23/06/2025
হামিদা(১০)
লেখনীতে: সোতস্বিনী
সুরাইয়া মৌলি নিস্তেজ শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। শেষবার তাকে যখন হামিদা দেখেছিল সে ছিল লাবণ্যময়ী, সুহাসিনী এক সুস্থ সবল নারী। মমতাময়ী মা, যত্নবান ও দায়িত্ববান স্ত্রী। যে ষোলো আনা ভালোবাসতে জানে, কিন্তু আদায় করে নিতে চায় না। ভাবে যা ভাগ্যে আছে তা আপনিই আসবে। জোর করে ভালোবাসা আদায় সে বড়ো ছোট কাজ। সুরাইয়া মৌলির মন অত ছোট নয়। তাই তো সৎ মেয়ে জেনেও হামিদাকে সন্তানের মতো ভালোবেসেছে। বিয়ের পরপরই হামিদাকে সঙ্গে করে ঢাকা নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সে কথা জেনে কতই না খুশি হয়েছিল হামিদা। নিজের পিতা, সুরাইয়া মৌলির মতো মা, সর্বপরি নিজের একটা পূর্ণ পরিবার! ইশ! কত সুখের শব্দগুলো! কিন্তু হামিদার কপালে সুখ কবেই বা সয়েছিল? নিজের বলতে ওর নিজ ছাড়া আর কিই-বা ছিল!
মেয়েদের প্রথম ভালোবাসা হয় আপন পিতা। হামিদার হৃদয় সেই পিতাই প্রথমবার ভেঙেছিল নিদারুণভাবে। যখন নিজের সবকিছু হবে বলে স্বপ্ন দেখছিল, তখনই ওর পিতা নিরালায় ডেকে নিয়ে যায়। হামিদার বালিকা মন তা থৈ থৈ করে নেচে ওঠে। ভাবে, আজ বুঝি বাবার আদর পাবে, স্নেহ মাখবে। কিন্তু হায়! মতুর্জা কবির পাষাণ, নির্মম গলায় বলল,
"আমি চাই না তুমি ঢাকা এসো। মৌলিকে সরাসরি না করে দেবে। যদি কারণ জিজ্ঞেস করে বলবে, এখানেই ভালো আছো তুমি। তাছাড়া কথাটা তো সঠিক। বড় ভাইয়ের মেয়ে নেই। তোমাকে এতদিন মেয়ে মনে করে লালন-পালন করেছেন। আজ হঠাৎ তার কাছ থেকে তোমাকে আমি নিয়ে যেতে পারি না। তুমি এখানেই ভালো থাকবে। যা খরচ লাগে আমি পাঠিয়ে দেবো।"
ওই প্রথম হামিদা বুঝেছিল মানুষ কথা দিয়ে সবচেয়ে বেশি আঘাত করতে পারে। কী ভীষণ তার যন্ত্রণা। ভাঙা মনটা দু হাতে চেপে ধরে মাথা হেঁট করে কাছারি ঘরের নির্জন পেছন দিকে বসে হু হু করে কেঁদেছিল। ওইটুকু বয়স! নিজেকে যে কী করে সামলেছিল জানে না। ওর পিতা ওকে মিথ্যাবাদী হতে বাধ্য করেছিল। তাই তো মিথ্যা বলেছিল সুরাইয়া মৌলিকে,
"দাদিজানকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। ঢাকা যাব না আমি, সোনা মা। কোনোদিন যাব না।"
তারপর দৌড়ে মোহনাদের বাড়িতে গিয়ে লুকিয়েছিল। সুরাইয়া মৌলি ও মর্তুজা ওইদিনই ঢাকা ফিরে গেল। হামিদা গাছের আড়াল থেকে ওদের চলে যাওয়া দেখেছে। সুরাইয়া মৌলির মুখখানা বিষণ্ণ ছিল। এদিক-ওদিক হামিদাকে একটিবার দেখার জন্য খুঁজছিল। হামিদা নজরে পড়েনি। সেদিন সারাদিন মোহনাদের বাড়িতে মন খারাপ করে বসে রইল। ভেবেছিল আর ও বাড়ি ফিরবে না। দু চোখ যেদিকে যায় চলে যাবে। কিন্তু রবিন ওর ঘাড় ধরে বাড়িতে নিয়ে এলো। সারা গায়ে ছিল ধুলো-ময়লা। মুখ শুকনো। রবিন নাক-মুখ কুঁচকে দাদিজানকে বলল,
"এরপর বাড়ি না ফিরলে খবরদার খুঁজে আনতে বলো না, দাদি। ওর কি চাকর আমি? দেখো কী হাল করেছে নিজের। কেউ দেখলে ভাববে কোথাকার কোন ফকিন্নির বাচ্চা!"
