19/06/2025
ইট পাথরের তৈরি শ্যাওলা পড়া পুরোনো দুতলা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কৌশিকের গাড়ি। কৌশিক একবার চোখ বুলালো পুরো বাড়িতে। ঠিক কতদিন পর আবার নিজের বাড়িতে পা রাখল জানা নেই তার। আসতে পারবে এই ধারণাও ছিল না সবটাই আল্লাহর ইচ্ছে।
দরজার ঠকঠক আওয়াজ কানে আসতেই স্তম্ভিত ফিরে তাকালেন রুমি বেগম। আস্তে ধীরে উঠে এসে খুলে দিলেন দরজাটা। কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চেনাপরিচিত মুখগুলো দেখে মনে হলো খুশি হননি তিনি। রুমি বেগমই হলেন কাশফিয়া আর কৌশিকের মামী। বাড়িটা কৌশিকের আব্বু-আম্মুর উনারা মা′রা যান কার এ*ক্সি*ডেন্টে। মা′রা যাওয়ার পরে আত্মীয়-স্বজন অনেকেই তখন দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন কৌশিক আর ছোট্ট কাশফিয়ার। তখন না বুঝলেও এখন ভালো করেই বুঝে কৌশিক সবার লোক দেখানো ভালোবাসা, তাদের দায়িত্ব নিতে চাওয়া সবটাই ছিল ওর বাবার রেখে যাওয়া বাড়ি আর জমিজমার লোভে। তিনকোলে কেউ না থাকায় একমাত্র মামা মামীকেই কৌশিক নিয়ে এল নিজের বাড়িতে, দায়িত্ব দিল ওর ছোট্ট বোনটার। বেঁচে থাকতে হলে পড়াশোনা করতে হবে, ইনকাম করতে হবে এই চিন্তা সবসময়ই ছিলো কৌশিকের মাথায়। তাই তো বোনকে একা রেখে পাড়ি জমিয়েছিল দূর দেশে। বোনের অভিভাবক হিসেবে রেখে গিয়েছিলো ওর মামা-মামীকে, কিন্তু মামীর মনে যে বিষ, তা তো জানা ছিল না কৌশিকের। কৌশিকের অবর্তমানে তার ছোট্ট বোনটাকে বের করে দিল বাড়ি থেকে! সব কথাই কানে গেছে কৌশিকের। তাই তো আজকে কৈফিয়ত চাইতে এসেছে সবকিছুর। মামীর ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখে হাসল কৌশিক। বলল উনাকে,
"কি হলো মামী? আমি বেঁচে আছি দেখে অবাক হলে বুঝি?"
শুকনো ঢোঁক গিলে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন রুমি বেগম,
"তা... তা হব কেন কৌশিক।"
"ভিতরে আসতে বলবে না?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ, ভিতরে আসো। তোমাদের বাড়িতে তোমরাই তো আসবে এখানে, আমার অনুমতি লাগে বুঝি!"
মাথাটা ঘুরিয়ে ইনায়ার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাশফিয়ার দিকে তাকাল কৌশিক, তারপর আবার ওর মামীর দিকে তাকিয়ে বলল,
"অথচ আমার বাড়ি থেকে তুমি আমার বোনকে বের করে দিয়েছিলে। এমনটা কেন করেছিলে, মামী? আমার অনুপস্থিতে তুমি আমার বোনকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলে কোন সাহসে?"
কৌশিকের কথা বলার ধরণে ভয় পেলেন রুমি বেগম। ওর ধমকে কেঁপে উঠলেন তিনি। এখন কি কৌশিক বাড়ি থেকে বের করে দেবে উনাদের? অসুস্থ স্বামী আর বিয়ে উপযোগী মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবেন তিনি! রাস্তায় রাস্তায় হাঁটা ছাড়া যে উপায় থাকবে না আর। রুমি বেগমের কী যেন হলো, হুট করেই মেঝেতে বসে কৌশিকের পা দুটো ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলেন, বললেন বারবার,
"ক্ষমা করে দে বাবা, আমার ভুল হয়েছে। আমি এতকিছু ভাবিনি তখন। কাশফিয়া সুখে থাকবে ভেবেই বিয়ে ঠিক করেছিলাম ওর।"
"সুখে থাকবে বলে? নাকি নিজের মাথার উপর থেকে ঋণের বোঝা নামাতে বিক্রি করতে চেয়েছিলে আমার বোনকে? আমি বেঁচে থাকতে ওর সাথে এমন অন্যায় করার সাহস দেখালে কীভাবে, মামী? নাকি ভেবেছিলে আমি ম′রে গেছি? আমার বোনকে তাড়িয়ে সব কিছু দখল করবে বলেই কি এত আয়োজন?"
