04/08/2025
তাসমানিয়ার এক নির্জন বন, রাতের আকাশে তারা ঝলমল করছে, আর চারদিকে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর হালকা ঠান্ডা বাতাস। ফটোগ্রাফার বেন অলড্রিজ হাতে তার ক্যামেরা আর বিশেষ UV লাইট নিয়ে হাঁটছিলেন, মনে মনে ভাবছিলেন—আজ দিনটা তেমন ভালো গেলো না, বেশি একটা ছবি তোলা হয়নি। আজ যেন দ্রুতই অন্ধকার নেমে এসেছিল। এসব ভাবতে ভাবতে হতাশ হয়ে বনের অন্য অংশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। ঠিক সেসময়ই হঠাৎ তার চোখে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্য। ঝোপের ভেতরে যেন হালকা সবুজাভ আলো ঝলমল করছে। প্রথমে তিনি ভাবলেন হয়তো কোনো জোনাকি পোকা, কিন্তু আলোটা অনেক বড় আর স্থির। ধীরে ধীরে ক্যামেরা ফোকাস করতেই দেখা গেল—একটি পূর্বাঞ্চলীয় কোয়াল, তাসমানিয়ার ছোট্ট মাংসাশী প্রাণী, তার পুরো শরীর যেন অদ্ভুত এক নরম জ্যোতিতে ভেসে উঠেছে! যেখানে তার লোম সাধারণত বাদামি বা কালো রঙের হয়, সেখানে এখন মনে হচ্ছিল যেন কোনো স্বর্গীয় আলো ছড়াচ্ছে প্রাণীটি। বেন নিঃশব্দে শ্বাস আটকে ক্যামেরার শাটার চাপলেন। সেই সাথে বন্য পরিবেশে প্রথম ‘অন্ধকারে জ্বলতে থাকা’ মার্সুপিয়ালের ছবি ধারণ করে ফেললেন ক্যামেরায়। নতুন এক ইতিহাস গড়লেন।ছোট্ট এই ঘটনাটি শুধু সুন্দরই নয়, বৈজ্ঞানিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। কোয়ালের এই জ্বলজ্বলে লোমকে বলে বায়োফ্লুরোসেন্স।
বায়োফ্লুরোসেন্স একটি বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ঘটনা, যেখানে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের শরীর নির্দিষ্ট আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে এবং তা অন্য রঙে প্রতিফলিত করে। সহজভাবে বললে, কিছু প্রাণীর শরীরে বিশেষ ধরনের প্রোটিন বা রাসায়নিক অণু থাকে, যেগুলো অতিবেগুনি (UV) বা নীল আলো শোষণ করে এবং পরে সেই আলোকে সবুজ, নীল, কমলা বা গোলাপি রঙে প্রকাশ করে। এই ঘটনাকে সাধারণত চোখে দেখা যায় না, বরং বিশেষ আলোয় বা ক্যামেরার সাহায্যে ধরা যায়।
কিন্তু বায়োফ্লুরোসেন্স কেন তৈরি হয়, সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হলো এটি প্রাণীদের যোগাযোগের একটি পদ্ধতি। অন্ধকারে নিশাচর প্রাণীরা সাধারণত চোখে না পড়ে চলাফেরা করে, কিন্তু UV আলোয় তাদের শরীরের জ্যোতি হয়তো একে অপরকে চিনতে সাহায্য করে। এই আলো সঙ্গী আকর্ষণ বা প্রজনন সংকেতের কাজও করতে পারে। যেমন, কিছু মাছ এবং প্রবাল রাতের বেলায় বায়োফ্লুরোসেন্ট হয়ে নিজেদের উপস্থিতি প্রকাশ করে। অন্যদিকে, কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে এই জ্যোতি আত্মরক্ষার কৌশল হতে পারে। অদ্ভুত আলোর প্রভাবে শিকারি প্রাণী বিভ্রান্ত হতে পারে অথবা তারা পরিবেশের সঙ্গে মিশে যেতে পারে।
এছাড়াও, বিজ্ঞানীরা মনে করেন বায়োফ্লুরোসেন্স পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার একটি অভিযোজনও হতে পারে। রাতের অন্ধকারে বা গভীর সমুদ্রের মতো পরিবেশে আলোর অভাব থাকে। সেখানে এমন আলো শোষণ ও প্রতিফলনের মাধ্যমে প্রাণীরা নিজেদের চারপাশ বুঝতে পারে বা সঠিকভাবে চলাচল করতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে এটি শরীরের প্রাকৃতিক রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফলাফল মাত্র। যেমন, প্রবাল বা কিছু জেলিফিশের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে Green Fluorescent Protein (GFP) থাকে, যা সূর্যালোক বা UV আলো শোষণ করে সবুজ আলো ছড়ায়।
এখন পর্যন্ত যেসব প্রাণীর মধ্যে বায়োফ্লুরোসেন্স দেখা গেছে তার মধ্যে রয়েছে মেরুভালুক, মোল, জেব্রা, ওম্ব্যাট, আর্মাডিলো, উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি এবং তাসমানিয়ার কোয়াল। শুধু স্তন্যপায়ী নয়, প্রবাল, কিছু প্রজাতির মাছ, কচ্ছপ, ব্যাঙ, পোকা, মাকড়সা, এমনকি কিছু পাখিও বায়োফ্লুরোসেন্ট। প্রতিটি প্রাণী আলাদা রঙে ঝলমল করে ওঠে। যেমন, সাগরের গভীরে পাওয়া কিছু হাঙর সবুজাভ আলো ছড়ায়, আবার প্যারাকিট নামের একধরনের পাখি UV আলোয় ডানায় উজ্জ্বল নকশা প্রকাশ করে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বায়োফ্লুরোসেন্সের সঠিক উদ্দেশ্য হয়তো একাধিক। এটা একদিকে প্রজনন, যোগাযোগ ও আত্মরক্ষার কাজে লাগে, আবার অন্যদিকে হয়তো কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়াই শুধু শরীরের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ঘটে। এই রহস্য উন্মোচনের জন্য গবেষকরা এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। হয়তো আগামী কয়েক বছরে আমরা জানব, এই প্রাকৃতিক জ্যোতি আসলে প্রাণীজগতে কী গভীর বার্তা বহন করে।
তাসমানিয়া কোয়ালের এই ছবি তোলার পর বেন অলড্রিজ মজার ছলে বলেছেন, “হয়তো ওরা নিজেদের শরীরে আলো উৎপন্ন করে পার্টি করে!” বেন অলড্রিজের তোলা এই অসাধারণ ছবিটি ২০২৫ সালের Beaker Street Science Photography Prize-এর জন্য জমা দেওয়া হয়েছে এবং আগস্ট ৬ থেকে ৩১ তারিখ পর্যন্ত তাসমানিয়ান মিউজিয়াম অ্যান্ড আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শিত হবে। সেখানে দর্শকরা নিজের পছন্দের ছবির জন্য ভোট দিতে পারবেন।
মূল লেখা: রাজেশ মজুমদার, বিসিবি।