সোতস্বিনী -Srotosini

সোতস্বিনী -Srotosini Contact information, map and directions, contact form, opening hours, services, ratings, photos, videos and announcements from সোতস্বিনী -Srotosini, Digital creator, Sirajganj.
(1)

23/06/2025

হামিদা(১০)
লেখনীতে: সোতস্বিনী

সুরাইয়া মৌলি নিস্তেজ শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। শেষবার তাকে যখন হামিদা দেখেছিল সে ছিল লাবণ্যময়ী, সুহাসিনী এক সুস্থ সবল নারী। মমতাময়ী মা, যত্নবান ও দায়িত্ববান স্ত্রী। যে ষোলো আনা ভালোবাসতে জানে, কিন্তু আদায় করে নিতে চায় না। ভাবে যা ভাগ্যে আছে তা আপনিই আসবে। জোর করে ভালোবাসা আদায় সে বড়ো ছোট কাজ। সুরাইয়া মৌলির মন অত ছোট নয়। তাই তো সৎ মেয়ে জেনেও হামিদাকে সন্তানের মতো ভালোবেসেছে। বিয়ের পরপরই হামিদাকে সঙ্গে করে ঢাকা নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সে কথা জেনে কতই না খুশি হয়েছিল হামিদা। নিজের পিতা, সুরাইয়া মৌলির মতো মা, সর্বপরি নিজের একটা পূর্ণ পরিবার! ইশ! কত সুখের শব্দগুলো! কিন্তু হামিদার কপালে সুখ কবেই বা সয়েছিল? নিজের বলতে ওর নিজ ছাড়া আর কিই-বা ছিল!

মেয়েদের প্রথম ভালোবাসা হয় আপন পিতা। হামিদার হৃদয় সেই পিতাই প্রথমবার ভেঙেছিল নিদারুণভাবে। যখন নিজের সবকিছু হবে বলে স্বপ্ন দেখছিল, তখনই ওর পিতা নিরালায় ডেকে নিয়ে যায়। হামিদার বালিকা মন তা থৈ থৈ করে নেচে ওঠে। ভাবে, আজ বুঝি বাবার আদর পাবে, স্নেহ মাখবে। কিন্তু হায়! মতুর্জা কবির পাষাণ, নির্মম গলায় বলল,

"আমি চাই না তুমি ঢাকা এসো। মৌলিকে সরাসরি না করে দেবে। যদি কারণ জিজ্ঞেস করে বলবে, এখানেই ভালো আছো তুমি। তাছাড়া কথাটা তো সঠিক। বড় ভাইয়ের মেয়ে নেই। তোমাকে এতদিন মেয়ে মনে করে লালন-পালন করেছেন। আজ হঠাৎ তার কাছ থেকে তোমাকে আমি নিয়ে যেতে পারি না। তুমি এখানেই ভালো থাকবে। যা খরচ লাগে আমি পাঠিয়ে দেবো।"

ওই প্রথম হামিদা বুঝেছিল মানুষ কথা দিয়ে সবচেয়ে বেশি আঘাত করতে পারে। কী ভীষণ তার যন্ত্রণা। ভাঙা মনটা দু হাতে চেপে ধরে মাথা হেঁট করে কাছারি ঘরের নির্জন পেছন দিকে বসে হু হু করে কেঁদেছিল। ওইটুকু বয়স! নিজেকে যে কী করে সামলেছিল জানে না। ওর পিতা ওকে মিথ্যাবাদী হতে বাধ্য করেছিল। তাই তো মিথ্যা বলেছিল সুরাইয়া মৌলিকে,

"দাদিজানকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। ঢাকা যাব না আমি, সোনা মা। কোনোদিন যাব না।"

তারপর দৌড়ে মোহনাদের বাড়িতে গিয়ে লুকিয়েছিল। সুরাইয়া মৌলি ও মর্তুজা ওইদিনই ঢাকা ফিরে গেল। হামিদা গাছের আড়াল থেকে ওদের চলে যাওয়া দেখেছে। সুরাইয়া মৌলির মুখখানা বিষণ্ণ ছিল। এদিক-ওদিক হামিদাকে একটিবার দেখার জন্য খুঁজছিল। হামিদা নজরে পড়েনি। সেদিন সারাদিন মোহনাদের বাড়িতে মন খারাপ করে বসে রইল। ভেবেছিল আর ও বাড়ি ফিরবে না। দু চোখ যেদিকে যায় চলে যাবে। কিন্তু রবিন ওর ঘাড় ধরে বাড়িতে নিয়ে এলো। সারা গায়ে ছিল ধুলো-ময়লা। মুখ শুকনো। রবিন নাক-মুখ কুঁচকে দাদিজানকে বলল,

"এরপর বাড়ি না ফিরলে খবরদার খুঁজে আনতে বলো না, দাদি। ওর কি চাকর আমি? দেখো কী হাল করেছে নিজের। কেউ দেখলে ভাববে কোথাকার কোন ফকিন্নির বাচ্চা!"

হামিদা রবিনের বকা-ঝকায় কষ্ট পেত, ভয় পেত আবার ওর চোখ টলমল করত। কিন্তু কেঁদে ভাসাত না। সেদিন সকল দুঃখের কান্না রবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদল। দাদিজান বুঝলেন আড়ালের ব্যাপার। জড়িয়ে ধরলেন নাতনিকে। রবিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। হামিদার এই অকারণ কান্না ওকে যারপরনাই বিরক্ত ও তিক্ত করল। খানিক কি অস্বস্তিও দিলো? কে জানে! ওর চোখে হামিদা যেন বিরক্তিরই নামান্তর ছিল!

"হামিদা!" সুরাইয়া মৌলির কোমল গলার হামিদা ডাক শুনে হামিদার অতীত ভাবনার সুতো ছিঁড়ল।

"সোনা মা!" হামিদার কান্না পেল। মৌলি ওকে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকতে হামিদা বেডের পাশে গিয়ে বসল। মৌলি উঠে বসতে গেলে বাধা দিলো,

"উঠো না। কী লাগবে বলো এনে দিই!"

"সারাদিন শুয়ে শুয়ে বিরক্ত হয়ে গেছি। ধর, একটু বসি।"

হামিদা তাকে বসতে সাহায্য করল। পিঠের কাছে বালিশ দিলো। মৌলি ওর হাতটা ধরে সামনে বসায়,

"কেমন আছিস? ইশ! মুখটা ওমন শুকিয়ে গেছে কেন? দুপুরে খেয়েছিলি কিছু? রবিন, আব্বাজান!"

"সোনা মা, ওকে কেন ডাকছ! খেয়েছি আমি। ওকে ডেকো না, দোহাই তোমার!"

মৌলি ওর মলিন মুখ দেখল।

"হ্যাঁ রে, ও কি এখনও তোকে বড্ড জ্বালাতন করে? করলে ওর রক্ষা নেই আজ!"

"না, না, রবিন ভাই কিছু করে না। তুমি ওসব ছাড়ো। কেমন আছো বলো? অনেক ব্যথা পেয়েছ, না? হিমু-মুমু ঘুমিয়ে আছে। ওদের হাতে-পায়েও ব্যন্ডেজ দেখলাম। আমার তো দেখেই কী যে কান্না পেল!"

বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে হামিদা। মৌলি ওর মুখ আঁজলা ভরে তোলে,

"আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা ঠিক আছি হামিদা। চিন্তা করিস না। কাঁদিস না সোনা!"

মৌলি ম্লান হাসল। মুখটা শুকিয়ে গেছে। কপালের পাশে ব্যান্ডেজ। পরনে মেক্সি। বুকে ওড়না। এই পোশাকে হামিদা তাকে এই প্রথমবার দেখছে। মৌলি সবসময়ই শাড়ি পরে। তবে ঘরে মাঝে মাঝে সুতি থ্রী পিস পরতে দেখেছে। চোখে টানা কাজল পরতে ভালোবাসত। আজ সেই চোখে নির্ঘুম রাতের কালি পরেছে।

হামিদার চোখ মুছে বলে,

"হিমু-মুমু সকালেও আমাকে তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। তারপর রবিনকে খুব করে ধরল," হামিপুকে নিয়ে এসো না, রবি ভাইয়া! যদি না আনো তবে কিন্তু তোমায় ম্যাগপাই রবিন ভাই বলে ডাকব।" তারপর রবিনকে এমনভাবে জ্বালাতন করল, বেচারা রাজি না হয়ে আর কই যায়। হ্যাঁ রে, রবিন নিয়ে এলো তোকে?"

হামিদা মনে মনে শ্লেষ হাসল। তারপর বলল,

"না, বড়দাদা ভাই নিয়ে এসেছে।"

"জুবিন! কী বলিস রে! কোথায় ও?"

"বাইরে, রবিন ভাই আর চাচাজানের সঙ্গে কথা বলছে। ডাকব?"

"থাক, পরে কথা বলব ওর সঙ্গে। এখন কেবল তুই পাশে থাক, কথা বল! কতদিন তোর কথা শুনি না।"

সোনা মায়ের সঙ্গে কত কথা বলার ছিল। কিন্তু তার রোগা, আহত মুখ দেখে হামিদা কিছু বলতে পারল না। শুধু মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল,

"হে আল্লাহ, সোনা মা, হিমু মুমু আর বাবাকে ভালো করে দাও।"

মৌলি হামিদার খোঁজ খবর নিলো, তারপর বাড়ির সকলের। দাদিজানের কথা শুনে মন খারাপ করে। বেডের পাশে কিছু ফল ছিল। গতকাল রাতে রবিন কিনে এনেছে। মৌলি ওগুলো কাটতে বলল হামিদাকে। হামিদা খাবে না। তবুও জোর করল,

"মায়ের আদেশ মানবি না?"

হামিদা এক টুকরো মুখে দিলো। তারপর আরো কয়েক টুকরো হাতে ধরিয়ে দেয় মৌলি। নিজেও কোনো রকমে খেল। হঠাৎ বলল,

"বাবাকে দেখেছিস?"

