22/03/2025
ফেসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
ফজরের আজানের সাথে ঘুম ভাঙলেও বিছানা ছাড়তে আরও আধঘণ্টা লেগে যায়। চোখ খুলেই প্রথমে হাত বাড়াই মোবাইলের দিকে। ফেসবুক খুলতেই দেখি নোটিফিকেশন আর মেসেজের বন্যা! রাতভর আমার পোস্টে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার চলেছে। কয়েকটা ট্রেন্ডিং গ্রুপেও আমার নাম দেখা যাচ্ছে। এই আনন্দেই দিনের শুরু!
আমি ফেসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র। এখানে কোনো অ্যাডমিশন ফি নেই, ক্লাসরুম নেই, অথচ জ্ঞান আর বিনোদনের অফুরন্ত ভাণ্ডার রয়েছে। কে বলল, পড়াশোনা শুধু বইয়ের পাতায় হয়? ফেসবুকে ঢুকলেই সব আছে—রাজনীতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্ম, বিনোদন, এমনকি খেলার বিশ্লেষণও। একটাই শর্ত—কী বিশ্বাস করবে আর কী করবে না, সেটা তোমার নিজের বুদ্ধিতে বুঝতে হবে।
প্রথম ক্লাস: রাজনীতি ১০১
সকালের প্রথম কাজ হলো ট্রেন্ডিং নিউজ দেখা। "দেশ ধ্বংসের পথে!"—একটা বড়সড় পোস্ট চোখে পড়ল। কমেন্ট সেকশনে ঢুকে দেখি, দুই দল তর্কযুদ্ধে মত্ত। আমি কোনো দলেই নেই, কিন্তু একটু হাওয়া দিতে তো দোষ নেই!
— "ভাই, সত্যি কথা বললে আবার সমস্যা? দেশ তো অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে!"
দুই মিনিটের মধ্যে রিপ্লাই আসল:
— "আপনার মাথা ঠিক আছে? কোন দলে?"
এটা সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রশ্ন! সরাসরি উত্তর না দিয়ে লেখলাম:
— "আমি সত্যের দলে!"
এই উত্তরে লাইকের ঝড়। আমার পোস্টের স্ক্রিনশট নিয়ে কয়েকজন নতুন গ্রুপেও শেয়ার করল। ফেসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এটাও এক ধরনের সাফল্য।
দ্বিতীয় ক্লাস: বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার
একটা পোস্ট ভাইরাল হয়েছে—"চন্দ্রগ্রহণের রাতে বাইরে গেলে বিপদ হবে!" কমেন্টে ঢুকে দেখি, কেউ বলছে এটা প্রমাণিত সত্য, আবার কেউ বিজ্ঞান দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে কেন এটা অবৈজ্ঞানিক। আমি কোথাও কমেন্ট করলাম না, শুধু একটা হাসির রিয়্যাক্ট দিলাম। কারণ, এখানে যুক্তি দিলেই ঝগড়া শুরু হয়ে যায়।
তবে ফেসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে থেকে একটা ব্যাপার শিখেছি—সবাই সব জানে। যে লোক গতকাল ফিজিক্সের গুরু ছিল, আজ সে ইতিহাসবিদ হয়ে গেছে।
তৃতীয় ক্লাস: সাহিত্য ও প্রেম
বিকেলের দিকে আমার নিউজফিড প্রেমময় হয়ে ওঠে। কবিতার পোস্ট, ভালোবাসার কোটস, বিরহের গল্পে ভরে যায় ফেসবুক। আমিও এক-আধটা কবিতা লিখি মাঝেমাঝে, যদিও আসল লেখকের নাম অনেকেই দেয় না।
— "ভালোবাসা মানে শুধু পাওয়া নয়, ছাড়তেও জানতে হয়…"
এই ছোট্ট লাইন লিখে পোস্ট দিলাম। মিনিট দশেকের মধ্যে বিশ-পঁচিশটা লাইক আর কমেন্ট চলে এল:
— "অসাধারণ বলেছেন ভাই!"
— "মন ছুঁয়ে গেল…"
— "ভাই, এমন স্ট্যাটাস দিচ্ছেন কেন? কিছু হয়েছে?"
বুঝলাম, রাতের মধ্যে পোস্টটা শত শত শেয়ারে চলে যাবে।
চতুর্থ ক্লাস: ফেসবুক যুদ্ধ
রাত বাড়ার সাথে সাথে ফেসবুকের পরিবেশও বদলে যায়। এ সময় সবচেয়ে উত্তপ্ত আলোচনা চলে ক্রিকেট, সিনেমা আর রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে।
একটা কমেন্টে ঢুকে দেখলাম, দু’জন তর্ক করছে—
— "তোমার প্লেয়ার কিছু পারে না!"
— "তোমার প্লেয়ার তো আরও বাজে!"
এমন পোস্টের নিচে কমেন্ট করাই বিপজ্জনক। কিন্তু আমি নিরপেক্ষতার নাম করে লিখলাম:
— "ভাই, খেলাধুলায় এত রাগ কেন?"
ব্যস! এখন আমাকেই আক্রমণ করা শুরু হলো।
— "আপনি কিছুই বোঝেন না!"
— "ফেসবুকে আসার দরকার নেই!"
ফেসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা নতুন কিছু নয়।
সেমিস্টার ফাইনাল: ট্রল বনাম জ্ঞান
রাত গভীর হলে ট্রল পোস্টের সংখ্যা বাড়ে। কেউ কারও ছবি এডিট করে মজার ক্যাপশন দিচ্ছে, কেউবা মিম বানিয়ে ট্রেন্ডিং করতে চাইছে। আমি কেবল বসে বসে দেখি, হাসি, আর মাঝে মাঝে শেয়ার করি।
কিন্তু এখানেও একদল মানুষ আছে যারা সবকিছু সিরিয়াসভাবে নেয়। তারা বলবে,
— "ভাই, এসব ফাজলামি বাদ দিন!"
— "এতে দেশের উন্নতি হবে না!"
আসলে ফেসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে ধৈর্য আর কৌশল দুইটাই দরকার। কে কখন সিরিয়াস, কে কখন মজার মুডে থাকে, সেটা বোঝার জন্য অভিজ্ঞতা লাগে।
ফেসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি
আমি এখন ফেসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ছাত্র। অনেক কিছু শিখেছি—কীভাবে ট্রেন্ডিং পোস্ট করতে হয়, কীভাবে বিতর্ক এড়িয়ে চলতে হয়, আর কাদের পোস্টে লাইক দিলে বেশি জনপ্রিয় হওয়া যায়।
ডিগ্রি পাওয়ার কোনো নিয়ম নেই এখানে, কিন্তু একটা লক্ষণ ঠিক আছে—যদি একদিন তোমার একটা পোস্ট ভাইরাল হয়, যদি হাজার হাজার লাইক-কমেন্ট আসে, আর তুমি বুঝতে পারো কীভাবে মানুষের মন জয় করতে হয়—তাহলে তুমি সফল ছাত্র!
আমি এখনো শিখছি, এখনো ফেসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করছি। কারণ, এখানে শেখার কোনো শেষ নেই!