31/10/2025
সুদানের সংকট আসলে কী?
অনেকেই আজ প্রশ্ন করছেন—সুদানে আসলে কী ঘটছে? কেন মানুষ একে অপরের র*ক্ত ঝরাচ্ছে? এ কি সেই সুদান নয়, যাকে একসময় বলা হতো “আফ্রিকার খাদ্যভান্ডার”? নীলনদের আশীর্বাদে ভরপুর উর্বর ভূমি, যেখানে ছিল বিশ্বের বৃহত্তম কৃষি প্রকল্প—গেজিরা স্কিম।
এই দেশই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম স্বর্ণসম্পদ আর পঞ্চম বৃহত্তম গবাদিপশুসম্পদের অধিকারী। অথচ আজ সেই সুদানই অনাহার, যু%দ্ধ আর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, প্রায় এক কোটি সুদানি মানুষ আজ মারাত্মক খাদ্যসংকটে ভুগছে, অনেকেই অনাহারের দ্বারপ্রান্তে।
প্রশ্ন জাগে—যে দেশ এত সম্পদে পরিপূর্ণ, সেখানে কীভাবে এমন র*ক্তস্নাত বিভীষিকা নেমে এলো?
---
বর্তমান সংঘাতের শেকড়
সুদানে চলমান গৃহযু%দ্ধ শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে, যখন দেশের দুটি প্রধান সামরিক শক্তি পরস্পরের বি*রুদ্ধে অ%স্ত্র তুলে নেয়—
১️। সুদানি সশস্ত্র বাহিনী (SAF)
২। র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF), যাদের *জাঞ্জাওয়িদ* নামেও চেনে অনেকে।
এ সংঘাত মূলত ক্ষমতা, সামরিক আধিপত্য এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের লড়াই।
পটভূমি এমন—
২০১৯ সালে গণবিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বাশিরের ৩০ বছরের শাসন পতন হয়। এরপর গঠিত হয় এক অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক-নাগরিক সরকার। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় ক্ষমতার টানাপোড়েন—সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং আরএসএফ প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমেদতি)-এর মধ্যে।
আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করা, ক্ষমতা ভাগাভাগি এবং ভবিষ্যৎ বেসামরিক সরকারের কাঠামো নিয়ে মতবিরোধ দেশকে গৃহযু%দ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
প্রথমে সংঘাত সীমিত ছিল রাজধানী খারতুম ও আশপাশের এলাকায়, কিন্তু দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে—বিশেষ করে দারফুরে, যেখানে লড়াইটি জাতিগত রূপ নেয়। শান্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত আল-ফাশির আজ এক ভগ্ন নগরী।
---
আরএসএফ-এর উত্থান কাহিনি
আরএসএফ শুরুতে কোনো আনুষ্ঠানিক সেনাবাহিনী ছিল না—বরং এক উপজাতীয় মিলিশিয়া। ২০১৯ সালের আন্দোলনের সময় বাশির সরকার নিজেদের রক্ষা করতে এই মিলিশিয়াকে পাশে নেয়, তাদের আধা-সরকারি মর্যাদা দেয়, আর নেতা হেমেদতিকে জেনারেলের পদে উন্নীত করে। এরপর এই বাহিনীর নাম দেওয়া হয় র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)।
যখন এপ্রিল ২০১৯-এ আল-বাশির উৎখাত হন, তখন জেনারেল আল-বুরহান ও তার সহকর্মীরা ক্ষমতা নেয় এবং গঠন করে ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিল। জনগণ প্রথমে একে স্বাগত জানালেও শীঘ্রই তারা বেসামরিক সরকার দাবি করে।
‘ফোর্সেস অফ ফ্রিডম অ্যান্ড চেঞ্জ (FFC)’ নামে এক রাজনৈতিক জোট গড়ে ওঠে, যারা নাগরিক শাসনের জন্য চাপ দেয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৯ সালের আগস্টে গঠিত হয় যৌথ সামরিক-নাগরিক সরকার। অর্থনীতিবিদ আবদুল্লাহ হামদক হন প্রধানমন্ত্রী, আর আল-বুরহান সেনাপ্রধান হিসেবেই থাকেন।
এই সময় সুদান ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিরে আসে; এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসপৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রের তালিকা থেকেও বাদ পড়ে।
কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবরে আল-বুরহান আবারও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বেসামরিক সরকার ভেঙে দেন এবং হামদককে গৃহবন্দি করেন। সেনাবাহিনী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়—এভাবেই ভবিষ্যতের সংঘাতের বীজ বপন হয়।
এদিকে আরএসএফও শক্তিশালী এক সমান্তরাল বাহিনীতে পরিণত হয়। সেনাবাহিনীতে একীভূত হওয়ার প্রশ্নে উত্তেজনা তীব্র হয়, এবং অবশেষে ২০২৩ সালের এপ্রিলে তা রূপ নেয় উন্মুক্ত যু%দ্ধে।
খারতুম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। আল-ফাশিরে শুরু হয় হ%ত্যাযজ্ঞ ও দুর্ভিক্ষ। ১ কোটি মানুষেরও বেশি বাস্তুচ্যুত হয়। যে “স্বাধীনতার বিপ্লব” একসময় আশার আলো জ্বেলেছিল, আজ তা পরিণত হয়েছে বিশৃঙ্খলায়।
---
বিদেশি স্বার্থ ও হস্তক্ষেপ
