Mrinal BD Music

  • Home
  • Mrinal BD Music

Mrinal BD Music গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ জাতের মানুষ

02/07/2025

মূল্যপ্রাপ্তি

অবদানশতক

অঘ্রাণে শীতের রাতে নিষ্ঠুর শিশিরঘাতে
পদ্মগুলি গিয়াছে মরিয়া-
সুদাস মালীর ঘরে কাননের সরোবরে
একটি ফুটেছে কী করিয়া।
তুলি লয়ে বেচিবারে গেল সে প্রাসাদদ্বারে,
মাগিল রাজার দরশন-
হেনকালে হেরি ফুল আনন্দে পুলকাকুল
পথিক কহিল একজন,
"অকালের পদ্ম তব আমি এটি কিনি লব,
কত মূল্য লইবে ইহার?
বুদ্ধ ভগবান আজ এসেছেন পুরমাঝ
তাঁর পায়ে দিব উপহার।'
মালী কহে, "এক মাষা স্বর্ণ পাব মনে আশা।'
পথিক চাহিল তাহা দিতে-
হেনকালে সমারোহে বহু পূজা- অর্ঘ্য বহে
নৃপতি বাহিরে আচম্বিতে।
রাজেন্দ্র প্রসেনজিৎ উচ্চারি মঙ্গলগীত
চলেছেন বুদ্ধদরশনে-
হেরি অকালের ফুল শুধালেন, "কত মূল?
কিনি দিব প্রভুর চরণে।'
মালী কহে, "হে রাজন্‌, স্বর্ণমাষা দিয়ে পণ
কিনিছেন এই মহাশয়।'
"দশ মাষা দিব আমি' কহিলা ধরণীস্বামী,
"বিশ মাষা দিব' পান্থকয়।
দোঁহে কহে "দেহো দেহো', হার নাহি মানে কেহ-
মূল্য বেড়ে ওঠে ক্রমাগত।
মালী ভাবে যাঁর তরে এ দোঁহে বিবাদ করে
তাঁরে দিলে আরো পাব কত!
কহিল সে করজোড়ে, "দয়া করে ক্ষম মোরে-
এ ফুল বেচিতে নাহি মন।'
এত বলি ছুটিল সে যেথা রয়েছেন বসে
বুদ্ধদেব উজলি কানন।
বসেছেন পদ্মাসনে প্রসন্ন প্রশান্ত মনে,
নিরঞ্জন আনন্দমূরতি।
দৃষ্টি হতে শান্তি ঝরে, স্ফুরিছে অধর- 'পরে
করুণার সুধাহাস্যজ্যোতি।
সুদাস রহিল চাহি- নয়নে নিমেষ নাহি,
মুখে তার বাক্য নাহি সরে।
সহসা ভূতলে পড়ি পদ্মটি রাখিল ধরি
প্রভুর চরণপদ্ম- 'পরে।
বরষি অমৃতরাশি বুদ্ধ শুধালেন হাসি,
'কহো বৎস, কী তব প্রার্থনা।'
ব্যাকুল সুদাস কহে, "প্রভু, আর কিছু নহে,
চরণের ধূলি এক কণা।'

29/06/2025

শিলাইদহে পদ্মাতীরে সাহিত্যচর্চা নিয়ে নিভৃতে বাস করতুম। একটা সৃষ্টির সংকল্প নিয়ে সেখান থেকে এলেম শান্তিনিকেতনের প্রান্তরে।

তখন আশ্রমের পরিধি ছিল ছোটো। তার দক্ষিণ সীমানায় দীর্ঘ সার- বাঁধা শালগাছ। মাধবীলতা- বিতানে প্রবেশের দ্বার। পিছনে পুব দিকে আমবাগান, পশ্চিম দিকে কোথাও- বা তাল, কোথাও- বা জাম, কোথাও- বা ঝাউ, ইতস্তত গুটিকয়েক নারকেল। উত্তরপশ্চিম প্রান্তে প্রাচীন দুটি ছাতিমের তলায় মার্বেল পাথরে বাঁধানো একটি নিরলংকৃত বেদী। তার সামনে গাছের আড়াল নেই, দিগন্ত পর্যন্ত অবারিত মাঠ, সে মাঠে তখনো চাষ পড়ে নি। উত্তর দিকে আমলকীবনের মধ্যে অতিথিদের জন্যে দোতলা কোঠা আর তারই সংলগ্ন রান্নাবাড়ি প্রাচীন কদম গাছের ছায়ায়। আর- একটি মাত্র পাকা বাড়ি ছিল একতলা, তারই মধ্যে ছিল পুরানো আমলের বাঁধানো তত্ত্ববোধিনী এবং আরো- কিছু বইয়ের সংগ্রহ। এই বাড়িটিকেই পরে প্রশস্ত করে এবং এর উপরে আর- একতলা চড়িয়ে বর্তমান গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে। আশ্রমের বাইরে দক্ষিণের দিকে বাঁধ তখন ছিল বিস্তৃত এবং জলে ভরা। তার উত্তরের উঁচু পাড়িতে বহুকালের দীর্ঘ তালশ্রেণী। আশ্রম থেকে দেখা যেত বিনা বাধায়। আশ্রমের পূর্ব সীমানায় বোলপুরের দিকে ছায়াশূন্য রাঙামাটির রাস্তা গেছে চলে। সে রাস্তায় লোকচলাচল ছিল সামান্য। কেননা শহরে তখনো ভিড় জমে নি, বাড়িঘর সেখানে অল্পই। ধানের কল তখনো আকাশে মলিনতা ও আহার্যে রোগ বিস্তার করতে আরম্ভ করে নি। চারি দিকে বিরাজ করত বিপুল অবকাশ নীরব নিস্তব্ধ।

আশ্রমের রক্ষী ছিল বৃদ্ধ দ্বারী সর্দার, ঋজু দীর্ঘ প্রাণসার দেহ। হাতে তার লম্বা পাকাবাঁশের লাঠি, প্রথম বয়সের দস্যুবৃত্তির শেষ নিদর্শন। মালী ছিল হরিশ, দ্বারীর ছেলে। অতিথিভবনের একতলায় থাকতেন দ্বিপেন্দ্রনাথ তাঁর কয়েকজন অনুচর- পরিচর নিয়ে। আমি সস্ত্রীক আশ্রয় নিয়েছিলুম দোতলার ঘরে।

এই শান্ত জনবিরল শালবাগানের অল্প কয়েকটি ছেলে নিয়ে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সহায়তায় বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ করেছিলুম। আমার পড়াবার জায়গা ছিল প্রাচীন জামগাছের তলায়।

ছেলেদের কাছে বেতন নেওয়া হত না, তাদের যা- কিছু প্রয়োজন সমস্ত আমিই জুগিয়েছি। একটা কথা ভুলেছিলুম যে সেকালে রাজস্বের ষষ্ঠ ভাগের বরাদ্দ ছিল তপোবনে, আর আধুনিক চতুষ্পাঠীর অবলম্বন সামাজিক ক্রিয়াকর্ম উপলক্ষে নিত্যপ্রবাহিত দানদক্ষিণা। অর্থাৎ এগুলি সমাজেরই অঙ্গ, এদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে কোনো ব্যক্তিগত স্বতন্ত্র চেষ্টার প্রয়োজন ছিল না। অথচ আমার আশ্রম ছিল একমাত্র আমারি ক্ষীণ শক্তির উপরে নির্ভর করে। গুরুশিষ্যের মধ্যে আর্থিক দেনাপাওনার সম্বন্ধ থাকা উচিত নয় এই মত একদা সত্য হয়েছিল যে সহজ উপায়ে, বর্তমান সমাজে সেটা প্রচলিত না থাকা সত্ত্বেও মতটাকে রক্ষা করবার চেষ্টা করতে গেলে কর্মকর্তার আত্মরক্ষা অসাধ্য হয়ে ওঠে, এই কথাটা অনেকদিন পর্যন্ত বহু দুঃখে আমার দ্বারা পরীক্ষিত হয়েছে। আমার সুযোগ হয়েছিল এই যে, ব্রহ্মবান্ধব এবং তাঁর খৃস্টান শিষ্য রেবাচাঁদ ছিলেন সন্ন্যাসী। এই কারণে অধ্যাপনার আর্থিক ও কর্ম- ভার লঘু হয়েছিল তাঁদের দ্বারা। এই প্রসঙ্গে আর- একজনের কথা সর্বাপেক্ষা আমার মনে জাগছে, তাঁর কথা কোনোদিন ভুলতে পারি নে। গোড়া থেকে বলা যাক।