"হুম!" হামিদা মুখ আনত করল।

"চিন্তা করিস না। তোর বাবা সুস্থ হয়ে যাবে। ডাক্তার বলেছেন আমাকে।"

বলতে বলতে তার গলা ধরে এলো। সুরাইয়া মৌলি বড়ো শক্ত মনের নারী। কিন্তু আজ হামিদা তার হাতটা ধরতে ডুকরে কেঁদে উঠলেন,

"হামিদা, আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। ওই মানুষটা ছাড়া আমি যে বাঁচতে ভুলে গেছি। তার কিছু হলে কী হবে আমার, হিমু-মুমুর?"

হামিদার গলায় শক্ত কিছু যেন আঁটকে গেল। ঢোক গিলতে কষ্ট হলো। সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে দিশেহারা। তবুও তো কিছু বলতে হবে।

"কিছু হবে না বাবার। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো সোনা মা।"

"তাই যেন হয় হামিদা! তাই যেন হয়! জানিস ওর শেষ কথা কী ছিল? মৌলি, হামিদাকে দেখো! একটা মানুষ শেষ সময়ে কাকে মনে করে জানিস হামিদা? যাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে!"

হামিদার চোখে পানি এলো। বাবা ওকে কোনোদিন মনে করতে পারে এ যে ও ভাবতেও পারেনি। যাকে সে কোনোদিন কাছে টানেনি, দায়িত্ব নেয়নি তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে! হামিদার ভাঙা হৃদয়ে সূক্ষ্ম ব্যথা জাগে। সোনা মা ওকে কত কী বলে 'বাবা ভালোবাসে' কথাটা বিশ্বাস করাতে চায়। হামিদার ভাঙা হৃদয়ে সে বিশ্বাস পোক্ত হয় না।

কিছুক্ষণ সোনা মায়ের সঙ্গে হামিদা সময় কাটায়। তারপর ওকে বিদায় নিতে হয়। হিমু-মুমু তখনও ঘুমিয়ে। ডাক্তার ওদের জাগাতে নিষেধ করে বলে দেখা করে যেতে পারল না হামিদা। মৌলি সান্ত্বনা দিলো,

"আবার আসবি তো। মন খারাপ করিস না। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করিস। সাবধানে যাস। ও শোন, কিছু লাগবে তোর?"

হামিদা এখন কেবল এই মানুষগুলোর সুস্থতা চায়। তবুও সুরাইয়া মৌলি জোর করে ওর হাতে পাঁচশ টাকা গুঁজে দিলো,

"মা কিছু দিলে ফেরত দিতে নেই, বলেছি না? রেখে দে, সোনা!"

প্রিয় মানুষগুলোকে রেখে চলে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল হামিদার। কিন্তু উপায় কি আর। চাচাজান ওকে এখানে দেখে রুষ্ট হয়েছেন। ভয় পেয়েছিল হামিদা। কিন্তু চাচাজান কিছু বলেননি। শুধু রবিনকে গম্ভীর মুখে আদেশ করলেন,

"যা, ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়!"

রবিন যে এই আদেশ শুনে খুশি হয়নি তা ওর মুখ দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে। জুবিনের মুখখানা কিন্তু প্রসন্ন। সুরাইয়া মৌলি ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেখে খুব খুশি হলেন। ওর মনোবল বাড়ালেন কত কী বলে! জুবিন বোধহয় তাতেই আরও খুশি হয়েছে।

ওরা হাসপাতালের বাইরে আসতে জুবিন বলল,

"তোকে সঙ্গে যেতে হবে না রবিন। তুই বরং একটা ভ্যান বা ট্যাক্সি ঠিক করে দে। আমি আর হামিদা বাড়ি ফিরতে পারব। কী রে হামিদা পারব না?"

রবিনের বুনো দৃষ্টি পড়ে হামিদার ওপর। ওই চোখে চোখ রাখে না হামিদা। ওর বুক কাঁপে। ওতে যেন অশুভ ছায়া বিরাজ করে। জুবিনের কথায় কেবল মাথা দুলালো। যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। জুবিনের সঙ্গে একলা যাওয়া ঝুঁকির। তবুও রবিনের সঙ্গে যাওয়া থেকে তো শ্রেয়। ধরেই নিয়েছিল জুবিনের কথার প্রতিবাদ করবে রবিন। কিন্তু অবাক হয়, সাথে স্বস্তিও পেল যখন রবিনকে বলতে শুনলো,

"ঠিক আছে। এতই যখন হেডাম তোদের, যা!"

একটা ট্যাক্সি ডেকে এনে ভাইকে তুলে দিলো রবিন। হামিদা ওপাশে দ্রুত গিয়ে বসল। রবিনের কাছ থেকে যত দ্রুত সরে পড়া যায় ততই মঙ্গল।

"আরাম করে বস, হামিদা!" জুবিনের গলায় ভীষণ আমোদ। কেন? এতদিন বাদে বাইরে এলো বলে?

"ভয় পাস না। আমি আছি তো!" সরে এসে ফিসফিস করে বলল জুবিন। হামিদার শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। ও জড়সড় হয়ে সরে বসে। জুবিন খেয়াল করেও যেন করে না। বাইরে তাকায়। গুনগুন করে। রবিন চালককে কিছু বলছে। কিন্তু ওর শ্যেন দৃষ্টি স্থির ভেতরে বসা দুজন মানব-মানবীর দিকে। কপালে ভাঁজ, ভুরু কুঞ্চিত। চোয়াল তীক্ষ্ণ।

"সাবধানে যাস!" শান্ত রবিনের গলার স্বর। রবিন হামিদাকে উৎপীড়ন না করে একদিন শান্ত থাকে না। অথচ, আজ কিছুই বলছে না। নীরবে কেবল দেখছে। এত ভালো হয়ে গেল হঠাৎ! হামিদার কোথাও গন্ডগোল মনে হয়। হয়ত হামিদারই মনের ভুল। জুবিনের কাছে তো সব স্বাভাবিক ঠেকছে। কই সে তো কোনো চিন্তা করছে না। হামিদাও অকারণে চিন্তা করবে না। জুবিন তো বলেছে, ঢাল হবে ওর। রবিন ও রবিনের এই পরিবর্তিত রূপ গোল্লায় যাক!

ট্যাক্সি দ্রুত ছুটছে। জনবহুল সেই হাসপাতাল ছেড়ে শহরের মাঝ দিয়ে এগোতে লাগল। এদিকে হামিদা আগে আসেনি। এদিকটাতে শহুরে ছোঁয়া। বিদ্যুতের আলোয় চারপাশ দিনের মতো আলোকিত। কত মানুষ! কত গাড়ির হর্ণ! কানে তালা লেগে যায়। কিছুদূর গিয়ে জুবিন ট্যাক্সি থামালো। হামিদা সপ্রশ্নে তাকায় দেখে বলে,

"আমার খুব খারাপ লাগছে হঠাৎ। একটু জিরিয়ে নেবো, পানি খাব। চল ওখানে বসি।"

ট্যাক্সি চালককে বলল,

"আপনি আমাকে ধরে হুইলচেয়ারে বসিয়ে ওই ঘরে দিয়ে আসতে পারবেন? আমার ভাই যা দিয়েছে রেখে দিন। আরও কিছু টাকা দেবো! পারবেন?"

ট্যাক্সি চালক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সজোরে মাথা নাড়ায়,

"খুব পারব!"

"হামিদা, ব্যাগটা নিয়ে আয় তো!"

হামিদার মন কেমন করে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে আবার ভাবল,

"এতে কী আছে? কেন দাদাভাই এত যত্ন করে আগলে রেখেছিল এত পথ?"

রাতের অন্ধকার তখন জমাট বাঁধছে। চারপাশে ঝিঁঝির ডাক। হামিদা ব্যাগ হাতে পিছু পিছু গেল। এদিকে হাতে গোনা কিছু দোকান-পাট। কয়েক ঘর বসত-ভিটা আছে সামান্য দূরে। জুবিনকে নিয়ে ট্যাক্সিচালক যে ঘরে প্রবেশ করেছে, সে ঘরের ওপরে একটা সাইনবোর্ড। তাতে লেখা 'কাজী অফিস'

হামিদার কলিজার পানি শুকিয়ে যায়। জমে গেল পা। হাতের ব্যাগটা কী যে ভারি লাগল। ব্যাগটা ফেলে হামিদা পালাবে এখন। পথ চেনে না তাই কি! জুবিন যেন টের পেয়েছে। ওকে ডাকছে। কী আকুতি ওই গলায়। যেন হামিদা ওর সর্বস্ব লুণ্ঠন করে পালাতে চাইছে। ট্যাক্সিচালক টাকা গুনতে গুনতে বেরিয়ে এলো। তার মুখ উজ্জ্বল। হামিদার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন করে তাকালো। তারপর যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকেই ফিরে গেল ট্যাক্সি চালিয়ে।

"হামিদা, হামিদা, দোহাই তোর হামিদা, সামনে আয়। একবার আয়।"

হামিদা পালিয়ে যেতে পারে না। সেই অসহায়ত্বে, সেই কারণে নিজেকে ধিক্কার দেয়। জুবিন চেয়ারে বসে আছে। সামনে কাজী সাহেব। জুবিন তাকে ইশারা করতে উঠে বাইরে গেল। বাইরে থেকে দরজা শব্দ করে রুদ্ধ হলো। শিউরে উঠল হামিদা।

"কাছে এসে বস, হামিদা! বিশ্বাস কর আমাকে!"

