02/04/2025
১৯৭২ সালে, একজন ফরাসি বিজ্ঞানী, মিশেল সিফ্রে, একটি চরম পরীক্ষা পরিচালনা করতে গিয়ে ১৮০ দিন ধরে একটি নিকষ অন্ধকার গুহার মধ্যে ৪৪০ ফুট গভীরে নিজেকে বন্ধ করে রাখেন। তার লক্ষ্য ছিল মানব মনের গহীনে প্রবেশ করা—বিশেষত সময়ের অনুভূতি কিভাবে কাজ করে যখন মানুষের কোনো বাইরের সংকেত থাকে না। এই পরীক্ষাটি ছিল মানব মন ও সময় সংক্রান্ত প্রথম বড় আয়না, যা পরবর্তী গবেষণার জন্য ভিত্তি তৈরি করে। (Source: Michel Siffre's book "Beyond Time")
সিফ্রে ছিলেন একজন ভূতত্ত্ববিদ এবং গবেষক, যিনি চরম পরিস্থিতিতে মানব বায়োলজির বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাইরের সময় সংকেতগুলির অভাবের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে তা বুঝতে পারলে, মানব মনের গোপন রহস্য উন্মোচিত হবে।
তাঁর পরীক্ষা ছিল অত্যন্ত সরল, কিন্তু একেবারে চরম: সিফ্রে নিজেকে সম্পূর্ণ একাকী রাখবেন, কোনও বাইরের জগতে যোগাযোগ ছাড়াই, এবং কোন আলোক বা ঘড়ি ছাড়াই ১৮০ দিন গুহার মধ্যে কাটাবেন। এই অবস্থা ছিল অত্যন্ত কঠিন, এবং নিস্তব্ধতা ছিল অপরিসীম। (Source: Siffre, M. (1975). "La Mémoire et Le Temps")
প্রথমদিকে, সিফ্রে একটি রুটিন অনুসরণ করার চেষ্টা করেছিলেন, যেখানে ক্ষুধা এবং ক্লান্তি তাকে খাওয়া এবং ঘুমানোর সময় নির্ধারণ করতে সাহায্য করছিল। তবে কোনো বাইরের সংকেত না থাকার কারণে, সময়ের অনুভূতি দ্রুত বিকৃত হতে শুরু করল। যেসব ঘণ্টা মনে হচ্ছিল মিনিট, সেগুলো আসলে দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছিল। তার মানসিক অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে থাকে। তিনি ছায়া এবং কণ্ঠ শুনতে শুরু করেন, এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর মধ্যে প্যারানইয়া চলে আসে, তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে গুহায় কেউ তাঁর সাথে আছে। (Source: Siffre, M. (1972). "The Man Who Lived in a Cave" - Psychological Journal)
এদিকে, সিফ্রের উপরে থাকা দল তার সমস্ত কার্যকলাপ মনিটর করছিল এবং তার কার্যকলাপকে প্রকৃত সময়ের সাথে তুলনা করছিল। ফলাফল ছিল চমকপ্রদ। দ্বিতীয় মাস শেষে, সিফ্রে বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে মাত্র ২৪ ঘণ্টা পেরিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা চলে গিয়েছিল। তার অভ্যন্তরীণ সময় মানসিক ঘড়ি অনেক স্লো হয়ে গিয়েছিল। তার শরীর একটি নতুন সময় চক্র তৈরি করেছিল—৩৬ ঘণ্টা জেগে থাকা এবং ১২ ঘণ্টা ঘুমানো—যা ২৪ ঘণ্টার দিনের চক্রের সাথে একদম মিল খায় না। (Source: Siffre, M. (1972). "The Effect of Isolation on Time Perception" - Psychological Science Journal)