হামিদা রবিনের বকা-ঝকায় কষ্ট পেত, ভয় পেত আবার ওর চোখ টলমল করত। কিন্তু কেঁদে ভাসাত না। সেদিন সকল দুঃখের কান্না রবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদল। দাদিজান বুঝলেন আড়ালের ব্যাপার। জড়িয়ে ধরলেন নাতনিকে। রবিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। হামিদার এই অকারণ কান্না ওকে যারপরনাই বিরক্ত ও তিক্ত করল। খানিক কি অস্বস্তিও দিলো? কে জানে! ওর চোখে হামিদা যেন বিরক্তিরই নামান্তর ছিল!
"হামিদা!" সুরাইয়া মৌলির কোমল গলার হামিদা ডাক শুনে হামিদার অতীত ভাবনার সুতো ছিঁড়ল।
"সোনা মা!" হামিদার কান্না পেল। মৌলি ওকে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকতে হামিদা বেডের পাশে গিয়ে বসল। মৌলি উঠে বসতে গেলে বাধা দিলো,
"উঠো না। কী লাগবে বলো এনে দিই!"
"সারাদিন শুয়ে শুয়ে বিরক্ত হয়ে গেছি। ধর, একটু বসি।"
হামিদা তাকে বসতে সাহায্য করল। পিঠের কাছে বালিশ দিলো। মৌলি ওর হাতটা ধরে সামনে বসায়,
"কেমন আছিস? ইশ! মুখটা ওমন শুকিয়ে গেছে কেন? দুপুরে খেয়েছিলি কিছু? রবিন, আব্বাজান!"
"সোনা মা, ওকে কেন ডাকছ! খেয়েছি আমি। ওকে ডেকো না, দোহাই তোমার!"
মৌলি ওর মলিন মুখ দেখল।
"হ্যাঁ রে, ও কি এখনও তোকে বড্ড জ্বালাতন করে? করলে ওর রক্ষা নেই আজ!"
"না, না, রবিন ভাই কিছু করে না। তুমি ওসব ছাড়ো। কেমন আছো বলো? অনেক ব্যথা পেয়েছ, না? হিমু-মুমু ঘুমিয়ে আছে। ওদের হাতে-পায়েও ব্যন্ডেজ দেখলাম। আমার তো দেখেই কী যে কান্না পেল!"
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে হামিদা। মৌলি ওর মুখ আঁজলা ভরে তোলে,
"আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা ঠিক আছি হামিদা। চিন্তা করিস না। কাঁদিস না সোনা!"
মৌলি ম্লান হাসল। মুখটা শুকিয়ে গেছে। কপালের পাশে ব্যান্ডেজ। পরনে মেক্সি। বুকে ওড়না। এই পোশাকে হামিদা তাকে এই প্রথমবার দেখছে। মৌলি সবসময়ই শাড়ি পরে। তবে ঘরে মাঝে মাঝে সুতি থ্রী পিস পরতে দেখেছে। চোখে টানা কাজল পরতে ভালোবাসত। আজ সেই চোখে নির্ঘুম রাতের কালি পরেছে।
হামিদার চোখ মুছে বলে,
"হিমু-মুমু সকালেও আমাকে তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। তারপর রবিনকে খুব করে ধরল," হামিপুকে নিয়ে এসো না, রবি ভাইয়া! যদি না আনো তবে কিন্তু তোমায় ম্যাগপাই রবিন ভাই বলে ডাকব।" তারপর রবিনকে এমনভাবে জ্বালাতন করল, বেচারা রাজি না হয়ে আর কই যায়। হ্যাঁ রে, রবিন নিয়ে এলো তোকে?"
হামিদা মনে মনে শ্লেষ হাসল। তারপর বলল,
"না, বড়দাদা ভাই নিয়ে এসেছে।"
"জুবিন! কী বলিস রে! কোথায় ও?"
"বাইরে, রবিন ভাই আর চাচাজানের সঙ্গে কথা বলছে। ডাকব?"