এই সময়ে দুটি তরুণ যুবক, তাঁদের বালক বললেই হয়, এসে পড়লেন আমার কাছে। অজিতকুমার চক্রবর্তী তাঁর বন্ধু কবি সতীশচন্দ্র রায়কে নিয়ে এলেন আমাদের জোড়াসাঁকো বাড়িতে, আমার একতলার বসবার ঘরে। সতীশের বয়স তখন উনিশ, বি. এ. পরীক্ষা তাঁর আসন্ন। তাঁর পূর্বে তাঁর একটি কবিতার খাতা অজিত আমাকে পড়বার জন্যে দিয়েছিলেন। পাতায় পাতায় খোলসা করেই জানাতে হয়েছে আমার মত। সব কথা অনুকূল ছিল না। আর কেউ হলে এমন বিস্তারিত বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হতুম না। সতীশের লেখা পড়ে বুঝেছিলুম তাঁর অল্প বয়সের রচনায় অসামান্যতা অনুজ্জ্বলভাবে প্রচ্ছন্ন। যাঁর ক্ষমতা নিঃসন্দিগ্ধ, দুটো একটা মিষ্ট কথায় তাঁকে বিদায় করা তাঁর অসম্মাননা। আমার মতের যে অংশ ছিল অপ্রিয় অজিত তাতে অসহিষ্ণু হয়েছিলেন, কিন্তু সৌম্যমূর্তি সতীশ স্বীকার করে নিয়েছিলেন প্রসন্নভাবে।

আমার মনের মধ্যে তখন আশ্রমের সংকল্পটা সব সময়েই ছিল মুখর হয়ে। কথাপ্রসঙ্গে তার একটা ভবিষ্যৎ ছবি আমি এঁদের সামনে উৎসাহের সঙ্গে উজ্জ্বল করে ধরেছিলুম। দীপ্তি দেখা দিল সতীশের মুখে। আমি তাঁকে আহ্বান করি নি আমার কাজে। আমি জানতুম তাঁর সামনে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরের দুই বড়ো ধাপ বাকি। তার শেষভাগে ছিল জীবিকার আশ্বাসবাণী আইনপরীক্ষায়।

একদিন সতীশ এসে বললেন, যদি আমাকে গ্রহণ করেন আমি যোগ দিতে চাই আপনার কাজে। আমি বললুম, পরীক্ষা দিয়ে পরে চিন্তা কোরো। সতীশ বললেন, দেব না পরীক্ষা। কারণ, পরীক্ষা দিলেই আত্মীয়স্বজনের ধাক্কায় সংসারযাত্রার ঢালু পথে আমাকে গড়িয়ে নিয়ে চলবে।

কিছুতে তাঁকে নিরস্ত করতে পারলে না। দারিদ্র্যের ভার অবহেলায় মাথায় করে নিয়ে যোগ দিলেন আশ্রমের কাজে। বেতন অস্বীকার করলেন। আমি তাঁর অগোচরে তাঁর পিতার কাছে যথাসাধ্য মাসিক বৃত্তি পাঠিয়ে দিতুম। তাঁর পরনে ছিল না জামা, একটা চাদর ছিল গায়ে, তার পরিধেয়তা জীর্ণ। যে ভাবরাজ্যে তিনি সঞ্চরণ করতেন সেখানে তাঁর জীবন পূর্ণ হত প্রতিক্ষণে প্রকৃতির রসভাণ্ডার থেকে। আত্মভোলা মানুষ, যখন তখন ঘুরে বেড়াতেন যেখানে সেখানে। প্রায় তার সঙ্গে থাকত ছেলেরা, চলতে চলতে তাঁর সাহিত্যসম্ভোগের আস্বাদন পেত তারাও। সেই অল্প বয়সে ইংরেজি সাহিত্যে সুগভীর অভিনিবেশ তাঁর মতো আর কারো মধ্যে পাই নি। যে- সব ছাত্রকে পড়াবার ভার ছিল তাঁর 'পরে তারা ছিল নিতান্তই অর্বাচীন। ইংরেজি ভাষার সোপানশ্রেণীর সব নীচেকার পইঠা পার করে দেওয়াই ছিল তাঁর কাজ, কিন্তু কেজো সীমার মধ্যে বদ্ধ সংকীর্ণ নৈপুণ্য ছিল না তাঁর মাস্টারিতে। সাহিত্যের তিনি রসজ্ঞ সাধক ছিলেন, সেইজন্যে তিনি যা পাঠ দিতেন তা জমা করবার নয়, তা হজম করবার, তা হয়ে উঠত ছেলেদের মনের খাদ্য। তিনি দিতেন তাদের মনকে অবগাহন- স্নান, তার গভীরতা অত্যাবশ্যকের চেয়ে অনেক বেশি। ভাষাশিক্ষার মধ্যে একটা অনিবার্য শাসন থাকে, সেই শাসনকে অতিক্রম করে দিতে পারতেন সাহিত্যের উদার মুক্তি। এক বৎসরের মধ্যে হল তাঁর মৃত্যু। তার বেদনা আজও রয়ে গেছে আমার মনে। আশ্রমে যারা শিক্ষক হবে তারা মুখ্যত হবে সাধক, আমার এই কল্পনাটি সম্পূর্ণ সত্য করেছিলেন সতীশ।

তার পরের পর্বে এসেছিলেন জগদানন্দ। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল সাধনা পত্রে তাঁর প্রেরিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পড়ে। এই- সকল প্রবন্ধের প্রাঞ্জল ভাষা ও সহজ বক্তব্যপ্রণালী দেখে তাঁর প্রতি আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আকৃষ্ট হয়েছিল। তাঁর সাংসারিক অভাব মোচনের জন্য আমি তাঁকে প্রথমে আমাদের জমিদারির কাজে নিযুক্ত করেছিলেম। তার প্রধান কারণ জমিদারি দপ্তরে বেতনের কৃপণতা ছিল না। কিন্তু তাঁকে এই অযোগ্য আসনে বন্দী করে রাখতে আমার মনে বেদনা দিতে লাগল। আমি তাঁকে শান্তিনিকেতনের অধ্যাপনার কাজে আমন্ত্রণ করলুম। যদিও এই কার্যে আয়ের পরিমাণ অল্প ছিল তবুও আনন্দের পরিমাণ তাঁর পক্ষে ছিল প্রচুর। তার কারণ শিক্ষাদানে তাঁর স্বভাবের ছিল অকৃত্রিম তৃপ্তি। ছাত্রদের কাছে সর্বতোভাবে আত্মদানে তাঁর একটুও কৃপণতা ছিল না। সুগভীর করুণা ছিল বালকদের প্রতি। শাস্তি উপলক্ষেও তাদের প্রতি লেশমাত্র নির্মমতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। একজন ছাত্রকে কোনো শিক্ষক তার একবেলার আহার বন্ধ করে দণ্ডবিধান করেছিলেন। এই শাসনবিধির নিষ্ঠুরতায় তাঁকে অশ্রু বর্ষণ করতে দেখেছি। তাঁর বিজ্ঞানের ভাণ্ডার খোলা ছিল ছাত্রদের সম্মুখে যদিও তা তাদের পাঠ্য বিষয়ের অন্তর্গত ছিল না। এই আত্মদানের অকার্পণ্য যথার্থ শিক্ষকের যথার্থ পরিচয়। তিনি আপনার আসনকে কখনো ছাত্রদের কাছ থেকে দূরে রাখেন নি। আত্মমর্যাদার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার চেষ্টায় তিনি ছাত্রদের সেবায় কখনো লাইন টেনে চলতেন না। তাঁর অধ্যাপকের উচ্চ অধিকার তাঁর সদয় ব্যবহারের আবরণে কখনো অতিপ্রত্যক্ষ ছিল না। বস্তুত সকল বিষয়েই তিনি ছেলেদের সখা ছিলেন। তাঁর ক্লাসে গণিতশিক্ষায় কোনো ছাত্র কিছুমাত্র পিছিয়ে পড়ে পরীক্ষায় যদি অকৃতার্থ হত সে তাঁকে অত্যন্ত আঘাত করত। শিক্ষার উচ্চ আদর্শ রক্ষার জন্য তাঁর অক্লান্ত চেষ্টা ছিল। অমনোযোগী বালকদের প্রতি তাঁর তর্জন গর্জন শুনতে অতিশয় ভয়জনক ছিল কিন্তু তাঁর স্নেহ তাঁর ভৎর্সনাকে ভিতরে ভিতরে প্রতিবাদ করে চলত, ছাত্ররা তা প্রত্যহ অনুভব করেছে। যে শিক্ষকেরা আশ্রমের সৃষ্টিকার্যে আপনাকে সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছিলেন, জগদানন্দ তার মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন। তাঁর অভাব ও বেদনা আশ্রম কদাচ ভুলতে পারবে না।

