18/12/2023
চশমা চোখে কুয়াশা এসে কাঁচকে যেমন ঘোলাটে দেখায়;তেমনি জীবনের সামনে যখন উপবিষ্ট হয় হতাশা,হতোদ্যম আর হঠকারিতা জীবনও তখন নিমজ্জিত হতে চায় পাপের সাগরে,ঘোলাটে হয়ে যায় সবকিছু।নিমজ্জনের এই ভয়াবহ মুহুর্তগুলো,নিষ্ঠুরতার এই অন্ধকার সময়গুলো জীবন থেকে এমনি এমনি চলে যায়না।বিপর্যয়ের দিনগুলোতে জীবন পথের যে পথিক সমুদ্র পথের সেই নাবিকের মতো ভেলায় চড়ে নিজের আসল তরী খুঁজে নিতে পারে,অথৈ সাগরের ঢেউ থেকেও সে-ই উঠে আসতে পারে।
কিন্তু যেকোনো ভেলায় উঠে পড়লেই তো হয় না,ভেলাকে মজবুত করে গন্তব্যস্থল নিশ্চিত করতে হয়।তবে সবাই কি পারে সেই দুর্গম পথের গন্তব্য নিশ্চিত করতে?কিংবা গন্তব্য নিশ্চিত করলেও সবাই কি পারে অন্ধকারের অতল গহবরে হারিয়ে গিয়েও সত্যের শুভ্র আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে?
হে দুর্গম পথের পথিক...
কোথায় পাবে সেই নিশ্চিত গন্তব্যস্থল?
কীভাবে চিনবে সেই সত্য আর কিভাবে দেখবে সেই শুভ্রতার আলো?
সেই পথ এ জীবনেই।কিন্তু কেমন জীবনে?কোন সে জীবন যে জীবন সিরাতুল মুস্তাকিমের পথকে নিজের গন্তব্যস্থল হিসেবে নিশ্চিত করেছে,যে জীবন কুরআনের আলোয়, শুভ্রতার আলোয় সত্যকে খুঁজে পেয়েছে, সত্যকে খুঁজে পেয়েছে আল্লাহকে পাওয়ার মাধ্যমে।
সে জীবন...কোন সে জীবন?সেই জীবনের বর্ননা আমি খুঁজে পেয়েছি একটি রহস্যের পাতায়..একটি বইয়ের পাতায়।
সেই বইটি আমি কিভাবে পেয়েছি কিংবা সেই বইটি থেকে আমি কি পেয়েছি, তার ক্ষুদ্র অংশটুকুও আমি সাহিত্যের ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম। যে বইটি আমার দু'চোখ মেলে দিয়েছে,মনের জানালা দিয়েছে খুলে সেই বইয়ের সারকথা আমি আমার মনের ভাষাতেই প্রকাশ করব।
বইটি পাঠককে তার জীবন নিয়ে ভাবায়।যে জীবন স্বাধীনভাবে বাঁচতে শেখে,বাঁচাতে শেখায়,সত্যকে খুঁজতে পারে,সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করাতে পারে,এমনই এক জীবনের স্বপ্ন দেখায় এই বইটি।ভেলায় চড়ে এই বইটি পাঠ করতে করতে পাঠক খুঁজে পাবে তার অস্তিত্বের ঠিকানা।ক্লান্ত,শ্রান্ত,অজানা ঠিকানায় হেটে চলা মুসাফির তার ক্লান্তি দূর করে হেটে যাবে জ্ঞানের সাধনায়,তার প্রতিটি কদমে রেখে যেতে পারবে জ্ঞানের ছাপ,শুরু হবে জ্ঞানীর পথচলা,জেগে উঠবে তার প্রত্যয় এবং জাগরণ হবে সুপ্ত প্রতিভাধর এক প্রজন্মের,ইনশাআল্লাহ।
এতক্ষন ধরে যে বইটি সম্পর্কে বলে আসছিলাম,সেই বইটির নাম,"যে জীবন ফরিঙের, যে জীবন জোনাকির।"
🔸প্রথম দেখা : গল্পের পোকা আমি সবসময় গল্পের গন্ধ খুঁজে বেড়াই।কিন্তু অজস্র গল্পের মধ্যে কোন গন্ধ কোন বই থেকে আসছে তা ঠিকমত বুঝতে পারি না এখনো।তাই গল্প খোঁজার সময় বইয়ের নাম দেখেই গল্প নির্বাচন করি।কখনো কখনো এই বাছাই পর্বে স্থান পায় বইয়ের প্রচ্ছদ ও।
সর্বশেষ পর্বে যখন আমি আমার বহু সাধের জমানো টাকা দিয়ে বই বাছাই করে কিনব বলে চিন্তায় মগ্ন তখন ই আমি এই বইটির নাম এবং প্রচ্ছদ দেখে এই বইটিকে নির্বাচন করলাম।কিছুক্ষনের জন্য চিন্তা করলাম যে জীবন ফরিঙের, আচ্ছা সে জীবন কেমন?সে জীবন কি ভালো নাকি খারাপ?যে বইয়ের নামের আগাগোড়ায় রহস্য জমে আছে সে বইটা কিনলে মন্দ হয় না! বই কিনার জন্য অনলাইন ওয়েবসাইট এ সার্চ দিলাম,আর বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে তো আমি আরো আভিভূত!
