত। সিনেমা হলে কোন নতুন সিনেমা এলেই সেই সিনেমা দেখা চাই আজাদের। সঙ্গে সঙ্গী খালাতো ভাইয়েরা। আজাদের ছিলো উদার হাত। বন্ধু বান্ধবদের যেকোন বিপদ আপদে সবার আগেই এগিয়ে আজাদ।
১৯৬০ সালে আজাদ যখন ক্লাস সিক্সে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়েন তখন তাঁর বাবা ইউনুস আহমেদ চৌধুরী দ্বিতীয় বিয়ে করলেন। আর এর ফলে তাঁর মা মোসাম্মাৎ সাফিয়া বেগম রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।
উঠলেন পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের ৬১ বি.কে.দাস রোডের আজাদের খালা শোভনা বেগমের বাড়িতে। কিন্তু আজাদ থাকতেন তাঁদের ইস্কাটনের সুরম্য বাড়িতে। প্রায়ই আজাদ আসতেন মাকে দেখতে। ওখানে থাকার সময়েই সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করলেন আজাদ।
এর কিছুদিনের মধ্যে মারা গেল তাঁর খালা। যার ফলে তাঁর মা ফের গিয়ে উঠলো জুরাইন মাজারের পাশে এক বাসায়। তখনো আজাদ থাকতেন তাঁদের ইস্কাটনের বাড়িতে। সেখানে থাকা অবস্থাতেই আজাদ প্রাইভেটে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পর ১৯৬৭ সালে চলে গিয়েছিলেন করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের উপর অনার্স করতে। এরই মধ্যে মাকে নিয়ে হাজারো পরিকল্পনা তাঁর।
আলাদাভাবে মা সহ থাকবেন আজাদ। তাঁর খালাতো ভাইবোনেরা মিলে একসঙ্গে বাসা নিবেন। ১৯৭০ সালে ইতিহাসের উপর অনার্স শেষ করে দেশে ফিরে এলেন আজাদ। সঙ্গে তাঁর বন্ধু আবুল বাশার।
আবুল বাশারের সঙ্গে আজাদের পরিচয় পাকিস্তানের করাচী থাকতেই। করাচীতে আজাদ পড়তেন ইতিহাসে আর বাশার পড়েছিলেন সাংবাদিকতায়। সে বছরই মাকে নিয়ে মগবাজারেই নতুন বাসা নিলেন আজাদ। সঙ্গে সঙ্গী খালাতো ভাইবোনেরা ও বন্ধু আবুল বাশার। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। আর আবুল বাশার সাংবাদিকতা শুরু করলেন মর্নিং নিউজ পত্রিকায়। ১৯৭১ এর শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করলেন আজাদ।
.
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেখলেন তাঁর বন্ধুরা যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, ফিরে এসেছে আগরতলা থেকে, ট্রেনিং নিয়ে। জুন মাসের শুরুতে অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল দিয়ে গে*রিলাদের অ*ভিযান শুরু। একে একে গে*রিলারা বেশ কয়েকটি অপা*রেশন করে ফেললো।
আজাদের বন্ধুরা আজাদকে বললো, 'চল আমাদের সাথে, অ*পারেশন করবি। তুই তো বন্দুক পি*স্তল চালাতে জানিস। তোর আব্বার তো ব*ন্দুক আছে, পি*স্তল আছে, তুই সেগুলো দিয়ে অনেকবার শি*কার করেছিস। তুই পারবি চল।'
আজাদ বললেন, ' এই জগতে মা ছাড়া আমার কেউ নেই, আর মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মা যদি আমাকে অনুমতি দেয় তবেই আমি যু*দ্ধে যাবো।'
একদিন রাতে খেতে বসে মায়ের কাছে আজাদ অনুমতি চাইলে তাঁর মা সাফিয়া বেগম বললেন,'বাবা তুমি অবশ্যই যু*দ্ধে যাবে।' মায়ের অনুমতি পেয়ে আজাদ যু*দ্ধে গেলেন। একাধিক অ*পারেশনে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অ*পারেশন তার মধ্যে অন্যতম।
২৯শে আগস্ট বাড়িতেই ছিলেন আজাদ। সেদিন আজাদের বাবার মামাতো ভাই সেকান্দার হায়াত খান ও এসেছে। আছে জুয়েল ও বন্ধু আবুল বাশার। সেদিন টিভি দেখে ঘরের বাকিরা ঘুমিয়ে গেলে তা*স নিয়ে বসলেন আজাদ, জুয়েল, কাজী কামাল এবং আবুল বাশার। ৩০শে আগস্ট দিবাগত রাত দুইটার দিকে পা*কিস্তানী হা*নাদার বা*হিনী অ*ভিযান চালায় আজাদদের মগবাজারের বাড়িতে।
সে রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন শহীদ আজাদের খালাতো ভাই গোলাম গাউসে আজম চঞ্চল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'প্রতিদিনের মতো আমরা খেয়ে দেয়ে টিভি দেখে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। আজাদদা, কাজীদা, জুয়েল এবং বাশার ভাই তাস খেলছিলেন। রাত দুইটার দিকে পাকিস্তানী বা*হিনী রেইড করে আমাদের বাড়িতে। দরজা ভেঙে তারা আমাদেরও ঘুম থেকে তুললো।
