07/05/2025
দুনিয়ার সবচেয়ে স্টুপিড লাভ স্টোরিটার নাম সম্ভবত, রব নে বানা দি জোডি। আর এই সিনেমার গল্প আমার খুব পছন্দ। তানি নামের এক যুবতীর গল্প এটি; যার বিয়ে ঠিক হয়। এবং বিয়ের দিন দুর্ঘটনায় পড়ে হবু স্বামীর মৃত্যু হয়। কন্যার মৃত্যুপথযাত্রী পিতা মৃত্যুর আগে কন্যার হাত মধ্যবয়স্ক ভীষণ সাধারণ এক ভদ্রলোকের হাতে তুলে দেন। ভদ্রলোকের নাম সুরিন্দর। বিয়ের কন্যা সুরিন্দরের বাড়ি আসেন। একই বাড়িতে দুইজন আলাদা থাকেন। তারপর সুরিন্দর সিদ্ধান্ত নেন তিনি বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে বউয়ের সমস্ত দুঃখ দুর করে দেবেন, সব বিষাদ মুছে দেবেন এবং মন জয় করে নেবেন তার। টিপিক্যাল অতি সাধারণ জলসা সিরিয়ালের একটা গল্প মাঝখানে গিয়ে ভয়াবহ এক মোড় নেয়।
একজন মানুষের দু’টো সত্তা আলাদা করে মাঝখানে এক যুবতীর প্রেম ঠেসে গুঁজে দেওয়া এই সিনেমা লিখেছেন আদিত্য চোপড়া। একটা সময় যখন মানসিক পরিপক্বতা আসেনি আমার, আমি দেখতে বসে ভাবছিলাম- সুরিন্দরের সমস্যাটা কোথায়?
তানি তখন স্বামী সুরিন্দরের ভীষণ সাধারণ জীবন যাপন পছন্দ করতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি বিষাদ কাটিয়ে হাসতে শুরু করেছেন কারণ তার একজন চমৎকার বন্ধুও হয়েছে। ওই বন্ধুর নাম রাজ। এখন তানি যদি স্বামীকে বেছে নেয়, তাও ভালো। যদি রাজকে বেছে নেয়, তবেও তো সমস্যা নাই, কারণ সুরিন্দর আর রাজ দুইজন একই ব্যক্তি। দিনশেষে সুরিন্দরই তানিকে পাবেন। তাহলে সুরিন্দরের সমস্যা কোথায়?
পরে আমি বুঝলাম, সুরিন্দরের সমস্যা অন্য কোথাও। প্রশ্নটা তানিকে পাওয়া নয়, প্রশ্নটা নিজেকে পাওয়া। যখনই তানির মন জয় করার জন্য সুরিন্দর নিজের একটা আলাদা পার্সোনালিটি সৃষ্টি করেছেন, তখনই মূলত তারা আলাদা হয়ে গেছেন। সুরিন্দর আর রাজ একই ব্যক্তি নয় তখন আর। তারা দুইজন আলাদা। এবং দুইজনের মধ্যে একটা চুপচাপ প্রতিযোগিতা চলছে। সেটা তানিকে পাওয়ার প্রতিযোগিতাও নয়। একে অন্যকে হারানোর প্রতিযোগিতা। সুরিন্দর অথবা রাজ দুঃখ পাচ্ছেন কারণ তানি যদি রাজকে বেছে নেয়, সারাজীবনের জন্য রাজ হারাবেন সুরিন্দর। তানি যদি সুরিন্দরকে বেছে নেয়, সুরিন্দর বাকি জীবনের জন্য হারাবেন রাজ।
সুরিন্দর একজন অতি সাধারণ মানুষ, চুপচাপ, কাজপাগল, ঝগড়াঝাঁটি থেকে দূরে থাকেন সবসময়, ভালোবাসতে পারেন প্রচণ্ড কিন্তু প্রকাশ করেন কম। অন্যদিকে রাজ অসাধারণ একজন মানুষ, বাচাল, ক্যাঁচাল পাকানোর ওস্তাদ, হাসাতে পারেন, ভালোবাসতে পারেন যেমন, প্রকাশও করতে পারেন তেমন। তানি রাজের প্রেমে পড়েছিল কারণ রাজের ভালোবাসা তার খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টাটুকুনও করতে হয়নি। রাজ নিজেই প্রকাশ করেছেন সব অবলীলায়। তারপরও তানি শেষ পর্যন্ত সুরিন্দরকে বেছে নেয়।
তানি সুরিন্দরকে বেছে নিয়েছিল কারণ সুরিন্দরের ভালোবাসার প্রকাশ ছিল আলাদা, কিন্তু প্রবল। সদ্য বিয়ের লগ্ন ভাঙা এক যু্বতী, সদ্য হারিয়ে ফেলা প্রেমিক, পিতা, চারপাশ- সম্পূর্ণ একলা একজন, যার হাত সুরিন্দর ধরেছিলেন ভালোবেসে। যতটা স্পেস চেয়েছে তানি, দিয়েছেন তার সবটুকুন। অনুমতি ছাড়া একটা স্পর্শও না। আর দশজন পুরুষের মতোন স্ত্রীর নাচানাচির শখ জেনে চোখ কপালে তুলে ফেলেননি। বরং নিজ থেকেই চেয়েছেন, বউ ব্যস্ত থাকুক যেমন ইচ্ছে তার। বউ যাতে ওই শোক কাটিয়ে উঠতে পারে।