"একটু পড়ে দেখুন" অপশনে ক্লিক করে বইয়ের সূচিপত্র চোখ বুলিয়ে নিলাম।দ্বিতীয় বারের মত ঠিক করলাম,এই বই আমাকে কিনতেই হবে।
🔸ডেকোরেশন : সূচিপত্র অংশে ঢুকে বইয়ের ডেকোরেশন সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়।এই বইয়ের সূচিপত্র দেখেও আমি ধারনা পেয়েছি গল্পের ধরন এবং ভাষারীতির।এতক্ষন ধরে যে কথাটি বলতে ভুলেই গিয়েছি তা হলো বইয়ের লেখকের নাম।বইটির লেখক "সাজিদ ইসলাম"।বইটি প্রকাশিত হয়েছে সর্বপ্রথম ২০২১ সালের মার্চ মাসে বুকমার্ক পাবলিকেশন থেকে।বইটিতে মোট ৫৫ টি শিরোনাম রয়েছে যদিও বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৭৬।
যা বুঝলাম তার সারমর্ম এই যে,বইটিতে ছোট ছোট আকারে অনেক গুলো গল্প রয়েছে।প্রতিটি গল্পের শিরোনামেই কি সুন্দর ছন্দ!কোনো কোনো শিরোনাম এক একটা বানীর মত।দেখে মনেহয় গল্পটা বুঝি শিরোনামের মধ্যেই শুরু আর এর মাধ্যমেই শেষ।লেখকের ভাবনা এবং বইয়ের বিষয়বস্তু গুলো এই বানীগুলোর মাধ্যমেই অনুধাবন করা যায়।যেমন,"সুখে থাকা মানে অনেক কিছু থাকা নয়,সুখে থাকা মানে সুখে থাকা" কিংবা "স্বাধীনতা 'মানুষ কি বলবে' নামের ঐ কারাগার থেকে মুক্তিতেই",এরকম কিছু উক্তিমূলক শিরোনাম।
কোনো কোনো শিরোনামের আগাগোড়ায় আবার রহস্যের মিশ্রণ।যেমন, "এক ঠোঙা ঝালমুড়ি এবং অতঃপর.." কিংবা "প্রচন্ড এক উত্তাপের দিনে.." কিংবা "আবরার ফাহাদ এবং সুরা বুরুজের সেই বালক ও রাজার গল্প" এর মতো কিছু রহস্যমূলক শিরোনাম।
এরকম শিরোনামগুলো পড়ে সেই গল্পগুলোর "থিম"বুঝে উঠতে পারছিলাম না।তৃতীয় বারের মতো বুঝলাম,এই বইটি আমাকে কিনতেই হবে।
একটি শিরোনামে গিয়ে আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।গল্পের শিরোনাম,"যে জীবন ফরিঙের,যে জীবন জোনাকির,সে জীবন যেন আমার না হয়.." এইবার বুঝলাম জোনাকি কিংবা ফরিঙের মত জীবন যাপন করতে লেখক অনুৎসাহিত করেছেন,কিন্তু তাদের জীবন কেমন যা আমার আপনার হওয়া উচিত না?আর বেশি কিছু না ভেবে কিনে ফেলার জন্য অর্ডার করে দিলাম।
🔸গল্পগুলো অন্যরকম: যে বইটি নিয়ে এতক্ষন কথা বলছিলাম সেই বইটির সাথে দ্বিতীয় দেখা হবার পরপর ই আমি বইটি নিয়ে বসলাম।যখন বইটি পড়া আরম্ভ করলাম আমার মনে হলো আমি যেন অন্য এক জগতে বিচরন করছি,মাঝে মাঝে মনেহয় সেই জগত সাড়ে ১৪০০ বছর আগের মত সুন্দর আর সাজানো আবার খানিক্ষন বাদেই মনেহয় নৈতিকতার এক চরম অধঃপতনের যুগে বুঝি আমি বিচরন করছি।বইটিতে লেখকের ভাষারীতি এবং সৃজনশীলতা আপনাকেও এই দুই সময়ের ব্যবধান নিয়ে ভাবাবে বলে আমার বিশ্বাস।কীভাবে ভাবাবে সেটি জানতে হলে যে আপনাকেও সেই রহস্যের পাতায় চোখ বুলাতে হবে!
