08/09/2025
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রায় প্রত্যেকটা প্রসিদ্ধ জীবনীগ্রন্থে ঘটনাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। খলিফার দায়িত্ব পাওয়ার পর উনি নিয়ম করে রাতের বেলা মহল্লায় মানুষদের খোঁজখবর নিতে বের হতেন।কোনো দলবল ছাড়াই। একা, একেবারে সাধারণ বেশভূষায়।
এমনই একদিনের ঘটনা। একটি ভগ্নপ্রায় কুঁড়েঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, ঘরের ভেতরে থাকা মা এবং মেয়ের কথোপকথন কানে আসে খলিফা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর। তিনি থামলেন এবং তাদের সেই আলাপচারিতা ভালোভাবে শুনবার জন্য কানজোড়াকে আরও সজাগ করলেন।
উক্ত ঘরের বাসিন্দারা বকরির দুধ বেচত। মা মেয়েকে বলছিল দুধের মধ্যে পানি মিশিয়ে পরিমাণ বাড়িয়ে নিতে। এতে করে বেশি টাকা পাওয়া যাবে। মায়ের কথায় প্রতিবাদ করে উঠল মেয়ে। মেয়েটা বলল, 'এটা তুমি কী বলছ মা! দুধের মধ্যে পানি মেশাব কেন? খলিফা জানতে পারলে কী হবে তুমি জানো?'
মা বলল, 'খলিফা কীভাবে জানবে এই কথা? খলিফা কি দেখবেন নাকি আমরা পানি মিশিয়েছি কি না?'
তখন মেয়েটা বলল, 'মা, খলিফা নাহয় দেখলেন না আমরা কী করছি। কিন্তু, যিনি আসমানে আছেন, তিনি তো দেখছেন। তার কাছ থেকে আমরা কীভাবে লুকোবো এই কাজ?'
মেয়েটার এহেন উত্তরে মুগ্ধ হোন বাইরে কান পেতে থাকা রাজ্যের খলিফা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি ঠিক করলেন, এই মেয়েটাকে তিনি পুত্রবধু বানাবেন।
ঠিক ঠিক তা-ই হলো। নিজের পুত্র আসিমের সাথে এই কন্যার বিয়ে দেন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু।
কিন্তু, ঘটনার সিলসিলা সেখানে থামেনি। আসিম এবং উক্ত মেয়ের ঘর আলো করে একটি কন্যা সন্তান জন্মলাভ করে। সেই কন্যা সন্তানের ঘর আলো করে আসে আরেকটি কন্যা সন্তান। আপনি কি জানেন কে ছিলেন শেষোক্ত এই কন্যা সন্তানটি? তিনি ছিলেন মুসলিম জাহানের আরেক ন্যায়পরায়ণ শাসক খলিফা উমার ইবন আবদুল আযীযের মা।
অর্থাৎ, দুধে পানি মেশাতে একদিন যে মেয়েটা আপত্তি করেছিল এই ভয়ে যে, খলিফাকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও আসমানে যিনি আছেন তাঁকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়, সেই মেয়েটা ছিলেন খলিফা উমার ইবন আবদুল আযীযের নানী।
সেই রাতে মেয়েটির একটা গুণই খলিফা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মুগ্ধ করেছিল—রবকে চেনার সক্ষমতা। মেয়েটা বলেছিলেন, 'আসমানে যিনি আছেন তাঁকে কীভাবে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব?' আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যে 'আস-সামী' এবং 'আল বাসীর' তথা 'সবকিছুই শোনেন' আর 'সবকিছুই দেখেন', তাঁর কাছ থেকে যে কোনোকিছুই লুকোনো যায় না, কোনোকিছুই গোপন করা যায় না—এই বোধ সেই মেয়ের মাঝে প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল।
রাত্রির নিবিড় অন্ধকারে পাতার নিচে চুপটি মেরে থাকা কোনো পোঁকা কিংবা সমুদ্রের গভীর তলদেশে বালির অতল তলে লুকিয়ে থাকা কোনো জলজ প্রাণী—সবার ব্যাপারেই সমান ওয়াকিবহাল আমাদের রব।