সুরিন্দরের সিনেমা পছন্দ নয়। সুরিন্দর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সিনেমা দেখতে যান। কারণ বউয়ের পছন্দ সিনেমা। মেলায় বউকে জাপানি স্টলের সামনেই শুধু আগ্রহ নিয়ে দাঁড়াতে দেখে জাপানি সুমো কুস্তিগিরের সঙ্গে লড়তে উঠে যান। কারণ, ওখানকার প্রথম পুরস্কার জাপান বেড়াতে যাওয়া। জাপান যাওয়া সুরিন্দরের আকাঙ্খিত পুরস্কার নয়, সুরিন্দরের জন্য পুরস্কার হলো- জাপান দেখে মুগ্ধ বউয়ের চোখ।
সুরিন্দরের টিফিনবক্স থেকে শুরু করে গাড়ির রঙ হলুদ, এমনকি কল্পনায় তার পেছনে নাচতে থাকা ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সারদের পরনের জামাটাও হলুদ রঙের। কারণ, প্রথমবার সুরিন্দর তানিকে যে জামা পরে হাসতে দেখেছিলেন, ওই জামার রঙ হলুদ।
সুরিন্দরের ভালোবাসার প্রকাশ ছিল অন্যরকম, অদ্ভুত, কিছুটা উদ্ভটও। ওইসব ভালোবাসা অবলীলায় বলে দেওয়া যায় না। গণনা করা যায় না হাতের আঙুলে। দেখা যায় না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি চট করে খুঁজেও পায় না তা। এইসব ভালোবাসা খুঁজে নিতে হয়।
স্বাভাবিকতই তানির খুঁজে পেতে দেরী হয়েছিল তাই। যখন খুঁজে পেয়েছিল তখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভালোবাসাকে খুব সহজেই বলে দিতে পেরেছে, আমি সুরিন্দরের হাত ছাড়তে পারবো না। আমি উনার মাঝে ঈশ্বর দেখতে পাই। মানুষটাকে আমি ছাড়তে পারবো, ঈশ্বরকে তো না।
আমাদের হুমায়ূন আহমেদ ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম’ উপন্যাসে মানুষের মাঝে ভালোবাসার ঈশ্বর দেখতে পাওয়ার রোমান্টিক একটা সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। ওখানে ঈশ্বরের রুপক হিসেবে ছিল নীলপদ্ম।
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই পাঁচটা নীলপদ্ম নিয়ে জন্মায়। যখন তারা কাউকে প্রচণ্ড ভালোবাসে, তখন তারা নিজের ওই নীলপদ্মগুলো ওই মানুষটিকে দিয়ে দেয়। এই দিয়ে দেওয়ার কাজটা কখনো-সখনো জেনেবুঝে করে মানুষ, কখনো-সখনো নিজের অজান্তে। এমনকি যাকে নীলপদ্ম দিচ্ছে, অনেক সময় তারও অজান্তে। একবার দিয়ে ফেলার পর ওই নীলপদ্ম কখনই ফেরত নেওয়া যায় না। কারোর কাছ থেকে উপহার পাওয়া নীলপদ্ম কখনই অন্য কাউকে দেওয়া যায় না আর। আজীবন একটা মানুষ আরেকজন থেকে উপহার পাওয়া পাঁচটা নীলপদ্ম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, বেঁচে থাকে। তানির নিকট ছিল সুরিন্দরের পাঁচটা নীলপদ্ম। মানুষটাকে তিনি ছাড়তে পারবেন। ওই নীলপদ্মগুলোকে নয়।
তানি যখন সুরিন্দরকে বেছে নেন, স্বাভাবিকতই রাজ হারিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু একলা স্টেজে তানিকে হারতে দেখে সাহায্য করার জন্য যে ব্যক্তি এগিয়ে আসেন- তাকে না সুরিন্দর বলা যায়, না রাজ। আলাদা করা যায় না। আর দুই সত্তার মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বের উপসংহার মিলে যায় তখন।