লেখক সাজিদ ইসলাম নিজস্ব এক গদ্যশৈলীর নির্মাতা।বইটিতে লেখক বিভিন্নসময় বিভিন্ন বর্ণনারীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।এজন্যই বইটি পড়তে গিয়ে কখনো মনে হয়েছে আমি বুঝি লেখকের কোনো ডায়েরী পড়ছি ,কখনো বা মনে হয়েছে যেন কোনো সিরাতগ্রন্থ পড়ছি।কখনো মনে হয়েছে আমি বুঝি মা-বাবা কে নিয়ে লেখা গল্প "মা,মা,মা ও বাবা" এর মত বই পড়ছি আবার কখনো মনে হয়েছে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলিমদের বিচরণ এবং মুসলিম সাহিত্যের স্বর্ণযুগ নিয়ে লেখা "মুসলিম মস্তিষ্ক " এর মতো বই পড়ছি।কোনো কোনো সময় মনে হচ্ছিল জীবন নিয়ে লেখা শ্রেষ্ঠ কোনো সাহিত্যিক এর শ্রেষ্ঠ কোনো লেখা বুঝি আমি পড়ছি।
বইটি যদিও আত্মউন্নয়নমূলক, আত্মশুদ্ধিমূলক,অনুপ্রেরণামূলক এবং ইবাদতে উৎসাহিতকরণের একটি বই তবুও আমি আমার আলোকে বইটিকে যেভাবে দেখেছি সে অনুযায়ী গল্পগুলোর বর্ণনা দিব।
(i) ডায়েরী : বইটিতে লেখক বিভিন্নসময় ডায়েরীর মত করে তার নিত্যদিনের ঘটে যাওয়া কিছু সাধারন ঘটনাকে অসাধারণ ভাবে উপস্থাপন করেছেন,অনেকটা আমরা যেভাবে ডায়েরী লিখি তেমন।যেন লেখকের কোনো একদিনের একটা ঘটনা ঘটার পরে হঠাৎ কিছু উপলব্ধি হলো-ওমনি তিনি লিখতে বসে গেছেন।তিনি এই ধরনের বর্ণনারীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন এভাবে-
"ল্যাপটপ কাজ করছিল না। প্রথমে ভাবলাম ব্যাটারির সমস্যা, নতুন ব্যাটারি কিনলাম কিন্তু সমস্যার সমাধান হলো না। আবার গেলাম ঐ দোকানে, সমস্যা নাকি চার্জারে, নতুন একটা চার্জারও কিনলাম। সঙ্গে এক ছোট ভাই ছিল। আপাতদৃষ্টিতে ছোট একটা সমস্যায় একসাথে এতগুলো টাকা চলে গেল বলে তাকে আফসোস করেই বললাম, হুদাই টাকাগুলো গচ্চা গেল। ছোটভাই জবাব দিল, ভাই এভাবেই তো আল্লাহ একজনকে দিয়ে আরেকজনের রিযিকের ব্যবস্থা করেন!
