
05/07/2025
📌সেদিন বিকেলে আমি ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিলাম আমাদের বাড়ির সামনের বাগানে। হঠাৎ আমার বাবা আমার পাশে এসে বসল। গাছপালাগুলো আগের মতো নেই, কিছু শুকিয়ে গেছে, কিছু এখনো বেঁচে আছে — ঠিক বাবার মতোই। তার বয়স এখন আশির কোঠায়। চোখে কম দেখেন, কথাও একটু ধীরে বলেন।
হঠাৎ একটা কাক উড়ে এসে বসল সামনের ঘাসে। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওটা কি?” আমি উত্তর দিলাম, “ওটা কাক, বাবা।”
একটু পর তিনি আবার বললেন, “ওটা কি?”
আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, “বাবা, ওটা তো কাক। আপনি দেখেন না?”
এর কিছুক্ষণ পর আবারও একই প্রশ্ন, “ওটা কি?”
এইবার আমি রাগ ধরে রাখতে পারলাম না। কণ্ঠস্বর চড়ে গেল, “আরে বাবা! আপনি কেন বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করছেন? ওটা কাক! আমি তো বারবার বলছি! আপনি বুঝতে পারছেন না?”
বাবা চুপ করে গেলেন। কোনও কথা বললেন না। চেয়ার ছেড়ে উঠে আস্তে আস্তে ঘরের ভেতর চলে গেলেন। আমি একরকম স্বস্তি পেলাম, মনে হচ্ছিল — উনার বয়সটা হয়তো এখন বোঝা হয়ে উঠছে।
মিনিট দশেক পর বাবা আবার এলেন — হাতে একটা পুরনো খাতা, অনেকটা ডায়েরির মতো। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এটা দেখবি? একবার মন দিয়ে পড়।”
আমি খাতাটা খুললাম। পাতাগুলো পুরনো, মলিন, কাগজে সময়ের দাগ। একটা পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা:
“আজ আমার তিন বছরের ছেলে আমায় একই প্রশ্ন করেছে ২৩ বার — "বাবা, ওটা কি?"
আমি ২৩ বারই উত্তর দিয়েছি, "ওটা কাক।"
প্রতিবার তাকে বুকে টেনে নিয়েছি, মাথায় হাত বুলিয়েছি, একটুও বিরক্ত হইনি। বরং তার মুখে বিস্ময়ের হাসি দেখে হৃদয় আনন্দে ভরে উঠেছে।”
আমি থমকে গেলাম। খাতার পাতাটা ঝাপসা হয়ে উঠল — আমার চোখের কোণে অশ্রু জমে আসছিল। আমার মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় বাবার কাঁধে চড়ে কাক, গাছ, আকাশ এসব চিনেছিলাম। অথচ আজ, বারবার একই প্রশ্নে আমি তাকে ধমক দিলাম!
আমি খাতা বন্ধ করলাম। মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ালাম। বাবার সামনে গিয়ে ধরা গলায় বললাম, “বাবা, আমি ভুল করেছি। সত্যি, খুব খারাপ ব্যবহার করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন।”
বাবা কিছু বললেন না। শুধু মাথায় হাত রাখলেন, যেমন ছোটবেলায় রাখতেন — সেই একই মমতায়, সেই একই নীরব ভালোবাসায়।
আজ বুঝি, আমাদের বাবা-মায়েরা বৃদ্ধ হলে শিশুর মতোই হয়ে যান। তাদের একঘেয়েমি প্রশ্নগুলো আমাদের জন্য ভালোবাসার নিঃশব্দ আহ্বান। অনেক সময়ই আমরা আমাদের বাবা-মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করি, উঁচু গলায় কথা বলি। কখনো কি ভেবে দেখি কি পরিমাণ ভালোবাসা আর কষ্ট তারা করেছেন আমাদের বড় করার জন্য? পৃথিবীর কোনকিছু দিয়ে কি তাদের এই ঋণ শোধ করা সম্ভব? এক সময় যারা আমাদের মুখে শব্দ ফুটিয়েছিলেন, হাঁটতে শিখিয়েছিলেন, হাত ধরে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন — তাদের কিছু কিছু ভুলে যাওয়া, বারবার একই প্রশ্ন করা, ধীরে ধীরে চলা এসব কি খুব বড় অপরাধ?
আজ যদি মা-বাবা জীবিত থাকেন, একটু সময় দিন তাদের। আর যদি না থাকেন, তাদের স্মৃতিকে সম্মান দিন। কারণ তারা ছিলেন বলেই আপনি আছেন। একবার ভাবুন — আপনার বাবা-মাকে শেষ কবে জড়িয়ে ধরেছিলেন? আজই না হয় হোক সেই দিনটা, একটা নতুন শুরু!
#শ্রদ্ধা
#সম্মান
#দায়িত্ববোধ
#কর্তব্য
#মাবাবাভালোবাসা