সতীশের বন্ধু অজিতকুমার যথার্থ শিক্ষকের পদে উচ্চ স্থান অধিকার করেছিলেন। তাঁর বিদ্যা ছিল ইংরেজি সাহিত্যে ও দর্শনে বহুব্যপ্ত। এই জ্ঞানের রাজ্যে তিনি ছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের ছাত্র। তিনিও নির্বিচারে ছাত্রদের কাছে তাঁর জ্ঞানের সঞ্চয় উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তাঁর ছাত্রেরা সর্বদাই তাঁর শিক্ষকতা থেকে উচ্চ অঙ্গের সাহিত্যরস আস্বাদনের অবকাশ পেয়েছিল। যদিও তাদের বয়স অল্প ও যোগ্যতার সীমা সংকীর্ণ তবুও তিনি কখনো তাদের কাছ থেকে নিজের পদের অভিমানে নির্লিপ্ত ছিলেন না। সতীশের মতো দারিদ্র্যে তাঁর ঔদাসীন্য ছিল না তবুও তিনি তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। আমাদের আশ্রম- নির্মাণ- কার্যে ইনি একজন নিপুণ স্থপতি ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।

মাঝখানে অতি অল্প সময়ের জন্য এসেছিলেন আমার এক আত্মোৎসর্গপরায়ণ বন্ধু মোহিতচন্দ্র সেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সেখানকার খ্যাতি প্রতিপত্তি সমস্ত ত্যাগ করে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষার এমন নিম্ন স্তরে লোকখ্যাতির দিক থেকে যা তাঁর যোগ্য ছিল না। কিন্তু তাতেই তিনি প্রভূত আনন্দ পেয়েছিলেন। কারণ শিক্ষকতা ছিল তাঁর স্বভাবসংগত। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়ে শিক্ষাব্রত অকালে সমাপ্ত হয়ে গেল। তাঁর অকৃপণতা ছিল আর্থিক দিকে এবং পারমার্থিক দিকে। প্রথম যেদিন আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল সেদিন তিনি আশ্রমের আদর্শের সম্বন্ধে যে সম্মান প্রকাশ করেছিলেন আমার আনন্দের পক্ষে তাই যথেষ্ট ছিল। অবশেষে বিদায় নেবার সময়ে তিনি বললেন, যদি আমি আপনার এখানকার কাজে যোগদান করতে পারতুম তবে নিজেকে কৃতার্থ বোধ করতুম। কিন্তু সম্প্রতি তা সম্ভব না হওয়াতে কিঞ্চিৎ শ্রদ্ধার অঞ্জলি দান করে গেলুম। এই বলে আমার হাতে একটি কাগজের মোড়ক দিয়ে গেলেন। পরে খুলে দেখলেম হাজার টাকার একখানি নোট। পরীক্ষকরূপে যা পেয়েছিলেন সমস্তই তিনি তাঁর শ্রদ্ধার নিদর্শনরূপে দান করে গেলেন। কিন্তু কেবল সেই একদিনের দান নয়, তার পর থেকে প্রতিদিন তিনি নিবেদন করেছেন তাঁর শ্রদ্ধার অর্ঘ্য একান্ত অনুপযুক্ত বেতন রূপে।

এঁদের অনেক পরে আশ্রমের সাধনাক্ষেত্রে দেখা দিলেন নন্দলাল। ছোটো বড়ো সমস্ত ছাত্রের সঙ্গে এই প্রতিভাসম্পন্ন আর্টিস্টের একাত্মকতা অতি আশ্চর্য। তাঁর আত্মদান কেবলমাত্র শিক্ষকতার নয়, সর্বপ্রকার বদান্যতায়। ছাত্রদের রোগে, শোকে, অভাবে তিনি তাদের অকৃত্রিম বন্ধু। তাঁকে যারা শিল্পশিক্ষা উপলক্ষে কাছে পেয়েছে তারা ধন্য হয়েছে।

তার পর থেকে নানা কর্মী, নানা বন্ধু, আশ্রমের সাধনাক্ষেত্রে সমবেত হয়েছেন এবং আপন আপন শক্তি ও স্বভাবের বিশিষ্টতা অনুসারে আশ্রমের গঠনকার্যে ক্রমশ বিচিত্র উপকরণ জুগিয়ে এসেছেন। সৃষ্টিকার্যে এই বৈচিত্র্যের প্রয়োজন আছে। নতুন নতুন কালের প্রেরণায় নতুন নতুন রূপ আপনাকে ব্যক্ত করতে থাকে এবং এই উপায়েই কালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে তবে সে আপনার শক্তিকে অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হয়। সেই পরিবর্তমান আদর্শের অনুবৃত্তির দ্বারা পুরাতন কালের ভিত্তির উপরেই নতুন কালের সৃষ্টি সম্পূর্ণতা লাভ করে। এই নিয়ে কোনো আক্ষেপ করা বৃথা। বস্তুত প্রাচীনকালের ছন্দে নতুনকালের তাল ভঙ্গ করলে সৃষ্টির সংগতি রক্ষা হয় না।