সময়ের এক্সিসে মাপলে কথাটা বলতে কয়েক সেকেন্ড লেগেছে কিন্তু মুহূর্তেই চিন্তার জগতটা ১৮০ ডিগ্রি কোণে ঘুরে গেল। আরে তাই তো? এভাবেই তো এই দোকানির রিযিকের ব্যবস্থা হয়, ঠিক সেভাবে মাে বার রিযিকের পেছনেও আল্লাহ কাউকে না কাউকে উছিলা বানিয়ে দেন। হঠাৎ আরও একটা উপলব্ধি হলো—উত্তম সোহবত!"
এইরকম বর্ণনারীতির পরে লেখক উত্তম সোহবত নিয়ে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদিস এবং সেগুলোর আলোকে আমাদের কি করা উচিত তার বর্ননা দিয়েছেন এবং গল্পের নাম দিয়েছেন "সোহবতের গল্প"।
আবার এমন অনেক ঘটনাও লেখক বর্ণনা করেছেন যেগুলো শুধু তাঁর নিজের জীবনেই নয়,বরং প্রায় আমাদের সবার জীবনের ঘটে যাওয়া কাহিনী। যে বিষয়গুলা তুচ্ছ ভেবে,যে সময়গুলোকে তুচ্ছ করে আমরা আমাদের চলার স্বাভাবিক গতিকে অব্যাহত রাখি,আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে চলমান রাখি, সেই তুচ্ছ বিষয়গুলোকে তুলে এনে লেখক প্রমাণ করেছেন যে আমাদের জীবনের গতিময়তা আসলে অস্বাভাবিক এবং ছন্দহীন। গল্পের এইরকম বর্ননারীতি দেখা যায় এভাবে,
"একবার আমাদের এদিকে টমেটো খুব সস্তা হয়ে গেল।আমার বাসায় সারাদিন টমেটোর আলোচনা।আমার আব্বা আম্মার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেল আজকে বাজারে টমেটোর কেজি কত করে বিক্রি হচ্ছে সেই খবর রাখা।একদিন নাকি টমেটো দুই টাকা করে কেজি বিক্রি হচ্ছিল,আব্বা কিনেননি, সেটা শুনে আমার আম্মা গেলেন ক্ষেপে—দুই টাকা কেজি হওয়া সত্ত্বেও কেন টমেটো কেনা হলো না সারাদিন সেই আলোচনা বাসায় ঘুরে ফিরে আসতে লাগল। আরেকদিন বাসায় একটা আলমিরা কেনা হলো। সকাল থেকে রাত অবধি আমি শুধু আলমিরার আলোচনা শুনলাম। আলমিরার রং, ড্রয়ার, আয়না, কোথায় বসানো হবে, কোন পজিশনে কীভাবে বসালে ভালো দেখাবে, আলমিরায় কী কী রাখা হবে—পুরো একটি দিন এসব অ্যলোচনা করে কাটল।
আমি অবাক হয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম এমন কেন হচ্ছে? সামান্য টমেটো আলোচনার বিষয়বস্তু, একটা আলমিরা নিয়ে সবাই ব্যস্ত! আমার মনে হয় আমাদের বেশিরভাগেরই এই অবস্থা। প্রত্যেক ঘরেই কমবেশি এরকম। আমি খুঁজে বের করলাম এর কারণ— আমরা একটি ভাবনা-চিন্তাহীন জীবন যাপন করছি। আমাদের মাথার উপর ছাদ আছে, থাকার জায়গা আছে, তিন বেলা খাবারের চিন্তা নেই, পরনের কাপড় যা প্রয়োজন তার চেয়ে কয়েকগুণ আছে। এই ভাবনা চিস্তাহীন, আপেক্ষিকভাবে নিরাপদ একটি জীবনে আমাদের কোনো প্রায়োরিটি নেই, কোনো লক্ষ্য নেই, উদ্দেশ্য নেই। আচ্ছা যাদের জীবন আমাদের মতো ভবনা-চিন্তাহীন নয়, তারা কী চিন্তা করে? তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু, তাদের প্রায়োরিটি কী থাকে?
এই যেমন ধরুন, চীনের উইঘুরের মুসলিমরা, যেখানে বাবা-মা জানে না তাদের সন্তান কোথায়। রোহিঙ্গা মায়ের কথা ধরুন, তার চোখের সামনে সন্তানকে আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে...."
