23/11/2024
উপন্যাস: তাহার অপেক্ষায় (4)
আহাদ স্কুলে যাচ্ছে না, প্রায় এক মাস হয়ে গেল। কী হয়েছে, কেন যাচ্ছে না, তা জানতে অমি সেদিন আহাদের বাড়ি গেল। দরজা খুলতেই আহাদ অবাক!
"এতদিন পর দেখা, কেমন আছিস তুই?" বলল আহাদ।
অমি হেসে বলল, "এইসব বাদ দে। আগে বল, স্কুলে যাচ্ছিস না কেন? কী সমস্যা তোর?"
আহাদ শান্তভাবে উত্তর দিল, "তেমন কিছু না। ভালো লাগে না, তাই যাই না। চল, পুকুরপাড়ে একটু ঘুরে আসি।"
কথা শেষ হতেই তারা দু'জন পুকুরপাড়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।
পুকুরপাড়ে পৌঁছে অমি আবারও বলল, "পড়াশোনা কতদূর এগিয়েছে, খেয়াল আছে তোর? আর শোন, আমাদের ক্লাসে নতুন একটা মেয়ে এসেছে। তুই চাইলে পটিয়ে দিতে পারি!"
আহাদ একটু আগ্রহ নিয়ে বলল, "নাম কী?"
"নাম জানি না। কিন্তু দেখতে পুরাই পরির মতো!"
"সত্যি?"
"হুম। তাহলে বল, পটিয়ে দিবো কি?"
আহাদ হেসে বলল, "পটানোর দরকার নেই। বন্ধু বানিয়ে দিলেই চলবে।"
অমি মজা করে বলল, "ঠিক আছে। কিন্তু কাল তুই স্কুলে আসতেই হবে।"
"আচ্ছা যাব। তুইও আসিস, আর সবাইকে বলতে ভুলিস না।"
সন্ধ্যার আড্ডা শেষে আহাদ অমিকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজের বাসায় ফিরে এল। বাড়ি ফিরেই বই-খাতা গুছাতে লাগল। এসব দেখে তার মা জাবিহা খাতুন বললেন,
"কি ব্যাপার আহাদ সাহেব? কাল তাহলে স্কুলে যাবেন?"
আহাদ মুচকি হেসে বলল, "জি, কাল থেকে নিয়মিত স্কুলে যাব।"
মা বললেন, "দেখা যাক।"
রাতে আহাদ খেয়ে শুয়ে পড়ল। সকালে উঠতে হবে যে!
সকালে সাতটা তিরিশে আহাদের মা তাকে ডেকে তুললেন। ঘুমঘুম চোখে উঠল আহাদ। ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে-দেয়ে রেডি হয়ে স্কুলে বেরিয়ে পড়ল।
স্কুলে তখন সবাই পৌঁছে গেছে—মিনু, অমি, রিফাত, মিম, আলিফ। শুধু আহাদ বাকি! কিছুক্ষণ পরই সে এসে হাজির। ওকে দেখে মিনু বলে উঠল,
"মামা, আমাদের ক্লাসে নতুন একটা মেয়ে এসেছে। রুমে গিয়ে দেখে আয়!"
আহাদ অস্বস্তি নিয়ে বলল, "রুমে তো সব মেয়েরা! আমি লজ্জা পাই। তুই চল, আমি শুধু ব্যাগ রেখে চলে আসব।"
মিনু হাসতে হাসতে বলল, "চল লজ্জাবতী মশাই!"
তারা ক্লাসে ঢোকার সময় আহাদ মিনুকে বলল, "তুই আমাকে ধাক্কা দে, আমি যেন অপ্রত্যাশিতভাবে ঢুকি।"
মিনু হেসে কুটিপাটি! "ঠিক আছে," বলেই সে আহাদকে ধাক্কা দিল। আহাদ রুমে ঢুকে দেখে মেয়েদের মধ্যে একজন নতুন মেয়ে। তার মনে হলো এটাই হয়তো সেই মেয়ে যার কথা অমি আর মিনু বলছিল।
ব্যাগ রেখে আহাদ বাইরে চলে এলো। সবাই মিলে আড্ডা দিতে শুরু করল। ক্লাস শুরু হলে তারা রুমে ফিরে গেল।
টিফিন পিরিয়ড
টিফিনে ক্লাসরুমে মেয়েরা গান গাইছিল। অমি বিরক্ত হয়ে বলল, "এই চিল্লা-চিল্লি বন্ধ করো তো!"