23/06/2025

আরো-সত্য

দাদামশায়, সেদিন তুমি যে আরও- সত্যির কথা বলছিলে, সে কি কেবল পরীস্থানেই দেখা যায়।
আমি বললুম, তা নয় গো, এ পৃথিবীতেও তার অভাব নেই। তাকিয়ে দেখলেই হয়। তবে কিনা সেই দেখার চাউনি থাকা চাই।
তা, তুমি দেখতে পাও?
আমার ঐ গুণটাই আছে, যা না দেখবার তাই হঠাৎ দেখে ফেলি। তুমি যখন বসে বসে ভূগোল- বিবরণ মুখস্থ কর তখন মনে পড়ে যায় আমার ভূগোল পড়া। তোমার ঐ ইয়াংসিকিয়াং নদীর কথা পড়লে চোখের সামনে যে জ্যোগ্রাফি খুলে যেত তাকে নিয়ে এক্‌জামিন পাশ করা চলে না। আজও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সারি সারি উট চলেছে রেশমের বস্তা নিয়ে। একটা উটের পিঠে আমি পেয়েছিলুম জায়গা।
সে কী কথা, দাদামশায়। আমি জানি, তুমি কোনোদিন উটে চড় নি।
ঐ দেখো দিদি, তুমি বড়ো বেশি প্রশ্ন কর।
আচ্ছা, তুমি বলে যাও। তার পরে? উট পেলে তুমি কোথা থেকে।
ঐ দেখো, আবার প্রশ্ন। উট পাই বা না পাই, আমি চ'ড়ে বসি। কোনো দেশে যাই বা না যাই, আমার ভ্রমণ করতে বাধে না। ওটা আমার স্বভাব।
তার পরে কী হল।
তার পরে কত শহর গেলেম পেরিয়ে- ফুচুং, হ্যাংচাও, চুংকুং; কত মরুভূমির ভিতর দিয়ে গিয়েছি রাত্তির বেলায় তারা দেখে রাস্তা চিনে চিনে। গেলুম উস্‌খুস্‌ পাহাড়ের তরাইয়ে। জলপাইয়ের বন দিয়ে, আঙুরের খেত দিয়ে, পাইন গাছের ছায়া দিয়ে। পড়েছিলুম ডাকাতের হাতে, সাদা ভালুক সামনে দাঁড়িয়েছিল দুই থাবা তুলে।
আচ্ছা, এত যে তুমি ঘুরে বেড়ালে, সময় পেলে কখন।
যখন ক্লাশসুদ্ধ ছেলে খাতা নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিল।
তুমি পরীক্ষায় পাশ করলে তা হলে কী করে।
ওর সহজ উত্তর হচ্ছে- আমি পাশ করি নি।
আচ্ছা, তুমি বলে যাও।
এর কিছুদিন আগে আমি আরব্য উপন্যাসে চীনদেশের রাজকন্যার কথা পড়েছি, বড়ো সুন্দরী তিনি। আশ্চর্যের কথা কী আর বলব, সেই রাজকন্যার সঙ্গেই আমার হল দেখা। সেটা ঘটেছিল ফুচাও নদীর ঘাটে। সাদা পাথর দিয়ে বাঁধানো ঘাট, উপরে নীল পাথরের মণ্ডপ। দুই ধারে দুই চাঁপা গাছ, তার তলায় দুই পাথরের সিংহের মূর্তি। পাশে সোনার ধুনুচি থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। একজন দাসী পাখা করছিল, একজন চামর দোলাচ্ছিল, একজন দিচ্ছিল চুল বেঁধে। আমি কেমন করে পড়ে গেলুম তাঁর সামনে। রাজকন্যা তখন তাঁর দুধের মতো সাদা ময়ূরকে দাড়িমের দানা খাওয়াচ্ছিলেন, চমকে উঠে বললেন, কে তুমি।
সেই মুহূর্তেই ফস্‌ করে আমার মনে প'ড়ে গেল যে, আমি বাংলাদেশের রাজপুত্তুর।
সে কী কথা। তুমি তো-
ঐ দেখো, আবার প্রশ্ন? আমি বলছি, সেদিন ছিলুম বাংলাদেশের রাজপুত্তুর, তাই তো বেঁচে গেলুম। নইলে সে তো দূর ক'রে তাড়িয়ে দিত আমাকে। তা না করে দিলে সোনার পেয়ালায় চা খেতে। চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে মেশানো সেই চা, গন্ধে আকুল করে দেয়।
তা হলে কি তোমাকে বিয়ে করল নাকি।
দেখো, ওটা বড়ো গোপন কথা। আজ পর্যন্ত কেউ জানে না।
কুসমি হাততালি দিয়ে বলে উঠল, বিয়ে নিশ্চয়ই হয়েছিল, খুব ঘটা করে হয়েছিল। - দেখলুম বিয়েটা না হলে ও বড়ো দুঃখিত হবে। শেষকালে হল বিয়ে- হ্যাংচাও শহরের আদ্ধেক রাজত্ব আর শ্রীমতী আংচনী দেবীকে লাভ করলুম। ক'রে-
করে কী হল। আবার বুঝি সেই উটে চড়ে বসলে?
নইলে এখানে ফিরে এসে দাদামশায় হলেম কী করে। হ্যাঁ, চড়েছিলুম- সে উট কোথাও যায় না। মাথার উপর দিয়ে ফুসুং পাখি গান গেয়ে চলে গেল।
ফুসুং পাখি? সে কোথায় থাকে।
কোথাও থাকে না; কিন্তু তার লেজ নীল, তার ডানা বাসন্তী, তার ঘাড়ের কাছে বাদামি, ওরা দলে দলে উড়ে গিয়ে বসল হাচাং গাছে।
হাচাং গাছের তো আমি নাম শুনি নি।
আমিও শুনি নি, তোমাকে বলতে বলতে এইমাত্র মনে পড়ল। আমার ঐ দশা, আমি আগে থাকতে তৈরি হই নে। তখনি তখনি দেখি, তখনি তখনি বলি। আজ আমার ফুসুং পাখি উড়ে চলে গেছে সমুদ্রের আর- এক পারে। অনেকদিন তার কোনো খবর নেই।
কিন্তু, তোমার বিয়ের কী হল। সেই রাজকন্যা?
দেখো, চুপ করে যাও। আমি কোনো জবাব দেব না। আর তা ছাড়া, তুমি দুঃখ কোরো না, তখনও তুমি জন্মাও নি- সে কথা মনে রেখো।
*
* *
আমি যখন ছোটো ছিলুম, ছিলুম তখন ছোটো;
আমার ছুটির সঙ্গী ছিল ছবি আঁকার পোটো।
বাড়িটা তার ছিল বুঝি শঙ্খী নদীর মোড়ে,
নাগকন্যা আসত ঘাটে শাঁখের নৌকো চ'ড়ে।
চাঁপার মতো আঙুল দিয়ে বেণীর বাঁধন খুলে
ঘন কালো চুলের গুচ্ছে কী ঢেউ দিত তুলে।
রৌদ্র- আলোয় ঝলক দিয়ে বিন্দুবারির মতো
মাটির 'পরে পড়ত ঝরে মুক্তা মানিক কত।
নাককেশরের তলায় ব'সে পদ্মফুলের কুঁড়ি
দূরের থেকে কে দিত তার পায়ের তলায় ছুঁড়ি।
একদিন সেই নাগকুমারী ব'লে উঠল, কে ও।
জবাব পেলে, দয়া ক'রে আমার বাড়ি যেয়ো।
রাজপ্রাসাদের দেউড়ি সেথায় শ্বেত পাথরে গাঁথা,
মণ্ডপে তার মুক্তাঝালর দোলায় রাজার ছাতা।
ঘোড়সওয়ারি সৈন্য সেথায় চলে পথে পথে,
রক্তবরন ধ্বজা ওড়ে তিরিশঘোড়ার রথে।
আমি থাকি মালঞ্চেতে রাজবাগানের মালী,
সেইখানেতে যূথীর বনে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালি।
রাজকুমারীর তরে সাজাই কনকচাঁপার ডালা,
বেণীর বাঁধন- তরে গাঁথি শ্বেতকরবীর মালা।
মাধবীতে ধরল কুঁড়ি, আর হবে না দেরি-
তুমি যদি এস তবে ফুটবে তোমায় ঘেরি।
উঠবে জেগে রঙনগুচ্ছ পায়ের আসনটিতে,
সামনে তোমার করবে নৃত্য ময়ূর- ময়ূরীতে।
বনের পথে সারি সারি রজনীগন্ধায়
বাতাস দেবে আকুল ক'রে ফাগুনি সন্ধ্যায়।
বলতে বলতে মাথার উপর উড়ল হাঁসের দল,
নাগকুমারী মুখের 'পরে টানল নীলাঞ্চল।
ধীরে ধীরে নদীর 'পরে নামল নীরব পায়ে।
ছায়া হয়ে গেল কখন চাঁপাগাছের ছায়ে।
সন্ধ্যামেঘের সোনার আভা মিলিয়ে গেল জলে।
পাতল রাতি তারা- গাঁথা আসন শূন্যতলে।

19/06/2025

চৈত্ররজনী

আজি উন্মাদ মধুনিশি ওগো
চৈত্রনিশীথশশী!
তুমি এ বিপুল ধরণীর পানে
কী দেখিছ একা বসি
চৈত্রনিথীথশশী!

কত নদীতীরে, কত মন্দিরে,
কত বাতায়নতলে,
কত কানাকানি, মন- জানাজানি,
সাধাসাধি কত ছলে!
শাখাপ্রশাখার, দ্বার- জানালার
আড়ালে আড়ালে পশি
কত সুখদুখ কত কৌতুক
দেখিতেছ একা বসি
চৈত্রনিশীথশশী।

মোরে দেখো চাহি, কেহ কোথা নাহি,
শূন্য ভবন- ছাদে
নৈশ পবন কাঁদে।
তোমারি মতন একাকী আপনি
চাহিয়া রয়েছি বসি
চৈত্রনিশীথশশী!