এইরকম আরো বিভিন্ন ঘটনা লেখক আমাদের সামনে চিত্রিত করেছেন।পুরো বইয়ের প্রায় পুরো অংশেই এরকম নিত্যদিনকার ঘটনার আলোকে গল্পে গল্পে তার চিত্রায়ন দেখতে পাবেন। তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কে কিভাবে সুন্দর করা যায় তার বিস্তৃত বর্ণনা এই বইয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।
(ii) সিরাতগ্রন্থ : বইটি পড়তে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল আমি যেন কোনো সিরাতগ্রন্থ পড়ছি।যদিও সেইগুলোর পরিমাণ বেশি ছিল না তবুও নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গোটা জীবনের সমষ্টি নিয়ে তিনি একটি ছোট্ট গল্প সাজিয়েছেন,গল্পের নাম "তিনিই আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম"। আবার আমাদের জীবনে মহানবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রভাব কতুটুকু হওয়া উচিত সেই বিষয় নিয়ে লেখক লিখেছেন,"শেষ কবে আপনি প্রিয় নবির জন্য কেঁদেছেন?"গল্পটি। সাহাবাদের জীবনীর কিছু অংশ নিয়েও তিনি বইটি সাজিয়েছেন,যেমন "একটি লাভজনক ব্যবসা" কিংবা "তাঁর ইহসানগুলো আমার পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব নয়" এর মত গল্পগুলো। পরিসর ছোট হলেও সেগুলো পড়ার পর আপনার চোখে পানি আসবেনা-এ কথা আমি কস্মিনকালেও ভাবতে পারি না।
(iii) "মা,মা,মা ও বাবা" : মা,মা,মা ও বাবা গল্পটি লেখক আরিফ আজাদের সম্পাদিত একটি বহুল পঠিত বই।এই বইয়ের পুরো অংশ জুড়েই মা,বাবাকে ঘিরে অনেকগুলো গল্প আছে। "যে জীবন ফরিঙের, যে জীবন জোনাকির " এই বইটিতেও বাবা-মা কে ঘিরে অন্যরকম বেশ কয়েকটি গল্প আছে,যেগুলো আপনাকে মা-বাবাকে নিয়ে ভাবতে শেখাবে,শেখাবে মা-বাবার অমায়িক হাসির আড়ালের দুঃখগুলোকে খুজে দেখতে। লেখকের ভাষায়:
"আমরা যারা শিক্ষিত হয়ে গেছি, আধুনিক হয়ে গেছি, পুরনো আমলের বাবা-মায়েদের সাথে মানসিক দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছি, আমাদের উচিত বাবা-মায়েদের সাথে বেশি বেশি সময় কাটানো। নিজের আধুনিক লেভেল এক পাশে সরিয়ে রেখে, বাবা-মায়েদের সেই পুরনো আমলের লেভেলে চলে আসা। তাদের সাথে তাদের মতো হয়ে যাওয়া। যেভাবে তারা ছোটবেলায় আমাদের সাথে আমাদের লেভেলে চলে আসত!"
(iv)মুসলিম মস্তিষ্ক : "মুসলিম মস্তিষ্ক" মূলত মুসলিম সাহিত্যের স্বর্ণযুগ যেসময় টি আমাদের কাছে "অন্ধকার যুগ" হিসেবে পরিচিত সেই সময়ের মুসলিম মনীষীদের জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ এবং সেসব শাখায় তাদের অগ্রগতি নিয়ে লেখা একটি বই।
"যে জীবন ফরিঙের,যে জীবন জোনাকির" বইটির একটি গল্পেও অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে কিন্তু যথাযথ তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে লেখক এই বিষয়গুলোকে তুলে এনে আমাদের দেখিয়েছেন মুসলিম জাতির জ্ঞান বিজ্ঞানের ইতিহাস। সে সময় এই বইটি পড়তে মনে হচ্ছিল আমি বুঝি জ্ঞান বিজ্ঞানের কোনো বই-ই পড়ছি!
অর্থাৎ এই একটিমাত্র বইয়েই লেখক অনেক ধাচের গল্পের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন এবং এজন্যই আমার মনেহয় যে এই বইয়ের "গল্পগুলোই অন্যরকম!"
