
22/06/2025
– শুনছো? বাবুটা খুব কাঁদছে।
– ঠিক করে খাওয়াও, ঘুমিয়ে পড়বে।
– আমি সারাদিন একটু বিশ্রাম পাই না আর রাতে এভাবে কাঁদে।
তুমি তো একটু…
– তোমার কী মনে হয়? আমি অফিসে সারাদিন বিশ্রাম করি? তুমি জানোনা কতটা খাটতে হয় আমাকে সারাদিন! তবুও এসে যতটুকু পারি করি, কিন্তু রাতে আমার একটু ঘুম দরকার। তুমি যদি ওকে ঘুম পাড়াতে পারো তো ভালো, না হলে ওকে নিয়ে বাইরে যাও।
– তোমার ছেলে, আর সব দায়িত্ব আমার?
– টাকাপয়সার দিক দিয়ে তো কিছুই ভাবতে দিই না, বাকি দিকগুলো না হয় একটু বেশি ভাবো। লাইট'টা অফ করে দিও।
আর কোনো কথা বলল না ঐশী। সেই ঘুরেফিরে বিষয়টা টাকায় এসেই ঠেকল, আর বরাবরের মতো ওকেই চুপ করে যেতে হলো। যাবে নাই বা কেন? এ যুগে দাঁড়িয়ে সংসারে একটা পয়সাও দিতে না পারাটা কি কোনো অপরাধের চেয়ে কম? ঋকের সংসার সামলানোর জন্যই ও চাকরি ছেড়েছিল আর আজ ওর সেই ত্যাগের কোনো দাম নেই ঋকের কাছেই।
– বউমা… এত রাতে বারান্দায়?
– মা… আসলে…
– একি! দাদুভাই এখনও ঘুমায়নি?
– না মানে… জানেনই তো রাতে ঘুমাতে চায় না, আপনার ছেলের ঘুমে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই আরকি...
– ঘুমে ব্যাঘাত? বাবা হিসেবে নিজের কর্তব্য পালন করতে গেলে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে?
– ……
– বুঝলাম, ও এখনো পুরোপুরি বাবা হয়ে উঠতে পারেনি। বউমা, তুমি সকাল হলে দাদুভাইকে রেখে তোমার বাপের বাড়ি চলে যেও তারপর আমি দেখছি।
– কী!! মা,এতটুকু বাচ্চাকে রেখে…
– ভরসা রাখো আমার উপর।
পরেরদিনের সকালটা আর রোজকার মতো সহজ হলনা ঋকের কাছে..
– ঐশীইই… এই ঐশী… আজ আমায় ডাকোনি কেন? কত দেরি হয়ে গেল উঠতে!
- ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন সকাল সকাল?
- মা..তোমার বউমা কোথায়? আজকে ডাকল না আমায় সকালে!
– কেন? দুধের শিশু তুই যে ডেকে তুলতে হবে?
– না মানে, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
– বউমার বাপের বাড়িতে জরুরি কিছু কাজ ছিল, সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে। তোর আজ অফিসে যাওয়া হবে না, ও দাদুভাইকে রেখে গেছে আর আমার যা হাঁটু-ব্যথা, সব কিছু একা সামলাতে পারব না।
– ও এতটুকু বাচ্চাকে একা রেখে চলে গেল? কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন!
– একা কোথায় রেখে গেছে? ওর বাবার ভরসায় রেখে গেছে। ব্রাশ কর আর কাজে লেগে পড়।
⸻
– চুপ কর না রে.. আর কত আদর করবো তোকে!!
– ও কি আদর খেতে চায় বলে কাঁদছে?
– বলতে তো পারে না কিছু, কী করে বুঝব কেন কাঁদছে?
– খিদে পেয়েছে, যা দুধ গরম করে নিয়ে আয়।
– আমি?
- তো কে আমি?
- যাচ্ছি যাচ্ছি।
– উফ! দুধটা কোথায় গেল!! কোথায় যে কী রাখে ঐশী… এটা বোধহয়… এই তো।
– এই নাও মা, নিয়ে এসেছি, খাইয়ে দাও।
– আমি? ও আমার কাছে খায়না। তোর ছেলে, তুই খাওয়া।
– মা, আমি এসব কোনোদিন করিনি।
– বউমাও করেনি, তাও শিখে গেছে। তুই কোথাকার কোন হরিদাস পাল?
– ………..
⸻
– এই বাবু..রান্না বসা, বেলা হচ্ছে তো।
– যাচ্ছি যাচ্ছি… তোমার নাতি চুপ'ই করছে না।
– তাই বলে রান্না করবিনা? দুপুরে খাবো কী?
- কিন্তু ওকে ফেলে...
- ফেলে কেন? কোলে নিয়ে রান্না কর।
– কী!! কোলে নিয়ে?