এসময় তারা বহু খুঁজে উল্টাপাল্টা করে তল্লাশি চালিয়ে স্টোর রুমে ফসফরাস পেল, পেয়েছিলো একটি থ্রি টু পি*স্তল। পি*স্তল পেয়ে তারা আমাকে গা*লি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো 'এটি কি?' আমি বললাম 'আমি জানিনা।' তখন আমাকে ঘু*ষি মারলো। আমি তীব্র ব্যথায় বসে পড়লাম। তখন বাম পায়ের বু*টের আ*ঘাত করলে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। এরপর তারা আজাদদাকে খুঁজছিলো। মেজর সরফরাজ বলছিলো 'আজাদ কাহা হে? তুম আজাদ হে বলে আজাদদাকে ধরতেই আজাদদা বললেন, 'মাগফার উদ্দিন চৌধুরী। ওটাই তো তাঁর আসল নাম ছিলো। তখন মেজর সরফরাজ তুমি মিথ্যা বলছো। তুমিই আজাদ। আজাদ দাদাকে যখন পাকিস্তানী মেজর সরফরা ঘু*ষি মারলো তখন কাজী দাদা স্টে*নগান থাবা দিয়ে নিয়ে ধস্তাধ*স্তি শুরু করে ব্রা*শ ফা*য়ার করে পালিয়ে যায়। গু*লিবিদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন জায়েদদা টগরদা। এছাড়া এরপর আজাদদা, জুয়েলদা, বাশার ভাই, মনোয়ার ভাই ও সেকান্দর হায়াত খানকে আ*টক করে গাড়িতে তুলে ফেললো।'
এরপর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মি*লিটারি ট*র্চার সে*লে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আজাদের উপর চালানো হয়েছিলো চরম পৈ*শাচিক নি*র্যাতন।
৩১শে আগস্ট তাঁদের রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হলে আজাদের মা আর খালাতো ভাই চঞ্চল রমনা থা*নায় এসেছিলেন আজাদকে দেখতে। তাঁর সারা গায়ে নি*র্যাতনের চিত্র। মুখে ঘু*ষির চিহ্ন, কালশিটে দাগ গাল ফোলা চোখের কাছে কেটে গেছে, ঠোঁট ফেটে গেছে। মা চিনতে পারেননা তাঁর আদরের আজাদকে। মাকে পেয়ে আজাদ বলেন, 'কি করবো আম্মা, এরা তো খু*ব মা*রে। সবার নাম বলতে বলে।'
সাফিয়া বেগম বললেন, 'তুমি কি সবার নাম বলে দিয়েছো?'
আজাদ বললেন, 'না বলিনি। যদি আবার মারে! আর তো সহ্য করতে পারছিনা।'
সাফিয়া বেগম বললেন, 'ধৈর্যধারণ করো বাবা। মুখ বুজে স*হ্য করে থাকো।' তিনি একথা বলে বের হবেন এই মুহূর্তে আজাদ বললো, 'দুদিন ধরে তো ভাত খাই না। কালকে দিয়েছিলো খেতে পারি নাই।'
সাফিয়া বেগম বললেন, 'আগামীকাল তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসবো বাবা।'
আজাদের মায়ের সঙ্গে পরদিন রমনা থানায় গিয়েছিলেন আজাদের খালাতো ভাই Golam Gausse Azam চঞ্চল ভাই। তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'পরের দিন সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ। সেদিন সকাল বেলা আম্মা সহ মগবাজারের বাসা থেকে টিফিনকারীর পাঁচ বাটিতে করে মুরগির মাংস, মাছের চচ্চড়ি আর গরুর মাংস নিয়ে আমরা গেলাম রমনা থানায়। দুপুর দুইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও আজাদদার দেখা পেলাম না। এরপর গেলাম হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। আমার দুই ভাই জায়েদদা আর টগরদাকে দেখতে। আগের দিন যে আজাদদার সঙ্গে আম্মার আর আমার যে দেখা হলো সেটাই ছিলো শেষ দেখা। বাড়ি ফিরে আম্মা রাতে খেতে গিয়ে বললেন, 'আমার ছেলে ভাত খায়নি, আমিও ভাত খাবোনা। আমার ছেলে যেদিন ফিরে আসবে সেদিন আমি ভাত খাবো।'
ধারনা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ক্র্যা*কপ্লাটুনের অন্য গে*রিলাদের সঙ্গে আজাদকেও হ*ত্যা করেছিলো পা*কিস্তানী হা*নাদার বা*হিনী। আজাদ নিখোঁজ হওয়ার ১৪ বছর পর মারা যান সাফিয়া খাতুন।
.
স্বাধীন দেশে মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদের স্বপ্ন ছিলো রাষ্ট্রদূত হয়ে নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি ঠিক, কিন্তু গোটা বিশ্বকে তো জানান দিয়েছিলেন একটি দেশের জন্য স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য কতোখানি আত্মত্যাগ করা যায়।
আজ শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ বীর বিক্রমের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে আজ আজাদ ৮০ বছরে পা দিতেন। কিন্তু দেশের জন্য আত্মত্যাগে হারিয়ে গেলেন মাত্র ২৫ বছর বয়সেই। প্রিয় আজাদ আপনি থাকবেন অণুপ্রেরণায় আমাদের মাঝে অনন্তকাল ধরে। 🙏💕
© আহমাদ ইশতিয়াক