🔸মূল কথন : বইটি মূলত জীবন কে ভিত্তি করেই অন্য এক জীবনের সন্ধান দেয়।চিন্তা করেই চিন্তার পরিধিকে বিস্তৃত করতে শেখায়। সমাজের ভয়ঙ্কর যে চক্র, সেই চক্রকে সমাজের মানুষের সাহায্যেই কিভাবে ভাঙতে হয় তা দেখায়।"ভাল্লাগেনা" রোগ নিয়ে,একরাশ হতাশা আর জীবনের প্রতি বুকভরা বিতৃষ্ণা সাথে নিয়ে আমরা এক জীবনে যেই সুখের সন্ধান করে কাটিয়ে দিই,সেই সুখ যে আসলে মরিচীকা ব্যতীত কিছুই না,এই ধ্রুব সত্যকে মরিচীকার ফাঁদে পা দেওয়ার আগেই আলিঙ্গন করতে শেখায়। এই মরিচীকাময় জীবনকেও নতুনভাবে উপলব্ধি করা যায়,মরুভূমির প্রতিটি তুচ্ছ ধুলিকনার মত তুচ্ছ সময়গুলোকে যে জীবন কাজে লাগাতে শেখায় সে জীবন কখনোই মরিচীকার পেছনে ছুটে না।সে সুখের জন্য নিজেকে অসুস্থ করে তোলে না,সে সুখের পিছনে ছোটে না,সে নিজেই সুখের উপকরন হয়ে দাঁড়ায়।কিন্তু সে জীবন কীভাবে গঠন করবেন?এই বইটিতে মূলত ছোট ছোট গল্প আকারে সেই জীবন গঠনের জন্যই তাগিদ দেওয়া হয়েছে।বইয়ের মূলকথাই হলো মনের জানালা মাঝে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখা আর তার বাস্তবায়ন করা।লেখকের ভাষায়,
"এই দ্বীন পালন যেন উত্তপ্ত মরুভূমিতে একাকি পথ চলা, তৃষ্ণায় কাতর হয়ে ছুটে চলা, থমকে যাওয়া, মাটিতে গড়িয়ে পড়া, শীতল পানিতে তৃষ্ণা মেটানো, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া গাছের ছায়ায়। উস্কোখুস্ক চুল, ধুলোমাখা পা, জরাজীর্ণ জামা—অবশেষে এই দৌড় প্রতিযোগিতার শেষ প্রান্তে পৌঁছা। যার পরের কদম থেকেই আল্লাহ আযযা ওয়া যাল আমাদের দিয়েছেন অনন্ত সুখের প্রতিশ্রুতি। তাই সেই জীবনের স্বপ্ন অন্তরে বুনে নিন, যে জীবন আল্লাহর জন্য বাঁচে। যে জীবন ঘাস ফড়িঙ কিংবা জোনাকি পোকার মতো বন্দি নয়। যে জীবন অনেকের ভিড়ে পরাজিত, অধঃপতিত মানসিকতার নয়। যে জীবন এক বিঘত বুকে বিশাল আকাশ ধারণ করে বাঁচে। যেদিন বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যাবে শত্রুর আঘাত, মাটিতে গড়িয়ে পড়বে প্রথম রক্তবিন্দু, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা দেখিয়ে দেবেন জান্নাতে আমাদের ঘর, সেদিন—সেদিন হয়তো আকাশের ওপারের ঐ জীবনের জন্য কিছু সঞ্চয় হলো।"
অর্থাৎ যে জীবন আল্লাহর জন্য বাঁচে সেই জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে লেখক এই বইটি রচনা করেছেন।আর আমি আপনাদের সামনে তার সারাংশটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ঠিক যেমনভাবে কেউ কোনো একটা ফল খেয়ে সেই ফলের বীজ মাটিতে ফেলে দেয় এবং ফলের বাগান করতে আগ্রহী ব্যক্তি সেই বীজ বপন করে নেয় যাতে করে ওই ফলের চারা গজায়;সেরকম ভাবে আমিও পুরো বইটি পড়ে সেই বইয়ের নির্যাসটুকু আপনাদের মাঝে তুলে ধরছি। তাই যদি কেউ আমার ফেলে দেওয়া বীজগুলোকে বপন করে নেয় এমন জীবন গঠনের জন্য যে জীবন আল্লাহর জন্য বাঁচে,তাহলে হয়তো কোনো একদিন সেই বীজ থেকে চারা গজিয়ে বিশাল বৃক্ষে পরিনত হবে এবং সেই বৃক্ষের ছায়ায় আরো কিছু জীবন উপকৃত হবে। আর সেদিনই হয়তো আমার এই বীজ ফেলা স্বার্থক হবে।
