23/06/2024
ঢাকা পতন: ৪
নিজেদের হেফাজত নিজেরা কর!
নীলফামারীর চিলাহাটি থেকে সরতে সরতে দিনাজপুরের খানসামা। বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের পরও পাক বাহিনীর আচানক পলায়ন। এসবের বর্ণনা দিয়ে আবু আত্তার বলছিলেন-
৩ ডিসেম্বরের আগে থেকেই এখানে ভারতীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হচ্ছিল। কিন্তু যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের ঘোষণা হলো সেদিন অবিশ্বাস্যভাবে কোন সংঘর্ষ ছাড়াই পাক ফৌজ চিলাহাটি ছেড়ে দিল। নীলফামারী থেকেও ফৌজ সরিয়ে নিল। পিছু সরতে সরতে অবস্থান নিল দশ মাইল দূরে মাজারগঞ্জে। আচমকাই এসব সিদ্ধান্ত নেয় সেনাবাহিনী। আমাদের সাথে কোন পরামর্শ করেনি।
আগের যুদ্ধক্ষেত্রের হিসাবে আল বদর বাহিনী চার মাইল সামনে ছিল। যদিও আমাদের রেজিমেন্ট পাক ফৌজের অধীনেই ছিল।
নতুন পরিস্থিতিতে আল বদরের মত সেনাবাহিনীর জওয়ানরাও হতাশ ও নাখোশ ছিল। তারাও এটা বুঝতে পারছিল না, কোন কারণ ছাড়া কেন নিজেদের এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে।
ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানে প্রবেশ করে ফেলেছিল। দুই দিন ধরে ওই ফ্রন্টে ব্যারিকেডের মত মোকাবেলা করেছে আল বদর। যদিও আল বদরের কাছে শুধু অটোমেটিক রাইফেল ছিল।
লড়ায়ের তীব্রতা বেড়ে গেলে আল বদরকে পিছনে সরে আসার নির্দেশ দিয়ে পাক আর্মি অনেক দূর থেকে গোলাগুলি শুরু করে। আমরা পিছে সরতে সরতে ডোমার থানা চলে আসি। কিন্তু ওখানে কেমন একটা নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। সাত দিন আমাদের মধ্যে কোন লড়াই হয়নি। মাঝে মাঝে ভারতীয় হেলিকপ্টার চক্কর লাগিয়ে যেত। কিন্তু আমাদের রাইফেল সেগুলোর কিছুই করতে পারত না।
আমরা এখনও পাক ফৌজ থেকে তিন মাইল আগে অবস্থান করছিলাম, খানসামায়। অষ্টম দিন ভারতীয় বাহিনী হেলিকপ্টার আর ট্যাংকসহ আল বদরের ওপর হামলা করে। এসময় ক্যাম্পে শুধু ৯৫ জন ক্যাডেট ছিল। এক ঘন্টা ধরে আমরা প্রতিরোধ করি। গাছ-গাছালির কারণে দুশমন আমাদের শক্তি আন্দাজ করতে পারছিল না। ফলে সামনে আগাতে ভয় পাচ্ছিল।
এ সময় আমাদের সাথে পাক আর্মি যোগ দেয়। ট্যাংক ফায়ার করলে বড় সংঘর্ষ শুরু হয়। এ যুদ্ধ চলে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত। পরে ভারতীয় ফৌজের জন্য সাহায্য আসে। তবুও তারা প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু পাক আর্মি আর সামনে এগোল না।
এ যুদ্ধে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সিপাহী বাশারাত অনেক দুঃসাহসের সাথে লড়াই করে। সে অ্যান্টি ট্যাংক চায়না গান দিয়ে দুশমনের দুইটি ট্যাংক ধ্বংস করে। কিন্তু একটা গোলা এসে লাগলে সে শহীদ হয়ে যায়। তার সাথে তিন রাজাকার আর সাত আল বদরও শহীদ হয়।
পরের দিন বারোটার দিকে আবার যুদ্ধ শুরু হল। কিন্তু পাক আর্মি কোন কারণ ছাড়াই পিছু সরতে লাগল। তারা ওখান থেকে সাত মাইল পিছনে চলে যায়। আর আল বদর চার মাইল আগে ভারতীয় বাহিনীর মুখোমুখি। তিন দিন পর পাক আর্মি আরও তিন মাইল পিছনে পালিয়ে দারোয়ানি রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান নেয়। পরদিন কর্নেল সাহেব আল বদর কমান্ডারকে ডেকে বললেন৷ "এখন তোমরা নিজেদের হেফাজত নিজেরা কর। আমরা অস্ত্র সমর্পণ করছি।"
তিনি কোন জবাবের অপেক্ষাও করেননি। জিপে সাদা পতাকা উড়িয়ে দুশমনের ক্যাম্পের দিকে চলে গেলেন। এবার যেন পাক ফৌজ আগে চলে গেল। আল বদর পিছে থেকে গেল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ঢাকা রওনা হল। আর আমরা, আল বদর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলাম। কেউ কেউ হিজরত করলাম।
সালিম মানসুর খালিদের 'আল বদর' বই থেকে অনূদিত।