15/06/2025
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বর্তমান পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ক্ষয়ক্ষতির বিশ্লেষণ
কার্যনির্বাহী সারসংক্ষেপ
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার বর্তমান সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি গভীর পরিবর্তন এনেছে, যা দীর্ঘদিনের ছায়া যুদ্ধ থেকে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। এই গবেষণা রিপোর্টটি সংঘাতের ঐতিহাসিক বিবর্তন, আধুনিক প্রযুক্তির (ড্রোন, সাইবার হামলা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) উদ্ভাবনী ব্যবহার, এর বহুমুখী মানবিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গতিপথ বিশ্লেষণ করে।
ঐতিহাসিকভাবে, ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৯ সালের শাহের শাসনামল পর্যন্ত ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি অপ্রত্যাশিত কিন্তু কৌশলগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব এই সম্পর্ককে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দেয়, ইসরায়েলকে "শয়তানের রাষ্ট্র" আখ্যা দিয়ে ফিলিস্তিনি কারণকে ইরানের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। এরপর থেকে ইরান লেবাননের হিজবুল্লাহ, হামাস এবং ইয়েমেনের হুথিদের মতো প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে একটি "প্রতিরোধ অক্ষ" গড়ে তোলে, যা ইসরায়েলের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
বর্তমান সংঘাতের তীব্রতা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলার পর উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, যার ফলে ইসরায়েল ইরানের মিত্রদের উপর ধারাবাহিক হামলা চালায় এবং প্রতিরোধ অক্ষকে দুর্বল করে দেয়। ২০২৫ সালের জুন মাসে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ব্যাপক প্রতিরোধমূলক হামলা চালায়, যার জবাবে ইরানও ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে পাল্টা হামলা করে। এই সংঘাতের মূল বৈশিষ্ট্য হলো আকাশপথে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, যেখানে ইসরায়েলের বিমান সক্ষমতা এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাকে কৌশলগত সুবিধা দিয়েছে, যদিও ইরানের পাল্টা হামলা ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধন করেছে।
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে, ড্রোন, সাইবার হামলা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) যুদ্ধের কৌশলকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করেছে। ইসরায়েল ড্রোন ঝাঁক এবং AI-সক্ষম গোয়েন্দা ব্যবস্থা ব্যবহার করে কৌশলগত চমক অর্জন করেছে, অন্যদিকে ইরান কম খরচের ড্রোন এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে অসম যুদ্ধ কৌশল প্রয়োগ করছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অগ্রগতি ইসরায়েলের জন্য "অস্তিত্বের হুমকি" হিসেবে বিবেচিত, যা ইসরায়েলের প্রতিরোধমূলক হামলার প্রধান চালিকা শক্তি।
এই সংঘাতের মানবিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যাপক। উভয় পক্ষেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হতাহত হয়েছে, যার মধ্যে বেসামরিক নাগরিকের সংখ্যা বেশি। গাজায় মানবিক সংকট, বাস্তুচ্যুতি, খাদ্য ও চিকিৎসা পরিষেবার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। অর্থনৈতিকভাবে, সংঘাত বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সরবরাহ চেইনকে ব্যাহত করেছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করছে।
আন্তর্জাতিকভাবে, বিশ্ব শক্তিগুলো (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সংঘাত নিরসনে জটিল ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরব, কাতার, তুরস্ক ও পাকিস্তান, ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং সংযম ও কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ, ন্যাটো এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সংঘাতের তীব্রতা এবং মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সামগ্রিকভাবে, এই সংঘাত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। এটি পারমাণবিক অপ্রসারণের চ্যালেঞ্জকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী একটি নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুঁকি তৈরি করেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং সংঘাতের মূল কারণগুলোর সমাধান অপরিহার্য।
১. ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার বর্তমান সংঘাতের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত, যা কেবল সাম্প্রতিক উত্তেজনা নয়, বরং কয়েক দশকের ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন, আদর্শিক সংঘাত এবং কৌশলগত স্বার্থের জটিল জালকে প্রতিফলিত করে। এই সম্পর্কটি বন্ধুত্বের পর্যায় থেকে চরম শত্রুতায় রূপান্তরিত হয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের গতিপথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