সুদানের এই যুদ্ধ শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ নয়—বড় শক্তিগুলোরও এতে গভীর স্বার্থ জড়িয়ে আছে।
রেড সি বা লোহিত সাগরের তীরে সুদানের অবস্থান অত্যন্ত কৌশলগত—মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপকে যুক্ত করা এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ। ফলে এটি পরিণত হয়েছে বৈশ্বিক শক্তির প্রতিযোগিতার ময়দানে।
🔹 সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE): আরএসএফকে অ%স্ত্র ও অর্থসহায়তা দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত। সুদানি সরকার তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছে।
আমিরাতের আগ্রহ মূলত সুদানের সোনা, কৃষিজমি ও বন্দরনগরীগুলো ঘিরে। অভিযোগ আছে—আমিরাত-সমর্থিত কোম্পানিগুলো দারফুরসহ উত্তরাঞ্চল থেকে সোনা পাচার করছে, বিনিময়ে আরএসএফকে অ%স্ত্র ও অর্থ দিচ্ছে।
🔹 মিশর: মিশর সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে, কারণ তারা আশঙ্কা করছে—আরএসএফ ক্ষমতায় এলে নীলনদের পানিবণ্টনে তাদের প্রভাব হুমকির মুখে পড়বে।
🔹 সৌদি আরব: সামনে থেকে শান্তি আলোচনা চালালেও, ভেতরে ভেতরে এমন এক সরকার চায়, যা তাদের আঞ্চলিক স্বার্থে অনুগত থাকবে।
🔹 রাশিয়া: তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট—রেড সি-তে নৌঘাঁটি স্থাপন। ওয়াগনার গ্রুপ নামের রুশ ভাড়াটে বাহিনী বহু বছর ধরেই সুদানের সোনা বাণিজ্যে যুক্ত।
🔹 যুক্তরাষ্ট্র ও ইস%রা*য়েল: আমেরিকা চায়, সুদান যেন রাশিয়া বা চীনের ঘনিষ্ঠ না হয়; আর ইস&রা%য়েল, আল-বাশির পতনের পর থেকে সুদানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, পূর্ব আফ্রিকায় এক কৌশলগত মিত্র গড়ে তুলতে চায়—ইরানি প্রভাব ঠেকানোর জন্য।
খবরে জানা যায়, ইস&রা&য়েলি গোয়েন্দারা আরএসএফ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং কায়রোর মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছে।
---
বিভক্তির আশঙ্কা
অনেক বিশ্লেষক এখন আশঙ্কা করছেন—সুদান হয়তো আবারও বিভক্তির পথে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ তা ঘোষণা করেনি।
বর্তমানে—
• উত্তর ও পূর্বাঞ্চল (যার মধ্যে পোর্ট সুদানও আছে) সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
• পশ্চিমাঞ্চল (বিশেষত দারফুর ও আল-ফাশির) আরএসএফের দখলে।
যদি যু%দ্ধ চলতেই থাকে, তবে দেশটি হয়তো তিন ভাগে ভেঙে যাবে—উত্তরে সামরিক শাসিত অঞ্চল, পশ্চিমে আরএসএফের এলাকা, আর পূর্বে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে একটি অঞ্চল।
আগে যে দেশটি দক্ষিণ সুদান আলাদা হওয়ার মাধ্যমে একবার বিভক্ত হয়েছিল, আজ সেই দেশ আবারও একই পথে হাঁটছে।
---
মানবিক বিপর্যয়
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ১২ হাজারেরও বেশি মানুষ নি&হত এবং ১৪ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত।
হাসপাতালগুলো ভেঙে পড়েছে, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ বন্ধ, শহরগুলো পরিণত হয়েছে মৃ&ত্যুপুরীতে। আল-ফাশির, নিয়ালা, আল-জেনেইনা—সবখানেই মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র।
যখন যু%দ্ধবাজরা সোনা, তেল, জমি আর ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ব্যস্ত—তখন সাধারণ সুদানি মানুষ মৃ&ত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে ক্ষুধা ও রোগে।
যে দেশ একসময় “আফ্রিকার ভবিষ্যৎ” নামে পরিচিত ছিল—উর্বর জমি, অফুরন্ত খনিজ, অসংখ্য গবাদিপশু আর নীলনদের আশীর্বাদে সমৃদ্ধ—আজ সেই দেশ জ্ব&লছে যু&দ্ধের আ*গুনে।
যেখানে একদা ছিল সজীব ফসলের মাঠ, আজ সেখানে ছড়িয়ে আছে গানপাউডারের গন্ধ। যেখানে শিশুরা তালগাছের ছায়ায় খেলত, আজ সেখানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মায়েদের আর্তনাদ।
---
উপসংহার
মূলত, এ যু%দ্ধ কোনো নীতির নয়—এটি স্বার্থের যু&দ্ধ, যা গরিব মানুষের র&ক্তে জ্বালানি পায়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন— “যখন তাদের বলা হয়, ‘তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করো না,’ তারা বলে, ‘আমরা তো শুধু সংশোধন করছি।’” (সূরা আল-বাকারা, ২:১১)
আজকের সুদান এই আয়াতের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি—যেখানে প্রত্যেকে বলে, তারা নাকি শান্তির জন্য লড়ছে, অথচ তাদের হাতের নিচে ভেসে যাচ্ছে র&ক্ত, ধ্বংস আর মানবতার আর্তনাদ।
লেখক: এনামুল হক ইবনে ইউসুফ
ইংরেজি থেকে অনুবাদ