
17/07/2025
চব্বিশ বছরের কুমারী জীবনের ইতি টেনে এক বুক আশা নিয়ে বাবার ঘর থেকে স্বামীর ঘরে পা রাখলো দীপা। আজ তার বিয়ের প্রথম রাত। খুব কাছের প্রিয় বান্ধবী মিমির বিয়ের গল্প শুনে কতবার কল্পনার রাজ্যে ডুব দিয়েছে। একদিন নিজেরও বিয়ে হবে। ছোট্ট সংসার হবে,সন্তানের মা হবে। আদরের সন্তান সারা ঘরময় দৌড়াদৌড়ি করবে। খুনসুটি,হাসি,গল্পে,আনন্দে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখবে প্রিয় মানুষগুলোকে।
ভার্সিটিতে পড়ার সময় ক্লাসমেট বন্ধু পলাশ প্রায়ই আড্ডা দেওয়ার সময় বলতো, ‘জানিস দীপা? আমার বউকে আমি খুব ভালোবাসবো। যে আমার বউ হবে সে খুব ভাগ্যবতী হবে। দীপা,তুই কি আমার লাইফ পার্টনার হবি?’
দীপা খিলখিল করে হেসে উড়িয়ে দিত। হাসতে
হাসতেই মজা করে বলতো,‘ইশ্ কি আমার জামাইরে? তোকে বিয়ে করতে যাবো কোন দুঃখে? আমার জামাই দেখতে তোর চেয়ে কত হ্যান্ডসাম হবে দেখিস। তুই আমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে থাকবি সারাজীবন।’
পলাশও হেসেই জবাব দিলো, ‘দেখবো তো কোন রাজকুমার স্বামী হিসাবে তোর কপালে জুটে? আমার মতো গভীরভাবে তোকে আর কেউ বুঝবে না। কথাটা লিখে রাখ দীপা।’
পলাশকে দীপা সব সময় খুব ভালো বন্ধু মনে করতো। আজ পলাশের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে দীপার।
সব জল্পনা,কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণের মুখোমুখি দীপা। জীবনসঙ্গী যাকে পেয়েছে তিনি অজানা,অচেনা সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন।
দীপার বাবার ছোটকালের বন্ধুর ব্যবসায়িক পার্টনারের একমাত্র ছেলে মৃদুলের সাথে কিছুটা তড়িঘড়ি করেই বিয়েটা হয়ে যায়। ভালো করে কথাবার্তা,দেখা,জানাশোনা কিছুই হয়নি দু'জনের মাঝে। সুসজ্জিত খাটে এলোমেলো ভাবনার ভিতরে দীপার টেনশন,উত্তেজনা দুটোই কাজ করছে। সেই সাথে নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে। আচ্ছা মৃদুল ঘরে আসার সাথে সাথে কি পা ছুঁয়ে সালাম করবো?
নানু অনেক কথার সাথে ছোট্ট করে বলে দিয়েছিল, ‘বিয়ের প্রথম রাতে স্বামীকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে হয়।’
মৃদুলের কথার আওয়াজ শুনে দীপা দরজার দিকে তাকায়। মৃদুল মোবাইল পাঞ্জাবির পকেটে রাখতে রাখতে ঘরে ঢুকলো।
মৃদুল খাটের পাশেই রাখা ডিভানে বসে বললো,
- 'দীপা,আপনার সাথে আমার খুব জরুরি কথা আছে। আশা করি আপনি আমাকে হেল্প করবেন।'
হঠাৎ এমন কথায় দীপার ভিতরে ধক করে শব্দ হলো। টেনশনের মাত্রা বেড়ে গেল। বিয়ের প্রথম রাতে বউয়ের মুখ না দেখে কি এমন জরুরি কথা বলতে চাইছে? দীপা এক পলক মৃদুলকে দেখে মাথা নীচু করে বললো,
- 'কি জরুরি কথা?'
- 'দীপা,আপনি কাউকে পছন্দ করতেন?'