18/06/2025

ভার

টুনটুনি কহিলেন, রে ময়ূর, তোকে
দেখে করুণায় মোর জল আসে চোখে।
ময়ূর কহিল, বটে! কেন, কহ শুনি,
ওগো মহাশয় পক্ষী, ওগো টুনটুনি
টুনটুনি কহে, এ যে দেখিতে বেআড়া,
দেহ তব যত বড়ো পুচ্ছ তারে বাড়া।
আমি দেখো লঘুভারে ফিরি দিনরাত,
তোমার পশ্চাতে পুচ্ছ বিষম উৎপাত।
ময়ূর কহিল, শোক করিয়ো না মিছে,
জেনো ভাই, ভার থাকে গৌরবের পিছে।

17/06/2025

পান্থ

শুধায়ো না মোরে তুমি মুক্তি কোথা, মুক্তি কারে কই,
আমি তো সাধক নই, আমি গুরু নই।
আমি কবি, আছি
ধরণীর অতি কাছাকাছি,
এ পারের খেয়ার ঘাটায়।
সম্মুখে প্রাণের নদী জোয়ার- ভাঁটায়
নিত্য বহে নিয়ে ছায়া আলো,
মন্দ ভালো,
ভেসে- যাওয়া কত কী যে, ভুলে- যাওয়া কত রাশি রাশি
লাভক্ষতি কান্নাহাসি-
এক তীর গড়ি তোলে অন্য তীর ভাঙিয়া ভাঙিয়া;
সেই প্রবাহের 'পরে উষা ওঠে রাঙিয়া রাঙিয়া
পড়ে চন্দ্রালোকরেখা জননীর অঙ্গুলির মতো;
কৃষ্ণরাতে তারা যত
জপ করে ধ্যানমন্ত্র; অস্তসূর্য রক্তিম উত্তরী
বুলাইয়া চলে যায়, সে তরঙ্গে মাধবীমঞ্জরি
ভাসায় মাধুরীডালি,
পাখি তার গান দেয় ঢালি।
সে তরঙ্গনৃত্যছন্দে বিচিত্র ভঙ্গিতে
চিত্ত যবে নৃত্য করে আপন সংগীতে
এ বিশ্বপ্রবাহে,
সে ছন্দে বন্ধন মোর, মুক্তি মোর তাহে।
রাখিতে চাহি না কিছু, আঁকড়িয়া চাহি না রহিতে,
ভাসিয়া চলিতে চাই সবার সহিতে
বিরহমিলনগ্রন্থি খুলিয়া খুলিয়া,
তরণীর পালখানি পলাতকা বাতাসে তুলিয়া।

হে মহাপথিক,
অবারিত তব দশদিক।
তোমার মন্দির নাই, নাই স্বর্গধাম,
নাইকো চরম পরিণাম;
তীর্থ তব পদে পদে;
চলিয়া তোমার সাথে মুক্তি পাই চলার সম্পদে,
চঞ্চলের নৃত্যে আর চঞ্চলের গানে,
চঞ্চলের সর্বভোলা দানেড্ড
আঁধারে আলোকে,
সৃজনের পর্বে পর্বে, প্রলয়ের পলকে পলকে।

16/06/2025


গিরির উরসে নবীন নিঝর,
ছুটে ছুটে অই হতেছে সারা।
তলে তলে তলে নেচে নেচে চলে,
পাগল তটিনী পাগলপারা।


হৃদি প্রাণ খুলে ফুলে ফুলে ফুলে,
মলয় কত কী করিছে গান।
হেতা হোতা ছুটি ফুল- বাস লুটি,
হেসে হেসে হেসে আকুল প্রাণ।


কামিনী পাপড়ি ছিঁড়ি ছিঁড়ি ছিঁড়ি,
উড়িয়ে উড়িয়ে ছিঁড়িয়ে ফেলে।
চুপি চুপি গিয়ে ঠেলে ঠেলে দিয়ে,
জাগায়ে তুলিছে তটিনীজলে।


ফিরে ফিরে ফিরে ধীরে ধীরে ধীরে,
হরষে মাতিয়া, খুলিয়া বুক।
নলিনীর কোলে পড়ে ঢ'লে ঢ'লে,
নলিনী সলিলে লুকায় মুখ।


হাসিয়া হাসিয়া কুসুমে আসিয়া,
ঠেলিয়া উড়ায় মধুপ দলে।
গুন্‌ গুন্‌ গুন্‌ রাগিয়া আগুন,
অভিশাপ দিয়া কত কী বলে।


তপন কিরণ- সোনার ছটায়,
লুটায় খেলায় নদীর কোলে।
ভাসি ভাসি ভাসি স্বর্ণ ফুলরাশি
হাসি হাসি হাসি সলিলে দোলে।


প্রজাপতিগুলি পাখা দুটি তুলি
উড়িয়া উড়িয়া বেড়ায় দলে।
প্রসারিয়া ডানা করিতেছে মানা
কিরণে পশিতে কুসুমদলে।


মাতিয়াছে গানে সুললিত তানে
পাপিয়া ছড়ায় সুধার ধার।
দিকে দিকে ছুটে বন জাগি উঠে
কোকিল উতর দিতেছে তার।


তুই কে লো বালা! বন করি আলা,
পাপিয়ার সাথে মিশায়ে তান!
হৃদয়ে হৃদয়ে লহরী তুলিয়া,
অমৃত ললিত করিস্‌ গান।

১০
স্বর্গ ছায় গানে বিমানে বিমানে
ছুটিয়া বেড়ায় মধুর তান।
মধুর নিশায় ছাইয়া পরান,
হৃদয় ছাপিয়া উঠেছে গান।

১১
নীরব প্রকৃতি নীরব ধরা।
নীরবে তটিনী বহিয়া যায়।
তরুণী ছড়ায় অমৃতধারা,
ভূধর, কানন, জগত ছায়।

১২
মাতাল করিয়া হৃদয় প্রাণ,
মাতাল করিয়া পাতাল ধরা।
হৃদয়ের তল অমৃতে ডুবায়ে,
ছড়ায় তরুণী অমৃতধারা।

১৩
কে লো তুই বালা! বন করি আলা,
ঘুমাইছে বীণা কোলের 'পরে।
জ্যোতির্ম্ময়ী ছায়া স্বরগীয় মায়া,
ঢল ঢল ঢল প্রমোদ- ভরে।

১৪
বিভোর নয়নে বিভোর পরানে-
চারি দিক্‌ পানে চাহিস্‌ হেসে!
হাসি উঠে দিক্‌! ডাকি উঠে পিক্‌!
নদী ঢলে পড়ে পুলিন দেশে! !

১৫
চারি দিক্‌ চেয়ে কে লো তুই মেয়ে,
হাসি রাশি রাশি ছড়িয়ে দিস্‌?
আঁধার ছুটিয়া জোছনা ফুটিয়া
কিরণে উজলি উঠিছে দিশ্‌!

১৬
কমলে কমলে এ ফুলে ও ফুলে,
ছুটিয়া খেলিয়া বেড়াস্‌ বালা!
ছুটে ছুটে ছুটে খেলায় যেমন
মেঘে মেঘে মেঘে দামিনী- মালা।

১৭
নয়নে করুণা অধরে হাসি,
উছলি উছলি পড়িছে ছাপি।
মাথায় গলায় কুসুমরাশি
বাম করতলে কপোল চাপি।

১৮
এতকাল তোরে দেখিনু সেবিনু-
হৃদয়- আসনে দেবতা বলি।
নয়নে নয়নে, পরানে পরানে,
হৃদয়ে হৃদয়ে রাখিনু তুলি।

১৯
তবুও তবুও পূরিল না আশ,
তবুও হৃদয় রহেছে খালি।
তোরে প্রাণ মন করিয়া অর্পণ
ভিখারি হইয়া যাইব চলি।

২০
আয় কল্পনা মিলিয়া দুজনা,
ভূধরে কাননে বেড়াব ছুটি।
সরসী হইতে তুলিয়া কমল
লতিকা হইতে কুসুম লুটি।

২১
দেখিব ঊষার পূরব গগনে,
মেঘের কোলেতে সোনার ছটা।
তুষার- দর্পণে দেখিছে আনন
সাঁজের লোহিত জলদ- ঘটা।

২২
কনক- সোপানে উঠিছে তপন
ধীরে ধীরে ধীরে উদয়াচলে।
ছড়িয়ে ছড়িয়ে সোনার বরন,
তুষারে শিশিরে নদীর জলে।

২৩
শিলার আসনে দেখিব বসিয়ে,
প্রদোষে যখন দেবের বালা
পাহাড়ে লুকায়ে সোনার গোলা
আঁখি মেলি মেলি করিবে খেলা।

২৪
ঝর ঝর ঝর নদী যায় চলে,
ঝুরু ঝুরু ঝুরু বহিছে বায়।
চপল নিঝর ঠেলিয়া পাথর
ছুটিয়া- নাচিয়া- বহিয়া যায়।

২৫
বসিব দুজনে- গাইব দুজনে,
হৃদয় খুলিয়া, হৃদয়ব্যথা;
তটিনী শুনিবে, ভূধর শুনিবে
জগত শুনিবে সে- সব কথা।

২৬
যেথায় যাইবি তুই কলপনা,
আমিও সেথায় যাইব চলি।
শ্মশানে, শ্মশানে- মরু বালুকায়,
মরীচিকা যথা বেড়ায় ছলি।

২৭
আয় কলপনা আয় লো দুজনা,
আকাশে আকাশে বেড়াই ছুটি।
বাতাসে বাতাসে আকাশে আকাশে
নবীন সুনীল নীরদে উঠি।

২৮
বাজাইব বীণা আকাশ ভরিয়া,
প্রমোদের গান হরষে গাহি,
যাইব দুজনে উড়িয়া উড়িয়া,
অবাক জগত রহিবে চাহি!

