08/10/2025
“বাবার নীরব হাত”
রিদয় ছোটবেলায় সবসময় মাকে জড়িয়ে থাকত। মা তাকে গল্প শোনাতেন, মুখে ভাত তুলে দিতেন, স্কুলে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু বাবা?
বাবা ছিলেন নীরব এক মানুষ—রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে, মাঠে-ঘাটে সারাদিন কাজ করে ঘরে ফিরতেন, মুখে হাসি থাকত, কিন্তু চোখে ক্লান্তি।
রিদয় তখন বুঝত না। সে ভাবত, বাবা তাকে ভালোবাসেন না, কারণ বাবা কখনো বেশি কথা বলেন না, কখনো কোলে নেন না।
একদিন সকালে স্কুলে যেতে দেরি হচ্ছিল। বাবা বললেন,
“পা চালা, দেরি হইলে শিক্ষক বকবে।”
রিদয় রাগ করে বলল, “আপনি তো কখনো ভালোভাবে বলেন না, সবসময় ধমক দেন!”
বাবা চুপ করে ছিলেন, শুধু বলেছিলেন,
“একদিন বুঝবি, কেন ধমকাই।”
সময় গেল।
রিদয় বড় হল, শহরে পড়তে গেল। বাবা তখনও ভোরে উঠতেন, চুপচাপ ছেলের খরচ পাঠানোর জন্য খাটতেন।
কখনো নিজের জন্য নতুন কাপড় কিনতেন না, নতুন জুতোও না—বলতেন,
“রিদয়ের লাগি টাকা জমাইতেছি।”
বছর পরে রিদয় চাকরি পেল। ফোনে বাবা শুধু বলেছিলেন,
“আল্লাহর শুকরিয়া। এখন তুই সুখে থাক।”
আর কিছু না।
বাবা-মা’র জন্য টাকা পাঠাত সে, কিন্তু বাবা কখনো কিছু চাইলেন না।
বলতেন,
“তোর টাকা তুই রাখ, আমি খাইতেছি গ্রামের বাতাসে।”
কিন্তু একদিন হঠাৎ খবর এলো—বাবা অসুস্থ।
রিদয় ছুটে গেল।
বাবা তখন বিছানায়, মুখে হাসি, চোখে জল।
রিদয় কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“বাবা, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি… আপনি কত কষ্ট করেছেন আমার জন্য!”
বাবা দুর্বল কণ্ঠে বললেন,
“বাবা, আমার সুখ তুই। তোর জন্য খাটছি বলে কষ্টটা কখনো কষ্ট লাগেনি।”
বাবা চোখ বুজলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই।
রিদয় সেই মুহূর্তে প্রথমবার বুঝল— বাবা কখনো বলেন না, কিন্তু তার ভালোবাসা পৃথিবীর সব শব্দের চেয়ে গভীর।
আজ রিদয় প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবার পুরনো হাতঘড়িটা পরে কাজে যায়।
বাবার সেই নীরব হাতের ছোঁয়া যেন তার জীবনের দিশা হয়ে গেছে।
বাবা হয়তো চুপ করে থাকেন, কিন্তু তাঁর নীরবতায় থাকে পুরো পৃথিবীর মমতা।
বছর কেটে গেছে। এখন রিদয় নিজেই একজন বাবা।
তার ছোট ছেলে, অর্ণব—বয়স মাত্র সাত।
রিদয় প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার আগে ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসে। ছেলেটা মাঝে মাঝে রাগ করে বলে,
“বাবা, তুমি সারাদিন অফিসে থাকো, আমার সাথে খেলো না।”
রিদয় হাসে, কিন্তু বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে ওঠে।
তার মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা—
সে-ও একদিন এমনই রাগ করেছিল নিজের বাবার উপর।
রাতে অর্ণব ঘুমিয়ে গেলে রিদয় তার মাথায় হাত রেখে বসে থাকে।
চুপচাপ ভাবে, “বাবা, তুমি যেমন আমার জন্য খাটেছো, আমিও আজ সেই পথে হাঁটছি।”
একদিন স্কুলের ফি দিতে গিয়ে টাকার টান পড়ল।
অফিসের প্রেশার, সংসারের দায়—সব মিলিয়ে মাথা ভারী।
কিন্তু সে থামেনি।
বাবার মতোই ভোরে উঠে কাজে গেল, মন বলল—
“কষ্ট না করলে সন্তান হাসবে কীভাবে?”
সেদিন রাতে ছেলেটা এসে বলল,
“বাবা, তুমি আমার হিরো।”
এই একটা বাক্য শুনে রিদয়ের চোখ ভিজে গেল।
সে মনে মনে বলল,
“বাবা, আমি এখন বুঝি— ভালোবাসা প্রকাশে নয়, ত্যাগে থাকে।”
বাবার পুরনো হাতঘড়িটা এখনও তার কব্জিতে ঝুলে থাকে।
যখনই ক্লান্ত লাগে, সে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে—
একটা অদৃশ্য মুখ হাসছে, যেন বলছে,
“ভয় পাস না, আমি আছি তো।”
রিদয় এখন জানে, বাবা মারা যান না—
তারা রয়ে যান ছেলের আচরণে, তার ত্যাগে, তার পরিশ্রমে।
বাবার ভালোবাসা ঠিক সেই ভোরের রোদের মতো—
চোখে লাগে না, কিন্তু সারাদিন উষ্ণতা দেয়।
শীতের এক বিকেল। আকাশে মেঘের ফাঁকে সূর্যের মলিন আলো।
রিদয় ছেলেকে নিয়ে গ্রামের পথে হাঁটছে—হাতে একটা ফুলের তোড়া।
অর্ণব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“বাবা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
রিদয় হালকা হাসল, বলল,
“তোর দাদার কাছে, যিনি একদিন আমার জন্য আকাশের নিচে ছায়া হয়ে ছিলেন।”
গাছপালায় ভরা সেই ছোট্ট কবরস্থানে এসে তারা দাঁড়াল।
রিদয় ধীরে ধীরে ফুলগুলো রাখল বাবার কবরের উপর।
চোখে জল এসে গেল, কিন্তু মুখে ছিল এক শান্ত হাসি।
“বাবা, আমি এসেছি… তুমি বলেছিলে, একদিন বুঝবি।
আজ বুঝেছি— ভালোবাসা মানে শুধু থাকা নয়, লড়ে যাওয়া।”
অর্ণব চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, বাবার চোখের জল দেখছিল।
তারপর ছোট্ট হাতটা রিদয়ের হাতের উপর রাখল,
বলল,
“বাবা, দাদাও কি তোমাকে খুব ভালোবাসতেন?”
রিদয় চোখ মুছে বলল,
“দাদার ভালোবাসা আমি এখনো টের পাই।
তুইও একদিন আমায় এমন করেই মনে রাখবি, তাই না?”
ছেলেটা মাথা নাড়ল।
রিদয় তার মাথায় হাত রেখে বলল,
“ভালোবাসা কখনো মরে না, অর্ণব।
বাবারা চলে যান, কিন্তু তাঁদের শেখানো পথটাই থাকে আমাদের ভেতরে।”
বাতাসে পাতার শব্দ হলো, যেন কোথাও থেকে একটা নরম কণ্ঠ ভেসে এল—
“বাবা, আমি তোর গর্ব…”
রিদয় চোখ বন্ধ করল।
সূর্যের শেষ আলো তার মুখে পড়ল,
আর মনে হলো—বাবা সত্যিই পাশে আছেন, নীরবে, আগের মতোই।