29/06/2025
"স্বপ্নের ঠোঙা"
গাজীপুর সাফারি পার্কের গেটের ঠিক বাঁ পাশে এক পুরনো ছাউনি আছে, যেটার নিচে প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকেন এক বাদাম বিক্রেতা। তার বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই কিন্তু তাঁর কণ্ঠে একরাশ দৃঢ়তা আর চোখে স্বপ্নের দীপ্তি।
সকালবেলা গেট খুলবার আগেই তিনি চুলায় আগুন দেন। কাঠকয়লার হালকা ধোঁয়ার সঙ্গে বাদামের ঘ্রাণ মিশে এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়।
এই বাদামই তাঁর জীবন।
এই বাদামেই চলে তাঁর সংসার, এই বাদামের হাঁড়িতেই গলেছে তাঁর আত্মত্যাগ।
তিন ছেলে ছিল হানিফ কাকার, কিন্তু কেউই পাশে থাকেনি। শুধু একমাত্র মেয়ে মরিয়ম—মাটি ছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছে। ছোটবেলা থেকে সে পড়তে ভালোবাসত, স্কুলের পরীক্ষায় সবসময় প্রথম হতো। কিন্তু অভাব ছিল প্রতিটা দিনে, প্রতিটা ভাতে, প্রতিটা রাতে।
হানিফ কাকা প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে চুলায় আগুন ধরাতেন, বাদাম ভাজতেন, আর নিজের খাওয়া ভুলে মরিয়মের খাতা কিনে আনতেন।
যখন বাড়ির চাল ঝরতে শুরু করত, তখনো কাকা বলতেন, “চাল পরে ঠিক করবো, আগে মেয়েটার লেখাপড়া হোক।”
অনেক কষ্টে, অনেক অনাহারে, অনেক অপমানের ভিতর দিয়ে মরিয়ম কলেজে উঠল। লোকজন বলত, "এই বয়সেও হানিফ কাকা বাদাম বিক্রি করেন! মেয়েকে কাজ শেখান, লেখাপড়া দিয়ে কী হবে?"
কিন্তু কাকা কোনোদিন কথায় পাত্তা দেননি।
তিনি শুধু মেয়েকে বলতেন,
“তুই একদিন এমন জায়গায় দাঁড়াবি, যেখান থেকে আমাকে আর কেউ 'বাদামওয়ালা' বলে হেয় করতে পারবে না।”
সেই স্বপ্নের কথা মনে রেখেই মরিয়ম পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। তার চোখে ছিল বাবার কুয়াশাঘেরা সকাল, কাঠকয়লার আগুন, আর গরম বাদামের ঠোঙার ঘ্রাণ।
বছর ঘুরে গেল।
একদিন সাফারি পার্কের গেটের সামনে একটি বড় গাড়ি থামে। হানিফ কাকা তখনও বাদাম ভাজছেন।
গাড়ি থেকে নামে এক স্মার্ট তরুণী, পরনে সরকারি কর্মকর্তার পোশাক, পাশে প্রটোকলের লোকজন।
লোকেরা বলে, ঐ যে দেখেন- আমাদের হানিফ কাকার মেয়ে—ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে!
মরিয়ম বাবার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল-
“আব্বা, এই আমি তোমার সেই স্বপ্নের ঠোঙা। তুমি গরম বাদাম বিক্রি করো বলেই আমি গরম আসনে বসতে পেরেছি।
সেদিন সাফারি পার্কের বাতাসে গরম বাদামের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল গর্ব, ভালোবাসা আর এক স্বপ্নপূরণের গন্ধ।