২৯
জলধররাশি উঠিবে কাঁপিয়া,
নব নীলিমায় আকাশ ছেয়ে।
যাইব দুজনে উড়িয়া উড়িয়া,
দেবতারা সব রহিবে চেয়ে।

৩০
সুর- সুরধুনী আলোকময়ী,
উজলি কনক বালুকারাশি।
আলোকে আলোকে লহরী তুলিয়া,
বহিয়া বহিয়া যাইছে হাসি।

৩১
প্রদোষ তারায় বসিয়া বসিয়া,
দেখিব তাহার লহরীলীলা।
সোনার বালুকা করি রাশ রাশ,
সুর- বালিকারা করিবে খেলা।

৩২
আকাশ হইতে দেখিব পৃথিবী!
অসীম গগনে কোথায় পড়ে।
কোথায় একটি বালুকার রেণু
বাতাসে আকাশে আকাশে ঘোরে।

৩৩
কোথায় ভূধর কোথায় শিখর
অসীম সাগর কোথায় পড়ে।
কোথায় একটি বালুকার রেণু,
বাতাসে আকাশে আকাশে ঘোরে।

৩৪
আয় কল্পনা আয় লো দুজনা,
এক সাথে সাথে বেড়াব মাতি।
পৃথিবী ফিরিয়া জগত ফিরিয়া,
হরষে পুলকে দিবস রাতি।

15/06/2025

দীন দান

নিবেদিল রাজভৃত্য, "মহারাজ, বহু অনুনয়ে
সাধুশ্রেষ্ঠ নরোত্তম তোমার সোনার দেবালয়ে
না লয়ে আশ্রয় আজি পথপ্রান্তে তরুচ্ছায়াতলে
করিছেন নামসংকীর্তন। ভক্তবৃন্দ দলে দলে
ঘেরি তাঁরে দরদর- উদ্‌বেলিত আনন্দধারায়
ধৌত ধন্য করিছেন ধরণীর ধূলি। শূন্যপ্রায়
দেবাঙ্গন; ভৃঙ্গ যথা স্বর্ণময় মধুভান্ড ফেলি
সহসা কমলগন্ধে মত্ত হয়ে দ্রুত পক্ষ মেলি
ছুটে যায় গুঞ্জরিয়া উন্মীলিত পদ্ম- উপবনে
উন্মুখ পিপাসাভরে, সেইমতো নরনারীগণে
সোনার দেউল- পানে না তাকায়ে চলিয়াছে ছুটি
যেথায় পথের প্রান্তে ভক্তের হৃদয়পদ্ম ফুটি
বিতরিছে স্বর্গের সৌরভ। রত্নবেদিকার 'পরে
একা দেব রিক্ত দেবালয়ে।'

শুনি রাজা ক্ষোভভরে
সিংহাসন হতে নামি গেলা চলি যেথা তরুচ্ছায়ে
সাধু বসি তৃণাসনে; কহিলেন নমি তাঁর পায়ে,
"হেরো প্রভু, স্বর্ণশীর্ষ নৃপতিনির্মিত নিকেতন
অভ্রভেদী দেবালয়, তারে কেন করিয়া বর্জন
দেবতার স্তবগান গাহিতেছ পথপ্রান্তে বসে?'

"সে মন্দিরে দেব নাই' কহে সাধু।

রাজা কহে রোষে,
"দেব নাই! হে সন্ন্যাসী, নাস্তিকের মতো কথা কহ।
রত্নসিংহাসন- 'পরে দীপিতেছে রতনবিগ্রহ-
শূন্য তাহা?'

"শূন্য নয়, রাজদম্ভে পূর্ণ' সাধু কহে,
"আপনায় স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নহে।'

ভ্রূ কুঞ্চিয়া কহে রাজা, "বিংশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়া
রচিয়াছি অনিন্দিত যে মন্দির অম্বর ভেদিয়া,
পূজামন্ত্রে নিবেদিয়া দেবতারে করিয়াছি দান,
তুমি কহ সে মন্দিরে দেবতার নাহি কোনো স্থান!'

শান্ত মুখে কহে সাধু, "যে বৎসর বহ্নিদাহে দীন
বিংশতি সহস্র প্রজা গৃহহীন অন্নবস্ত্রহীন
দাঁড়াইল দ্বারে তব, কেঁদে গেল ব্যর্থ প্রার্থনায়
অরণ্যে, গুহার গর্ভে, পথপ্রান্তে তরুর ছায়ায়,
অশ্বত্থবিদীর্ণ জীর্ণ মন্দিরপ্রাঙ্গণে, সে বৎসর
বিংশ লক্ষ মুদ্রা দিয়া রচি তব স্বর্ণদীপ্ত ঘর
দেবতারে সমর্পিলে। সে দিন কহিলা ভগবান-
"আমার অনাদি ঘরে অগণ্য আলোক দীপ্যমান
অনন্তনীলিমা- মাঝে; মোর ঘরে ভিত্তি চিরন্তন
সত্য, শান্তি, দয়া, প্রেম। দীনশক্তি যে ক্ষুদ্র কৃপণ
নাহি পারে গৃহ দিতে গৃহহীন নিজ প্রজাগণে
সে আমারে গৃহ করে দান!' চলি গেলা সেই ক্ষণে
পথপ্রান্তে তরুতলে দীন- সাথে দীনের আশ্রয়।
অগাধ সমুদ্র- মাঝে স্ফীত ফেন যথা শূন্যময়
তেমনি পরম শূন্য তোমার মন্দির বিশ্বতলে,
স্বর্ণ আর দর্পের বুদ্‌বুদ্‌!'

রাজা জ্বলি রোষানলে,
কহিলেন, "রে ভন্ড পামর, মোর রাজ্য ত্যাগ করে
এ মুহূর্তে চলি যাও।'

সন্ন্যাসী কহিলা শান্ত স্বরে,
"ভক্তবৎসলেরে তুমি যেথায় পাঠালে নির্বাসনে
সেইখানে, মহারাজ, নির্বাসিত কর ভক্তজনে।'

15/06/2025

বিসর্জন

দুইটি কোলের ছেলে গেছে পর- পর
বয়স না হতে হতে পুরা দু- বছর।
এবার ছেলেটি তার জন্মিল যখন
স্বামীরেও হারালো মল্লিকা। বন্ধুজন
বুঝাইল- পূর্বজন্মে ছিল বহু পাপ,
এ জনমে তাই হেন দারুণ সন্তাপ।
শোকানলদগ্ধ নারী একান্ত বিনয়ে
অজ্ঞাত জন্মের পাপ শিরে বহি লয়ে
প্রায়শ্চিত্তে দিল মন। মন্দিরে মন্দিরে
যেথা সেথা গ্রামে গ্রামে পূজা দিয়ে ফিরে,
ব্রত ধ্যান উপবাসে আহ্নিকে তর্পণে
কাটে দিন, ধূপে দীপে নৈবেদ্যে চন্দনে
পূজাগৃহে; কেশে বাঁধি রাখিল মাদুলি
কুড়াইয়া শত ব্রাহ্মণের পদধূলি;
শুনে রামায়ণ- কথা; সন্ন্যাসী সাধুরে
ঘরে আনি আশীর্বাদ করায় শিশুরে।
বিশ্বমাঝে আপনারে রাখি সর্বনীচে
সবার প্রসন্নদৃষ্টি অভাগী মাগিছে
আপন সন্তান লাগি। সূর্য চন্দ্র হতে
পশুপক্ষী পতঙ্গ অবধি কোনোমতে
কেহ পাছে কোনো অপরাধ লয় মনে,
পাছে কেহ করে ক্ষোভ, অজানা কারণে
পাছে কারো লাগে ব্যথা- সকলের কাছে
আকুল- বেদনা- ভরে দীন হয়ে আছে।