"থাক, পরে কথা বলব ওর সঙ্গে। এখন কেবল তুই পাশে থাক, কথা বল! কতদিন তোর কথা শুনি না।"
সোনা মায়ের সঙ্গে কত কথা বলার ছিল। কিন্তু তার রোগা, আহত মুখ দেখে হামিদা কিছু বলতে পারল না। শুধু মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল,
"হে আল্লাহ, সোনা মা, হিমু মুমু আর বাবাকে ভালো করে দাও।"
মৌলি হামিদার খোঁজ খবর নিলো, তারপর বাড়ির সকলের। দাদিজানের কথা শুনে মন খারাপ করে। বেডের পাশে কিছু ফল ছিল। গতকাল রাতে রবিন কিনে এনেছে। মৌলি ওগুলো কাটতে বলল হামিদাকে। হামিদা খাবে না। তবুও জোর করল,
"মায়ের আদেশ মানবি না?"
হামিদা এক টুকরো মুখে দিলো। তারপর আরো কয়েক টুকরো হাতে ধরিয়ে দেয় মৌলি। নিজেও কোনো রকমে খেল। হঠাৎ বলল,
"বাবাকে দেখেছিস?"
"হুম!" হামিদা মুখ আনত করল।
"চিন্তা করিস না। তোর বাবা সুস্থ হয়ে যাবে। ডাক্তার বলেছেন আমাকে।"
বলতে বলতে তার গলা ধরে এলো। সুরাইয়া মৌলি বড়ো শক্ত মনের নারী। কিন্তু আজ হামিদা তার হাতটা ধরতে ডুকরে কেঁদে উঠলেন,
"হামিদা, আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। ওই মানুষটা ছাড়া আমি যে বাঁচতে ভুলে গেছি। তার কিছু হলে কী হবে আমার, হিমু-মুমুর?"
হামিদার গলায় শক্ত কিছু যেন আঁটকে গেল। ঢোক গিলতে কষ্ট হলো। সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে দিশেহারা। তবুও তো কিছু বলতে হবে।
"কিছু হবে না বাবার। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো সোনা মা।"
"তাই যেন হয় হামিদা! তাই যেন হয়! জানিস ওর শেষ কথা কী ছিল? মৌলি, হামিদাকে দেখো! একটা মানুষ শেষ সময়ে কাকে মনে করে জানিস হামিদা? যাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে!"
হামিদার চোখে পানি এলো। বাবা ওকে কোনোদিন মনে করতে পারে এ যে ও ভাবতেও পারেনি। যাকে সে কোনোদিন কাছে টানেনি, দায়িত্ব নেয়নি তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে! হামিদার ভাঙা হৃদয়ে সূক্ষ্ম ব্যথা জাগে। সোনা মা ওকে কত কী বলে 'বাবা ভালোবাসে' কথাটা বিশ্বাস করাতে চায়। হামিদার ভাঙা হৃদয়ে সে বিশ্বাস পোক্ত হয় না।
কিছুক্ষণ সোনা মায়ের সঙ্গে হামিদা সময় কাটায়। তারপর ওকে বিদায় নিতে হয়। হিমু-মুমু তখনও ঘুমিয়ে। ডাক্তার ওদের জাগাতে নিষেধ করে বলে দেখা করে যেতে পারল না হামিদা। মৌলি সান্ত্বনা দিলো,
"আবার আসবি তো। মন খারাপ করিস না। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করিস। সাবধানে যাস। ও শোন, কিছু লাগবে তোর?"
হামিদা এখন কেবল এই মানুষগুলোর সুস্থতা চায়। তবুও সুরাইয়া মৌলি জোর করে ওর হাতে পাঁচশ টাকা গুঁজে দিলো,
"মা কিছু দিলে ফেরত দিতে নেই, বলেছি না? রেখে দে, সোনা!"
প্রিয় মানুষগুলোকে রেখে চলে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল হামিদার। কিন্তু উপায় কি আর। চাচাজান ওকে এখানে দেখে রুষ্ট হয়েছেন। ভয় পেয়েছিল হামিদা। কিন্তু চাচাজান কিছু বলেননি। শুধু রবিনকে গম্ভীর মুখে আদেশ করলেন,
"যা, ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়!"