"বিশ্বাস! এই মুহূর্তে ওই শব্দ কৌতুক মনে হচ্ছে আমার কাছে। আপনি যদি ভেবে থাকেন চুপচাপ সব মেনে নেবো, তবে ভুল ভেবেছেন আপনি। আপনাকে আমি দাদাভাই ভিন্ন কোনোদিন কিছু মনে করিনি। আর না পারব! দোহাই এই পাগলামি বন্ধ করুন। আমি নতুন করে একটা ভ্যান ডাকছি। চলুন বাড়ি ফিরে যাই।"

হামিদা দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ব্যাগটা সেখানে রাখল। এক পা এগোতে জুবিন দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

"আজ আমি বাড়ি ফিরব না হামিদা। নিজের সঙ্গে একচোট লড়েছি আমি। একবার ভেবেছিলাম তোকে জোর করব না। কিন্তু পরে বুঝলাম ও ছাড়া তোকে পাবার পথও নেই। আজ এইখানে তুই আমার হবি। শুধু তো তিনটা শব্দ, হামিদা। বল না! বিশ্বাস কর ওই তিনটে শব্দ তোর পুরো ভবিষ্যৎ বদলে দেবে। তুই আমার বউ হবি। এই জুবিনের। কেউ তোকে অনাদর, অসম্মান করার সাহস করবে না। আমি তোকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করব হামিদা। আমার হয়ে যা, হামিদা!"

হামিদার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ও ফের পা বাড়ায়। জুবিন এবার আতঙ্কিত গলায় বলে,

"যাবি? যা তবে। আর এক পা এগিয়ে গিয়ে দেখা হামিদা। এই দ্যাখ, আমার হাতে বিষের বোতল। আজ হয় তুই আমার হবি নয়ত মৃত্যু!"

হামিদা একচুল এগিয়ে গেল না। ওর শরীর কাঁপছে। রুদ্ধ দরজা যেন বহু ক্রোশ দূরে। জুবিনের হাতে সত্যি বিষের বোতল। রাগে, ক্ষোভে সামনের ব্যাগটা ছুঁড়ে দিলো জুবিনের পায়ের কাছে হামিদা। অসহায়ত্বে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে,

"কেন ধোঁকা দিলেন, কেন?"

চলবে....

20/06/2025

হামিদা(০৯)
লেখনীতে: Srotosini

প্রথমবারের মতো মহসীন কবির ভূঁইয়া পিতার মৃত্যু বার্ষিকি বাতিল করতে বাধ্য হলেন। কারণ, তার ছোট ভাই সপরিবারে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ওরা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিল। পথিমধ্যে বিপরীত দিক থেকে আসা একটা লড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্রাইভেট কারটি উলটে পড়ে রাস্তার পাশে। স্ত্রী ও কন্যাদের বাঁচাতে গিয়ে মর্তুজার মাথায়, পায়ে আর ডান হাতে মারাত্মক জখম হয়েছে। সুরাইয়া মৌলি পিঠে আঘাত পেয়েছে। মেয়ে দুটোর আঘাত তেমন গুরুতর নয়। হিমু আর মুমুকে মায়ের সঙ্গে বেডে শিফট করা হয়েছে। কিন্তু মর্তুজার বিপদ কাটেনি। জরুরি বিভাগে রয়েছে এখনও।

মানুষের হৈচৈ লেগে থাকার সময়টাতে বাড়িতে থমথমে অবস্থা। মহসীন কবির ও রবিন সারারাত জেলা সদরের হাসপাতালে ছিল। আজ মর্তুজার শরীরিক অবস্থার উন্নতি না হলে ঢাকায় পাঠানো হবে। দাদিজান খুব কাঁদছিলেন। ছেলের চিন্তায় তার শরীর খারাপ করেছে। জরিনা পাশে বসে মাথায় তেলপানি দিচ্ছে। ছুটিতে নিজের বাড়িতে গিয়েছিল। আজই ফিরেছে সে। চাচিজান মাথা ধরার অজুহাতে ঘরে শুয়ে আছেন। মর্জিনা রান্নাঘরে খট খট শব্দে কী যেন করছে। জুবিন ঘর থেকে বের হয়নি এখনও। সব মিলিয়ে গুমোট বাতাবরণ বাড়িটা জুড়ে।

হামিদার মনে জমেছে বৈশাখের মেঘ। পিতা ওর কেবল নামেই। তবুও তো পিতা। জন্মদাতা। তার দূর্ঘটনার কথা শুনে চোখে পানি এসেছিল। সৎ মা ও দু বোন হিমু, মুমুকে দেখবে বলে পরাণ ছুটে যাচ্ছে। শুনেছে এখন আর বিপদ নেই ওদের। কিন্তু আঘাত তো পেয়েছে। ওদের অদেখা ব্যথাতুর মুখ ভেবেই চোখ ভেজে হামিদার। কেউ একটু ওকে নিয়ে যেত হাসপাতালে! এক পলক দেখে আসতে পারত মা, বোন আর পিতাকে। কাকে বলবে সাহস করে কথাটা?

"হামিদা!"

জুবিনের ডাকে চোখ মুছল হামিদা। জুবিন হুইলচেয়ার ঠেলে পাশে এসে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর হামিদা বলল,

"কিছু দরকার, দাদা ভাই?"

হামিদা আবার ওকে দাদা ভাই বলে ডাকছে। জুবিনের মনে স্বস্তি আসে, কিন্তু কোথাও একটা মন্দ লাগার রেশ রয়ে যায়।

"সকলকে জিজ্ঞেস করিস তাদের কী দরকার! কই কেউ তো তোকে একবারো জিজ্ঞেস করে না তোর কী দরকার। তোর কি কিছুর দরকার পড়ে না হামিদা?"

হামিদা কী জবাব দেবে? কম্পিত ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল নত মুখে। জুবিন গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

"চাচিমণিকে দেখতে যাবি?"

হামিদার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। জুবিনের ভেতর স্বার্থপর এক ভাবনার উদয় হয়। শর্ত রাখতে ইচ্ছে করে,

"তুই যদি আমার বউ হতে রাজি হস তবে তোকে হাসপাতালে চাচিমণি আর হিমু-মুমুকে দেখতে নিয়ে যাব। শর্তে রাজি কি না বল!"

হামিদার মন সরল। সৎ মাকে সৎ ভাবে না। বোন দুটো যেন ওর একই মায়ের পেটের। বেশ করে কৌশল করলে হামিদাকে বিয়েতে রাজি করানো যাবে। কিন্তু জুবিনের বিবেকে বাধল। এভাবে চায় না হামিদাকে। আগে ওর সরল মনে জায়গা করতে হবে। যেমন করে কেউ কখনো জায়গা করেনি।

"তৈরি হয়ে আয়। আমি নিয়ে যাব তোকে।"

"কিন্তু!"

হামিদা যে ওর অসহায় পা দুটোকে নিয়ে চিন্তা করে তা জুবিনের পছন্দ হয় না। পা অচল হলেই মানুষ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় না কি? জুবিন আজ হামিদাকে দেখিয়ে দেবে পা অচল হলেও ও অসহায় নয়। হামিদার সাহস ও শক্তির কেন্দ্র হতে পারবে।

"ফের কিন্তু টিন্তু করছিস! তাড়াতাড়ি যা!"

হামিদা এই সুযোগ বিফলে যেতে দিতে চায় না। মনের কিন্তু পরন্তু মনে গোপন করে। জুবিন নিশ্চয় ওকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারবে। দাদিজানকে বলে যাওয়ার অবস্থা নেই। তবুও জরিনাকে বলল। মর্জিনা আর চাচিজানকে না বলাই শ্রেয়। পরে অবশ্য এ জন্য সমস্যার সম্মুখীন হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সেসবের পরোয়া করল না হামিদা।

টিনের ট্রাঙ্কটা থেকে নতুন সবুজ রঙের থ্রী পিচটা পরে নিলো, চুল আচড়ে বিনুনি করল। তারপর ওড়না মাথায় তুলে বেরিয়ে এলো।

জুবিন কাওকে দিয়ে ভ্যান ডেকেছে। কারো সাহায্য নিয়ে ভ্যানের একপাশে বসেছে পা ঝুলিয়ে। হুইলচেয়ারটা পেছনে ভ্যানের ওপর বাঁধা। একটা ছোট ব্যাগও রাখা। ওতে আবার কী? এই মানুষটার পূর্বের ভুল সেই মুহূর্তে হামিদা ভুলে গেল। ভুলবে না কেন? হামিদাকে খুশি করতে সে নিজের গন্ডি অতিক্রম করেছে আজ। ভুলতে চাইছে নিজের অথর্ব জীবনের অসহায়ত্ব। আসলে অথর্ব তো তারা যারা চেষ্টা করতে ভয় পায় বা সংকোচে সামনে এগোতে চায় না। জুবিন সেই ভয় আজ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।

হামিদার বিমর্ষ মুখে প্রত্যুষের কিরণের মতো একফালি প্রসন্নতা দেখা দিলো। জুবিন ওকে দেখতে হাত ইশারা করে ডাকল,

"তাড়াতাড়ি ওঠ। নয়ত যেতে রাত হয়ে যাবে। আয়, আয়!"

কী উদ্দীপনা তার ভেতরে আজ। গম্ভীর মুখে প্রাণখোলা হাসি। হামিদা পেছনে বসতে গেলে হাসি নিভু নিভু করে,

"পেছনে যাচ্ছিস কেন? পাশে বস!"

"কিন্তু!"

"আবার কিন্তু! এক মিনিটের মধ্যে পাশে না বসলে যাওয়া ক্যান্সেল হামিদা!"

হামিদা তড়িঘড়ি পাশে এসে বসল। জুবিন গোপনে হাসে। ভ্যানওয়ালাকে তাড়া দিলো,

"নিন, আল্লাহর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করুন!"