দীপা চমকে উঠলো। নিজেকে প্রশ্ন করে,উনি কি বলতে চাইছে? চুপ থেকে আস্তে করে জবাব দিলো,
- 'না। তেমন কাউকে পছন্দ হয়নি।'
মৃদুল কথা শুরু করলো,
- 'আমাদের বিয়েটা খুব তাড়াহুড়ো করে হয়ে গেলো। নিজেদের কথা কিছুই জানানো হলো না। আমার নিজের কথাগুলো জানার পর আমাকে কাপুরুষ,প্রতারক অনেককিছু ভাবতে পারেন। আপনাকে সত্যিটা জানানো খুব প্রয়োজন। বিশ্বাস করেন,আপনাকে আমি ঠকাতে চাই না।
আমি নিরুপায় ছিলাম। পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমি বিয়ে করেছি। আমি একজনের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ। ওর নাম ন্যান্সি। সাত বছর ধরে ওর সাথে সম্পর্ক। দু'জনেই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগ্রি ইকোনমিক্সের উপর মাস্টার্স শেষ করি। ন্যান্সি এখন এমএস করার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছে। দু'জনেই একসাথে অনেকদিন ধরে ট্রাই করছিলাম। কথা ছিল দু'জনেই অস্ট্রেলিয়া সেটেল্ড হওয়ার পর বিয়ে করবো। আমারও যাবার প্রয়োজনীয় সব পেপারস প্রায় ঠিকঠাক হওয়ার পথে।
এরই মাঝে বাসায় দুটো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। দাদিজান দু'দুবার স্ট্রোক করলেন। দাদিজান বেঁচে ফিরলেও উনাকে নিয়ে আব্বার দুশ্চিন্তা বেড়েই যাচ্ছিল। কারণ, আব্বার জীবনে দাদিজানই সব। আমার কোনো চাচা,ফুপু নেই। আব্বার যখন এক বছর বয়স তখন দাদা মারা যান। দাদিজান নতুন করে সংসারে জড়াননি। আব্বাকে নিয়েই দাদিজানের পুরো পৃথিবী ছিল। আব্বার ধ্যান জ্ঞানেও শুধু দাদিজান। আব্বা দাদিজানকে সব সময় ভালো রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। ছোটবেলা থেকেই তাই দেখে আসছি।
দাদিজানের স্ট্রোকের অল্প কিছুদিন পর আব্বার হার্টে পাঁচটা ব্লক ধরা পড়লো। ডাক্তার দ্রুত অপারেশন করে রিং পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আব্বা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। উনি সুস্থ হলেও অনেকটা পরিবর্তন হয়ে যান। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করেন। হঠাৎ দাদিজানের শরীর আবার খারাপ হতে শুরু করে। নিউমোনিয়ায় শ্বাসকষ্টজনিত কারণে হসপিটালে ভর্তি হলে আব্বা মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েন। দাদি আব্বাকে ডেকে হাত ধরে বললেন, ‘বাবা, আমার দিন শেষ হয়ে আসতেছে। একটাই ইচ্ছে, মৃদুলের বউ দেখে মরতে চাই। ঘরে বউ আনার পর যেন মৃদুল বিদেশ পড়তে যায়।’
এই কথা শোনার পর আব্বা কাউকে কোনোকিছু বলার সুযোগই দিলেন না। তড়িঘড়ি করে আমাকে বিয়ে করিয়ে দাদিজানের মনের ইচ্ছে পূরণ করে উনার হুকুম পালন করলেন। আম্মা আমার পছন্দের কথা কিছুটা জানতেন। জেনেই বা কি করার ছিল? চোখের পলকে সব কিছু ঘটে গেলো।'
মৃদুল কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছু সময় চুপ থেকে আবার বললো,
- 'দীপা,আমি আর ন্যান্সি দু'জন দু'জনকে খুব পছন্দ করি। আমি পরিস্থিতির স্বীকার। আপনাকে ঠকাতে চাই না। সত্যিটা আপনার জানা খুব দরকার ছিল। আমাকে ক্ষমা করবেন।'
মৃদুল কথা শেষ ওয়াশরুমে গেল।
ঘুরে আসুন আমাদের পেইজ থেকে facebook.com/snehovibes
মুহূর্তের মধ্যে দীপার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের জমানো রঙিন স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। চোখ থেকে নিঃশব্দে কয়েক ফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। হাতে রাখা টিস্যু চোখ দুটোতে চেপে ধরে অঝোরে কাঁদে।
মৃদুল বাথরুম থেকে বের হলে চোখ মুছে প্রশ্ন করে,
- 'আর কতদিন লাগবে আপনার সবকিছু গুছাতে'?
