19/08/2023
সাম্য রাইয়ানের কবিতা প্রথমদিকে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি পড়েছিলাম লিটলম্যাগে৷ তখন দুর্বোধ্য ঠেকতো৷ এর প্রধান কারন ছিল আমার অপরাপর কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাকে বুঝতে চেয়েছিলাম৷ পরে একদিন কোন এক অনলাইন ম্যাগাজিনে তাঁর ‘হাসতে হাসতে মরে যাবো’ কবিতাটি পড়ার পর প্রথমবার তাঁর প্রতি আমার অত্যন্ত কৌতুহল জন্মায়৷ আমি পূর্বের অভিজ্ঞতার সাথে মিলাতে পারি না৷ এরপর তাঁর বই খুঁজতে থাকি৷ অনলাইনে ‘লিখিত রাত্রি’, ‘বিগত রাইফেলের প্রতি সমবেদনা’ বইগুলোর পিডিএফ পেয়ে যাই। প্রথম পড়ি ‘লিখিত রাত্রি’৷ এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় পড়তে শুরু করেছিলাম৷ একটানা দুইবার পড়ে ফেলি বইয়ের কবিতাগুলো৷ সেইদিন আমরা সহজেই সহজ হয়ে গিয়েছিলাম। নতুন কবিতার কৌতূহল নিয়ে কবিমহলে যে কনফিউশন বিদ্যমান, সেইগুলো নিয়া কোনো ভড়ং বা আঁতলামি ছাড়াই এ কবি যেন নিজেকেই আশ্চর্য ফর্মেটে মেলে ধরছিলেন৷ উনার সহজ অভিব্যক্তিগুলো আমার ভালো লাগছিল৷ নৈকট্য অনুভব করছিলাম। তার লিখিত রাত্রির কবিতাগুলো অস্বাভাবিক ভাল লেগে গেল আমার। এই ভালো লাগা রহস্যের কারন হতে পারে ‘মোহ’। মোহ থেকে তৈরী হয় পক্ষপাতিত্ব। তবে পাঠকের ভিতর লেখককে নিয়া যখন পক্ষপাতিত্ব তৈরি হয়, তখন বুঝতে হবে ওই লেখকের লেখায় ওই পাঠকের উপযুক্ত উপাদান রয়েছে৷ যার কারণে তিনি পাঠককে আক্রান্ত করতে, নিজের দিকে টানতে পারছেন। এ বই পাঠের পর সাম্য রাইয়ানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব অনুভব করছিলাম৷ ফলে অচিরেই তাঁর অন্যান্য বইসহ সবগুলোর হার্ড কপি সংগ্রহের চেষ্টা করি৷ কিন্তু পুরো সফল হয়নি কারন তাঁর কিছু বই আর পাওয়া যায় না৷ আর যেগুলো পাওয়া যায়, জনপ্রিয় ধারার লেখক না হওয়ায় সেগুলো ভারত পর্যন্ত পৌঁছনো কষ্টসাধ্য৷ তবুও কয়েকটি বই সংগ্রহ করেছি: ‘লোকাল ট্রেনের জার্নাল’, ‘উৎপলকুমার বসু’, ‘হালকা রোদের দুপুর’, ‘লিখিত রাত্রি’। পড়ছি তাকে। পড়তে গিয়ে ভালোলাগা তৈরি হচ্ছে তার লেখার প্রতি। বেশির ভাগ কবিতা লেখকদেরই প্রথম বই আর শেষ বইয়ের তেমন কোন পার্থক্য নাই। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে সাম্য রাইয়ানের কবিতা পড়ে একটি বিষয় খুব ভালভাবে বুঝলাম, তাঁর শুধু কয়েকটি কবিতা তো দূর কি বাৎ, এমনকি তার একটি আস্ত কাব্যগ্রন্থ পড়েও ভেবে নেয়ার সুযোগ নেই যে তিনি এমন করে লিখেন, বা লিখছেন…৷ কেননা আপনি যখন ‘হলুদ পাহাড়’ পড়ে তাঁর কবিতা সম্পর্কে ধারণা করছেন, তখন দেখা যাবে তিনি ‘হলুদ পাহাড়’ ফর্ম ছেড়ে ‘লিখিক রাত্রি’ লিখে ফেলেছেন৷ আবার যখন ‘লিখিত রাত্রি’ পড়ে আপনি তাঁর কবিতা সম্পর্কে ধারণা করছেন, তখন দেখা যাবে তিনি ‘হালকা রোদের দুপুর’ লিখে ফেলেছেন৷ এত বৈচিত্র তাঁর কবিতায় যে, তাকে নির্দিষ্ট ছকে আটকানো অসম্ভব৷ প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই তিনি নিরীক্ষাপ্রবণ৷ যা সকলেই নয়, কেউ কেউ করতে পারেন৷ আর সেজন্যই জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ কবি’৷
“চারদিকে রোজ ঘন হয়ে ফোটা অন্ধকার পেরিয়ে
আমাকে বাড়ি ফিরতে হয়। আর এর মাঝে যদি
এরকম হতো, বাড়িটাই আসতো আমার দিকে
তাহলে এর অধিক, ঝড়-বাদলের রাতও
কী সুসজ্জিত শোভন প্রেমে কাটিয়ে দেয়া যেত!”
