02/12/2025
রিলেশনের তিন বছরের মাথায় আমার বয়ফ্রেন্ডকে আমারই বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে ইরোটিক সিচুয়েশনে দেখে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল যেন। এই দুইটা মানুষকে আমি আমার অস্তিত্বের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করেছিলাম। আর তারপর আমার সাথে যা করল তারা, তা কি আদৌ আমি ডিজার্ভ করি?
জামা-কাপড় থেকে শুরু করে পছন্দের সবকিছু, ইনফ্যাক্ট ফ্রেন্ড সার্কেলটাও শেয়ার করে নিয়েছিলাম যেই মেয়েটার সাথে, সে কেড়ে নিল আমার শখের পুরুষকে। আর যেই লোকটাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করেছিলাম, সে প্রতারণা করল; ছুড়ে ফেলে দিলো ভঙ্গুর প্রিয়ম মুর্তজাকে। তার প্রতি আমার এতটাই আস্থা ছিল যে, সে আমাকে ঠকিয়েছে–এই সত্যটাটাকে সত্য হিসেবে মেনে নিতেই তিনদিন লাগিয়ে ফেললাম। একটা ছোট্ট লাইনে যদি আমার এ অবধি লাইফটাকে ডিসক্রাইব করতে বলা হয়, তবে বলব–সে ছিল রেডফ্ল্যাগ আর আমি কালারব্লাইন্ড; রেড-গ্রীন আমার কাছে ধূসর।
দোষ শুধু এটুকুকেও দেওয়া যায় না। যখন আমরা নির্দিষ্ট একটা বিষয়কে ‘কখনো ঘটবে না’ বলে মেনে নিই, তখন সেই বিষয়টা ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়; মেনে নেওয়ার কষ্টটাও বাড়ে সমানুপাতিক হারে। সেই ঘটনাটা ছিল আমার লাইফের টার্নিং পয়েন্ট। একবিকেলের ব্যবধানে কত কিছু হারালাম–তার হিসেবে এলে আমি তাচ্ছিল্যভরা হাসি। পেয়েছিও নেহাত কম নয়। ডিপ্রেশন, এনজাইটি, ইনসমনিয়া, ডিমেনশিয়া, খিদেমন্দতা, কান্নারা গলার মধ্যভাগে আটকে গিয়ে শ্বাসেদের পথরুদ্ধতা আর নতুন করে বাঁচবার খোয়ায়িশ…
বাস্তবে ঘটা ওই দৃশ্যটা আমাকে স্বপ্নেও স্বস্তি দেয় না; ছটফট করতে থাকি একটুখানি ভালো থাকতে। যখন আমি সুখ খুঁজতে পুরোদস্তরভাবে মরিয়া হয়ে পড়লাম–আমাকে শান্তি এনে দিলো আমার প্রাণ। আমার ধ্রুব!
____
মেঝেতে পড়ে থাকা এই কালচে বাদামি রঙের ডায়ারিটা বাতাসের বদৌলতে শুরুর দিককার একটি পৃষ্ঠায় এসে থমকে আছে। প্রিয় বারান্দার মেঝেতে এসে বসল। বাঁ হাতে আলগোছে ডায়ারিটা তুলে নিজের কোলের ওপর রাখল। স্থির তাকিয়ে রইল সুবিশাল আকাশের দিকে, যার বিশালতার মাঝে ছড়িয়ে আছে তার গল্প। তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে সে বিড়বিড় করে উঠল, “প্রিয় অম্বর, বলো তো… কার হৃদয়ের দুঃখ গহীন? কার যন্ত্রণা বেশি তীব্র, তমসাচ্ছন্ন? তোমার না আমার? বলো বলো…”
শূন্যে ভাসমান মেঘেরা গর্জে উঠল ক্ষীণ শব্দে। স্মিত হাসল প্রিয়।
সেই ঘটনার আজ তিন বছর পেরোলেও, বুকের ভেতর চাপা পড়ে যাওয়া দুঃখেরা সময়ে-অসময়ে জ্বালাতন করা বন্ধ করেনি। এই যে–সে হাসে, সে আনন্দ-উল্লাসে মাতে, সে ঘোরাঘুরিতে নিজেকে ব্যস্ত রাখে! এসবের মধ্যে থেকে কেউ কখনো দেখতে পায় না, তার বুকের কোন জায়গায় গিয়ে একটা কাটা তাকে প্রতিনিয়ত ক্ষত দিয়ে যাচ্ছে। অনুভূতির এতশত জ্বালাতনের মধ্যে অকস্মাৎ সে বড়ো করে শ্বাস টেনে নিজের বাঁ পাশে তাকাল। ধ্রুব বসে আছে নিশ্চুপ হয়ে। বিস্মিত প্রিয় শুধাল, “কখন এলেন?”