চুপ রইলেন রুমি বেগম। কী-ই বা বলবেন তিনি? এমনটাই তো চেয়েছিলেন মনে মনে। সব পেয়েও লোভ জেগেছিল উনার মনে। তিন মাস ধরে প্রাণপ্রিয় বোনের খোঁজ নিচ্ছিল না কৌশিক, উনার মাথায় এটাই এসেছিল, কোনো অঘটন ঘটেছে। কৌশিক হয়তো বেঁচে নেই আর। তাই তো করেছেন এত কিছু। তার শাস্তিও পেয়েছেন, স্বামী উনার অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন ঘরের এক কোণে, মেয়েটারও নানা অসুখ বিসুখ লেগেই আছে। আল্লাহ মেনে নিতে পারেননি উনার এত অবিচার তাই তো শাস্তি দিচ্ছেন এভাবে। মামীর কান্নায় করুণা হলো না কৌশিকের, কিন্তু কাশফিয়া, ওর মনটা যে নরম। মামীর কান্নায় কষ্ট পাচ্ছে কাশফিয়া নিজেও। কথার মাঝখানেই কোথা থেকে ছুটে এসে রুমি বেগমের মেয়ে খবর দিল উনাকে,
"আব্বুর অবস্থা খুব খারাপ আম্মু, তাড়াতাড়ি চলো।"
কান্না থামালেন রুমি বেগম, দ্রুত উঠে চলে গেলেন মেয়ের পিছু পিছু। কাশফিয়া, কৌশিক আর ওদের সাথে থাকা ইনায়াও গেল। দরজার সামনে আসতেই বিছানায় শুয়ে থাকা মামার ফ্যাকাশে চেহারাটা নজরে এল কাশফিয়ার। ভাবল মনে মনে —-"ইস, মানুষটা কেমন ছিলেন আর কী হয়ে গেলেন।"
ওর যে বড়ই কষ্ট হচ্ছে মামার জন্য। বুকটায় কেমন ব্যথা হলো কাশফিয়ার, কষ্টে কান্না এল চোখ বেয়ে। স্ত্রী-সন্তানের থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকালেন কাশফিয়ার মামা রাফসান সাহেব, কাঁপা কাঁপা হাতটা তুলে ডাকলেন ওদেরকে। কৌশিক আর কাশফিয়া দুজনেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করল, তারপর দৌড়ে গেল মামার কাছে। মামী যেমনই হোন, মামা তো বরাবরই বটগাছের মতো আগলে রেখেছিলেন ওদের। কাশফিয়া ওর মামার মাথার কাছটায় বসল, উনার হাত ধরে বলল আশ্বাস দিয়ে,
"মামা, তুমি ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আছি তো, এক্ষুণি তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাব।"
মলিন হাসলেন রাফসান সাহেব, বললেন ভাগ্নীকে,
"আমি তোকে দেখে রাখতে পারিনি রে মা। ক্ষমা করে দিস তোর এই অভাগা মামাকে।"
কথাটা বলেই বড় করে শ্বাস ছাড়লেন রাফসান সাহেব। কাশফিয়া বুঝল শ্বাস নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে উনার। মামার এমন অবস্থা দেখে কান্না করে দিল সে। কৌশিক মামাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল আবারও,
"এসব বলো না মামা, তুমি ভালো হয়ে যাবে।"
ইনায়া দাঁড়িয়ে দেখছে সবটাই। উনাকে হসপিটালে নিয়ে কাজ হবে না বুঝতে পারছে ভালো করেই। তবে উপস্থিত সবাই ভেঙে পড়বে তাই বলল না কিছুই। সময় পেরোল কিছুটা, রাফসান সাহেবের অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেল। বোনের কান্না আর মামার অবস্থা দেখে কৌশিক তৈরি হলো উনাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে বলে। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। শরীরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে এসেছে রাফসান সাহেবের, সারা শব্দ না পেয়ে কৌশিক হয়তো আন্দাজ করল কি ঘটেছে, চোখের ইশারায় কিছু বলল ইনায়াকে। দ্রুত এগিয়ে আসল ইনায়া, চেক করল রাফসান সাহেবকে শ্বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে উনার। বুঝতে বাকি নেই কারোরই, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন রাফসান সাহেব। কাছের মানুষের মৃত্যু যে খুব কষ্ট দেয় প্রত্যেকেই যেভাবে কষ্ট পাচ্ছেন রুমি বেগম, উনার মেয়ে আর কাশফিয়া। রাফসান সাহেবের দীর্ঘ দুই মাসের রোগভোগের অবসান হলো অবশেষে। কান্নায় ভেঙে পড়ল সবাই। কৌশিক দাঁড়িয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে, চোখের কোণে একরাশ অশ্রু জমেছে ওর। কে বলেছে ছেলেরা কাঁদে না? কাছের মানুষ হারানোর কষ্ট কেমন কৌশিক যে বুঝে, মা-বাবার পর আপন বলতে এই এক মামা'ই ছিলো ওদেন, উনিও আজ চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে!
---------
রাফসান সাহেবের মৃত্যুর পেরিয়ে গেছে এক সপ্তাহ, একটার পর একটা ধাক্কা দুর্বল করে দিচ্ছে কাশফিয়াকে। সবকিছু ছেড়ে ইয়াশের চলে যাওয়াটা যে খুব কষ্ট দিচ্ছে ওকে। পুড়াচ্ছে ভিতরটা। কী করলে অবসান ঘটবে এই কষ্টের? কীভাবে আবার কাছে পাবে ইয়াশকে? কাশফিয়ার রুমের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল কৌশিক,কাশফিয়ার রুমের পরেই ওর রুমটা। রাত প্রায় ১২টার কাছাকাছি হবে। এতো রাতে কাশফিয়ার রুমের দরজা খোলা দেখে চিন্তা হলো ওর, উঁকি মেরে দেখল মেঝেতে বসে আছে কাশফিয়া। চলন্ত সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভেবে যাচ্ছে। ভালো করে কাশফিয়াকে লক্ষ্য করল কৌশিক, মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালসিটে দাগ পড়েছে। লম্বা চুলগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। যে কেউ দেখলে বলে দেবে অনেক দিন হলো নিজের যত্ন নেয় না কাশফিয়া। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কৌশিক, ভাবল মনে মনে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে কি কাশফিয়ার চঞ্চলতাও কমে গেছে? কিন্তু বাড়ি ফেরার পর থেকে যে কৌশিক আগের চঞ্চল কাশফিয়াকেই মিস করে যাচ্ছে সারাক্ষণ। কৌশিক তো ভেবে এসেছিল, এতোদিন পর ওকে দেখে দৌড়ে এসে জাপ্টে ধরবে কাশফিয়া। কত শত অভিযোগ জানাবে তাকে। কিন্তু তা তো কিছুই হলো না। কাশফিয়ার মলিন চেহারার দিকে তাকালেই মনে হয় বিষণ্ণতা ঘিরে ধরেছে ওকে। কথাগুলো ভেবে বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠল কৌশিকের। ওর অনুপস্থিতিতে কী এমন ঘটেছে কাশফিয়ার সাথে? কেন এভাবে ভেঙে পড়েছে ওর বোন! কৌশিক কথা বলতে চাইল কাশফিয়ার সাথে, ওর রুমে যাবে বলে পা বাড়াতেই মনে হলো কেউ দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। মাথাটা ঘুরিয়ে তাকাল কৌশিক, দেখল ইনায়া দাঁড়িয়ে আছে ওর থেকে দুই আতিন হাত দূরে।ইনায়া ওর চোখের ইশারায় কাশফিয়ার রুমে যেতে বারণ করল কৌশিককে। কৌশিকও শুনল ইনায়ার কথা, একবার তাকাল মেঝেতে বসে থাকা কাশফিয়ার দিকে, পরে আবার রুমের দরজাটা আটকে চলে গেল ইনায়ার সাথে।