(আট নম্বর কবিতা/ লিখিত রাত্রি)
দ্বিতীয় দশকের কবি সাম্য রাইয়ান দারুণ চিত্রকর—কবিতায় চিত্রকর। সাম্য রাইয়ানের কবিতা পড়ছি ২০১৯ সাল থেকে। বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু লিটলম্যাগ ও অনলাইন ম্যাগের সংখ্যাগুলোতে নিয়মিত উপস্থিতি তাঁর। তবে তাঁর কাব্যভাষায় বদল ঘেটেছে নিয়মিত। ‘লিখিত রাত্রি’ (২০১৯) কবিতার বইয়ে তিনি ছোট ছোট কথা দিয়ে, ভাষা দিয়ে কবিতায় চিত্রকল্প তৈরি করেছেন; চিত্রের ফুল দিয়ে দিয়ে কবিতার মালা গেঁথেছেন। কবিতায় একটির পর একটি ছবি গড়ে তুলেছেন। সেসব ছবির বন্ধনের মধ্য দিয়ে কবিতা নির্মাণ করেছেন। যা আমাদের বিরক্তি উৎপাদন করে না৷ আগ্রহী করে, ঘোরাচ্ছন্ন করে৷ তাঁর কবিতার চিত্রকলা কখনো কখনো কল্পনার পথে যাত্রার, কখনো বা নিসর্গ সৌন্দর্যের। আবার কখনো সুখ-দুঃখ মিশ্রিত আনন্দ-বেদনার। তার কবিতায় সমুদ্রের ঢেউয়ের মৃদু সঙ্গীত বাজে।
“ঘর গোছানো সেরে মাছপরীদের সাথে হাঁটতে
বেরিয়ে মনভালো অনুভূতি হলে নিজেকে আমার
আনন্দ প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্র মনে হয়।
মনে হয় গভীর থেকে বেরিয়ে আসে বুঝি অজস্র
শিশুদের স্বতস্ফুর্ত কুলধ্বনি; সদ্য প্রকাশিত।”
(সাতচল্লিশ নম্বর কবিতা/ লিখিত রাত্রি)
এ বইয়ের কবিতাগুলো নারকেলের মত, বাইরে শক্ত হলেও ভেতরে নরম ও সুস্বাদু। রসাস্বাদন করে তৃষ্ণা মিটানোর পাশাপাশি পুষ্টিও গ্রহণ করা যায়। বাংলার রমণীর আটপৌরে শাড়ির ব্যবহারের মতো সাম্যের কবিতা সবসময় পড়া যায়।
“ছাপোষা মধ্যরাতে পুরোনো প্রেমিকাকে মনে পড়া
দোষের কিছু নয়। যখন তা ছিলো বৃক্ষের নতুন
পাতাদের মতো। ওরা সুউচ্চ জিরাফের গ্রীবা থেকে
নেমে এলে যে উজ্জ্বল পাখিঘুম আমার দিকে
তাকিয়ে থাকে, ওর কোনও ভাবনারেখা নেই!”
(চার নম্বর কবিতা/ লিখিত রাত্রি)
তাঁর কবিতাগুলো যেন দিগন্ত-বিস্তৃত রাতের টুকরো টুকরো ছবি-কোথাও ছাপোষা মধ্যরাত, কোথাও বা আধারি শরীরের দিকে তাক করা ভালোবাসা, ডাহুকের ডাক। বিভিন্ন পটভূমির মনস্তাত্ত্বিক দৃশ্যগুলো পাঠকের মস্তিষ্কে স্থায়ীরূপ দিতে সক্ষম। এভাবেই কথা বলে সাম্য রাইয়ানের কবিতা। নান্দনিক ও কমনীয়তায় মুগ্ধ করে পাঠককে। তার কবিতা পড়লে মনে হয় ‘শেষ হয়েও হয় না শেষ’। মস্তিষ্কে অনেকক্ষণ খেলা করে, আলোড়ন তোলে। এসব কারণেই তার কবিতা পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন নিতে সক্ষম। হৃদয়ের মুক্তিপিয়াসি এ কবি শুধু সময় আঁকড়েই থাকেননি, সময়কে ভবিষ্যতের সঙ্গে সেতু নির্মাণ করে দিতে সক্ষম হয়েছেন। ব্রায়ান লারার ধ্রুপদী টেস্ট-ইনিংসে ক্ষণে ক্ষণে কব্জির মোচড় দিয়ে সীমানা ছাড়া করার মতো নান্দনিক সাম্য রাইয়ানের কবিতার আবেদন। তাই তার কবিতা পাঠে আলাদা একটা আবেদন আছে, আনন্দ-বিষাদ একই মুদ্রার মতো মিশে থাকে।
সর্বপ্রাণবাদী এক জীবনদর্শনের রূপ ফুটে ওঠে সাম্যের কবিতায়। সর্বপ্রাণবাদ উত্তর-আধুনিক কবিতার প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য৷ জগতে বিদ্যমান সকল প্রাণের প্রতি তাই তাঁর প্রেমময় সুর হচ্ছে:
“জ্ঞানমুখি বৃক্ষকে শোনো, ওর কাছে যাও, ওকে
আলিঙ্গন করো প্রগাঢ় শ্রদ্ধায়। বিভিন্ন আকাশে
তার একই রূপ; একই রকম যথার্থ ডানা।
কেন সে হলো মিলনকাতর, প্রবল বিপদেও
এতো নিরুত্তাপ কেনো, তাকে জিজ্ঞেস করো, ভালোবাসো।”
(তিরিশ নম্বর কবিতা/ লিখিত রাত্রি)
তার কবিতার বিশেষত্ব হলো- সহজ-সরল জলের মতো পাঠকের অন্তর গহনে তির তির করে ঢেউ তোলে-কি শব্দচয়নে, কি ছন্দ বা চিত্রকল্পে, এমনকি বিষয় নির্বাচনে। তিনি নতুন শাড়ির পাড় ভাঙার মতো যা দেখান-তা হলো বাস্তব জীবনবোধের নকশা। এ কারণে তার কবিতা বড় বেশি হৃদয়স্পর্শী। তার কবিতায় পাওয়া যায় সংবেদনশীল মনের গভীর পরিচয়।
“কিছুটা আঁধারে রূপালী গাছ প্রাচীন উটপাখি
হয়ে ঝুলে আছে মেঘের কলোনীতে। আমি দেখলাম
তাকে, হৃদয়ের চশমা খুলে। আমার খুব মন
চায় ওই পাখিটার পিঠে উঠি। সাদরে সে গ্রহণ
করুক আমাকে; আমার সকল বৃথালাপায়োজন।”
(ছেচল্লিশ নম্বর কবিতা/ লিখিত রাত্রি)
সাম্য রাইয়ানের প্রধান কয়েকটি গুণের মধ্যে একটি হচ্ছে, সমসাময়িক বিষয়কে এড়িয়ে না গিয়ে নিপুণতার সাথে কবিতায় উপস্থাপন করা। সমকাল চেতনার কবি তিনি। সময়ের সংকটকে তুলে ধরেছেন। যুগ সংকটের কাল বা ছবি স্পষ্ট করেছেন, ছবি এঁকেছেন কবিতার মাধ্যমে। যেমন:
“এই যে প্রতিদিন কতোবার দিনেদুপুরে খুন
হয়ে যাচ্ছি; কেউ টের পাচ্ছে না, কিছু বলছে না।
এই যে ঘুমের মধ্যে ওঙ্কারধ্বণি শুনতে পাচ্ছি
এর মধ্যে একবিন্দু মিথ্যে নেই জানেন! বরং
যে বাজার আমাকে নির্মাণ করে, ওটা মিথ্যায় ভরা।”
(উনিশ নং কবিতা/ লিখিত রাত্রি)
নান্দনিকতার অপার ভুবন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন সাম্য রাইয়ান। প্রকৃতির অপরূপ নৈসর্গিকতা কবিকে মুগ্ধতার পরশে আচ্ছন্ন করেছে। তবে হতাশায় নিজেকে প্রকৃতির কাছে সমর্পণ করেননি তিনি, বরং প্রকৃতিকেই প্রকৃত বন্ধু বলে জেনেছেন।
“ওরা চায় আমি পাগল হয়ে যাই, একা হয়ে যাই
শহরে ঘুরিফিরি নিঃসঙ্গ মানুষ; আমার মৃত্যু হোক
জলের অভাবে নির্মম: বর্ণনাতীত। অথচ কতো
পাখি ফুল নদী বন্ধু হচ্ছে অকপটে; কী তুমুল
আড্ডা দিচ্ছি আমরা। সুযোগ নেই, হবো: একলা-পাগল।”
(কুড়ি নম্বর কবিতা/ লিখিত রাত্রি)
কবি সাম্য রাইয়ানের অপার রাত্রির গাঁথা পড়তে পড়তে আমি ভ্রমণের অনুভূতি পাই৷ কবিতায় তিনি নতুন কল্পলোকের চাবি পাঠকের হাতে ধরিয়ে দেন৷ যেখানে পাঠক স্বাধীন, নদীর ছবির মতো ফ্রেমবন্দী নয়৷ কবি জানেন জীবনপুরাণ, “সাঁতারু নামে না কোনো ফ্রেমবন্দী নদীতে”৷ তাই পাঠককে ফ্রেমবন্দী আকাশের ছবি দেখানোর পরিবর্তে মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর স্বাধীনতা দেন তিনি কবিতায়৷
__________________________
#বইরিভিউ
সাম্য রাইয়ানের ‘লিখিত রাত্রি’: বহুমাত্রিক রাতের টুকরো টুকরো ছবি
লিখেছেন: অবন্তিকা সেন
__________________________
বই: লিখিত রাত্রি
ধরন: কবিতা
কবি: সাম্য রাইয়ান
প্রকাশক: ঘাসফুল
বইটি কিনুন রকমারী, বইবাজার বা বইফেরী থেকে৷