ভ্যান ছুটে যাচ্ছে। দু পাশে কত চেনা মুখ, বাড়ি-ঘর, গাছ-গাছালির সারি হারিয়ে গেল। চেনা মুখগুলো হামিদা ও জুবিনকে পাশাপাশি দেখে থমকে যায়, ফিরে ফিরে দেখে। হামিদা লজ্জা পায়। ওড়না টেনে মুখ আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। ভ্যান যত এগোয় ততই ওর মন কু ডাকে। কাওকে না বলে জুবিনের সঙ্গে বের হওয়া কি ঠিক হলো? মনকে বোঝায়,

"দাদা ভাই হয় ও তোর। কিছু হবে না। একদম ভয় পাস না।"

এই নড়বড়ে বিশ্বাসকে জাপটে ধরে চুপচাপ বসে আছে হামিদা।

জুবিন শেষ কবে ভ্যানে চড়েছিল মনে করতে পারে না। হয়ত যখন স্কুলে ছিল তখন! না কি দূর্ঘটনার শিকার হওয়ার মাস খানেকের মধ্যেও চড়েছিল? তখন হয়ত ভ্যানকে ছোটোলোকি বাহন ভাবত। কিন্তু এখন মনে হলো ভ্যানের চেয়ে চমৎকার বাহন পৃথিবীতে দুটো নেই। খোলা বিশুদ্ধ হাওয়া যেন ছুটে এসে ওকে আলিঙ্গন করছে। ওর অচল পা দুলে দুলে ওঠে। একটু কি অনুভূতি শক্তি সঞ্চার হয় তাতে! না, না, সবই জুবিনের মনের ভুল। মাথার ওপর বিশাল নীল আকাশ। দু-পাশে লোকালয় ছাড়িয়ে মাঠ-বাজার! কী মুগ্ধকর এই বাহনে যাত্রা!

"হামিদা!" জুবিন ডাকল। কেন যেন ওর আজ নীরবতা ভালো লাগছে না। হামিদা ছোট্ট করে জবাব দিলো,

"হুম?"

"ভ্যানে চড়ে তোর কেমন লাগে?"

হামিদা প্রশ্ন শুনে কপাল কুঁচকে বলল,

"ভালোই তো!"

"কী দায়সারা জবাব তোর। আমার কেমন লাগে শুনবি?"

"হ্যাঁ!"

"ভীষণ সুখী সুখী লাগে।" আপমনেই হাসল তারপর জুবিন। ভ্যানচালকের সঙ্গে টুকটাক পরিচয় হয়েছে। জানতে চাইল,

"করিম ভাই, ভ্যান চালানো কি খুব কষ্টের কাজ?"

"কোন কাম কষ্টের না কন ভাইজান? তয় আমার অত কষ্ট লাগে না। প্যাডেল মারতে মারতে একখান গান ধরি। তারপর কুনতে কই যাইগা মাঝে মাঝে তো খেয়ালই থাহে না।"

ভ্যানচালক হাসল। জুবিন অচল পা দুটোর দিকে তাকিয়ে আশান্বিত গলায় বলল,

"আমার পা যদি কোনোদিন ভালো হয়, তবে আমিও ভ্যান চালাব, করিম ভাই। কিন্তু গান যে গাইতে পারি না।"

হামিদা বোকার মতো শুনলো কথাগুলো। জুবিন কেমন ভবঘুরেদের মতো কথা বলছে! ভ্যানওয়ালা শব্দ করে হাসল। জুবিনের কথায় তাল দিয়ে বলল,

"আল্লাহ আপনের পা ঠিক সারাইয়া দিবো ভাইজান। গরিবের দোয়া ফেলে না সে। তখন আইসেন আমার বাড়ি। আমার এই ভ্যান আপনারে চালাইতে দিমুনে। গান গাওয়া আর কী এমন ব্যাপার! মনে সুখ আইলে গান আপনাতেই গলায় আয়া পড়ে।"

জুবিন ভ্যানওয়ালার কথা শুনে খুশি হলো। সারা রাস্তায় দুজনে ভ্যান, গান থেকে শুরু করে নানান গল্প করল। হামিদা এই জুবিনকে দেখে প্রথমে অবাক হয়। রবিনের আর কী অহংকার আছে! জুবিন একসময় ওর চেয়েও বড়ো অহংকারী ছিল। গরিব বা অসহায়দের সঙ্গে বসে খেত না। আজ সেই কি না ভ্যানচালানো শিখতে চায়, ভ্যানচালককে বন্ধু বলে! সময়ের কত রূপ!

সূর্য ডুবে পশ্চিমাকাশে লালিমা ছড়িয়েছে। ঠিক তখন ভ্যান এসে পৌঁছাল হাসপাতালের মুখে। হামিদা সবে চোখ তুলেছিল সামনে। মুহূর্তে তা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এদিকে এগিয়ে আসা রবিনকে দেখে। চুল এলোমেলো, পরনের কাপড়ে কুঁচকানো। চোখ-মুখে রাজ্যের ক্লান্তি ও অবসন্নতা। শক্ত চোয়ালজোড়া যেন হামিদাকে সতর্ক করছে,

"লুকিয়ে যা, ওর দৃষ্টি সীমানার আড়ালে যা।"

সেই সুযোগ পেল না হামিদা। রবিনের বুনো দৃষ্টি বজ্রপাতের মতো পড়ল যেন ওর ওপর। থেমে গেল পা। দৃষ্টি পাশে সরিয়ে ভাইকে দেখল। যে এখনও ভ্যানওয়ালার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মেতে আছে। রবিন যেন বিশ্বাস করতে পারেনি এমনভাবে ধীরে ধীরে হেঁটে আসছিল। ওর বিশ্বাস পোক্ত হতে চিতার বেগে হেঁটে এলো! চিতার বেগে! হামিদা এর চেয়ে ভালো উপমা আর পেল না।

"তোরা!"

জুবিন থমকে গেল। হামিদা ভয়ে কাঠ। কেন এত ভয় পাচ্ছে ও জানে না। অন্যায় তো কিছু করেনি। রবিন কি আর ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারে?

"হামিদা চাচিমণি ও হিমু-মুমুর চিন্তায় কাঁদছিল। তাই নিয়ে এলাম। আমাকে ধরে নামা তো রবিন!"

রবিনের দৃষ্টিতে বিস্ময় আবার রাগও। জুবিন ভাইকে তাড়া দিতে দাঁতে দাঁত পিষে ও বলল,

"আমাকে বলছিস কেন? যাকে সাথে করে নিয়ে এসেছিস তাকে বল কোলে করে নামাক তোকে। কী রে হামিদা, পারবি না?"

হামিদা ভুলেও সে কটাক্ষের প্রতিবাদ করল না। ওর গায়ে কাটার মতো লাগলেও না।

"রবিন!"

রবিন দু হাত মুঠ করে কঠিন কিছু তেতো কথা বলতে যাচ্ছিল ভাইকে, কিন্তু ভ্যানওয়ালাকে দেখে থেমে গেল।

"হুইলচেয়ারটা নামাও!"

রাজার মতো হুকুম করল ভ্যানওয়ালাকে। তারপর জুবিনকে কোলে তুলে বসিয়ে দেয় হুইলচেয়ারে। জুবিন খপ করে ওর বাহু চেপে ধরে,

"হামিদাকে কিচ্ছুটি বলিস না, রবিন। আমার কসম দিলাম তোকে। বিনিময়ে যা চাস আমি করব। আগামী সপ্তাহে জেলা শহরে তোর ফুটবল ম্যাচ আছে না? টাকা লাগবে? বাবার কাছে চাইতে যাস না। আমি দেবো। তোর যা যা অ্যাসাইনমেন্ট আছে সামনে সেটাও প্রয়োজনে করে দেবো। দোহাই রবিন কিছু বলিস না ওকে!"

রবিন যেন জমে গেল। ওর চোখের পলক পড়ল না। চোয়াল কঠিন, কপালের রগ ফুলে উঠেছে। হামিদার জন্য চিন্তা হচ্ছে জুবিনের। যে কোনো মূল্যে এবার রবিনের উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করবে ও! হামিদা ভ্যানের একপাশে সভয়ে, আনত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। যেন ও আসামীর কাঠগড়ায় দন্ডায়মান। সামনে মাননীয় জজ আজ ওর জীবন-মরণ ফয়সাল করবে। কী আশ্চর্য! সকলকে অবাক করে দিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে রবিন। ওর মুখে রাগের রেশ নেই। জুবিন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে যেন।

"চল তোদের চাচিমণির কেবিনে নিয়ে যাই। কী রে হামিদা, ওমন ভীতু বকরির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমি কি বাঘ না হায়েনা যে তোকে খেয়ে ফেলব! জুবিন ভাইকে নিয়ে আমার পিছু পিছু আয়!"

রবিন ভ্যানওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে আগে আগে চললো। জুবিন ফের দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে করিম ভাইয়ের থেকে বিদায় নেয়।

"চল, হামিদা!"

হামিদা জুবিনের হুইলচেয়ার ঠেলে রবিনকে অনুসরণ করছে। জুবিন নিচু গলায় বলল,

"ভয় পাস না, হামিদা। রবিন এখন থেকে আর তোকে জ্বালাবে না, কষ্ট দেবে না। ওর আর তোর মাঝে ঢাল হয়ে দাঁড়াব আমি। কথা দিচ্ছি!"

আস্তে বললেও কথাটা যেন রবিন শুনল। হামিদা পেছন থেকে দেখল রবিনের গলার রগটা ফুলে উঠেছে। চোয়াল ভীষণ তিক্ষ্ণ! জুবিনের কথা হামিদা বিশ্বাস করতে চায়। কিন্তু রবিন! রবিন যেন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর বজ্রপাত। কখন না জানি ওর মাথার ওপর পড়বে!

চলবে...

18/06/2025

হামিদা(০৮)
লেখনীতে: Srotosini

হামিদা কলেজ থেকে ফিরে বাড়ির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তবুও মোহনা আসবে সে কথা ভোলেনি। কখন আসে, কখন আসে ভেবে ভেবে দরজায় বারংবার তাকাচ্ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার ঠিক আগে চাচির আদেশে ছাদে গেল শুকনো কাপড় আনতে। কাপড় হাতে নিচের সিঁড়ির ধাপে নেমে আসতে মোহনার রাগী গলার স্বর শুনতে পেল। রবিন হাসছে! হামিদা শুকনো কাপড় পাশের চেয়ারের ওপর ফেলে দৌড়ে গেল।

কথামতো ইফতারের আগে আগে এসে হাজির মোহনা। হাতে একটা ব্যাগ। রবিন দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে। হামিদার পায়ের শব্দ শুনেও ফিরে তাকাল না, নড়লও না।

"ওই দ্যাখো, শাঁকচুন্নিকে উদ্ধার করতে শকুন্তলা চলে এসেছে?"