১.১. ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্কের ইতিহাস: ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে ২০২৩ পর্যন্ত যুদ্ধের সূত্রপাত
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক ছিল এক জটিল সমীকরণ। প্রাথমিকভাবে, এই দুই দেশের মধ্যে একটি অপ্রত্যাশিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, যা তৎকালীন মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছিল বিরল।
প্রাথমিক বৈরিতা ও ইসরায়েলের স্বীকৃতি:
১৯৪৭ সালে, ফিলিস্তিনের ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের জন্য জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া ১৩টি দেশের মধ্যে ইরান অন্যতম ছিল। এরপর, জাতিসংঘে ইসরায়েলের সংযুক্তির বিপক্ষেও ইরান ভোট দেয়। এই পদক্ষেপগুলো প্রাথমিকভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইরানের সংহতি প্রকাশ করে। তবে, বিস্ময়করভাবে, ১৯৫০ সালে তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া দ্বিতীয় মুসলিম দেশ ছিল ইরান। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বৈরিতায় টিকে থাকতে ইসরায়েল ইরানকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে।
শাহের শাসনামলে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক (১৯৫৩-১৯৭৯):
১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থানের পর, যখন মোহাম্মদ রেজা পাহলভি (শাহ) ক্ষমতায় পুনর্বহাল হন, তখন দুই দেশের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ইসরায়েলের "পেরিফেরি ডকট্রিন" (Periphery Doctrine) এর অংশ হিসেবে ইরান, তুরস্ক ও ইথিওপিয়ার মতো অনারব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই মতবাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্যান-আরব জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করা এবং আরব বিশ্বের বাইরে মিত্র খুঁজে বের করা।
১৯৫৮ সালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন এবং তুর্কি প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্ডারেস "ট্রাইডেন্ট" (Trident) নামক একটি গোপন জোট গঠন করেন, যেখানে ইরানও একটি কেন্দ্রীয় অংশীদার ছিল।
এই সম্পর্কের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং অস্ত্র বাণিজ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইসরায়েলের মোসাদ (Mossad) এবং ইরানের তৎকালীন গুপ্তচর সংস্থা সাভাক (SAVAK) ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করত। ইসরায়েল ইরানকে সামরিক উপদেষ্টা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিত, বিশেষ করে ইরানের সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সের উন্নয়নে।
ইরান ইসরায়েলের প্রধান অপরিশোধিত তেল সরবরাহকারী ছিল এবং ইসরায়েল নিয়মিত ইরানকে অস্ত্র বিক্রি করত, যা ইসরায়েলের উদীয়মান প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইসরায়েলের বাইরে ইরানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ইহুদি বসবাস করত, যা উভয় দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের একটি সামাজিক দিক ছিল।
ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার উপর আদর্শের নমনীয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার ১৯৪৮-১৯৭৯ সালের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কেবল একটি ঐতিহাসিক কৌতূহল নয়, বরং এটি দেখায় যে কীভাবে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য আদর্শগত মতপার্থক্যকে সাময়িকভাবে ছাপিয়ে যেতে পারে।
ইসরায়েলের "পেরিফেরি ডকট্রিন" এবং ইরানের অনারব পরিচয় উভয়কেই আরব জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে একটি অভিন্ন কৌশলগত ভিত্তি প্রদান করেছিল। এই সম্পর্ক প্রমাণ করে যে, এমনকি তীব্র আদর্শগত বিরোধের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, বাস্তববাদী ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ দেশগুলোকে অপ্রত্যাশিত জোট গঠনে চালিত করতে পারে। এটি মধ্যপ্রাচ্যের জটিল এবং পরিবর্তনশীল জোটের একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ, যা বর্তমান সংঘাতের গতিপথ বুঝতে সহায়ক।
যুদ্ধের সূত্রপাত (২০২৩):
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে হামলার পর এই সংঘাতের তীব্রতা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এই হামলার পর ইসরায়েল কঠোর সামরিক প্রতিক্রিয়া জানায় এবং ইরানের মিত্রদের (যেমন হামাস, হিজবুল্লাহ, হুথি) উপর ধারাবাহিক হামলা চালায়, যা ইরানের "প্রতিরোধ অক্ষ" (Axis of Resistance) কে দুর্বল করে দেয়। এই ঘটনাগুলো ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে একটি নতুন এবং বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে আসে।
১.২. ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব এবং ইরান-ইসরায়েল সম্পর্কের মোড় পরিবর্তন
