26/02/2024
ইসলামের দৃষ্টিতে পর্দা
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অতি মুহাব্বত করে সৃষ্টি করেছেন, মানুষ যাতে ইহকাল ও পরকালে কোন ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাদের জন্য নেয়ামত স্বরূপ বিভিন্ন রকমের বিধি প্রণয়ন করেছেন। উম্মতে মুহাম্মাদির কাছে যে বিধান পৌছানোর জন্য তার প্রিয় হাবীব ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে পাঠিয়েছেন। তিনি সে বিধান অক্ষরে অক্ষরে নিজেও পালন করেছেন এবং উম্মতের কাছে পৌছে দিয়েছেন। তার ঐ সকল বিধানাবলির মধ্যে অন্যতম একটি বিধান হলো পর্দা।
ইসলামের পূর্ব যুগে পর্দার বিধান ছিলনা, সে যুগে যে সকল কারনে বর্বরতা ও অশ্লীলতা তাদের মাঝে স্থান করে নিতে পেরেছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো পর্দাহীণতা, সে যুগে মহিলাদের কে ভোগ বিলাসের উপকরণ মনে করা হতো। তাদের কোন স্বকীয়তা এবং ব্যক্তিত্ব বলতে কিছুই ছিলনা। কোন পুরুষ কোন এলাকায় গেলে সেই এলাকার কোন মহিলার সাথে সাময়িক ভাবে কোন অর্থ সম্পদের বিনিময়ে তাদের খাহেশাত পুরা করত: একে তারা সাময়িক বিবাহ নাম দিয়ে বৈধ করার চেষ্টা করত। এভাবে স্বাধীন মহিলারা ও তাদের অর্থ উপার্র্জন এভাবেই করত। এবং বাদীদের দ্বারাও তাদের মনিবেরা জ্বিনা ব্যভিচার করিয়ে অর্থ উপার্জন করত। এমনকি সেই যুগে মহিলারা অবাধে চলাফেরা এবং মেলামেশা করত। যার পরিনতিতে তাদের মাঝে জ্বিনা ব্যভিচার ও বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়েছিল। যার পরিনতিতে তাদের সমাজে মহিলা জাতি মূল্যহীন এবং ভোগের বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। তাই এহেন মূহর্তে ইসলাম এসে সকল নারী জাতির সম্মান এবং তাদের শান উচুঁ করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাদের কে ঘরের অভ্যন্তরে জীবন যাপন করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
وقرن في بيوتكن ولاتبرجن تبرج الجاهلية الأولى (سوره احزاب آيت ৩৩)
অর্থ ( হে মহিলা জাতি) তোমরা তোমাদের ঘরের মধ্যে অবস্থান করো এবং প্রথম বর্বর যুগের প্রদর্শনের মত প্রদর্শন করোনা। সূরা আহযাব -৩৩)
এই আয়াতে যদিও নবীজীর স্ত্রীগণকে উদ্দেশ্যে করে বলা হয়েছে, কিন্তু এ বিধান বিশ্বের সকল নারী ও রমনীর জন্য প্রযোজ্য। কেননা কুরআনের আয়াত নির্দিষ্ট ব্যক্তি অথবা ঘটনার প্রেক্ষাপটে অবতীর্ন হয়। কিন্তু তা সর্বকালের জন্যে প্রযোজ্য হয়। যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে তা নির্দিষ্ট না করা হয়। পবিত্র কুরআনের ছোট এ আয়াতটুকু নারী জাতির মুক্তির জন্য অমিয়সুধা। নারী জাতির এ আয়াতটুকু মেনে চললে লাঞ্চনা বাঞ্চনা হত্যা এবং অপহরণ হতে বেঁচে রাষ্ট ও সমাজের বুকে তারা নিজেদেরকে সম্মানি ও মূল্যবান জাতি রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। পক্ষান্তরে যদি তারা কুরআনের এ আয়াতকে অমান্য ও উপেক্ষা করে গৃহাভ্যন্তর থেকে বহির্গমন করে নিজেদেরকে বর্বর যুগের মত প্রদর্শন করতে থাকে তাহলে রাষ্ট, সমাজ ও পরিবারে তারা বর্বর যুগ থেকেও মারাত্মকভাবে লাঞ্চিত, বঞ্চিত, অবহেলিত ও অপহৃত হতেই থাকবে। যা বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে এই পর্দার বিধানকে না মানার কারনে।
