27/10/2025
রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দুয়াটা দৈনিক সবচেয়ে বেশিবার করতেন সেটা দুনিয়াবি বিষয়াদি নিয়ে ছিল না৷ এমনকি, যুদ্ধজয় কিংবা দ্বীনের অন্য কোনো ব্যাপারেও তিনি সাহায্য কামনা করতেন না সেই পুনঃ পুনঃ আওড়ানো দুয়াতে।
তিনি কি চাইতেন, জানেন?
তিনি বলতেন, ‘হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আপনি আমার অন্তরকে দ্বীনের উপর দৃঢ় রাখুন।’
এই দুয়াটাই ছিল দিনের মধ্যে আল্লাহর রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত দুয়া। এই দুয়ায় তিনি আল্লাহকে বলতেন যেন মহান রব তাঁর অন্তরকে দ্বীনের উপর অটল রাখেন। কোনো বিচ্যুতি যেন সেখানে প্রবেশ করতে না পারে।
দুয়াটার শুরুতে যে ‘ইয়া মুকাল্লিবাল ক্বুলুব’ অংশটা রয়েছে, সেটা অত্যন্ত ভয় জাগানিয়া একটা অংশ।
‘ইয়া মুকাল্লিবাল ক্বুলুব’ মানে হলো—হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার অসীম কুদরতের একটা উদাহরণ হলো এই—তিনি যখন তখন যেকোনো অন্তরকে, যেকোনো পথে ফিরিয়ে দিতে বা পরিচালিত করতে পারেন। এই কাজটা এতো দ্রুত ঘটে যে, চোখের পলক ফেলতে যে সময়টুকু লাগে আমাদের, সেই সময়টাকে যদি হাজারকোটি অংশে ভাগ করা হয়, সেই হাজারকোটি ভাগের এক ভাগেরও কম সময়ে এটা ঘটে যাওয়া সম্ভব।
আদতে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কোনো কাজকে কি সময়ের ফ্রেমে বন্দী করা যায়? তিনি যখন কোনোকিছু করতে ইচ্ছা করেন তখন কেবল বলেন ‘হও’, আর তা হয়ে যায়।
তিনি যে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী, এই ব্যাপারটা বোঝার জন্য আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচারের দিকে তাকালেই ভালো বুঝতে পারব।
ধরুন, এইমাত্র একজন লোক পাঁচ পৃষ্ঠা কুরআন তিলাওয়াত করে উঠেছেন। সালাতের আগে আর পরের যিকির আযকার, নফল আর সুন্নাহ সালাতগুলোও আদায় করেছেন অপূর্ব মনোযোগ আর প্রশান্তির সাথে। সব মিলিয়ে, দিলজুড়ে তার বইছে রবের স্মরণের ফল্গুধারা।
তারপর, নৈমিত্তিক রুটিনের অংশ হিশেবে তিনি ফেইসবুকে আসলেন। কিছুদূর স্ক্রল করতেই বুঝলেন গোটা ফেইসবুক দুনিয়া একটা ব্লকবাস্টার মুভির রিভিউতে সয়লাভ। এতো ভালো মুভি নাকি মুভি ইন্ড্রাস্ট্রিতে এর আগে কখনো নির্মিতই হয়নি।
যেহেতু ফেইসবুক এখন ফলো করলে তার লেখাও দেখায়, ফলো করা হয় না এমন লোকের লেখাজোকাও দেখায়, তার হোমফিড যেন সেই মুভির রিভিউতে ছেঁয়ে আছে।
তার মন তখন একটু ওয়াসওয়াসা পাওয়া শুরু করবে৷ এতো এতো মানুষ দেখছে, সবাই এতো ভালো রিভিউ দিচ্ছে, খুব ক্রিটিক্যাল মানুষজনও ভূয়সী প্রশংসা করছে, তার মানে কাজটা মনে হয় আসলেই দারুন হয়েছে।
তার অন্তরের একটা অংশ বলবে—‘মুভিটা দেখে ফেললে মন্দ হয় না। এই একটাই তো মুভি। নিত্যদিন তো আর দেখা হচ্ছে না।’
অন্তরের আরেকটা অংশ স্মরণ করিয়ে দিবে, ‘না না৷ ভুলেও ও পথে যাওয়া যাবে না৷ তোমার অন্তরে এক দারুন প্রফুল্লতা বিরাজ করছে। আজ সারাদিন তুমি অনেক আমলের মধ্যে ছিলে। দিনের শেষে এই কাজের মাধ্যমে নিজের গুনাহের খতিয়ান শুরু করো না।’
অন্তরের এই দুই অংশের দ্বৈরথ একটা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায় এবং অধিকাংশের বেলায় প্রথম অংশ, অর্থাৎ ওয়াসওয়াসার অংশটা জয়ী হয়ে যায়। কারণ, চোখের সামনে এতো এতো রিভিউ, মুভিটার এতো এতো ছোট ছোট ক্লিপ, এতো এতো রিলস দেখার পরে, নিজের নফসকে অবদমিত রাখা কঠিন হয়ে উঠে বৈকি!
তারপর?
তারপর সে মুভিটা দেখা শুরু করে। চোখের গুনাহ, শ্রবণের গুনাহ আর অন্তরের গুনাহ—নানাবিধ রঙ বেরঙের এক গুনাহের বেশতিতে জড়িয়ে পড়ে সে।
অথচ—দিনটা কিন্তু তিনি শুরু করেছিলেন খুব চমৎকারভাবেই। কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, নফল সালাত ইত্যাদির মাধ্যমে।
আর, দিনের সমাপ্তি টানলেন একটা ব্লকবাস্টার মুভি দেখে যেখানে গুনাহের পসরা সাজানো থরে থরে।
মুভির রিভিউটা একটা উদাহরণ মাত্র৷ এটাকে একটা নাটক বা সিরিয়াল বা ওয়েবসিরিজ, কিংবা একটা ইউটিউবের গানের প্লে-লিস্ট, কিংবা বেগানা পুরুষ অথবা নারীর সাথে আড্ডা, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় একান্ত চ্যাটিং—নানান উদাহরণে সাজিয়ে নিতে পারেন।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শিখিয়ে গেছেন—অন্তর জিনিসটা বড় অগোছালো, অস্থির, চঞ্চল, বিচ্যুতি-প্রবণ। যেকোনো সময়, ঠুনকো থেকেও ঠুনকো কারণে অন্তর বিচ্যুতির পথে হাঁটতে পারে৷ ছোট্ট থেকেও ছোট্ট উসিলায় মানুষ গুনাহের সাগরে অবগাহন করতে পারে।
তাই, প্রতিদিনের অনেক অনেক দুয়ার ভিড়ে, তিনি আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন যে—আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি চাইতে হবে দ্বীনের উপর অন্তরের অবিচলতা, স্থিরতা। কোনো ফাহেশা কাজ দেখলে, কোনো বিচ্যুতির উপকরণ বা উসিলা সামনে এলেই যেন আমরা পথ হারিয়ে না ফেলি।
নবিজি সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশি বেশি পড়তেন—‘ইয়া মুকাল্লিবাল ক্বুলুব, সাব্বিত ক্বলবি আলা দ্বীনিক।’
আরিফ আজাদ