১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক মোড় ঘুরিয়ে দেয়, যা দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বৈরিতার ভিত্তি স্থাপন করে।
সম্পর্কের আকস্মিক বিচ্ছিন্নতা:
১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লব রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এই নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ইসরায়েলকে "শয়তানের রাষ্ট্র" (Little Satan) আখ্যা দিয়ে তার বৈধতা প্রত্যাখ্যান করে। ইরান ইসরায়েলের সাথে সব ধরনের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ইসরায়েলে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
ইসলামী বিপ্লবের পর ইহুদিদের একটি বড় অংশ ইরান ত্যাগ করে, যদিও বর্তমানে ২০,০০০-এর বেশি ইহুদি ইরানে বসবাস করে।
ফিলিস্তিনি কারণের প্রতি জোরালো সমর্থন:
নতুন ইরানি শাসনব্যবস্থা ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের প্রতি জোরালো সমর্থন জানায় এবং ফিলিস্তিনি কারণকে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
১৯৭৯ সালের আগস্টে বিপ্লবী নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রদর্শনের জন্য রমজানের শেষ শুক্রবারকে "কুদস (জেরুজালেম) দিবস" হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ইসলামী বিপ্লবী গার্ড কর্পস (IRGC)-এর অভিজাত ইউনিট "কুদস ফোর্স" (Qods Force) এর নামকরণও জেরুজালেমের নামে করা হয।ইরান ইসরায়েলকে মুসলিমদের পবিত্র ভূমি দখলকারী হিসেবে বিবেচনা করে এবং খোমেনি ইসরায়েলকে "ইসলামী দেশগুলোর দেহে একটি ক্যান্সারযুক্ত টিউমার" বলে অভিহিত করেন, যা উপড়ে ফেলতে হবে।
আদর্শিক রূপান্তর ও ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণ এই পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব কেবল একটি শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন ছিল না, এটি ইরানের পররাষ্ট্রনীতির একটি মৌলিক আদর্শিক রূপান্তর ছিল। ইসরায়েলকে "শয়তানের রাষ্ট্র" হিসেবে আখ্যায়িত করা এবং ফিলিস্তিনি কারণকে নিজেদের এজেন্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণকে আরও গভীর করে তোলে, যা পরবর্তী চার দশকের প্রক্সি সংঘাতের ভিত্তি স্থাপন করে।
এই আদর্শিক পরিবর্তন ইরানের আঞ্চলিক কৌশলকে প্রভাবিত করে; ফিলিস্তিনি কারণকে সমর্থন করে ইরান মুসলিম বিশ্বে তার বিপ্লবী পরিচয় ও প্রভাব বাড়াতে চেয়েছিল। এর ফলস্বরূপ, ইরান লেবাননে হিজবুল্লাহর মতো প্রক্সি বাহিনী তৈরি করে, যা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি নতুন ফ্রন্ট তৈরি করে। এটি মধ্যপ্রাচ্যে একটি "প্রতিরোধ অক্ষ" গঠনের ভিত্তি স্থাপন করে, যা ইসরায়েলের পতনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।এই আদর্শিক রূপান্তর মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যে স্থায়ী পরিবর্তন আনে এবং ইসরায়েল তার "পেরিফেরি ডকট্রিন" পুনর্বিবেচনা করে।
প্রতিরোধ ফ্রন্টের সংঘাতের সূচনা:
১৯৮০-এর দশকের শুরুতে ইরানের সহায়তায় গেরিলা বাহিনী হিসেবে হিজবুল্লাহ গঠিত হয়, যারা দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবানন আক্রমণ করলে উত্তেজনা আরও বাড়ে, কারণ এই আগ্রাসন ইরানের মিত্র ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) এবং শিয়া সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব ফেলে।ইরান লেবাননের বেকা উপত্যকায় প্রায় ১,৫০০ IRGC উপদেষ্টা পাঠায়, যারা হিজবুল্লাহকে সংগঠিত, প্রশিক্ষণ ও সজ্জিত করতে সহায়তা করে।
কৌশলগত বাস্তববাদ বনাম আদর্শিক বৈরিতা এই সময়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। ইরান-ইরাক যুদ্ধের (১৯৮০-১৯৮৮) সময় প্রকাশ্যে বৈরিতা সত্ত্বেও ইরান ও ইসরায়েল গোপন সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। ইসরায়েল ইরানকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে, যার বেশিরভাগের মূল্য পরিশোধ করা হয় ইরানি তেল দিয়ে। এই গোপন অস্ত্র বিক্রি "ইরান-কন্ট্রা অ্যাফেয়ার" (Iran-Contra affair) এর অংশ ছিল, যেখানে ইসরায়েলি মধ্যস্থতাকারীরা লেবাননে আমেরিকান জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে ইরানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল।
এই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতা এবং "শত্রুর শত্রু বন্ধু" নীতির গুরুত্ব তুলে ধরে। এটি দেখায় যে, এমনকি গভীর আদর্শিক বিভাজন থাকা সত্ত্বেও, জাতীয় নিরাপত্তা এবং টিকে থাকার স্বার্থে দেশগুলো বাস্তববাদী এবং গোপন সহযোগিতা বজায় রাখতে পারে।
১.৩. ইরানী বৈদেশিক নীতি, পারমাণবিক কর্মসূচি ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ
১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন আসে, যা ইসরায়েলের প্রতি প্রকাশ্য বৈরিতার জন্ম দেয় এবং পারমাণবিক কর্মসূচির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।
ইরানের পররাষ্ট্রনীতির বিবর্তন ও "প্রতিরোধ অক্ষ":