ধ্রুবর শান্ত ও গম্ভীর স্বর, “এইমাত্র।”
যখন যখন প্রিয়র খুব করে এই লোকটাকে প্রয়োজন হয়, কীভাবে কীভাবে যেন সে টের পেয়ে যায়! প্রিয়র খুশি বাঁধে আটকায় না। এখনকার এই ঝড়ের আগমুহূর্তের শান্ত পরিবেশে এই লোকটাকেই তো সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। সে একনিমিষেই পালটে গেল, উচ্ছ্বসিত বাচ্চার মতো ধ্রুবর কাঁধে মাথা রেখে বলল, “আপনাকেই খুঁজছিলাম।”
“আমি জানি।”
“হুম..সব জানেন। আমার সবজান্তা লোক!”
ধ্রুব হাসছে। একহাতে আগলে রেখেছে প্রিয়র কাঁধ, মাঝে মধ্যে এলোমেলো চুলগুলো হাতের সাহায্যে গুছিয়েও দিচ্ছে। তার এসব করতে ভালো লাগে, অদ্ভুত ও অনিন্দ্য শান্তি লাগে।
প্রিয় ধীরে ধীরে ঘুমে তলিয়ে যেতে লাগল। ধ্রুব অন্যহাতে ডায়ারিটা গুছিয়ে ফেলে মেয়েটার নিষ্পাপ মুখশ্রীর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর প্রিয় ঘুম জড়ানো আওয়াজে ডাকল, “ধ্রুব?”
“শুনছি।”
“আপনিও কি ছেড়ে চলে যাবেন?”
“না।”
“সবাই তো চলে যায়। আপনি কেন যাবেন না?”
“আপনি জানেন প্রিয়দর্শিনী, কেন যাব না।”
প্রিয় ঘুমের ঘোরেই মুচকি হাসল, “আমার ধ্রুব! আর এজন্যই আপনাকে আমি এত ভালোবাসি। ঘুম পাড়িয়ে দিন এখন। আর তার আগে একশত আটচল্লিশটা চুমু।”
“এত কেন?”
“আপনি এতগুলো মিনিট আমার চোখের সামনে ছিলেন না। এখন এতটা চুমু খেয়ে আমায় শান্ত করবেন। আমি আদর খেতে খেতে ঘুমাব।”
ধ্রুব সত্যি সত্যি চুমু খেতে লাগল। মাথায়, কপালে, চোখে, গালে, নাকে, চিবুকে! এই স্পর্শে কেবল ও কেবলমাত্র ভালোবাসা আছে।
____
আজ শুক্লপক্ষের শেষ তিথি, পূর্ণচাঁদের রাত। চাকচিক্যময় এই শহরটিতে কখনো আঁধারিয়া দেখা যায় না। কখনো-সখনো মনের মলিনতাও যা খানিক আঁধারের স্রষ্টা সাজে, অন্যথায় তা-ও না। ওদিকে চাঁদের পূর্ণাঙ্গতায় আজ যেন আক্ষরিকভাবেই রাজধানীতে ঐশ্বর্য ফিরেছে।
গুলশানের একটি সিক্সথ ফ্লোরের অ্যাপার্টমেন্টের তমসাচ্ছন্ন বারান্দায় বসে চাঁদের সাথে কারো তুলনায় ডুবে ছিল আশফিক রহমান শ্রেয়ান। পরনে কৃষ্ণাভ টি-শার্ট, ট্রাউজার। ডান হাতটিতে একটা সলভড কিউব, একটু পর পর অক্রমিক করছে, তারপর আবারও সমাধানের ইচ্ছেতে সক্রিয় হয়ে উঠছে হাতদুটো। ভেজা চুলগুলোর পানি শুকোয়নি, ঝুঁকে বসে থাকার দরুন টপটপ করে সামনের চুল বেয়ে পানির ফোঁটা যত্রতত্র ছুঁয়ে ফেলছে। বাসায় ফিরতে আজ তার রাত হয়ে গিয়েছে। তারপর একটা ল-ম্বা শাওয়ার শেষে বিনিদ্র রজনী এই এত সুন্দর চাঁদকে সে উৎসর্গ করল আরেক চাঁদের বিভ্রমে। সেই চাঁদ তাকে আসমান ভাবত, বুকে আগলে রাখা আসমান। অথচ, আকাশের বুকে লক্ষ তারার বসতি কখনও নিয়ম-বহির্ভূত নয়। মেয়েটা যে কেন তা বুঝল না… খুব মায়া হলো শ্রেয়ানের। আবারও কিছু একটা ভেবে সে মোহাচ্ছন্নভাবে হাসল, মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে রইল শূন্যে। সে খুব করে টের পেল, এ ঘোর সহজে কাটবার নয়।
অথচ ঘোর কাটাতে প্রকৃতি তৎপর। তৎক্ষণাৎ তার মুঠোফোনটি সাইড বক্সের ওপর ভাইব্রেট করে উঠল। কপাল কুঁচকে ফেলল সে, ফোনটা হাতে তুলল। কল রিসিভ করে কানে নিতেই, ওপাশ থেকে এক মেয়েলি আওয়াজ ভেসে এলো, “হ্যালো...”