তানি সুরিন্দরের ভেতর ঈশ্বর দেখতে পায় কারণ, রাজ সুরিন্দরেরই সৃষ্টি। তানির দুঃখ মোছার জন্যই সৃষ্টি করা একটা ফুল। এখানে বৃক্ষ সুরিন্দর স্বয়ং। স্রষ্টা আর সৃষ্টির খেলায় দিনশেষে সবাইকে পৌঁছুতে হয় স্রষ্টার নিকট। স্রষ্টাই শুরু, স্রষ্টাই শেষ।
এমুভির কিছুদৃশ্যপট আমার কাছে অসাধারন লেগেছে
প্রথম দৃশ্য। তানি ও রাজ, দুইজন আলাদা ট্রায়ালরুমে, রাজ জিজ্ঞেস করেন, তানিজি, একটু বলুন তো, নারী আসলে কী চায়? তানি হেসে উত্তর দেয়, একজন নারী কী চায়, সেটা একজন নারীই সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারে, পুরুষ নয়। একজন নারী চায়, কেউ তাকে এত বেশী ভালোবাসুক, যত বেশী ভালো পৃথিবীর আর কেউ কাউকেই বাসেনি। ট্রায়ালরুম থেকে তানি বের হওয়ার পর দেয়ালে মাথা হেলান দিয়ে রাজ বলে, ওইরকম ভালো তো সুরিন্দরও আপনাকে বাসে। আপনিই শুধু দেখতে পাচ্ছেন না।
সাধারণ দৃশ্য, সাধারণ কথোপকথন। কিন্তু সাধারণ হয়ে থাকে নাই। রাজের দেয়ালে হেলান দেওয়া মাথা, হাত রাখা, কাতর দৃষ্টি সঙ্গে ভায়োলিনের সুর- কি তীব্র সুন্দর অসহায়ত্ব আর বিষাদে আচ্ছন্ন করে ফেলে মুহূর্তেই। একটা গল্প বলে ফেলে কয়েক সেকেন্ডেই।
দ্বিতীয় দৃশ্য। একটা উঁচু জায়গার উপর। রাজ তানিকে নিয়ে শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গার কোনো একটা পার্কের কিনারে পৌঁছেছেন। তানি উপর থেকে রাত্তিরের শহর দেখে মুগ্ধ। হঠাৎ শহরের সমস্ত লাইট নিভে যায়। তানি চমকান। পরক্ষণেই শহরের বিভিন্ন জায়গার নির্দিষ্ট কিছু বিল্ডিং-এর লাইট জ্বলতে শুরু করে এক এক করে। সবগুলো জ্বলার পর দেখা যায়, শহরের মাঝখানে আলো দিয়ে লেখা- আমি তোমায় ভালোবাসি।
কত শত সিনেমায়, কত শত প্রপোজ দৃশ্য লেখা হয়েছে, বানানো হয়েছে, নির্মাণ করা হয়েছে। সাধারণ একটা দৃশ্য, কিন্তু সাধারণ থাকে নাই। রাজের কৌতুহলী মুখ, তানির অপ্রত্যাশিত, হতভম্ব, বিস্মিত, মুগ্ধ ও ভয়ংকর সুন্দর একজোড়া চোখ আর ব্যাকগ্রাউন্ডের টানা গলার স্বর- একটা মুহূর্ত তৈরী করে দিয়ে যায়। বিশেষ একটা এক্সপেরিয়েন্স-এর অংশ করে নেয়।
শুধু গোঁফ ফেলে জিন্স-প্যান্ট পরার কারণে তানি নিজের স্বামী সুরিন্দরকে চিনতে পারে নাই- এটা একটা লেইম স্ক্রিপ্ট। এই লেইম স্ক্রিপ্ট কি এটাও ইঙ্গিত দেয় না? যে- তানি আদৌ কখনো সুরিন্দরকে মনোযোগ দিয়ে দেখেইনি। যতদিন রাজের সঙ্গে তার দেখা হয় নাই। যতদিন সে ভেতর থেকে সুখী অনুভব করে নাই। যতদিন দ্বন্দ্ব শুরু হয় নাই। যতদিন চোখে পড়ে নাই, অগোচরে বাড়ির কোথাও ফুটে আছে একটা নয়নতারা ফুল।
ভালোবাসার প্রকাশ জরুরি। সব সুরিন্দর সিনেমার শেষে জিতে যায় না। পৃথিবীর সব তানি খুঁটিয়ে দেখতে যায় না অপ্রকাশিত ভালোবাসা। মানুষ ভালোবাসার কাঙাল হয়। ওরা খুঁজে যায়। মাঝে মাঝে ওরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক উঁচুতে উঠে যায়। ওখান থেকে দেখা যায় আস্ত শহর। ওরা ওদিক তাকিয়ে খুঁজে তুমুল ভালোবাসা। তখন কেউ যদি একটা ফানুস উড়িয়ে দেয় তার নামে, ওখানেই পাঁচটা নীলপদ্ম রেখে আসে ওরা। বাকি জীবন কাউকে দেওয়ার মতো একটা নীলপদ্ম খুঁজে পায় না আর।