আকাশটা ঢেকে আছে অন্ধকারে, নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারিপাশে। ইনায়া আর কৌশিক দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে ছাদে। তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। অনেকক্ষণ হলো এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে দু’জনে। নিরবতা ভেঙে কথা বলল কৌশিক,
"আমার বোনটার কী হলো ইনায়া? ওর এই বিধ্বস্ত অবস্থা চোখের সামনে দেখতে পারছি না আমি।"
কৌশিকের কথার উত্তরে বলল ইনায়া,—- "ওকে একা থাকতে দাও কৌশিক। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।"
কথাটা বলেই চলে যাচ্ছিল ইনায়া, পথ আটকাল কৌশিক। শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরল, ভ্রু কুঁচকে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
"তোমার আবার কী হলো?"
"আমার ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে কৌশিক। আম্মু-আব্বু বারবার কল দিচ্ছেন।"
"আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে তুমি?"
"আমি এখানে থাকতে আসিনি কৌশিক।"
এক ঝটকায় কৌশিকের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল ইনায়া, পা বাড়াল আবারও চলে যাবে বলে। কানে এল কৌশিকের কণ্ঠস্বর,
"বিয়ে করবে আমাকে?"
থেমে গেল ইনায়ার পা জোড়া, চোখ-মুখে ওর খুশির ঝিলিক। কৌশিকের মুখে এই কথাটা শুনবে বলেই তো অপেক্ষা করছে সে। দেরিতে হলেও কথাটা শুনল তবে! ফিরে তাকাল ইনায়া, কৌশিক ওর কাছে এসে হাত দুটো ধরে বলল,
"আমার ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের আম্মু হবে ইনায়া? ভালোবাসবে আমাকে?"
মুচকি হাসল ইনায়া, উপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল কৌশিকের কথার। কৌশিকও হাসল ইনায়ার হাসির উত্তরে, ওকে আগলে নিল নিজের বুকে।
----------
কলেজে যাবে বলে রেডি হচ্ছে কাশফিয়া। সকালেই সিমির ফোন পেল সে, সুফিয়া বেগম নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন হুট করেই। উনাকেই দেখবে বলেই যাচ্ছে, হোস্টেলে যাওয়াটা বাহানা মাত্র। ইয়াশ না থাকলেও ওই বাড়ি আর বাড়ির মানুষগুলোর সাথে যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে সে। মায়ের মতো শাশুড়ি অসুস্থ শুনে মন ঠিকছে না ঘরে, তাই তো সকাল সকাল রেডি হচ্ছে ও বাড়িতে যাওয়ার জন্য। কৌশিককে তো আর বলা যাবে না ওর বিয়ের বিষয়ে, কৌশিক কেমন ভাবে নেবে বিষয়টা এটাও তো জানা নেই কাশফিয়ার। আয়নার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো কাশফিয়া,চুল গুলো ঠিক করে নিচ্ছিলো,তখনই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইনায়ার প্রতিবিম্ব দেখল সে। ঘুরে তাকাল ওদিকে, হেসে ভিতরে আসতে বলল ইনায়াকে। দুই হাতে কতগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে এসেছে ইনায়া। সবগুলো বিছানায় রেখে একটা একটা করে কাশফিয়াকে খুলে দেখাল সব। ওর পছন্দের সব জিনিসপত্র চকলেট, চুড়ি, কত রকমের কসমেটিক্স রাখা একেকটা ব্যাগে। অবাক হলো কাশফিয়া ইনায়া জানল কিভাবে ওর পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে? পরক্ষণেই আবার ভাবল, হয়তো ওর ভাই বলেছে। ইনায়া মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল কাশফিয়াকে,
"কেমন আছো উপমা?"