আননোওন নম্বর। ট্রু কলারে কলার-আইডি ভেসে আসছে ‘তুশি’ নামে। শ্রেয়ানের মনে পড়ছে না সে তুশি নামের এই মেয়েটিকে চেনে কি না। মনে করার চেষ্টাও করল না।
ওপাশ থেকে জবাব না পেয়ে তুশি হাঁসফাঁস করে যাচ্ছে। একহাতে ক্রমাগত ওড়নাটা পেঁচাচ্ছে, খুলছে। পায়চারি থামানোর নাম তো নেই-ই। সে আবার ডাকল, “আশফিক ভাই?”
শ্রেয়ান গা এলিয়ে দিলো সোফাটিতে। আকাশের দিকে চোখ দুটো স্থির রেখে বলল, “বলো, তুশি।”
তুশি অবাক হলো। চোখ বড়ো বড়ো তার, ফোন নিয়ে এলো সম্মুখে। পাশ থেকে আয়াত ইশারায় শুধাল, “কী হয়েছে?”
তুশি নিজেকে সামলাতে গুণে গুণে আড়াই সেকেন্ড নিল। এরপর ফোন আরেকটু দূরে সরিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “আমার নাম বলল.. চিনল কী করে!”
আয়াত মোটেও অবাক হলো না, “চিনলে চিনেছে।”
তুশি প্রচণ্ড উত্তেজিত। ফোনটা আবার কানে তুলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, “ভালো আছেন, আশফিক ভাই?”
“কী জন্য কল দিয়েছ?”
যাহ্ বাবা! এ কেমন কথা? তুশির গাল ফোলাতে ইচ্ছে করল খুব। কিন্তু মান ভাঙানোর নিশ্চয়তা যেখানে নেই, সেখানে অভিমান করাটা ভীষণ বেখাপ্পা। আপাতত এরকম বেখাপ্পা কাজ তার করতে ইচ্ছে করল না। প্রশ্নের উত্তরে বলল, “এমনিই।”
“এমনিই কেউ কিছু করে না, তুশি। অভিয়েসলি ইউ হ্যাভ আ স্ট্রং রিজন টু কল মি। নাউ টেল মি দ্য রিজন।”
তুশি শুকনো ঢোক গিলল, এরপর সত্য-মিথ্যের খেলায় বলে দিলো, “কাজিনের বিয়েতে ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার গেইম খেলার সময় আমাকে ডেয়ার দেওয়া হয়েছে—রাত একটা বাজে ক্রাশকে কল দিয়ে ১০ মিনিট কথা বলতে হবে এবং কনফেস করতে হবে। আই ডোন্ট হ্যাভ এনি ক্রাশ, এক্সেপ্ট ইউ। প্রথমে রাজি না হলেও, পরে কী ভেবে যেন আমি ডেয়ারটা এক্সেপ্ট করেছি। ঠিকঠাকভাবে করি যেন, এজন্য কাজিন বাসায় এসে বসে আছে। আ'ম সরি অ্যান্ড আই লাভ ইউ...”
পাশ থেকে আয়াত নিম্নস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠল, “প্রিয় বোনু, আমাকে ফাঁসানোর আর জায়গা পাও না?”
তুশি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “সরিইই।”
ওদের এহেন কর্মকাণ্ডে অন্যমনস্কভাবে শ্রেয়ান কিঞ্চিৎ হাসল। তুশি তখন শ্রেয়ানকে বলল, “দশ মিনিট ডান। আশফিক ভাই, আমি এখন রাখি?”