"রবিন ভাই, ওকে আসতে দিন!"

রবিন ভ্রুক্ষেপ করল না হামিদার কথা। মোহনাকে বলল,

"আগে ব্যাগ খুলে দেখাও তারপর ভেবে দেখব বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারবে কি না!"

মোহনা ঝাঁঝ গলায় বলে,

"আপনাকে কেন দেখাতে যাব? গেলাম না ভেতরে। এই হামিদা বাইরে আয় তুই!"

হামিদা এগোতে রবিন ঘাড়ের ওপর থেকে তাকালো। বড়ো বুনো দৃষ্টি,

"আর এক পা এগিয়েই দ্যাখ, হামিদা! এই সন্ধ্যা বেলা তোকে পুকুরে চুবাবো।"

হামিদার কী আর সাহস হয় সে কথা তুচ্ছ করার! রবিন ক্রুর হাসি দিয়ে মোহনার দিকে ফিরল আবার। এর মধ্যে পবিত্র আজানের ধ্বনি ভেসে আসে।

"রোজাদারকে কষ্ট দিলে আল্লাহর গজব পড়বে আপনার ওপর, রবিন ভাই!" মোহনা সতর্কে বলল। রবিন সোজা হয়,

"কে রোজা?"

"হামিদা!"

রবিন ভুরু কুঞ্চিত করে। পেছনে তাকায়।

"তুই রোজা ছিলি?"

হামিদা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ায়। রবিন তখনই সরে দাঁড়ায় না। কতক্ষণ কী ভাবে। তারপর দরজা ছেড়ে বলে,

"যাও শাঁকচুন্নি, তোমাকে ঢুকতে দিলাম!"

তারপর আর দাঁড়ায় না। হনহনিয়ে বসার ঘরে গিয়ে বসে। মোহনা নাক-মুখ কুঁচকে বিড়বিড় করে গালি দিলো। হামিদা ওর হাত চেপে ধরে,

"চল আমার ঘরে!"

হামিদার ঘরে আলো নেই। তাই ও দাদিজানের ঘরে নিয়ে এলো মোহনাকে। দাদিজান অজু করে ঘরে এসে মোহনাকে দেখে হাসিমুখে কুশলাদি জানতে চাইলেন। তারপর হামিদাকে বললেন,

"ওই দ্যাখ আমার টেবিলের ওপরে মুড়ির মোয়া, কলা আর দই চিড়ে রাখা আছে। যা ইফতার করে নে।"

মোহনার দিকে তাকিয়ে বলল,

"তুমিও খেয়ো। আমি গেলাম, নামাজ আদায় করে আসি ও ঘর থেকে!"

হামিদা প্রথমে পানি খেয়ে রোজা ভাঙল। তারপর মোহনার দিকে দুটো মুড়ির মোয়া এগিয়ে দিয়ে দই-চিড়ের বাটি আর একটা কলা নিয়ে বসে পড়ে পাশে।

"কলা দিয়ে দই-চিড়ে মাখালে খাবি তো?"

"আমাকে সাধছিস কেন? রোজা তুই রেখেছিস। একা খা।"

"আরে! খেয়েই দেখ না। আমি অনেক সুন্দর দই চিড়ে মাখাতে পারি।"

হামিদা কলার খোসা আলাদা করে চামচ দিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে দই চিড়ের সঙ্গে মাখালো। তারপর উঠে গিয়ে পরিস্কার একটা বাটিতে রেখে দেয় কিছুটা। দাদিজান এইটুকু খাবে। বাটিটা ঢেকে আরেকটা চামচ নিয়ে এলো।

"খেয়ে দ্যাখ!"

মোহনা হাঁপ ছাড়ল। হাতে আধ খাওয়া মোয়া। তবুও চামচে দই চিড়ে মাখা নিয়ে মুখে দিলো।

"ওরে! আসলেই তো খেতে মজা। খা!"

দুজনে গল্প করতে করতে খাচ্ছিল। হামিদার নজর বার বার মোহনার ব্যাগে যায়,

"তুই কেক আনিস নি তো? আমি কিন্তু কেক কাটব না আজ।"

"আরে জানি তো। কেক টেক আনিনি।"

"তাহলে কী এনেছিস, দেখি?"

"তর সইছে না, হ্যাঁ?"

"একটু না। দেখা না!"

মোহনা ব্যাগ হাতে নেয়। বিছানার ওপর তুলে বলে,

"তুই না কাল বলেছিলি জন্মদিন টন্মদিন পালন করবি না। আর এখন আবার উপহার দেখার জন্য তর সইছে না, হ্যাঁ!"

হামিদা দাঁত বের করে হাসে। বাটিটার খাবার প্রায় শেষ। বাকিটুকু মোহনার জন্য রেখে বাবু মেরে বসল। মোহনা প্রথমে একটা মাঝারি সাইজের টিফিন বাটি বের করে আনল। তারপর একটা সুন্দর ডাইরি আর এক বক্স চকলেট।

"ডাইরিটা অনেক সুন্দর!"

হামিদা ডাইরি ও চকলেট পেয়ে খুব খুশি। ডাইরির প্রথম পাতায় মোহনার সুন্দর হাতের লেখা জন্মদিনের শুভেচ্ছা। জন্মদিন পালন আসলেও খারাপ ব্যাপার না। উপহার পেতে কার না ভালো লাগে! মনের শান্তি!

"খুশি হয়েছিস?"

"অনেক!"

মোহনার মন ভরে গেল বান্ধবীর খুশি দেখে। হামিদা টিফিন বাটির দিকে তাকালো,

"ওটাতে কী?"

মোহনা বাটি খুলতে হামিদার খিদে পেয়ে গেল। কী সুঘ্রাণ,

"গোরুর গোশতের বিরিয়ানি। ইশ, নিশ্চয় আন্টির হাতের। আমার ওটা খুব পছন্দের! ওমা, রোস্ট আর ক্ষীরও!"

বলতে বলতে হামিদার গলা জড়িয়ে এলো। ইচ্ছে করল মোহনাকে লাফ দিয়ে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু ওর সব খুশি ভেসে গেল রবিনে গলার স্বর শুনে,

"ঘ্রাণে তো ঘরে টিকে থাকাই মুশকিল হলো রে। আমারই বাড়িতে বসে, আমাকে না দিয়ে কী খাচ্ছিস তোরা লুকিয়ে লুকিয়ে? বিরিয়ানি, রোস্ট আর ক্ষীর!"

মোহনা তাড়াতাড়ি ঢাকতে গেল। রবিন ভুরু তুলে হামিদার দিকে তাকিয়ে বলল,

"একা খাবি?"

হামিদা মনে মনে রাগ হলো। গাল ফুললো। রবিন বলল,

"আতার মতো গাল ফুলাচ্ছিস কেন? একা খেলে বল চলে যাই!"

"হ্যাঁ, ও একাই খাবে। যান আপনি! আপনাকে ডেকেইছে কে শুনি?"

মোহনার কথার ঝাঁঝে রবিন বলল,

"শাঁকচুন্নির জিহ্বা তো নয় যেন ব্লেড! আসতেও কাটে, যেতেও কাটে।"

মোহনার মুখ লাল হয়ে ওঠে। রবিন এবার হামিদার দিকে ফেরে,

"নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। বুঝে গেছি কী চাস তুই।"

রবিন বের হয়ে গেল। মোহনা ভাবল ও একেবারে গেছে। হাঁপ ছেড়ে বলল,

"তোর এই রবিন ভাই নামক শয়তানের চ্যালাকে এক মিনিট আমি বরদাস্ত করতে পারি না। তুই এত বছর কেমনে পারলি? নে তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। পরে আবার না অন্য কেউ এসে হামলা দেয়। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুই ভূঁইয়া বাড়িতে নয় বরং সুন্দরবনে আছিস। তুই বেচারি হরিণ বাকিরা শেয়াল, বাঘ, হনুমান ইত্যাদি ইত্যাদি!"

হামিদার মুখ তখনও ভার। একটু আগের সেই আনন্দ আর নেই।

"দাঁড়া, প্লেট নিয়ে আসি।" বলে উঠতে গেল হামিদা।

"প্লেট আনার কষ্ট করতে হবে না তোকে।"

রবিন ফের এসে হানা দিলো। এবার ওর হাতে একটা প্লেট আর চামচ। হামিদার বেজার, করুণ মুখ, মোহনার রাগ রাগ মুখ উপেক্ষা করে টিফিন বাটি থেকে অর্ধেকটা বিরিয়ানি, রোস্টের লেগ পিচ আর খানিক ক্ষীর তুলে নিয়ে নেয়।

"বাকিটা শাঁকচুন্নি আর শকুন্তলা মিলেমিশে খা। পানি লাগলে বলিস, মর্জিনা খালাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবো। বাহ, খেতে তো চমৎকার হয়েছে। সেই স্বাদ, সেই স্বাদ!"

রবিন খেতে খেতে বেরিয়ে গেল। হামিদার চোখে পানি। অবশিষ্ট ওইটুকু বিরিয়ানি ও খাবে না কি মোহনাকে দেবে! দাদিজানেরও তো ভালো করে হবে না। নিলো তো নিলো সকলের জন্য রেখে নিতো। মোহনা রাগে ফুঁসতে লাগল,

"বিশ্ব বেহায়া কোথাকার!"