– হ্যাঁ, বউমা তো রোজ তাই-ই করে।
– মা, আমার সাথে তোমার বউমার তুলনা করোনা।
– কেন? ওর দুটো বাড়তি হাত আছে না পা আছে?
– না আসলে...যাচ্ছি।
⸻
– চুপ কর না রে… এত ছিঁচকাঁদুনে হয়েছিস কেন? তোর মা কী করে যে সামলায় তোকে!.. এত খাটাখাটনির পর এখন আবার তোকে ঘুম পাড়াতে হচ্ছে… ঘুমিয়ে পড় না বাবা।
– ওই ভাবে বললে ঘুমাবে? বাচ্চারা এত কথা বোঝে? দোল দে।
– সেটা কীভাবে দেয়?
– হায় ভগবান!! এক কাজ কর, এঁটো বাসন পরে আছে, মেজে দে গিয়ে। আমি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
– আবার বাসন!!
⸻
– উফ! Finally রাজ্যের কাজ শেষ হলো, একদিনেই এই অবস্থা!! আমার অফিসের কাজ এর চেয়ে অনেক শান্তির। না না, আর একটা দিনও এত দায়িত্ব সামলানো যাবে না। ঐশীকে কালই গিয়ে নিয়ে আসব।
– বাবু রে… দেখলি সব কাজ কী সুন্দর করে ফেললি? কী বা এমন কাজ!! বউমা এমন একটা ভাব দেখায় যেন ও ছাড়া কেউ পারবে না এসব করতে… কিন্তু ও তো জানেনা আমার ছেলে কী!! যে বাইরের জগৎ সামলাচ্ছে ঘরের এই কটা মাত্র কাজ তার কাছে জলভাত। ও তো তাও পারেনা ঠিক মতো।
– না মা, ঐশীকে এভাবে বলো না। আমি যা করেছি অন্যায় করেছি। একদিনেই আমার এই হাল..আর ও তো রোজ করে। যেই কাজের কোনো ছুটি নেই, আয় নেই, এমনকি কদরও নেই সেই কাজ ও করে কোনো অভিযোগ না করেই আর আমি এতদিন তার কোনো মূল্যই দিইনি।
– ওর কাজ মূল্য পাওয়ার দাবি রাখে বলছিস?
- আলবৎ রাখে।
- বেশ। ওই দেখ, তোর ছেলে আবার কাঁদছে...
– আবার উঠে পড়েছে? ছোট বাচ্চাদের চোখে ভগবান কি ঘুম দেন না?
⸻
– উঠে পড়েছিস বাবু… ঐশী তুমি…
– বাচ্চাকে কোনায় বালিশ না দিয়ে কেউ একা রেখে যায়? এক্ষুনি পড়ে যেত...
– সরি, এত সব মাথায় রাখতে পারিনি।
– স্বাভাবিক। আহা রে! আমার বরটার কী হাল হয়েছে!! খুব ক্লান্ত হয়ে গেছো বলো?
– সে আর বলতে! আর একটা দিনও যদি এসব একা হাতে করতে হতো, আমি তো শেষ।
– হাহা!! আমি তা হতে দিতাম? নাও নাও এবার এসে শুয়ে পড়ো, আমি দুটো ছেলেকে একসাথে ঘুম পাড়িয়ে দিই।
– ঐশী, কাল থেকে ওকে সামলানোর দায়িত্বটা আমরা ভাগ করে নেবো। ভোর অবধি আমি দেখব, তারপর তো তুমি উঠেই পড়ো।
– পাগল নাকি? সারাদিন খেটে…
– তোমার তুলনায় আমি কিছুই খাটিনা। এইটুকু যদি করতে পারি তাও বুঝব কিছু করেছি অন্তত।
– বাব্বাহ! একদিনেই আমার বরটা কী ভীষণ কর্তব্যপরায়ণ হয়ে গেছে!
– এবার একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও, আর তোমার ছেলেকে বলো একটু ঘুমানো প্র্যাকটিস করতে… বাবা কিন্তু অত আদর করে সারারাত দোল দিতে পারবে না।
– না পারলে মা তো আছেই। এটুকুই তো চেয়েছিলাম আমি তোমার কাছ থেকে। ভাগ্যিস মা…
– মা! মা কী করলেন আবার?
– ইয়ে মানে… ভাগ্যিস মা ছিলেন, সবটা সামলাতে তোমায় একটু সাহায্য করলেন।
– তাই বলো।
দরজার আড়াল থেকে চুপ করিয়ে দিলেন ঐশীর শাশুড়িমা তাকে। শাশুড়ি–বউমার এসব ব্যক্তিগত আলোচনার কথা কি আর সবাইকে বলা যায়? একটা প্রাইভেসি আছে না!
-মৌজানি
ছবি সংগৃহিত