রবিন যে এই আদেশ শুনে খুশি হয়নি তা ওর মুখ দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে। জুবিনের মুখখানা কিন্তু প্রসন্ন। সুরাইয়া মৌলি ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেখে খুব খুশি হলেন। ওর মনোবল বাড়ালেন কত কী বলে! জুবিন বোধহয় তাতেই আরও খুশি হয়েছে।
ওরা হাসপাতালের বাইরে আসতে জুবিন বলল,
"তোকে সঙ্গে যেতে হবে না রবিন। তুই বরং একটা ভ্যান বা ট্যাক্সি ঠিক করে দে। আমি আর হামিদা বাড়ি ফিরতে পারব। কী রে হামিদা পারব না?"
রবিনের বুনো দৃষ্টি পড়ে হামিদার ওপর। ওই চোখে চোখ রাখে না হামিদা। ওর বুক কাঁপে। ওতে যেন অশুভ ছায়া বিরাজ করে। জুবিনের কথায় কেবল মাথা দুলালো। যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। জুবিনের সঙ্গে একলা যাওয়া ঝুঁকির। তবুও রবিনের সঙ্গে যাওয়া থেকে তো শ্রেয়। ধরেই নিয়েছিল জুবিনের কথার প্রতিবাদ করবে রবিন। কিন্তু অবাক হয়, সাথে স্বস্তিও পেল যখন রবিনকে বলতে শুনলো,
"ঠিক আছে। এতই যখন হেডাম তোদের, যা!"
একটা ট্যাক্সি ডেকে এনে ভাইকে তুলে দিলো রবিন। হামিদা ওপাশে দ্রুত গিয়ে বসল। রবিনের কাছ থেকে যত দ্রুত সরে পড়া যায় ততই মঙ্গল।
"আরাম করে বস, হামিদা!" জুবিনের গলায় ভীষণ আমোদ। কেন? এতদিন বাদে বাইরে এলো বলে?
"ভয় পাস না। আমি আছি তো!" সরে এসে ফিসফিস করে বলল জুবিন। হামিদার শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। ও জড়সড় হয়ে সরে বসে। জুবিন খেয়াল করেও যেন করে না। বাইরে তাকায়। গুনগুন করে। রবিন চালককে কিছু বলছে। কিন্তু ওর শ্যেন দৃষ্টি স্থির ভেতরে বসা দুজন মানব-মানবীর দিকে। কপালে ভাঁজ, ভুরু কুঞ্চিত। চোয়াল তীক্ষ্ণ।
"সাবধানে যাস!" শান্ত রবিনের গলার স্বর। রবিন হামিদাকে উৎপীড়ন না করে একদিন শান্ত থাকে না। অথচ, আজ কিছুই বলছে না। নীরবে কেবল দেখছে। এত ভালো হয়ে গেল হঠাৎ! হামিদার কোথাও গন্ডগোল মনে হয়। হয়ত হামিদারই মনের ভুল। জুবিনের কাছে তো সব স্বাভাবিক ঠেকছে। কই সে তো কোনো চিন্তা করছে না। হামিদাও অকারণে চিন্তা করবে না। জুবিন তো বলেছে, ঢাল হবে ওর। রবিন ও রবিনের এই পরিবর্তিত রূপ গোল্লায় যাক!
ট্যাক্সি দ্রুত ছুটছে। জনবহুল সেই হাসপাতাল ছেড়ে শহরের মাঝ দিয়ে এগোতে লাগল। এদিকে হামিদা আগে আসেনি। এদিকটাতে শহুরে ছোঁয়া। বিদ্যুতের আলোয় চারপাশ দিনের মতো আলোকিত। কত মানুষ! কত গাড়ির হর্ণ! কানে তালা লেগে যায়। কিছুদূর গিয়ে জুবিন ট্যাক্সি থামালো। হামিদা সপ্রশ্নে তাকায় দেখে বলে,
"আমার খুব খারাপ লাগছে হঠাৎ। একটু জিরিয়ে নেবো, পানি খাব। চল ওখানে বসি।"
ট্যাক্সি চালককে বলল,
"আপনি আমাকে ধরে হুইলচেয়ারে বসিয়ে ওই ঘরে দিয়ে আসতে পারবেন? আমার ভাই যা দিয়েছে রেখে দিন। আরও কিছু টাকা দেবো! পারবেন?"
ট্যাক্সি চালক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সজোরে মাথা নাড়ায়,
"খুব পারব!"
"হামিদা, ব্যাগটা নিয়ে আয় তো!"