দ্রুত গতিতে মাথা তুলে তাকাল কাশফিয়া, হাসিমুখটা চুপসে গেল ওর। এই অতিপরিচিত ডাকনামটা যে কেবল ইয়াশের মুখেই মানায়। ইনায়া সেই নামে কেন ডাকছে ওকে? নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল কাশফিয়া,
"এই নামে আমাকে ডেকো না, ইনায়া আপু।"
"কেন? এই নামে স্পেশাল কেউ ডাকে বুঝি?"
চুপ করে রইল কাশফিয়া। ওর যে নামটা শুনলেই মনে পড়ে ইয়াশের কথা। পরে আবার নিজেকেই বকাঝকা দেয়,কেন ভাবে ওই স্বার্থপর মানুষটার কথা! ধ্যান ভাঙল কাশফিয়ার, ইনায়া ডেকে বলল ওকে,—-"এই মেয়ে, কী ভাবছ এতো?"
কথা কাটানোর জন্য বলল কাশফিয়া,—- "কই, কিছু না তো। তোমরা বিয়ে করছ কবে?"
"তোমার এক্সাম শেষ হলে।"
"আমার এক্সামের সাথে তোমাদের বিয়ের কী সম্পর্ক?"
"তোমার এক্সাম শেষ না হলে আমাদের সাথে লন্ডন যাবে কী করে?"
ইনায়ার কথায় হাসল কাশফিয়া। সময় নষ্ট করল না আর। ইনায়ার নিয়ে আসা জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রেখে চলে গেল সে কলেজের উদ্দেশ্যে।
---------
কথা ছিল কাশফিয়ার এক্সামের পরেই লন্ডনে ফিরে যাবে
কৌশিকরা। কিছুদিন হলো পরীক্ষা শেষ হয়েছে কাশফিয়ার। এরমধ্যে আবার ইনায়ার আম্মু আব্বু এসেছেন দেশে। কৌশিক ইনায়ার আংটিবদল হয়েছিল আগেই, বিয়েটাও ফেলে রাখতে চাইলেন না উনারা। কৌশিক ছেলেটা দেখতে সুন্দর, ভালো চাকরি করে, তার উপর আবার একমাত্র মেয়ের পছন্দ, তাই এই বিয়েতে বাধা দেননি কেউ-ই। সুন্দর মতোই বিয়ে হয়েছে ওদের। কৌশিক-ইনায়ার বিয়ের এক সপ্তাহ হলো, কাশফিয়ার পরীক্ষা শেষ হয়েছে অনেকদিন। রেজাল্টও বেরিয়ে যাবে হয়তো। তাই আর দেরি করলো না কৌশিক, আজকেই ওরা ফিরে যাবে লন্ডনে। বাড়িতে এখনও আছেন রুমি বেগম। উনি চিরকৃতজ্ঞ কৌশিকের কাছে এতো কিছুর পরেও যে ঠাঁই দেবে বাড়িতে, ধারণাতেও ছিল না উনার।
-----------
সময়টা সকাল, চারদিকে সুন্দর আবহাওয়া বিরাজ করছে। নির্জন, নিস্তব্ধ রাস্তাটা দিয়ে একা একা হেঁটে যাচ্ছে কাশফিয়া, কোলে ওর ছোট্ট একটা বিড়ালছানা। কাশফিয়া এই বিড়ালটার নাম দিয়েছে মমী। দিনের বেশিরভাগ সময়ই এই বিড়ালটার সাথে কথা বলে কাটায় সে। বাতাস বইছে চারদিকে, সেই বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে রাস্তার দুই পাশে থাকা গাছের ডালপালা গুলো দুলছে বারবার। লন্ডনে আসার পর আজকে দ্বিতীয়বার হাঁটতে বেরিয়েছে কাশফিয়া, তাও একা একা। কৌশিক বা ইনায়াকে বলে আসেনি কিছুই, ওরা চিন্তা করছে হয়তো! করলে করুন, কাশফিয়ার মনটা ভালো নেই। মন খারাপগুলো উড়িয়ে দিতেই