১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে ইসরায়েলের প্রতি ইরানের সম্পর্ক "কোল্ড পিস" থেকে প্রকাশ্য শত্রুতায় পরিণত হয়। ইরান ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদ, হামাস এবং ইয়েমেনের হুথিদের মতো ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে তহবিল ও সমর্থন দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে প্রক্সি সংঘাত চালায়। ইরান তার "প্রতিরোধ অক্ষ" (Axis of Resistance) গড়ে তোলে, যা লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়া ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের নিয়ে গঠিত। এই প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক প্রভাব বাড়াতে এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা হুমকিতে ফেলতে কাজ করে।
"প্রতিরোধ অক্ষ" এর কৌশলগত দুর্বলতা ও ইসরায়েলের লক্ষ্য এখানে স্পষ্ট। ইরানের "প্রতিরোধ অক্ষ" মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারের একটি মূল কৌশল হলেও, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলায় এই অক্ষের উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। ইসরায়েলের লক্ষ্য কেবল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করা নয়, বরং ইরানের আঞ্চলিক নেটওয়ার্ককে ভেঙে দেওয়া, যা ইসরায়েলের জন্য দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি বৃহত্তর কৌশলগত উদ্দেশ্য নির্দেশ করে। হামাস ও হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদের পতন ইরানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ রুট বন্ধ করে দিয়েছে।
এই দুর্বলতাগুলো ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবকে সীমিত করছে এবং ইসরায়েলকে ইরানের বিরুদ্ধে আরও আক্রমণাত্মক হতে উৎসাহিত করছে। "প্রতিরোধ অক্ষ" এর দুর্বলতা মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আনছে এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর (যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত) ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
পারমাণবিক কর্মসূচি ও ইসরায়েলের উদ্বেগ:
ইসরায়েল বহু দশক ধরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে তার অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইসরায়েল বিশ্বাস করে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে, যদিও ইরান দাবি করে তার কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে। জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা (IAEA) সতর্ক করেছে যে ইরানের কাছে "কয়েকটি" পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত ইউরেনিয়াম রয়েছে। ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইরানের একটি সংগঠিত পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ছিল বলে IAEA এবং পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে।
ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে অসংখ্য গোপন হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে সাইবার হামলা এবং ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা অন্তর্ভুক্ত। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে আসার পর ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ দ্রুত গতিতে বেড়েছে।
২০২৫ সালের জুন মাসে IAEA ইরানকে পারমাণবিক অপ্রসারণ চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য নিন্দা জানায়, যার প্রতিক্রিয়ায় ইরান একটি তৃতীয় সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেয়। ইসরায়েল ইরানের নাতাঞ্জ (Natanz) পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, যা ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সক্ষমতাকে কয়েক মাস বা বছর পিছিয়ে দিতে পারে।
পারমাণবিক কর্মসূচি: ইসরায়েলের জন্য "অস্তিত্বের হুমকি" এবং "সময় ফুরিয়ে আসছে" ধারণাটি ইসরায়েলের পদক্ষেপের মূল চালিকাশক্তি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বারবার বলেছেন যে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি রোধে "সময় ফুরিয়ে আসছে"। IAEA-এর সাম্প্রতিক নিন্দা এবং ইরানের তৃতীয় সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা ইসরায়েলের এই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করেছে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে।
ইসরায়েল মনে করে, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে তা ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হবে।এই ধারণা ইসরায়েলকে প্রতিরোধমূলক (preemptive) হামলার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক আইনের "আত্মরক্ষার অধিকার" (self-defense) এর বিতর্কিত ব্যাখ্যাকে সামনে এনেছে। এই ধরনের হামলা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে এবং পারমাণবিক অপ্রসারণের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দেয়।
আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ ও প্রতিক্রিয়া:
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক প্রক্সি কার্যক্রম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চীন ও রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্রসহ আকাশপথে ইরানকে সহায়তা করছে বলে রিপোর্ট রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল দীর্ঘকাল ধরে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি রোধে সামরিক পদক্ষেপের অঙ্গীকার করেছে।তবে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন একটি কূটনৈতিক সমাধান খুঁজছে, যদিও ইসরায়েল কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রতি সন্দিহান।
১.৪. ইরান-ইসরায়েল সম্পর্কের জটিলতা এবং প্রতিরোধ
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাত দীর্ঘকাল ধরে একটি "ছায়া যুদ্ধ" হিসেবে চলে আসছিল, যেখানে গোপন হামলা, সাইবার আক্রমণ এবং প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে একে অপরের ক্ষতি করা হতো। এই সংঘাতের প্রকৃতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবর্তিত হয়েছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ছায়া যুদ্ধ থেকে সরাসরি সংঘাতে রূপান্তর:
২০২৪ সালে এই সম্পর্ক সরাসরি সংঘাতে রূপ নেয়, যেখানে উভয় পক্ষই একে অপরের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ২০২৫ সালের জুন মাসে (চলমান যুদ্ধে) ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ব্যাপক হামলা চালায়, যা এই সংঘাতকে আরও তীব্র করে তোলে।
"ছায়া যুদ্ধ" থেকে "সরাসরি সংঘাতে" রূপান্তরের প্রভাব আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি নতুন এবং বিপজ্জনক মাত্রা যুক্ত করেছে। এটি কেবল সামরিক কৌশলকেই প্রভাবিত করেনি, বরং উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। সরাসরি হামলাগুলো উভয় দেশের "রেড লাইন" (red line) কে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। ইসরায়েলের "প্রতিরোধমূলক" হামলার দাবি এবং ইরানের "অপারেশন ট্রু প্রমিজ ৩" এর মতো নামকরণ উভয় পক্ষের পক্ষ থেকে একটি নতুন ধরনের সংঘাতের বৈধতা এবং জনসমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা। এটি মধ্যপ্রাচ্যে একটি "নতুন স্বাভাবিক" (new normal) অবস্থা তৈরি করছে, যেখানে সরাসরি সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি অনেক বেশি।
এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক আইনের "আত্মরক্ষার অধিকার" (right of self-defense) এর ব্যাখ্যা নিয়েও নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। সরাসরি সংঘাতের এই নতুন পর্যায় আঞ্চলিক দেশগুলোকে (যেমন জর্ডান, ইরাক, মিশর) আরও বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলেছে, কারণ তাদের আকাশসীমা এবং ভূখণ্ড উভয় পক্ষ দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি বিশ্ব অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে তেল ও গ্যাসের বাজারে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।
ইসরায়েলের আগ্রাসনমূলক পদক্ষেপ:
ইসরায়েল তার হামলাকে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি রোধে একটি কথিত "প্রতিরোধমূলক, সুনির্দিষ্ট, সমন্বিত আক্রমণ" (preemptive, precise, combined offensive) হিসেবে বর্ণনা করেছে। ইসরায়েল দাবি করে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে এবং ইরানের নেতৃত্ব ইসরায়েলকে ধ্বংস করার বারবার হুমকি দিয়েছে।
ইসরায়েল তার গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের মাধ্যমে ইরানের অভ্যন্তরে অস্ত্র পাচার করে এবং ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন করে। এই কৌশলগুলো ইসরায়েলকে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করতে এবং কৌশলগত চমক (strategic surprise) অর্জন করতে সাহায্য করে।
ইরানের প্রতিরোধ ও পাল্টা হামলা:
ইসরায়েলের হামলার জবাবে ইরান শত শত ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করে। ইরান ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে "স্যাচুরেট" করতে এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে ড্রোন ঝাঁক (drone swarms) ব্যবহার করে। ইরান তার পাল্টা হামলাকে "অপারেশন ট্রু প্রমিজ ৩" (Operation True Promise 3) নামকরণ করে এবং ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি ও বিমানঘাঁটিতে আঘাত হানার দাবি করে।
চলবে...
Israel Defense Forces Israel Ministry of Foreign Affairs Israeli Air Force Organisation of Islamic Cooperation (OIC) Arab News Daily Ittefaq Channel 24 News NewsBangla24.com The Daily Star bdnews24.com Daily Naya Diganta Daily News Prothom Alo Rtv News । সংবাদ somoynews.tv Daily Jugantor NEWS24 MD Hussain Billah Urdu News Saudi Arabia RADIO TEHRAN
Hussain Billah
Founder & Chief Analyst, SIPRS