হামিদার মন কেমন করে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে আবার ভাবল,
"এতে কী আছে? কেন দাদাভাই এত যত্ন করে আগলে রেখেছিল এত পথ?"
রাতের অন্ধকার তখন জমাট বাঁধছে। চারপাশে ঝিঁঝির ডাক। হামিদা ব্যাগ হাতে পিছু পিছু গেল। এদিকে হাতে গোনা কিছু দোকান-পাট। কয়েক ঘর বসত-ভিটা আছে সামান্য দূরে। জুবিনকে নিয়ে ট্যাক্সিচালক যে ঘরে প্রবেশ করেছে, সে ঘরের ওপরে একটা সাইনবোর্ড। তাতে লেখা 'কাজী অফিস'
হামিদার কলিজার পানি শুকিয়ে যায়। জমে গেল পা। হাতের ব্যাগটা কী যে ভারি লাগল। ব্যাগটা ফেলে হামিদা পালাবে এখন। পথ চেনে না তাই কি! জুবিন যেন টের পেয়েছে। ওকে ডাকছে। কী আকুতি ওই গলায়। যেন হামিদা ওর সর্বস্ব লুণ্ঠন করে পালাতে চাইছে। ট্যাক্সিচালক টাকা গুনতে গুনতে বেরিয়ে এলো। তার মুখ উজ্জ্বল। হামিদার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন করে তাকালো। তারপর যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকেই ফিরে গেল ট্যাক্সি চালিয়ে।
"হামিদা, হামিদা, দোহাই তোর হামিদা, সামনে আয়। একবার আয়।"
হামিদা পালিয়ে যেতে পারে না। সেই অসহায়ত্বে, সেই কারণে নিজেকে ধিক্কার দেয়। জুবিন চেয়ারে বসে আছে। সামনে কাজী সাহেব। জুবিন তাকে ইশারা করতে উঠে বাইরে গেল। বাইরে থেকে দরজা শব্দ করে রুদ্ধ হলো। শিউরে উঠল হামিদা।
"কাছে এসে বস, হামিদা! বিশ্বাস কর আমাকে!"
"বিশ্বাস! এই মুহূর্তে ওই শব্দ কৌতুক মনে হচ্ছে আমার কাছে। আপনি যদি ভেবে থাকেন চুপচাপ সব মেনে নেবো, তবে ভুল ভেবেছেন আপনি। আপনাকে আমি দাদাভাই ভিন্ন কোনোদিন কিছু মনে করিনি। আর না পারব! দোহাই এই পাগলামি বন্ধ করুন। আমি নতুন করে একটা ভ্যান ডাকছি। চলুন বাড়ি ফিরে যাই।"
হামিদা দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ব্যাগটা সেখানে রাখল। এক পা এগোতে জুবিন দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
"আজ আমি বাড়ি ফিরব না হামিদা। নিজের সঙ্গে একচোট লড়েছি আমি। একবার ভেবেছিলাম তোকে জোর করব না। কিন্তু পরে বুঝলাম ও ছাড়া তোকে পাবার পথও নেই। আজ এইখানে তুই আমার হবি। শুধু তো তিনটা শব্দ, হামিদা। বল না! বিশ্বাস কর ওই তিনটে শব্দ তোর পুরো ভবিষ্যৎ বদলে দেবে। তুই আমার বউ হবি। এই জুবিনের। কেউ তোকে অনাদর, অসম্মান করার সাহস করবে না। আমি তোকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করব হামিদা। আমার হয়ে যা, হামিদা!"
হামিদার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ও ফের পা বাড়ায়। জুবিন এবার আতঙ্কিত গলায় বলে,
"যাবি? যা তবে। আর এক পা এগিয়ে গিয়ে দেখা হামিদা। এই দ্যাখ, আমার হাতে বিষের বোতল। আজ হয় তুই আমার হবি নয়ত মৃত্যু!"
হামিদা একচুল এগিয়ে গেল না। ওর শরীর কাঁপছে। রুদ্ধ দরজা যেন বহু ক্রোশ দূরে। জুবিনের হাতে সত্যি বিষের বোতল। রাগে, ক্ষোভে সামনের ব্যাগটা ছুঁড়ে দিলো জুবিনের পায়ের কাছে হামিদা। অসহায়ত্বে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে,
"কেন ধোঁকা দিলেন, কেন?"
চলবে....