যখন বছর দেড় বয়স শিশুর
যকৃতের ঘটিল বিকার; জ্বরাতুর
দেহখানি শীর্ণ হয়ে আসে। দেবালয়ে
মানিল মানত মাতা, পদামৃত লয়ে
করাইল পান, হরিসংকীর্তন- গানে
কাঁপিল প্রাঙ্গণ। ব্যাধি শান্তি নাহি মানে।
কাঁদিয়া শুধালো নারী, "ব্রাহ্মণ ঠাকুর,
এত দুঃখে তবু পাপ নাহি হল দূর?
দিনরাত্রি দেবতার মেনেছি দোহাই,
দিয়েছি এত যে পূজা তবু রক্ষা নাই?
তবু কি নেবেন তাঁরা আমার বাছারে?
এত ক্ষুধা দেবতার? এত ভারে ভারে
নৈবেদ্য দিলাম খেতে বেচিয়া গহনা,
সর্বস্ব খাওয়ানু, তবু ক্ষুধা মিটিল না?'
ব্রাহ্মণ কহিল, "বাছা, এ যে ঘোর কলি!
অনেক করেছ বটে তবু এও বলি,
আজকাল তেমন কি ভক্তি আছে কারো?
সত্যযুগে যা পারিত তা কি আজ পারো?
দানবীর কর্ণ- কাছে ধর্ম যবে এসে
পুত্রেরে চাহিল খেতে ব্রাহ্মণের বেশে,
নিজহস্তে সন্তানে কাটিল; তখনি সে
শিশুরে ফিরিয়া পেল চক্ষের নিমেষে।
শিবিরাজা শ্যেনরূপী ইন্দ্রের মুখেতে
আপন বুকের মাংস কাটি দিল খেতে,
পাইল অক্ষয় দেহ। নিষ্ঠা এরে বলে।
তেমন কি এ কালেতে আছে ভূম #ডলে?
মনে আছে ছেলেবেলা গল্প শুনিয়াছি
মার কাছে- তাঁদের গ্রামের কাছাকাছি
ছিল এক বন্ধ্যা নারী, না পাইয়া পথ
প্রথম গর্ভের ছেলে করিল মানত
মা গঙ্গার কাছে; শেষে পুত্রজন্ম- পরে
অভাগী বিধবা হল, গেল সে সাগরে,
কহিল সে নিষ্ঠাভরে মা গঙ্গারে ডেকে,
মা, তোমারি কোলে আমি দিলাম ছেলেকে-
এ মোর প্রথম পুত্র, শেষ পুত্র এই,
এ জন্মের তরে আর পুত্র- আশা নেই।
যেমনি জলেতে ফেলা, মাতা ভাগীরথী
মকরবাহিনী- রূপে হয়ে মূর্তিমতী
শিশু লয়ে আপনার পদ্মকরতলে
মার কোলে সমর্পিল। নিষ্ঠা এরে বলে।'
মল্লিকা ফিরিয়া এল নতশির করে,
আপনারে ধিক্কারিল- এতদিন ধরে
বৃথা ব্রত করিলাম, বৃথা দেবার্চনা,
নিষ্ঠাহীনা পাপিষ্ঠারে ফল মিলিল না।

ঘরে ফিরে এসে দেখে শিশু অচেতন
জ্বরাবেশে। অঙ্গ যেন অগ্নির মতন।
ঔষধ গিলাতে যায় যত বারবার
পড়ে যায়, কণ্ঠ দিয়া নামিল না আর।
দন্তে দন্তে গেল আঁটি। বৈদ্য শির নাড়ি
ধীরে ধীরে চলি গেল রোগীগৃহ ছাড়ি।
সন্ধ্যার আঁধারে শূন্য বিধবার ঘরে
একটি মলিন দীপ, শয়নশিয়রে
একা শোকাতুরা নারী। শিশু একবার
জ্যোতিহীন আঁখি মেলি যেন চারি ধার
খুঁজিল কাহারে। নারী কাঁদিল কাতর,
"ও মানিক, ওরে সোনা, এই- যে মা তোর,
এই- যে মায়ের কোল, ভয় কী রে বাপ!'
বক্ষে তারে চাপি ধরি তার জ্বরতাপ
চাহিল কাড়িয়া নিতে অঙ্গে আপনার
প্রাণপণে। সহসা বাতাসে গৃহদ্বার
খুলে গেল, ক্ষীণ দীপ নিবিল তখনি-
সহসা বাহির হতে কলকলধ্বনি
পশিল গৃহের মাঝে। চমকিল নারী।
দাঁড়ায়ে উঠিল বেগে শয্যাতল ছাড়ি,
কহিল, "মায়ের ডাক ওই শুনা যায়-
ও মোর দুঃখীর ধন, পেয়েছি উপায়,
তোর মার কোল চেয়ে সুশীতল কোল
আছে ওরে বাছা!'

জাগিয়াছে কলরোল
অদূরে জাহ্নবীজলে, এসেছে জোয়ার
পূর্ণিমায়। শিশুর তাপিত দেহভার
বক্ষে লয়ে মাতা, গেল শূন্যঘাট- পানে।
কহিল, "মা, মার ব্যথা যদি বাজে প্রাণে
তবে এ শিশুর তাপ দে গো মা জুড়ায়ে।
একমাত্র ধন মোর দিনু তোর পায়ে
এক- মনে।' এত বলি সমর্পিল জলে
অচেতন শিশুটিরে লয়ে করতলে
চক্ষু মুদি। বহুক্ষণ আঁখি মেলিল না;
ধ্যানে নিরখিল বসি মকরবাহনা
জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি ক্ষুদ্র শিশুটিরে
কোলে ক'রে এসেছেন, রাখি তার শিরে
একটি পদ্মের দল; হাসিমুখে ছেলে
অনিন্দিত কান্তি ধরি দেবী- কোল ফেলে
মার কোলে আসিবারে বাড়ায়েছে কর।
কহে দেবী, "রে দুঃখিনী, এই তুই ধর্‌
তোর ধন তোরে দিনু।' রোমাঞ্চিতকায়
নয়ন মেলিয়া কহে, "কই মা! ॥ কোথায়!'
পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী;
গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলধ্বনি।
চীৎকারী উঠিল নারী, "দিবি নে ফিরায়ে?'
মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে।