হামিদার আর খেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু দাদিজান এসে বুঝালো। তিনি নিজ হাতে করে মোহনা ও হামিদাকে খাইয়ে দিলেন। ওদের অনুরোধে দু তিন মুঠো নিজেও খেলেন।

এসবে হামিদার মাগরিব কাজা হলো। মোহনা চলে গেল এশার পূর্বে। হামিদা তখন রান্নাঘরে রাতের খাবার আয়োজন করছে। মর্জিনা খালা চাচিজানের পা টিপছে ঘরে। আজ তেমন বিশেষ কিছু আয়োজন করতে নিষেধ করেছেন চাচিজান। চাচাজান আজ আর ফিরবে না বাড়িতে। রবিন বন্ধুর ওখানে রাত কাটাবে এই সুযোগে। বেরিয়েও গেছে এতক্ষণে। ওর প্রতি আজ আকাশ সমান ক্ষোভ হামিদার! শুধু আজ রাত কেন, সারা জীবনের জন্য রবিন ওর চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যেত!

দুদিন বাদে দাদাজানের মৃত্যু বার্ষিকি। প্রতিবারই ঘটা করে পালন করা হয়। এতিম, মিসকিনসহ গ্রামের গণ্যমান্য লোকদের দাওয়াত করে খাওয়ানো হয় এদিনে। এ বাড়ির মেঝো মেয়ে থাকে জেলা শহরে, ছোট ছেলে ঢাকাতে। আগামীকাল তারা আসবে। তাই আজ থেকে চাচিজানের মাথা ধরেছে। এক বাড়ি মানুষ দেখলেই তার মাথা ধরে। সব তখন হামিদা আর কাজের লোকদের করতে হয়। হামিদার কাজ করতে কষ্ট হয় না। কষ্ট হয় পিতাকে সামনে দেখেও তার আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে। ওর পিতা ও এ বাড়ির ছোট ছেলে মর্তুজা মাহমুদ ভূঁইয়া দু বছর হয় এ বাড়িতে কোনো উপলক্ষেই আসে না। কারণটা যে হামিদা তা ও ঠিক জানে। এবারো আসবে কি না নিশ্চয়তা নেই। তবে এত খারাপ লাগার মাঝেও ভালো লাগে সৎ মা সুরাইয়া মৌলি ও সৎ দুই বোনকে কাছে পেয়ে। ওরা যেন সৎ এর চলিত অর্থই বদলে দিয়েছে। হামিদাকে আপনের মতো ভালোবাসে। হামিদার সৎ দু বোনের বয়স দশ বছর। জমজ ওরা। কী মিষ্টি দেখতে! হামিদাকে দেখলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। কত গল্প শোনায়। ওই কয়েকদিন হামিদা ওদের সান্নিধ্যে থেকে ভুলে যায় এ বাড়ির কাজের লোক নয় বরং মেয়ে ও।

"হামিদা!"

জুবিনের গলা শুনে সচকিত হয় হামিদা। আলু কাটছিল। সিদ্ধ দেবে। আরেকটু হলে আঙুল কেটে ফেলত।

"কিছু লাগবে জুবিন ভাই!"

হামিদা উঠে দাঁড়িয়ে জড়সড় হয়ে জিজ্ঞেস করল। দৃষ্টি আনত। জুবিনের বলতে ইচ্ছে করল,

"তোকে চাই আমি হামিদা। কেন বুঝিস না!"

জুবিন হুইলচেয়ার ঠেলে কাছে এলো না। সেদিন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বড্ড পস্তাচ্ছে।

"কী রান্না করছিস!" আগের মতো সহজ হতে চায় জুবিন। হামিদা হয় না।

"ভাত, আলু ভর্তা আর ডাল। আপনার জন্য বিকেলের মাছের তরকারি আছে।"

"ওসব বাদ দে। বিরিয়ানি আর পায়েস রান্না কর।"

"কিন্তু!"
হামিদা চোখ তুললো এবার। জুবিনের বুকের ওপর চাপা ভারটা আস্তে আস্তে হালকা হয়ে এলো। মুচকি হাসল,

"কিন্তু টিন্তু ছাড়। আমি যা বলেছি তাই কর। ও শোন, গোরুর গোশতের বিরিয়ানি করবি। যা লাগবে জব্বার চাচাকে দিয়ে এক্ষুণি এনে নে। আর কেউ যদি তোকে কিছু বলে, বলবি আমি বলেছি। ঠিক আছে?"

হামিদা হ্যাবলার মতো চেয়ে রইল। তারপর সজোরে মাথা নাড়িয়ে বলল,

"আচ্ছা, ঠিক আছে!"

জুবিন হাসল। ওর সেখানে দাঁড়িয়ে হামিদার রান্না দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাতে হামিদার অস্বস্তি হবে। তাই সেই কারাগারের মতো ঘরটায় ফিরে যেতে লাগল। পথে থামল। দাদিজানের ঘরটা পশ্চিমে। নিজের ঘরে আর গেল না জুবিন। হুইলচেয়ার ঠেলে চললো দাদিজানের ঘরের দিকে।

চলবে...

18/06/2025

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল -১
________________________