প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছে সে। একটা সাদা কালো রঙের লং কুর্তি পড়েছে কাশফিয়া, গলায় সাদা রঙের একটা ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছে। কোমর পেরিয়ে যাওয়া লম্বা চুলগুলো খুলে দিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা অর্ধপরিচিত ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভেবে চলেছে। আগেরবার যখন ইনায়ার সাথে ঘুরতে বেরুল, এখানে এসেই দেখা হয়েছিল মমীর সাথে। তারপর আর কি,মমীকে ভালো লাগল কাশফিয়ার, অসহায়ের মতো একা একা ঘুরছিল মমী, তাই নিয়ে গেল নিজের সাথে করে। ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে এসবই ভাবছিল কাশফিয়া। ভাবল এবার চলে যাবে জায়গাটা ছেড়ে। অসাবধানতায় হোচট খেয়ে পড়ে যেতে নিল সে। কোনোভাবে আবার সামলে নিল নিজেকে, কিন্তু ওর হাতে থাকা বিড়ালছানাটা কোথায় যেন চলে গেল তখন। কাশফিয়া চারদিকে তাকিয়ে খুঁজল বিড়ালটাকে। না পেয়ে ভাবল এবার ফ্ল্যাটের ভিতরে গিয়েই খুঁজবে।
ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকে আশেপাশে মমীকে খুঁজল কাশফিয়া। পেয়েও গেলো সে, পা বাড়ালো মমীকে নিয়ে আসবে বলে, কিন্তু তখনই কেউ এসে কোলে তুলে নিল মমীকে। মমীর থেকে চোখ সরিয়ে ওই মানুষটার দিকে তাকাল কাশফিয়া, পিছিয়ে গেল কয়েক পা, চোখের সামনে এ কাকে দেখছে সে? ইয়াশ দাঁড়িয়ে আছে কাশফিয়ার থেকে কিছু দূরেই! কাশফিয়ার যে বিশ্বাসই হচ্ছে না কিছুই সে কি স্বপ্ন দেখছে? না, হয়তো সত্যিই দেখছে। ওর যে ইচ্ছে করছে ইয়াশের কাছে যেতে। ইয়াশকে জিজ্ঞেস করতে কেন এতো কষ্ট দিল ওকে? কেন এতো দিন পালিয়ে বেরিয়েছে ওর থেকে? ইয়াশ কি উত্তর দেবে কাশফিয়ার সব প্রশ্নের? হয়তো না, এতোদিনে হয়তো ভুলেই গেছে সে কাশফিয়াকে। কাশফিয়া ভাবছে কথাগুলো, এরমধ্যেই মুখ তুলে তাকাল ইয়াশ, ইয়াশকে ভালো ভাবে লক্ষ্য করল কাশফিয়া আগের থেকে অনেকটা শুকিয়ে গেছে ইয়াশ। গায়ে থাকা কালো রঙের শার্টটার বুকের দিকের কয়েকটা বোতাম খুলে রেখেছে,চুলগুলো কেমন এলো মেলো হয়ে লেপ্টে আছে কপালের সাথে। ইয়াশ তো অগোছালো নয় তাহলে এই অবস্থা কেন ওর? ইয়াশ তাকিয়েছে কাশফিয়ার চোখ বরাবর, একটু একটু করে এগিয়ে আসল ওর কাছে। ইয়াশের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে আগে থেকেই জানতো কাশফিয়া এখানে আসবে। অপেক্ষা করছিল ওর জন্যই। ইয়াশ মুচকি হেসে ফ্ল্যাটের দরজার দিকে হাত দেখিয়ে বলল কাশফিয়াকে,
"ওয়েলকাম টু আওয়ার নিউ হোম, মিসেস ইয়াশ রায়হান।"