বর্তমান যুগে মহিলারা বেপর্দাভাবে চলা ফেরার কারনে বর্বরতার যুগকেও হার মানিয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থা এই হয়েছে যে, কোথাও বেপর্দার কারণে মেয়েদের কে ছেলেরা উত্যক্ত করছে। যার ফলে তারা আত্মহত্যা করছে। কোথাও কোন ছেলে কোন মেয়েকে পাওয়ার জন্য যত চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হয় তখন এসিড নিক্ষেপ করছে। আবার কোথাও তাদের ইজ্জত হনন করত: হত্যা করছে। মোটকথা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অশান্তির অন্যতম কারণই হলো বেপর্দায় চলাফেরা করা। তাই এই অশান্ত জীবন কে শান্ত করার লক্ষে এবং মা বোনদের মান মর্যাদা অটুট রাখার নিমিত্তেই আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় বান্দাদের উপর পর্দার এই বিধান কে চালু করেন।
পর্দার সংজ্ঞা: পর্দা উর্দূ শব্দ। বাংলাতেও এ শব্দ ব্যবহৃত হয়। আরবীতে হিজাব বলে।
পরিভাষায় পর্দা বলা হয়: কোন মহিলা বা মেয়ের জন্য যে সকল পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয আছে, এমন পুরুষের সামনে নিজ আপাদমস্তক এর কোন অংশ প্রদর্শন করা হতে বিরত থাকা।
পর্দার হুকুম: পর্দা করা ফরজ। ইসলামী পরিবার ও সমাজে বর্বরতা ও অশ্লীলতা ছড়ানোর জন্য যে সকল উপকরনের দরকার ছিল। শয়তান আদাজল খেয়ে উঠে পড়ে লেগে সে সকল উপকরণ পরিবার সমাজ ও রাষ্টে সচল এবং অশ্লীলতা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্টে ছড়িয়ে দিয়েছিল।
ইসলাম এর আবির্ভাব হয়েই অমনি অশ্লীলতা ও বর্বরতার সে সকল উপকরনগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়নি বরং ধীরে ধীরে সে গুলোর মূলোৎপাটন করেছে। তাই ইসলামী সমাজ থেকে অশ্লীলতা দূর করার জন্যে নবীজীর হিজরতের পরে মদীনার জীবনে আল্লাহ তায়ালা মহিলা জাতির উপর পর্দা করা ফরজ করে দেন।
পর্দা সংক্রান্ত আয়াতের তাফসীরে দেখা যায় যে আল্লাহ তায়ালা এখানে পর্দা সম্পর্কিত দুটি বিষয়ের প্রতি ইশারা করেছেন। প্রথমত প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পাকের নিকট নারীদের বাড়ী থেকে বের না হওয়াই কাম্য। গৃহকর্ম সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এতেই তারা পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করবে। বস্তুত: শরীয়ত মত আসল পর্দা হল গৃহের অভ্যন্তরে অনুসৃত পর্দা। দ্বিতীয়ত: একথা বুঝা গেল যে, শরয়ী প্রয়োজনের তাকিদে যদি নারীকে বাড়ী থেকে বের হতে হয় তবে যেন সৌন্দর্য ও দেহ সৌষ্ঠব প্রদর্শন না করে বের হয়, বরং বোরকা বা গোটা শরীর আবৃত করে ফেলে এমন চাদর ব্যবহার করে বের হবে। সুতরাং উপরোক্ত ব্যাখ্যার দ্বারা বুঝা গেল যে শরয়ী প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলে সম্পূর্ণ শরীর আবৃত করে বের হতে হবে। এই সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