কিছু মাস ধরে অরু খুব ডিপ্রেশনে আছে৷ তার ডিপ্রেশনের কারণ দাঁড়ালো তন্ময়ের সামনে গেলেই কিছু না কিছু উদ্ভট কান্ডকারখানা সে করে বসে৷ যা খুবই বিব্রতকর৷ বিব্রতবোধ করতে করতেই মুলত তার ডিপ্রেশন চলে এসেছে৷ যেমন প্রতিদিনের মতো গত সপ্তাহে সে তন্ময়ের বাসায় পড়তে গিয়েছিল৷ পড়ার একফাঁকে তার হাঁচি এলো৷ হাঁচি দিতে গিয়ে খেয়াল করলো, হাঁচির সাথে সর্দি বেরিয়ে গিয়েছে৷ এমতাবস্থায় সে হাত আর নাকমুখ থেকে সরাতে পারছে না৷ লুকিয়ে ওড়না বা জামায় যে মুছবে তারও উপায় নেই৷ তন্ময় সামনেই বসে কফি খাচ্ছিলো৷ বিষয়টি তন্ময়ের চোখে পৌঁছাতেই সে পেছন থেকে টিস্যু এগিয়ে দিলো৷ তারপর কফি হাতে বেরিয়ে গেল৷ বিষন্ন মন নিয়ে নাক পরিষ্কার করা অরুর জীবনে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি ইদানীং হয়েই চলেছে৷ যেমন পরশু তার টেস্ট ছিলো৷ তন্ময় তাকে মনোযোগ সহকারে পড়াচ্ছিল৷ অরুও মনোযোগ দিয়ে পড়ছে৷ তাদের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ পড়ালেখা চলছে৷ এমন সময় অরু শব্দ করে উঠলো৷ এখন সেটা কীসের শব্দ ছিলো তা বুঝতে বাকি নেই কারো৷ শব্দ শুনেও না শোনার ভাণ করে পড়িয়ে চলেছে তন্ময়৷ কিন্তু অরু আর পড়তে পারল না৷ হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বইপত্র গুঁছিয়ে বেরিয়ে পড়লো৷ সেই যে বেরিয়েছে লজ্জায় সে এখনো তন্ময়ের সামনে যেতে পারছে না৷ বাড়িতে সারাদিন থাকে তখন তো এটা হয়না৷ তাহলে তন্ময়ের সামনে গেলেই কেন হবে? নির্লজ্জ শব্দ একটা। লজ্জায় হতভম্ব অরু নিজের উপরেই চরম বিরক্ত৷ বিরক্ত তাকে বিরক্ত করতে চলে এসেছে দীপ্ত৷ দীপ্তর হাতে নিউজপেপার৷ নিউজপেপারের এক অংশে বড় করে শাবিহার ছবি দেওয়া হয়েছে৷ তন্ময়ের ছোট বোন শাবিহা একজন জার্নালিস্ট৷ জার্নালিস্ট তাকে পত্রিকায় দেখতে পাওয়া আসলেই প্রশংসনীয়৷ আর্টিকেলটায় ছোটছোট শব্দে প্রশংসা করা হয়েছে শাবিহার৷ দীপ্ত গলা পরিষ্কার করে উচ্চস্বরে আর্টিকেল পড়তে শুরু করলো৷ সম্পুর্নটা শুনে অরু তার বোনের উপর গর্বিত৷ ব্যাগে বইপত্র গুঁছিয়ে নিয়ে দীপ্তর সামনে এসে দাঁড়ালো৷ দীপ্তর হাত থেকে নিউজপেপার নিয়ে নিজে কয়েকবার দেখল৷
- মাথা নষ্ট করা সুন্দরীকে বুক ভেঙে ফেলার যন্ত্র লাগছে একদম৷ আপুর এই ছবিটা কিন্তু আমার ভিষণ পছন্দের!
- আমারও তো পছন্দের৷
- বড় চাচ্চুকে দেখিয়েছিস?
- সবাই দেখেছে৷ শুধু তুমি মাত্র দেখছ৷
হুট করে অরুর বিষন্নতা আবারো ফিরে এলো৷ যদি সে দীপ্তকে বলতে পারতো তার বিষন্ন মনের কারণ তাহলে হয়তো একটু মনে শান্তি পেত৷ তারপর ভাবল দীপ্ত ছোট হলেও ছেলে মানুষ৷ হেসে তাকে নিশ্চয়ই বলবে,
- ছিঃ! তুমি বায়ু দূষণ করে ফেললে তাও তন্ময় ভাইয়ের সামনে ?
তখন তো অরু লজ্জায় জিন্দা মরে যাবে৷ বিষন্ন মনকে শান্ত করে বললো,
- আকাশ ভাইয়া কোথায়? বেরিয়েছে?
- হ্যাঁ৷
- আপুও বেরিয়েছে?
- হ্যাঁ৷
- এই আপুকে ফোন করে বল আজ আমাদের ট্রিট দিতে৷
- তোমার বলতে হবেনা৷ এটা আগেই বলে রেখেছি৷ আপু বলেছে রাতে ফেরার সময় পিজ্জা কোক এবং বার্গার আনবে সবার জন্য৷
- আচ্ছা। তুই এখনো বাড়িতে কেন? স্কুল যাসনি?
- আমার ডায়রিয়া হয়েছে৷ আজ বড় চাচ্চু ছুটি নিয়ে দিয়েছে৷
অরুর মন খারাপ হয়ে এলো৷ তার ডায়রিয়া হয়না কেন? ডায়রিয়া হলে দীপ্তর মতো সেও রেস্ট নিতে পারতো এই সুন্দর ওয়েদারে৷ আফসোস পেটে জমিয়ে কাঁধে ব্যাগ চেপে বেরিয়ে পড়লো কলেজের উদ্দেশ্যে৷ সাধারণত ড্রাইভার চাচা অরুকে আর দীপ্তকে একসাথে স্কুল দিয়ে আসে৷ কারণ তাদের স্কুল, কলেজ এবং ভার্সিটি একসাথেই৷ তবে মাঝেমধ্যে অরু বাইসাইকেল করে কলেজ যেতে সাচ্ছন্দ্য অনুভব করে৷ যেমন আজ সে সাইকেল নিয়ে চললো৷ হুট করে তার আরেকটি বিব্রতকর পরিস্থিতি মনে পড়লো৷ মাস খানেক আগের ঘটনা৷ অরু তন্ময়ের জন্য নিজে হাতে কফি করেছে৷ এবং কফিটা ঠিক টি-টেবিলের উপরে রেখেছিলো৷ তন্ময় গোসল সেড়ে কফি নিয়ে অরুর সামনে বসেছে৷ অরুও পড়ার ফাঁকেফাঁকে চুলগুলো আলতো করে গুঁছিয়ে নিচ্ছে৷ আশায় আছে কফির প্রশংসা শুনবে তন্ময়ের মুখ থেকে৷ তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে খেয়াল করলো তন্ময়ের কফির মগে একটা বড় চুল৷ যেটা দেখে বোঝা যাচ্ছে তার মাথার৷ এই চুল দেখলে তন্ময় কফি আর খাবেনা এরজন্য সে দ্রুত চুলটা সরিয়ে ফেলতে চাইছে৷ বুদ্ধি করে এগিয়ে গেল সামনে৷ তন্ময় কফি মুখে নিয়েছে আর অরু কফির মগ ধরেছে৷ ছোট মগ দুজনের ধরায় দুজনেই একই মুহুর্তে আবার ছেড়ে দিয়েছে৷ গরম কফির মগ পড়ল তন্ময়ের গুপ্ত স্থানে৷ বড়বড় চোখ করে চেঁচিয়ে উঠলো অরু৷ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ঝাড়তে লাগলো তন্ময়ের গুপ্ত স্থানের উপর৷ হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ বসে থেকে তন্ময় উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেল৷ মাথাটা ঠান্ডা হতেই অরুর মস্তিষ্ক জ্বলে উঠলো৷ তারপর হাতটা ধরে সে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ৷ তারপর হাতটি বিছানায় ফেলে নিঃশব্দে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো৷ ওটা কী তার ধরার মতো যায়গা? দুঃখে কষ্টে অরু তারপর একসপ্তাহ পড়তে যায়নি৷ সেই লজ্জাজনক পরিস্থিতি মনে করে অরুর ডিপ্রেশন বেড়ে চলেছে৷ সাইকেল নিয়ে কলেজের ভেতর ঢুকে মারজিকে দেখল৷ সে সাইকেল পার্ক করছে৷ অরু ওর পাশে সাইকেল পার্ক করে বললো,
- ব্যাপার কী তোর? কাল কলেজ আসলি না যে?
- ডায়রিয়া৷
- আরে ভাই! আমাকে বাদে সবার ডায়রিয়া৷ ডায়রিয়া কী আমার সাথে শত্রুতা করেছে? দীপ্তরও ডায়রিয়া হয়েছে৷
- তুই সেধে ডায়রিয়া চাইছিস? ফালতু মেয়ে!
- চাইব না? ডায়রিয়া হলে যদি কলেজ মিস দেওয়া যায়, তাহলে আমি সেটাই চাই৷
- পাগল! জানিস সুমনা নতুন প্রেম করছে!
- কার সাথে?
- স্কুলের সহযোগী শিক্ষক মুবিন স্যারের সাথে৷
অরু নিশ্চুপ হয়ে গেল৷ সুমনা তার কাজিন৷ কাজিনকে নিয়ে কী কেউ গসিপ করে? হয়তো কেউ করেনা৷ কিন্তু সে করে৷ করার অবশ্য অনেক কারণ আছে৷ সুমনা আর তার কখনো বনে না৷ বনবে কীভাবে? সুমনার চলাফেরা আর তার চলাফেরায় আকাশপাতাল তফাৎ৷ এই মেয়ে দু'একদিন পরপর নতুন প্রেমে জড়ায়৷ ওর নামে কতো খারাপ আলাপ-আলোচনা শোনা যায়৷ এর উপর বেশ কয়েকবার তন্ময়কে স্যাডুইউসডও করতে চেয়েছে৷ তাও তার চোখের সামনে৷ তন্ময় কখনো পাত্তা দেয়নি বিদায় সুযোগ পায়নি৷ নাহলে অরুর মনে হয় তন্ময়কে নিজের সব বিলিয়ে দিতো, না চাইতেই৷ পেছন থেকে কেউ তার নাম ডাকল৷ অরুর সঙ্গে মারজিও পেছনে তাকাল৷ অয়ন সাদা শার্ট-প্যান্ট, গলায় টাই ঝুলিয়ে কাঁধে ব্যাগ চেপে এগিয়ে আসছে৷ অয়ন তাদের সিনিয়র৷ অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে এবার৷ আবার তাদের বাড়িও পাশাপাশি৷ এক ছাঁদ থেকে অন্য ছাঁদে লাফিয়ে আসা যাবে এমন সিচুয়েশন৷ তাদের পরিবারের মধ্যেও বেশ সুন্দর একটা বন্ডিং আছে৷ মজার বিষয় হচ্ছে অয়নের পিছেও সুমনা পড়েছিল৷ কিন্তু অয়নের পাত্তা পায়নি৷ অরু হেসে তাকাতেই অয়ন বললো,
- ট্রিট কই?
- আমাকে বলে লাভ নেই অয়ন ভাইয়া৷ আপুকে গিয়ে বলতে হবে৷ জার্নালিস্ট সে, ছবি পত্রিকায় তার ছেপেছে৷ পাকাপোক্ত ভাবে নিজেকে স্যাটেলও করে নিচ্ছে। আর তুমি আমার থেকে ট্রিট চাও?
- তোর আপুকে বুঝি পাওয়া যায়?
- আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে৷ ট্রিট দিবে৷ ছাদে আমাদের আড্ডা হবে আজ৷ তোমাকে ইনভাইটেশন দিলাম৷ চলে আসিও৷
অয়নের চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো৷
- সত্যি?
- পাক্কা৷
- তাহলে আমি কিন্তু চলে আসবো৷ ঠিক এক্সাক্ট সময় বল৷
- নয়টা?
- আচ্ছা৷
অয়ন বন্ধুদের দিক চলে গেল৷ যেতে নিয়ে আরেকবার শিয়রিটি দিলো, সে কিন্তু চলে আসবে৷ অরু হেসে মাথা দোলাল৷ মারজি অরুর পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বললো,
- দেখ সুমনা এদিকে তাকিয়ে৷
অরু হাসলো৷
- ওর ক্রাশ সেধে এসে কথা বলছে আমাদের সাথে তাই জ্বালা করছে ওর৷
দুজনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো৷ হাসতে হাসতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে৷ যেমন আজকের মতো আনন্দ তারা আর পায়নি জীবনে৷
------------