- 'প্রায় দুই মাস।'
দীপা খাট থেকে নেমে অর্নামেন্টস খুলে মৃদুলের দিকে এগিয়ে দেয়।
- 'এইগুলি ন্যান্সির জন্য রেখে দিন।'
মৃদুল মুখ মুছতে মুছতে বললো,
- 'অর্নামেন্টস খোলার কি খুব দরকার?'
- 'পরেই বা কি হবে? যার সাথে সংসার হওয়ার কথা সেইতো আমার না।'
মৃদুল দু'পা এগিয়ে দীপার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
- 'এইগুলো পরে নিন। সব অর্নামেন্টস আপনার। একটা রিকোয়েস্ট রাখতে হবে।'
- 'বলুন।'
- 'বাড়ির মানুষগুলো যেন কোনোভাবেই দু'জনের দূরত্বের কথা বুঝতে না পারে। আপনার কষ্ট হলেও দাদিজান,আব্বার শরীরের দিক বিবেচনা করে সবার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করতে হবে।'
দীপা মৃদুস্বরে বললো,
- 'ভিতরে পাহাড়সম কষ্ট নিয়ে ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি রেখে আমি না হয় সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো। সুখে থাকার অভিনয় করবো। যখন সবাই সবকিছু জানতে পারবে তখন আপনার প্রিয় ও কাছের মানুষগুলো কতটা কষ্ট পাবে জানেন? আমার বাবা,মা তাদের মেয়ের এতবড় ক্ষতি তারা সহ্য করতে পারবেন না। এখনি সব জানাজানি হোক।'
- 'দীপা,প্লিজ ক'টা দিন সময় নিচ্ছি। আপনি হেল্প করলে আমরা দু'জনেই এর সমাধান করতে পারবো।'
হঠাৎ ফোন বেজে উঠে। মৃদুল ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে বারান্দায় চলে যায়। দীপা শাড়ি চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। ঘুমহীন চোখের পাতা দুটো বারবার ভিজে উঠে। আপনমনে বিড়বিড় করছে,জীবনে কাউকে ঠকাইনি,কষ্ট দেইনি। বিধাতা তুমি কেন আমার ভাগ্যটা এমন করলে? কি দোষ করেছি আমি?
কিছু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দীপার স্যাঁতস্যাতে চোখের পাতায় ঘুম চলে আসে।
সকালে সজাগ পেয়ে দীপা দেখে মৃদুল ডিভানে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। দীপা মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আস্তে করে ডাকলো,
- 'মৃদুল,সকাল হয়ে গেছে। যদি আরও ঘুমুতে ইচ্ছে করে খাটে শুয়ে ঘুমান। এই মৃদুল উঠুন!'
দীপা দুইবার ডাকার পরও মৃদুলের কোনো সাড়াশব্দ নেই। দীপা আস্তে করে পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিল কয়েকবার। মৃদুল নড়েচড়ে চোখ মেলে দেখে দীপা তার পায়ের কাছে। শোয়া থেকে উঠে বসে।
- 'আমি ঘুমিয়েছি এই একঘন্টা আগে। ন্যান্সি ফোন দিয়েছিল। ওর একটা সমস্যার চলছে। ওর রুমমেট নাইজেরিয়ান একটা মেয়ে। প্রতিদিন মদ খেয়ে রুমে ফিরে ওকে খুব ডিস্টার্ব করে। ন্যান্সি খুব ভয়ে আছে।'
দীপা মৃদুলের কথা থামিয়ে দিয়ে বললো,
- 'ন্যান্সির সাথে আপনার কি কথা হয়েছে তা শুনতে চাচ্ছি না,চাই না এবং কোনোদিন চাইবো না। আপনাদের দু'জনের বিষয় নিজেদের মাঝে রাখলেই ভালো। ঘুমুতে ইচ্ছে করলে ডিভান থেকে খাটে যান। এইজন্যই ডাকছিলাম।'