“কল দেওয়ার সময় আমার পারমিশন নিয়েছিলে?”
“উঁহু।”
“তাহলে এখন?”
“আচ্ছ সরি!”
শ্রেয়ান কিছু বলল না, তুশিও কল কাটল না। আয়াত তাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, “বারান্দায় গিয়ে কথা বল।”
সে আনমনে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। পথিমধ্যে শ্রেয়ান ডাকল, “তুশি?”
বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্বোধন হলো প্রিয় মানুষটার মুখে নিজের ডাকনাম। এমন কিছু কল্পনায় এনে বিশ্রী রকমের ভালো লাগছে তুশির, সেই সাথে ভয় হচ্ছে। বড়ো নাজুক বাচ্চা মেয়েটা যে খেলায় নেমেছে, তাতে শঙ্কায় দেহ মূর্ছা যাচ্ছে। ডাক-শোনা কম্পিত জবাব তার, “হুঁ?”
শ্রেয়ান বড়ো সাবলীলভাবে জিজ্ঞেস করল, “পুরো নাম?”
“অন্তরা অবন্তিকা তুশি।”
“আমি তোমায় চিনি?”
তুশি অবাক হলো, “আমাকে চিনতে পারেননি, আশফিক ভাই?”
“উঁহু!”
“আমি আপনার বন্ধুর মামাতো বোনের খালাতো বোন। চিনেছেন?”
“চিনিনি।”
সে চেনানোর তাগিদে কিছু আজগুবি কুণ্ডলী পাকানো কথার পসরা সাজাল, “সে বার আপুর সাথে আপনার বন্ধুর বিয়েতেই না আমাদের কথা হলো?”
শ্রেয়ানের তৎক্ষনাৎ কিছু মনে পড়ল না। কমবেশি অনেক মেয়ের সাথেই টুকিটাকি তার কথা হয়েছে, এড়িয়ে গেছে এরও অধিক সংখ্যককে। হ্যাঁ, কিছু বছর আগেই যখন তার বন্ধুর বিয়ে হলো, তখন সেখানে শ্রেয়ান গেছিল। সাথে ছিল এক দীর্ঘশ্বাসও। সেই দীর্ঘশ্বাসে এতটাই মগ্ন ছিল শ্রেয়ান যে অন্য কোনো মেয়েকে পাত্তা দেয়নি। তুশিও হয়তো সেই সময় থেকেই এখানে উঠে এসেছে।
তবে এ বিষয় নিয়ে আর ঘাটতে ইচ্ছে করল না তার। তাই বলল, “আচ্ছা! বুঝতে পেরেছি। মনে পড়েছে।”
জান ফিরে পেল তুশি, আহাম্মকের মতো হেসে বলল, “আই লাভ ইউ।”
“বয়স কত তোমার?”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তুশি, “বয়স?”
“হুঁ।”
“সতেরো।”
“আঠারো হবে কবে?”
“গুণে গুণে ছয় মাস পর।”
“ঠিক আছে।”
শ্রেয়ান বাঁকানো এক হাসির সাথে হাতের কিউবটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সম্মুখের চাঁদের দিকে স্থিরভাবে তাকাল। কিছু হিসেব মেলালো। আর তারপর বলল, “এই ছ’মাস সম্পূর্ণভাবে পড়াশোনায় ফোকাস করবে। মাঝে সময় যা পাবে, তাতে আমার ব্যাপারে খোঁজ নিতে থাকবে। ছ’মাস পর তোমার ভালো লাগা কদ্দূর থাকে, তা দেখতে চাই। আ’ম এগারলি ওয়েটিং, তুশি।”
তুশি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “লিসেন, আশফিক ভাই! আমার ভালোবাসাকে কিশোরীর ভালোলাগা ভেবে থাকলে, ভুল করবেন। একজন দৃঢ় প্রত্যয়ী কিশোরীর লক্ষ আপনি, আমি আপনাকে ছাড়ছি না। এখনও না, ছ’মাস পরও না।”
শ্রেয়ানের হাসি প্রশস্ত হলো, “অবশ্য তোমার ভালোবাসাতে আমার সন্দেহ—এমনটা আমি বলছি না। কেননা..”
“কেননা?”
“খোঁজ নিতে থাকো, বুঝে যাবে..”
চলবে...
#চান্দ্রমাসের_গান
- নবনীতা শেখ
[পর্ব ১]
প্রথম পর্বে সবাইকে কমেন্ট করার অনুরোধ।