সিফ্রের পরীক্ষা একটি গভীর সত্য উন্মোচন করেছিল: মানব মস্তিষ্কে একটি অন্তর্নিহিত সময় ব্যবস্থার অস্তিত্ব রয়েছে। বাইরের সংকেত ছাড়াই, আমাদের মস্তিষ্ক এবং শরীর নিজেদের একটি সময় অনুভূতি তৈরি করে। এটি একটি বৈপ্লবিক আবিষ্কার ছিল যা আমাদের সার্কেডিয়ান রিদম, মস্তিষ্কের কাজ এবং সময়ের অনুভূতির বিষয়গুলি নতুন করে বুঝতে সহায়তা করেছিল। (Source: Czeisler, C. A., & Gooley, J. J. (2007). "Circadian Rhythms and Sleep in Human Physiology" - New England Journal of Medicine)
তবে এই পরীক্ষার ফলস্বরূপ সিফ্রের মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। সপ্তাহের পর সপ্তাহে, তিনি শব্দ ভুলে যেতে শুরু করেন, মৌলিক তথ্য মনে রাখতে সমস্যা হচ্ছিল, এবং তাঁর আবেগ হঠাৎ করে আনন্দ থেকে বিষণ্ণতায় চলে যাচ্ছিল। একাকিত্ব তার মস্তিষ্ককে চরমভাবে প্রভাবিত করছিল। (Source: Siffre, M. (1975). "La Mémoire et Le Temps")
যখন তাঁকে ১৮০ দিন পর গুহা থেকে বের করা হয়, সিফ্রে চমকে গিয়ে জানতে পারেন যে, প্রকৃতপক্ষে মাত্র ১৫১ দিন পেরিয়েছে। বাইরের কোনো সময় সংকেত ছাড়া, তার মস্তিষ্ক নিজেই একটি আলাদা সময় ধারণা তৈরি করেছিল এবং তিনি পুরো এক মাসেরও বেশি সময় হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা তার মস্তিষ্ককে আবার নতুন করে তৈরি করেছিল এবং তিনি সময়ের সঙ্গেও সম্পর্ক হারিয়ে ফেলেছিলেন। (Source: Siffre, M. (1972). "The Man Who Lived in a Cave")
সিফ্রের এই আবিষ্কারগুলি শুধু সময়ের অনুভূতির বিষয়টিই নয়, বরং মহাকাশ গবেষণা (যেখানে নভশ্চররা দীর্ঘ একাকিত্ব অনুভব করেন) এবং একাকী কারাবাসের মতো ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। তাঁর গবেষণা দেখিয়েছে যে সময়ের অনুভূতি কতটা জরুরি এবং এটি আমাদের বাস্তবতা অনুধাবনকে কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে। (Source: NASA Studies on Human Isolation in Space)
তবে সিফ্রের ওপর এর গভীর প্রভাব পড়েছিল। তিনি স্থায়ীভাবে স্মৃতি হারিয়েছিলেন এবং তার মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে অনেক বছর সময় লেগেছিল। তিনি অভিজ্ঞতাটিকে “একটি অবিরাম রাত্রি” হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন, যা তাকে বহু বছর ধরে তাড়িত করেছে। (Source: Siffre, M. (1975). "The Man Who Lived in a Cave")
তবে এর পরও, সিফ্রে তার গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন এবং অন্যান্য গুহায় আরো একাকিত্বের পরীক্ষা করেছিলেন। তার কাজ আধুনিক নিদ্রা বিজ্ঞান এবং সময় মনস্তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। কিন্তু তিনি যে প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন, তা আজও রয়ে গেছে: আসলে সময় কী? এটি কি বাইরের কোনো বাস্তবতা, না কি এটি শুধুমাত্র মনের সৃষ্টি? (Source: Siffre, M. (1975). "La Mémoire et Le Temps")
সিফ্রের উত্তরাধিকার আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানব মনের অসীম শক্তি এবং ভঙ্গুরতার কথা। তাঁর গবেষণা শুধু সময়ের অনুভূতির জটিলতাগুলোই নয়, একাকিত্বের মানসিক ও আবেগিক প্রভাবগুলোকেও উন্মোচন করেছে।
যেমন সিফ্রে নিজে বলেছিলেন, "মস্তিষ্ক একটি নিজস্ব মহাবিশ্ব।"
collected