🔸চরিত্র : আপাত দৃষ্টিতে বইটিতে কোনো চরিত্র নেই।আবার অন্য দৃষ্টিতে দেখলে বইটির চরিত্র স্বয়ং আপনিই।বইটিতে প্রতিটি ক্ষেত্রে আরেকটি চরিত্র সর্বক্ষণ আমাদের মধ্যে অনুপ্রেরণা এবং আশা জোগায়,সেই চরিত্র টি হলো আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।কেন আমরা লেখকের উৎসাহ দেওয়া জীবন গঠন করব?কেননা এই জীবন গঠন করতে বলেছেন স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা,এই জীবন এর স্বপ্ন দেখিয়েছেন আমাদের প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা এবং আমাদের প্রতি তার ভালোবাসাই গল্পগুলোকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে। সেই ভালোবাসার জন্য আমাদের জীবন কেমন হতে হবে তার আলোকচ্ছটা এই বইটি।যে জীবন শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বাঁচে সে জীবন কেমন?সেই জীবন শুধু গল্পের মধ্যেই নয়,বরং গল্পগুলোকে নিজের চরিত্রে ধারণ করার মধ্যে নিহিত আছে।তাই গল্প যাই হোক না কেন,সর্বদা মাথায় রাখতে হবে এই গল্পের চরিত্র আপনি নিজে।
এই হিসেবে আমি মনে করি,"যে জীবন ফরিঙের,যে জীবন জোনাকির" বইটির চরিত্র আমি,আপনি এবং আমরা সবাই।
🔸ছোট্ট একটা দাগ : ক্ষনস্থায়ী এই পৃথিবীর কোনো কিছুই ত্রুটিমুক্ত নয়। তাই এই বইটিও যে সব ত্রুটির উর্ধ্বে, এমনটা আমি বলবো না।যেমন লেখক রিদ্দা,ইরজা,খুরুজ এইরকম কঠিন শব্দগুলো বর্ননা করেননি,যা আমার মতো ক্ষুধে পাঠক দের জন্য আরেকটু খোলাসা করে বললে ভালো হতো বলে আমি মনে করি।
🔸রেললাইনের সমাপ্তি : ট্রেন আসার জন্য এতক্ষন ধরে যে রেললাইন তৈরি করে আসছিলাম সেই বিরাট রেললাইনের সমাপ্তি এখনই করব । ট্রেন নির্মাতার ভাষায়:
"দুনিয়াবি ক্যারিয়ার গড়তে জান-প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে, দিনে কয়েক ওয়াক্ত সালাত পড়ে, সামাজিক ছবি(!) দেখে আর জীবনবোধের গান (!) শুনে, চেতনা অন্তরে লালন করে, টেবিলভর্তি সেক্যুলার বইয়ের উপর কাপড়ে বাঁধা কুরআনে সাজানো রুম--এই ছেলেটারই সমাজ থেকে মিলবে 'গুড বয় ইমেজ'। আখিরাতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে দুনিয়ার অর্জনগুলোতে ছাড় দেওয়া ছেলেটার শুনতে হবে---অমুক তো তোর মতোই নামায-রোযা করে, সে কি সব করছে না! কী করে বোঝাই, ঐ জীবন ফড়িঙের, ঐ জীবন জোনাকি পোকার। কী করে বোঝাই এই জীবনে পৃথিবীর ওপারে কিছুই নেই। কী করে বোঝাই আমি ঐ জীবন চাই না।"
কোন জীবন জোনাকির যে জীবন আপনার চাওয়া উচিত না?সেই জীবনের সন্ধান পেতে হলে ট্রেনের যাত্রী আপনাকেই হতে হবে!ট্রেন কিন্তু সামনেই আছে,আপনি বসার অপেক্ষায়....