14/06/2025

চণ্ডী

দিদি, তুমি বোধ হয় ও পাড়ার চণ্ডীবাবুকে জান?
জানি নে! তিনি যে ডাকসাইটে নিন্দুক।
বিধাতার কারখানায় খাঁটি জিনিস তৈরি হয় না, মিশল থাকেই। দৈবাৎ এক- একজন উৎরে যায়। চণ্ডী তারই সেরা নমুনা। ওর নিন্দুকতায় ভেজাল নেই। জান তো, আমি আর্টিস্ট্‌- মানুষ। সেইজন্যে এরকম খাঁটি জিনিস আমার দরবারে জুটিয়ে আনি। একেবারে লোকটা জীনিয়স বললেই হয়। একটা এড়িয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। একদিন দেখি, অধ্যাপক অনিলের দরজায় কান দিয়ে কী শুনছে। আমি তাকে বললুম, অমন করে খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছ কাকে হে।
সেটাই যদি জানতুম তা হলে তো কথাই ছিল না। চার দিকে চোখ কান খুলে রাখতে হয়, কাউকে বিশ্বাস করবার জো নেই- চোর- ছ্যাঁচড়ে দেশ ভরে গেল।
বলো কী হে।
শুনে অবাক হবেন, এই সেইদিন অমন আমার চাঁপার রঙের গামছাখানা আলনার উপর থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেল।
বলো কী হে, গামছা!
আজ্ঞে হ্যাঁ, গামছা বই- কি। কোণটাতে একটুখানি ছেঁড়া ছিল, তা সেলাই করিয়ে নিয়েছিলুম।
তুমি অনিলবাবুর দরজার কাছে অমন ঘুর- ঘুর করছিলে কেন। পরের ছেঁড়া গামছা জোগাড় করবার রোগে তাঁকে ধরেছে নাকি।
আরে ছি ছি, ওঁরা হলেন বড়োলোক, গামছা কখনো চক্ষেও দেখেন নি। টার্কিস তোয়ালে না হলে ওঁর এক পা চলে না।
তা হলে?
আমি ভাবছিলুম, ওঁর পাওনা তো বেশি নয়। অথচ, এত বাবুআনা চলে কী ক'রে।
বোধ হয় ধার ক'রে!
আজকালকার বাজারে ধার তো সহজ নয়, তার চেয়ে সহজ ফাঁকি।
আচ্ছা, তুমি পুলিশে খবর দিয়েছিলে নাকি।
না, তার দরকার হয় নি। সেটা বেরোল আমার স্ত্রীর ময়লা কাপড়ের ঝুড়ির ভিতর থেকে। কাউকেই বিশ্বাস করবার জো নেই।
কী বল তুমি, ওটা ঠিক জায়গাতেই তো ছিল।
আপনি সাদা লোক, আসল কথাটাই বুঝতে পারছেন না। আপনি জানেন তো আমার শালা কোচ্‌লুকে। কী রকম সে গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ায়। পয়সা জোটে কোথা থেকে। কাজটি করছেন তিনি, আর গিন্নি সেটাকে বেমালুম চাপা দিয়েছেন।
তুমি জানলে কী ক'রে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, এ কি জানতে বাকি থাকে।
কখনো তাকে নিতে দেখেছ?
যে এমন কাজ করে সে কি দেখিয়ে দেখিয়ে করে। এ দিকে দেখুন- না, পুলিশ আছে চোখ বুজে, তারা যে বখরা নিয়ে থাকে। এই- সব উৎপাত আরম্ভ হয়েছে যখন থেকে দেখা দিয়েছেন ঐ আপনাদের গান্ধিমহারাজ।
এর মধ্যে তিনি আবার এলেন কোত্থেকে।
ঐ যে তাঁর অহিংস্র নীতি। ধড়াধড় না পিটলে চোরের চুরি রোগ কখনো সারে? তিনি নিজে থাকেন কপ্‌নি প'রে। এক পয়সা সম্বল নেই। এ- সব লম্বাচওড়া বুলি তাঁকেই সাজে। আমরা গেরস্থ মানুষ, শুনে চক্ষু স্থির হয়ে যায়। এ দিকে আর- এক নতুন ফন্দি বেরিয়েছে জানেন তো? ঐ যে যাকে আপনারা বলেন চাঁদা। তার মুনফা কম নয়। কিন্তু সেটা তলিয়ে যায় কোথায় তার হিসেব রাখে কে। মশায়, সেদিন আমারই ঘরে এসে উপস্থিত অনাথ- হাসপাতালের চাঁদা চাইতে। লজ্জা হয়, কী আর বলব। খাতা হাতে যিনি এসেছিলেন আপনারা সবাই তাঁকে জানেন। ডাক্তার- আর নাম করে কাজ নেই, কে আবার তাঁর কানে ওঠাবে। তিনি যে মাঝে মাঝে আসেন আমাদের ঘরে নাড়ী টিপতে। সিকি পয়সা দিতে হয় না বটে, তেমনি সিকি পয়সার ফলও পাই নে। তবু হাজার হোক, এম- বি তো বটে। এমনি হাল আমলের তাঁর চিকিৎসা যে রোগীরা তাঁর কাছে ঘেঁষে না। কাজেই টাকার টানাটানি হয় বই- কি।
ছি ছি, কী বলছ তুমি।
তা মশায়, আমি মুখফোড় মানুষ। সত্যিকথা আমার বাধে না। ওঁর মুখের সামনেই শুনিয়ে দিতে পারতুম। কিন্তু কী বলব, আমার ছেলেটাকে আদায়ের কাজে রেখে আমার মুখ বন্ধ করেছেন। তার কাছ থেকেও মাঝে মাঝে ইশারা পাই। দক্ষিণহস্ত বেশ চলছে ভালো। বুঝছেন তো? আমাদের দেশে আজকালকার ইৎরমি যে কী রকম অসহ্য, তার আর- একটা নমুনা আপনাকে শোনাই।
কী রকম।
আমাদের পাড়ায় আছে একটা গোমুখ্য যাকে ওরা নাম দিয়েছে কবিবর। তাকে দিয়ে দেখুন আমার নামে কী লিখিয়েছে। ঘোর লাইবেল। নিন্দুকেরা দল পাকিয়েছে। পাড়ায় কান পাতবার জো নেই। খ্যাঁক্‌শিয়ালি ব'লে চেঁচাচ্ছে আমার পিছনে পিছনে। এত সাহস হত না যদি না এদের পিছনে থাকত নামজাদা মুরুব্বি সব গান্ধিজির চেলা।
দেখি দেখি কী লিখেছে। মন্দ হয় নি তো। লোকটার হাত দোরস্ত আছে। -
আলো যার মিট্‌মিটে,
স্বভাবটা খিট্‌খিটে,
বড়োকে করিতে চায় ছোটো,
সব ছবি ভুসো মেজে
কালো ক'রে নিজেকে যে
মনে করে ওস্তাদ পোটো,
বিধাতার অভিশাপে,
ঘুরে মরে ঝোপে ঝাপে,
স্বভাবটা যার বদ্‌খেয়ালি,
খ্যাঁক্‌ খ্যাঁক্‌ করে মিছে
সব তাতে দাঁত খিঁচে,
তারে নাম দিব খ্যাঁক্‌শেয়ালি।
ও কী ও, আপনার দরজায় পুলিশ যে।
ব্যাপারটা কী।
চণ্ডীবাবুর ছেলের নামে কেস এসেছে।
হ্যাঁ, কিসের কেস।
অনাথ- হাসপাতালের চাঁদার টাকা তিনি ভেঙে বসেছেন।
মিথ্যে কথা। আগাগোড়া পুলিশের সাজানো। আপনি তো জানেন, আমার ছেলে একসময় আহার নিদ্রা ছেড়ে গান্ধির নামে দরজায় দরজায় চাঁদা ভিক্ষে করে বেড়িয়েছিল, সেই অবধি বরাবর তার উপর পুলিশের নজর লেগে আছে। কিছু না, এটা পলিটিক্যাল মামলা।
দাদামশায়, তোমার এই গল্পটা আমার একটুও ভালো লাগল না।
*
* *
যেমন পাজি, তেমনি বোকা,
গোবর- ভরা মাথা,
লোকটা কে- যে ভেবে পাচ্ছি না তা।
কবে যে কী বলেছিল ঠিক তা মনে নাই,
আচ্ছা ক'রে মুখের মতো জবাব দিতে চাই;
কী যে জবাব, কার যে জবাব যদি মনে পড়ে-
প্রাণ ফিরে পাই ধড়ে।
হাতে পেলে দেওয়াই নাকে খত,
স্ত্রীর ছিঁড়ে দিই নথ।
রাস্কেল সে, পাজির অধম, শয়তান মিট্‌মিটে;
দিনরাত্তির ইচ্ছে করে, ঘুঘু চরাই ভিটেয়।
বদ্‌মাশকে শিক্ষা দেব- অসহ্য এই ইচ্ছে
মনকে নাড়া দিচ্ছে।
লোকটা কে- যে পষ্ট তা নয়, এই কথাটাই পষ্ট-
অতি খারাপ, নিতান্তই সে নষ্ট।
পথের মোড়ে যদি পেতেম দেখা,
মনের ঝালটা ঝেড়ে নিতেম যদি থাকত একা।
বুকটা ভ'রে অকথ্য সব জমে উঠছে ঢের,
লক্ষ্য মনে না পড়ে তো কাগজ করব বের,
যেখানে পাই নাম একটা করব নির্বাচন-
খালাস পাবে মন।

Address


Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Mrinal BD Music posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Shortcuts

  • Address
  • Alerts
  • Claim ownership or report listing
  • Want your business to be the top-listed Media Company?

Share