রবকে চেনার এই একটা গুণ মেয়েটাকে কী মহান উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, সুবহানাল্লাহ! তিনি উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘরে এসেছিলেন তাঁর পুত্রবধুর মর্যাদায়। উমার ইবন আবদুল আযীযের জন্মের সিলসিলাতেও তিনি ভাস্বর হয়ে ছিলেন। আসমানের অধিপতি তাঁর উপর সন্তুষ্ট থাকুন।
দুনিয়াতে খুব কম ঘটনাই কো-ইন্সিডেন্টলি ঘটে। প্রায় প্রত্যেকটা মহান এবং অ-মহান ঘটনার পেছনে লুকিয়ে থাকে এমন কিছু কার্যকারণ, যা ঘটনাগুলোর পেছনে অনুঘটক হিশেবে কাজ করে।
সেই মেয়েটির ঘটনাতেই দেখুন। তিনি যদি আল্লাহর 'আস-সামী' এবং 'আল-বাসীর' নামকে হৃদয়গভীরে ধারণ করতে না পারতেন, তাহলে তিনি খলিফা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘরে তাঁর পুত্রবধু হয়ে আসার মর্যাদাও পেতেন না, তাঁর বংশে জন্মও নিতেন না খলিফা উমার ইবন আবদুল আযীযের মতো ন্যায়পরায়ণ শাসকও।
সন্তানদেরকে আমরা অনেকসময় ভালো কিছু শেখাতে আলসেমি করি। আমরা ধরে নিই যে, বয়সের সাথে সাথে এমনিতেই তারা শিখে ফেলবে। আল্লাহ সবকিছু দেখেন আর সবকিছু শোনেন—এটা আর এমন কী জ্ঞান? এটা শেখানো আর এমন কী ঘটনা? 'আল্লাহ সবকিছু দেখেন আর সবকিছু শোনেন'—এটা তোতাপাখির মতো তাকে মুখস্ত করানো এক ব্যাপার, সন্তানের মনে এই বোধ, এই উপলব্ধি গেঁথে দেওয়া সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার।
দ্বীনের পথে সন্তানের পেছনে আমরা যে সময় ব্যয় করি, যে অর্থ খরচ করি এসবের কোনোটাই ব্যর্থ নয়। মৃত্যুর পরেও যে তিন আমলের সওয়াব মানুষের কবরে পৌঁছে এবং আমলনামাতে যোগ হয় সেই তিন আমলের একটা হলো পিতামাতার জন্য নেককার সন্তানের দুয়া।
কোনো একজন সালাফ বলেছিলেন, একবার তিনি একজন মৃত লোককে স্বপ্নে দেখেন। স্বপ্নে তিনি তাকে জিগ্যেস করেন, 'আল্লাহ আপনার সাথে কীরূপ আচরণ করেছেন?' সেই লোক বলল, 'আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।' সালাফ পুনরায় জানতে চাইলেন, 'আপনার কোন আমলের জন্য তিনি আপনাকে ক্ষমা করেছেন?' লোকটা বলল, 'আমি আমার সন্তানকে সুরা আল ফাতিহা শিখিয়েছিলাম। এই একটা কারণে তিনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।'
সন্তানকে কেবল সুরা ফাতিহা শেখানোর উসিলাতেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা একজনকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ!
সন্তানদের রবের সাথে পরিচয় করানো, রবের পবিত্র এবং সুন্দর নামগুলো তাদের অন্তর মননে গেঁথে দেওয়াটা একজন বাবা হিশেবে আমার ফরয দায়িত্ব। আমি আমার সন্তানদের সামনে যে ভঙ্গিতে, যে ভাষায়, যে উপমা আর উদাহরণের মাধ্যমে রবের নামগুলো তুলে ধরি, সেই একই ধাঁচে আমি একটা সিরিজ লিখেছি 'আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নাম' শিরোনামে।
৪ থেকে ১২ বছর বয়েসি বাচ্চাদের জন্য এই সিরিজ একটি অসাধারণ উপহার হবে রবের নামগুলোর সাথে পরিচিত হতে, ইন শা আল্লাহ। একদিকে আছে গল্পের আদলে আল্লাহর নামগুলোর পরিচয়, অন্যদিকে আছে নজরকাড়া সব ছবির সমন্বয়। ছোট্ট সোনামণিদের জন্য এটি হয়ে উঠবে এক অনন্য উপহার, ইন শা আল্লাহ।
রবকে চেনার মাধ্যমেই বেড়ে উঠুক আমাদের স্বপ্নেরা 💚