এই শুনে নতুন মেয়েটি তিরিক্ষি স্বরে বলল, "আমাদের দিকে তাকাতে কে বলেছে? লজ্জা হয় না?"
আহাদের রাগ চড়ে গেল। "তোমার এমন কী চেহারা, যে তোমার দিকে তাকাবে"
এই কথায় মেয়েটি রাগান্বিত দৃষ্টিতে আহাদের দিকে তাকিয়ে রইল। পাশে বসে মিনু পুরো দৃশ্য উপভোগ করছিল। এভাবেই দিনটা শেষ হলো
আহাদের বন্ধু বলতে অমি, মিনু, মিম, আলিফ, আর রিফাত। এদের পরিচয় দিতে গেলে গল্প ফুরোবে না!
অমি:
অমি হলো সেই বন্ধু, যে সবসময় একটা গান নিয়ে হাজির হয়। ক্লাসে পড়ার সময় গুনগুন করে গান গাইতে গিয়ে স্যারের বকুনি খাওয়া ওর নিত্যদিনের ব্যাপার। বন্ধুরা ওকে নিয়ে মজা করলেও, অমি গানের প্রতিভা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। স্কুলের কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অমি মানেই সবার আগে গান শোনার জন্য হুড়োহুড়ি!
মিনু:
মিনু পুরো ক্লাসের বিনোদনের মূল উৎস। কথায় কথায় এমন কিছু বলে, যা সবাইকে হাসিয়ে দেয়। টিফিনের সময় মিনুর সাথে থাকলে কেউ কখনো খারাপ মুডে থাকতে পারে না। তবে মজার মানুষ হলেও, ক্লাসের পড়ালেখায় বেশ সিরিয়াস।
আলিফ:
আলিফ হলো পুরো ক্লাসের 'হ্যান্ডসাম বয়।' স্কুলের যেকোনো নাচের প্রতিযোগিতায় আলিফ মানেই সেরা পারফরম্যান্স। ওর স্টাইল আর আত্মবিশ্বাস দেখে সবাই মুগ্ধ। বন্ধুরা মজা করে বলে, "আলিফের মতো নাচতে পারলে সেলিব্রিটি হয়ে যেতাম!"
মিম:
মিম একটু চুপচাপ স্বভাবের, কিন্তু বন্ধুত্বের দিক দিয়ে সবার কাছে খুব প্রিয়। ও কথা কম বলে, কিন্তু ওর চোখের ভাষা যেন সব বলে দেয়। যখন বন্ধুরা বেশি দুষ্টুমি করে, মিমের এক চাহনিতেই সবাই শান্ত হয়ে যায়।
রিফাত:
রিফাত ক্লাসের সবচেয়ে পরিশ্রমী ছেলেদের একজন। পড়াশোনা, খেলাধুলা, বা স্কুলের যেকোনো কাজে রিফাত সবসময় তার সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করে। বন্ধুরা ওকে নিয়ে গর্ব করে কারণ ওর মতো উদার মন আর কারও নেই। কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে রিফাতই সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
এরপরের দিন আহাদ জানতে পারে সেই মেয়েটির নাম সামিয়া। সামিয়া তাদের পরিবারের দ্বিতীয় মেয়ে। তারা তিন ভাই-বোন, এবং সে এবার অন্য স্কুল থেকে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
এদিকে আহাদ মনে মনে ভাবলো, "সামিয়া যেমন মেয়ে, তার সাথে প্রথম পরিচয় ঝগড়ার মধ্যে দিয়ে হলো। আবার নাকি বন্ধু হবে!" এইসব ভাবতে ভাবতে সে একটু হেসে উঠলো। মিনু বলল, "হাসতেসিস কেন?" আহাদ বললো, "এমনি।"
এভাবেই দিনগুলো কাটতে লাগলো আহাদের। এখন তেমন সাইবার কথা তার মনে পড়ে না, সে শুধু তার পড়াশোনা এবং বন্ধুবান্ধব নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
একদিন আহাদ লক্ষ্য করলো, কিছুদিন ধরে বাবুর সাথে তেমন কথা হয় না। তাই সে ভাবলো আজকে তার সাথে দেখা করবে। বিকেলে তারা আবার তাদের প্রিয় মাঠে বসে গল্প করতে থাকে। একসময় বাবু বলল, "তোমার স্কুল জীবন কেমন যাচ্ছে?"