يا أيها النبي قل لأزواجك وبناتك ونساء المؤمنين يدنين عليهن من جلابيبهن ذالك أدنى أن يعرفن فلا يؤذين وكان الله غفورا رحيما. ( سوره احزاب ৫৯)
অর্থাৎ - হে নবী আপনি বলে দিন আপনার স্ত্রীগন, আপনার মেয়েদের এবং মুমিনদের স্ত্রীদেরকে তারা যেন তাদের চেহারার উপর তাদের চাদর ঝুলিয়ে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবেনা। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সুরা আহযাব-৫৯)
উল্লেখিত আয়াত দ্বারা বুঝা গেল যে, মাথার উপর থেকে চেহারার উপর পর্যন্ত চাদর ঝুলিয়ে পর্দা করলে তাদেরকে কষ্ট দেওয়া হবেনা। সুতরাং একথা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যদি মাহলারা চেহারা ঢেকে পর্দা না করে বাহিরে বের হয় তাহলে তাদের কে কষ্ট দেওয়া হবে। যা বর্তমান যুগে দেখা যাচ্ছে যে, হিলা ও যুবতীদের কে কোথাও কোথাও উত্যক্ত করা হচ্ছে তাদের মাঝে শরয়ী পর্দা না থাকার কারণে।
পর্দা ফরয হওয়া সম্পর্কে হাদীস শরীফে আছে যে, হযরত আয়েশা রা. বর্ণনা করেন যে, একদা আমার দুধ চাচা আসলেন। অতপর আমার কাছে অনুমতি চাইলেন, তখন আমি তাকে অনুমতি দিতে অস্বীকার করিলাম রাসূল সা. এর নিকট জিজ্ঞাসা করা ব্যতিত। অতপর আমি রাসূল সা. কে জিজ্ঞাসা করিলাম, তখন তিনি বল্লেন, যে সে তো তোমার চাচা। তুমি তাকে অনুমতি দিতে পার। তখন আমি রাসূল সা. কে বল্লাম, যে ইয়া রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে দুধ পান করিয়েছে তো মাহিলা পুরুষ তো দুধ পান করায়নি। তখন রাসূল সা. বললেন, সে তোমার চাচা তাই সে তোমার নিকট আসতে পারবে। আয়শা রা. বলেন যে, এই গটনা ছিল পর্দা ফরয হওয়ার পরে। (বুখারী-২, তিরমিজী-১, মেশকাত)
অন্য হাদীসে রাসূলে পাক সা. বলেন, মহিলাগন তাদের আপদ মস্তক ঢেকে রাখার বস্তু, যখনই তারা পর্দাহীনভাবে বাহীরে আসে, তখন শয়তান তাদের প্রতি উকি মারে। (তিরমিজী)
আরেক হাদীসে রাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেন, সাবধান কোন পর পুরুষ যেন কোন পর মহিলার সাথে নির্জনে অবস্থান না করে। কেননা যখনই তারা নিরিবিলিতে একত্রিত হয়, শয়তান তখন তাদের তৃতীয় জন হয় এবং উভয়কে কুকর্ম লিপ্ত করানোর প্রচেষ্টায় সে তাদের পিছনে লেগে যায়। (তিরমিজী)
আরো অসংখ্য অগনিত আয়াত ও হাদীস রয়েছে পর্দার বিধান ফরয হওয়ার ব্যাপারে।
সুতরাং এই সকল কুরআনের আয়াত ও হাদীস দ্বারা এই কথাই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, মানুষ যদি দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তি, সম্মান, ইজ্জত ও দামী হতে চায় তাহলে অবশ্যই পুরুষ জাতি ও নারী জাতীয় জন্য ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্দার বিধান কে পালন করা ছাড়া আর অন্য কোন পদ্ধতি নেই। একমাত্র পর্দার বিধান মানার মধ্যেই মানুষের জন্য সুখ শান্তি ও সফলতা। আর এ বিধান ছাড়ার মধ্যেই মানুষের জীবনে রয়েছে অশান্তি আর অশান্তি। তাই আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া কামনা করিতেছি যে, আল্লাহ তায়ালা যেন, আমাদেরকে সঠিকভাবে শরয়ী পর্দা মত জীবন যাপন করার তৌফিক দান করেন। আমীন ।