শাবিহা মাত্রই অফিস থেকে বেরিয়েছে৷ এখন সন্ধ্যা ছ'টায়৷ কিছু খেয়ে আবার অফিসে ঢুকবে৷ মুলত তাদের ব্রেক টাইম এখন৷ হেঁটে বাস স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়ালো৷ রাস্তা পাড় হয়ে ওপার যাবে৷ এমন সময় তার ফোন বেজে উঠলো৷ স্ক্রিনে ' তন্ময় ভাই ' লেখাটি ভেসে উঠেছে৷ শাবিহা কল রিসিভ করলো৷
-- হ্যাঁ ভাই৷
-- কোথায় তুই?
-- অফিস থেকে বেরোলাম মাত্র৷ ব্রেক টাইম এখন৷ বাস স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷
-- আশেপাশেই আছি৷ দাঁড়িয়ে থাক আসছি আমি৷
-- আচ্ছা৷
শাবিহা কল কেটে পাশে তাকাল৷ তার থেকে কিছুটা দূরে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে৷ পরনে সাদা হুডি৷ আঁড়চোখে তার দিকেই তাকাচ্ছে৷ ছেলেটিকে চিনতে সময় লাগলো না শাবিহার৷ সময় লাগবে কীভাবে? দিনে দুএকবার এই ছেলে ওর সামনে চলে আসবে কোনো না কোনো অজুহাত নিয়ে৷ সবই বুঝে শাবিহা৷ একটা ছেলে বারবার সামনে কেন আসছে বা কেন তাকে ফলো করছে, বা কেন তার দিক বারবার তাকায় এগুলো বুঝতে পারে সে! বুঝলেই বা কী? ভাবতেই শাবিহার লজ্জা লাগে৷ সে এইবার মাস্টার্স প্রথম বর্ষে৷ অয়ন মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে৷ বাচ্চা ছেলে৷ মাত্র গ্রো-আপ করছে৷ চেহারায় এখনো বাচ্চামো ভাব৷ ক্লিন শেভে তাকে বাচ্চা তো লাগবেই৷ তার উপর শাবিহার সন্দেহ জাগে, এই ছেলের মনে হয় এখনো দাড়িও গজায়নি৷ নেহাতি বাচ্চা ছেলে৷ তার উপর ছোট থেকে ওকে বড় হতে দেখেছে৷ খারাপ কোনো ব্যবহার করতেও দ্বিধাবোধ হয়৷ একপ্রকার সে জালে আটকে৷ একটা কাটা তার গলায় আটকে৷ না পারছে কাটা ফেলতে আর না পারছে গিলতে৷ প্রতিদিনের মতো অভিনয় সুরে বললো,
- অয়ন তুমি এখানে?
অয়ন ভদ্র ছেলের মতো এগিয়ে সামনে দাঁড়ালো৷ প্রত্যেকদিনের মতো মিথ্যে একটা বলে দিল৷
- বন্ধুকে ড্রপ করতে এসেছিলাম৷
- ওহ্ আচ্ছা৷
- কংগ্রাচুলেশনস৷
- থ্যাংকইউ৷
- ইউ ডিজার্ভ ইট৷
শাবিহা হাসলো৷ হেসে বললো,
- থ্যাংকস৷
তন্ময়ের পৌঁছাতে দশ মিনিট লেগেছে৷ তাকে দেখেই বাইকের পেছনে উঠে বসলো শাবিহা৷ তন্ময় হুট করে অয়নকে খেয়াল করলো৷ যে আপাতত বাইকে বসে এখানে মাত্রই পৌঁছেছে এমন ভঙ্গিমা করছে৷
-- তুই এখানে যে?
-- হয়েছে কী ভাই! বন্ধু সজিবের এখানে দরকার ছিলো৷ ড্রপ করতে এসেছিলাম৷
-- তুই কী এখন বিজি?
-- না ভাই৷ বাসায় যাচ্ছিলাম৷
-- তো আয় আমাদের সাথে৷ আজ শাবিহা নামকরা জার্নালিস্টদের মধ্যে একজন হতে পেরেছে৷ নিউজপেপার দেখেছিস? আম প্রাউড অব হার৷ তাই ওকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট যাচ্ছিলাম৷ আয় সাথে৷ ট্রিট দেই৷
-- আচ্ছা ভাই৷
তন্ময় বাইক স্টার্ট করে যেতেই অয়ন ও বাইক স্টার্ট করে পেছন পেছন চললো৷ বসুন্ধরার সামনে একটা রেস্টুরেন্টে বাইক থামাল৷ অয়নও এসে পাশেই থেমেছে৷ তন্ময় বাইক লক করে হেলমেট এবং চাবি নিয়ে শাবিহার দিক তাকাল৷ সারাদিন কাজ করে শাবিহার চোখমুখ ক্লান্ত৷ বোনের কাঁধ চেপে রেস্টুরেন্টের ভেতরে নিতে নিতে তন্ময় বললো,
-- কী দরকার এতো কষ্ট করার? পড়াশোনা মন দিয়ে কর শুধু৷
-- তোমারও তো এতো কাজ করার প্রয়োজন নেই৷ বাবার এতো টাকাপয়সা ফেলে, কেন করো?
-- তুই জানিস কেন করি!
-- তাহলে তুমিও জেনে নাও আমি কেন করি৷
তন্ময় তর্ক করতে জানেনা৷ অল্পতেই হাড় মেনে যায়৷ একটি সাইলেন্ট কর্নার বেছে নিল৷ সেখানেই তিনজন বসলো৷ শাবিহা বসে তন্ময়ের ঘামে ভেজা মুখ দেখে মন খারাপ করে ফেললো৷ কখনো গাড়ি ছাড়া চলাচল না করা তার ভাই এখন এতো কষ্ট করে অফিস করে ভাবতেই, শাবিহার শ্বাস আটকে আসছে৷ ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে তন্ময়ের কপালের ঘাম মুছে দিল৷
-- অফিসে অনেক প্রেসার বুঝি?
-- হ্যাঁ একটু আকটু৷
-- মা কেমন আছে?
-- ভালোই৷ তোর চিন্তা করে সারাদিন৷
-- বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে না ভাইয়া?
তন্ময় ওয়েটার ডাকল৷ শাবিহার কথাটি সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করলো৷ শাবিহা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চোখ ফেরাতেই অয়নের উপর নজর পড়লো৷ তার দিকই তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে৷ চোখ দিয়েই খেয়ে ফেলবে যেমন৷ শাবিহার ইদানীং মনে হচ্ছে এই ছেলে নিজ থেকে থামবে না৷ তাকে খোলাখুলি ওর সাথে কথা বলতে হবে৷ তন্ময় মেনু এগিয়ে দিয়ে বললো,
-- কি খাবি অর্ডার দে৷
শাবিহা বললো,
-- ট্রিট তো আমার দেওয়ার কথা!
-- তুই ট্রিট দিবি তাও আমাকে?
-- আমাকে এখনো ছোট ভেবে রেখেছ?
-- আমার কাছে ছোট্টো তুই!
-- হু৷
ওয়েটার অর্ডার নিয়ে যেতেই তন্ময় এবার অয়নের দিক ফিরল৷
-- পড়াশোনা কেমন চলছে অয়ন?
-- ভালো ভাই৷
-- একমাত্র ছেলে তুই তোর বাবার৷ অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা তোর উপর৷ তাই মন দিয়ে পড়াশোনা করবি৷
-- জি৷
-- তা প্রেম-ট্রেম করছিস নাকি?
-- ন..না ভাই৷ একদম না৷
-- কেন কাউকে ভালো লাগেনা?
-- ভালো তো লাগে৷
-- কাকে?
-- আছে একজন৷ কিন্তু এগোনোর সাহস পাচ্ছিনা৷
-- আজকাল প্রপোজ করতে সাহস লাগে নাকি?
-- না আমার পছন্দের মানুষ খুব রাগী স্বভাবের৷ যদি উল্টাপাল্টা রিয়েকশন করে?
শাবিহা কেশে উঠলো৷ তন্ময় কথা বন্ধ করে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো৷ পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করে শাবিহা টপিক ঘুরিয়ে ফেললো৷
-- ভাইয়া আমি কিছু পার্সেল নিব অরুদের জন্য৷ এখন নিলে তো ঠান্ডা হয়ে যাবে তাই না? ভাবছি ছুটি হলেই নিয়ে ফিরবো৷ ওদের আজ ট্রিট দিতেই হবে৷ আমার অপেক্ষায় নিশ্চয়ই বসে একেকটা৷
তন্ময় বললো,
-- এই অরু পড়তে আসছে না যে?
-- কি জানি!
-- গিয়ে বলিস আজ টাইম মতো চলে আসতে৷
-- তুমি ওকে কেন পড়াচ্ছ? এভাবেই সারাদিন অফিস করো৷ বাসায় ফিরে রেস্ট করবা তা না! তুমি জানো অরুর দেখাদেখি এখন দীপ্তও তোমার কাছে পড়তে চায়?
তন্ময় হেসে বললো,
-- ও তো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট৷ ওকে আমার পড়াতে কেন হবে? অরু হায়ার ম্যাথম্যাটিকসে বেশ দুর্বল৷ টিচার্সদের পড়ানো বোঝেনা বিদায় ওকে আমার আলাদা পড়ানো৷
---------
সাতটা ত্রিশে অরু কাঁধে ব্যাগ চেপে বেরিয়েছে৷ তার উদ্দেশ্য তন্ময়ের বাসা৷ বেশিদূর না এখান থেকে৷ সাইকেল করেই চলে যাওয়া যায়৷ এতক্ষণে নিশ্চয়ই তন্ময় কাজ থেকে চলে এসেছে? অরুর একটু সংকোচ অনুভব হচ্ছে৷ কিন্তু এতো সংকোচ অনুভব করলে, হায়ার ম্যাথম্যাটিকসে আবারো চল্লিশের নিচে পাবে৷ তন্ময় ছাড়া সে কারো থেকে পড়া বুঝে না৷ তার টিচার্সরা তাকে হায়ার ম্যাথম্যাটিকস বোঝায় নাকি গরুর ঘাস খাওয়ায় অরু বুঝে পায়না৷ তার তো ইচ্ছে করে সব কয়টা সাবজেক্ট তন্ময় থেকে পড়তে৷ কিন্তু তন্ময়ের সময় কই? আগের দিন গুলো মনে পড়তে লাগল অরুর৷ যখন তারা সবাই একসাথে একই ছাঁদের নিচে থাকতো৷ তন্ময়কে ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পেতো৷ সন্ধ্যার পর তন্ময় সবাইকে পড়াতে বসাতো৷ কই সেই দিন গুলো? তাদের পরিবার না ভাঙলে কী চলছিলো না? এই দন্ড, ঝগড়াবিবাদ না হলে কী পারতো না? অরু খুব করে চায় বড় চাচ্চু আর বড় মায়ের যেন ভুল বুঝাবুঝি শেষ হয়ে যায়৷ আর কত? দুটো বছর তো হয়ে গেল৷ আর কত অপেক্ষা?
অরু একটা আটতলা বিল্ডিংয়ের সামনে সাইকেল থামাল৷ তাকে চিনে দারোয়ান ঢুকতে দিলো৷ ঢুকে সাইকেল লক করে লিফট ধরলো৷ তন্ময়দের ফ্ল্যাট পাঁচতলায়৷ সেখানে পৌঁছে কলিং বেল চাপলো৷ দরজা খুলে দিয়েছে জবেদা বেগম৷ অরুর বড় মা৷ অরু ব্যাগ ফেলে জাপ্টে ধরলো তাকে৷
- ভেতরে আয় আগে৷
গলা জাপ্টে ধরেই ভেতরে গেল৷ চারপাশে নজর বুলিয়ে বললো,
- কই তন্ময় ভাই?
- আসছে বললো৷ তুই পড়তে বোস৷ এখনই চলে আসবে৷
অরু টেবিলে বসে সরঞ্জাম তৈরি করছে৷ প্রথমে চুল বাঁধলো৷ যেনো চুল টুল কোথাও না উড়ে যায়৷ তারপর টিস্যু এগিয়ে রাখল সামনে৷ যদি কাশি চলে আসে? টিস্যু কাজে দিবে৷ কিন্তু বায়ু দূষণ প্রতিরোধ কীভাবে করবে? সে ভেবে রাখল, বায়ু দূষণ শুরু হবার আগেই উচ্চস্বরে কথা বলে, তন্ময়কে শুনতেই দেবেনা৷

চলবে

Address

Sirajganj

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when সোতস্বিনী -Srotosini posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share