আহাদ: "হুম, ভালই যাচ্ছে।"
বাবু: "মেয়ে ফ্রেন্ড নেই, কেউ?"
আহাদ: "না, এখনো হয়নি। দেখি কি হয় সামনে।"
বাবু: "সাইবার কথা মনে পড়ে না?"
এই কথা শুনে আহাদ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বললো, "মনে পড়লেও কি করবো বলো? তার সামনে গিয়ে তো আর বলতে পারব না যে, 'তোমাকে ভালো লাগে, তুমি কি আমার বন্ধু হবে?' জানোই তো আমি কেমন। তবে আমার মনে হয়, সে আমাকে চিনেই না এখনো, আমার সম্পর্কে কিছু জানে না, আমার অনুভূতিগুলো তার জানা নেই। সেদিনের পর তাকে আর সামনে থেকে দেখিনি, জানি না এখন দেখতে কেমন হয়েছে।"
বাবু: "তাকে ভালোবাসে ফেলেছো তাই না?"
আহাদ: "ভালোবাসি কি না জানি না, তবে এটা বলব, তার নাম শুনলেই অন্যরকম ভালো লাগে, তার কথা ভাবলেই মুখে অজান্তেই হাসি চলে আসে।"
বাবু: "বুঝছি আমি।"
সেদিনের মতো আড্ডা দিয়ে তারা বাড়ি ফিরে যায়।
কিছু দিন পর আহাদ স্কুলে যায়। সেদিন তেমন কেউ আসে না, শুধু মিনু ছাড়া। তাই আহাদ আর মিনু হোটেলে গিয়ে কিছু খাওয়াদাওয়া করে। তারা খাওয়া শেষ করে আহাদ বিল দেয় এবং তারা হোটেল থেকে বের হয়ে আসে। ক্লাসরুমে বসে গল্প করতে থাকে।
ঠিক তখন মিনু বলে উঠে, "মামা, তুই কি বিল দিয়েছিস?"
আহাদ বলে, "হ্যাঁ, আমি তো দিলাম বিল। কেন, কি হয়েছে?"
মিনু বলে, "আরেহ মামা, কি করেছিস! আমি তো বিল দিয়েছি। চল, চল টাকা ফেরত নিয়ে আসি।"
আহাদ ও তার সাথে সহমত পোষণ করে। তারা হোটেলের দিকে যেতে থাকে। ঠিক মাঝপথে মিনু খিল খিল করে হেসে বলে, "আমি তো মজা করছি, তো সাথে একটু মজা করলাম, আমি তো বিল দেইনি।" এটা শুনে আহাদের মাথা গরম হয়ে যায়। মিনুকে ধরার জন্য সে তার পেছনে দৌড়াতে থাকে। "মিনু, তুই থাম, আজকে তোর খবর আছে!" মিনু তো আর থামে না, সে দৌড়াতেই থাকে।
মিনু মেয়েেরা যেখানে খেলা করে, সেখানে গিয়ে বসে থাকে। আহাদ আর কিছু বলে না, সে ক্লাসরুমে চলে আসে।
একটু পর মিনুও আসে এবং আহাদকে বলে, "মামা, সরি, ভুল হয়ে গেছে, এবারের মতো মাফ করে দে।" আহাদও বেশি কিছু বলল না।
মিনু আহাদকে বলে, "তুই কি জানিস, অমি আমাদের ক্লাসের একজনকে ভালোবাসে?"
এটা শুনে আহাদ অবাক হয়ে বলে, "কে? কাকে ভালোবাসে অমি?"
মিনু বলে, "আমিও জানি না, শুধু শুনলাম কালকে তার কাছ থেকে শুনতে হবে।"
আহাদও বলে, "হুম, কালকে আসুক স্কুলে, তারপর শোনা যাবে। সে কাকে ভালবাসে?"
চলবে.....