- 'না,আর ঘুমাবো না। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে যাবো।'
- 'ঠিক আছে। আপনি আসুন। আমি যাই।'
দীপা ডাইনিং রুমে আসতেই শাশুড়ি বললেন,
- 'এই যে বৌমা ভালোই হলো তুমি সকাল সকাল উঠেছো। তোমার দাদি শাশুড়ি বায়না ধরেছে, তোমার হাতে খাবে। আমার হাতে খাবে না, তোমার শ্বশুরের হাতেও খাবে না এমন কি শিউলির মায়ের হাতেও না। বয়স যতই বেড়ে চলেছে উনিও স্বভাবে ততই ছোট বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে। জানো সেইদিনও উনাকে চিপস কিনে দিয়েছি। চিপস উনার খুব পছন্দ।'
দীপা মৃদু হেসে বললো,
- 'বেশ ভালো তো! আজ থেকে আমিই দাদিজানকে খাইয়ে দিব। মা,খাবারের প্লেটটা আমায় দিন।'
দীপা খাবারের প্লেট নিয়ে দাদী শাশুড়ির ঘরে আসলো। পঁচাত্তর বছর বয়স্ক কামরুন্নেছা বেগম শুয়ে চোখ বন্ধ রেখে তজবি জপছেন।
- 'দাদিজান, আমি দীপা। আপনার খাবার নিয়ে আসছি।'
কামরুন্নেছা চোখ মেলে তাকালেন।
- 'বইন তুই আসছোস? তোর হাতে খাইতে চাইছি মন খারাপ করোস নাই তো?'
- 'কেন রাগ করবো দাদিজান? এ যে আমার সৌভাগ্য। আমার দাদি বেঁচে নেই। আজ থেকে আপনার সবকিছু আমিই দেখভাল করবো। আপনি শুধু বলবেন আপনার কখন কি খেতে ইচ্ছে করে।'
দীপা নাস্তার প্লেট পাশে রেখে দাদি শাশুড়িকে ধরে শোয়া থেকে বসালেন। মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। দু'জনে টুকটাক কথা বলছে।
মৃদুল খাবার টেবিলে কাউকে না পেয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে মা'কে ডাক দিলো,
- 'মা,নাস্তা দাও।'
মৃদুলের মা কিচেন থেকে হটপট হাতে করে টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন।
- 'বৌ'মাকে নিয়ে খেতে বস। মায়ের ঘরে আছে। তোর দাদি বায়না ধরেছে দীপার হাতে খাবে।'
মৃদুল দাদির ঘরে উঁকি দিয়ে বললো,
- 'দুই সই বেশ জমিয়ে গল্প করছো। দেখতে দারুণ লাগছে।'
মৃদুল কথাটা শেষ করেই আড়চোখে দীপার দিকে তাকাতেই দু'জনের চোখাচোখি হলো।
- 'দাদি তোমার খাওয়া হয়েছে?'
- 'হইছে ভাই। খুব তৃপ্তি নিয়া খাইলাম। আয় ভাই, তুই আমার কাছে বয় একটু।'
মৃদুল দাদির গা ঘেঁষে বসলো। কামরুন্নেছা দীপার ডানহাতটি নিজের হাতের ভিতর রেখে বললেন,
- 'দীপা,আমার মৃদুল দাদাভাই খুব ভালো মনের মানুষ। খুব নরম মনের মানুষ। দেখিস তোকে খুব ভালোবাসবে। ছোট থাকতে ও আমার গলা জড়িয়ে ঘুমাতো। কতবার যে নিজ হাতে ঔষধ খাইয়ে দিছে। মশারি টানায়ে দিছে। তুই আমার নাতিটাকে বেশি করে সেবা যত্ন করবি।'
দীপার চোখ দুটো টলমল। মাথা নীচু করে আছে। মৃদুলের দৃষ্টি দীপার সিক্ত চোখ দুটোকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য মৃদুল তাড়াতাড়ি বললো...
(চলবে)....
গল্পঃ তুমি শুধুই আমার
পর্বঃ ১
লেখাঃ মাকসুদা খাতুন
----------------------------------
নেক্সট পার্ট সবার আগে আইডিতে পোস্ট করা হবে, নীল লেখার চাপ দিয়ে সবাই আইডি ফলো করুন। 👉 Choto Dairy 01