13/08/2025
বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য একটি সুষম শাসনব্যবস্থা অতীব জরুরী। এ কাজে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তারা এগিয়ে না আসলে, তাদেরকে ঠেলে সেখানেই নিয়ে আসতে হবে। এই কাজ জাতীয় সংসদে হতে হবে এবং জাতীয় সংসদের মাধ্যমেই শাসনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি সুষম শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
১। প্রথম আলো পত্রিকার একটা স্লোগান ছিল, ‘বদলে যাও, বদলে দাও’। স্লোগানটা প্রথমে শুনলে বেশ ভাল লাগে। মনে হয় যেন, সত্যিই তো, বদলে যেতে হবে, বদলে দিতে হবে। কিন্তু স্লোগানটা প্রথমেই একজনকে মানুষকে বুঝিয়ে দেয়, সে নিজে ভাল না। ফলে তার ভেতর ভাল হওয়ার তাগাদা অনুভূত হয়। পরে আবার যখন সে এই স্লোগানটিই দেখে, তখন ভাবে, আরে আমি তো ভালই, তো আমি নিজেকে বদলাবো কেন? দ্বন্দ্বটা শুরু হয় এখানেই।
২। খুব সম্ভবত বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর এই স্লোগানের বিরোধীতা করে বেশ বড় বড় বিলবোর্ড স্থাপন করেছিল সেসময়। সত্যিই তো, ‘কেন বদলে যাবো? কেন বদলে দিব?’ যদি আমি ভাল হই। যদি যা আছে তা ভাল হয়। পরবর্তীতে প্রথম আলো সেই স্লোগান পাল্টে দেয়। তাদের এখন নতুন স্লোগান ‘যা কিছু ভাল, তার সাথে প্রথম আলো’। এটা বেশ। সবসময় ভালর সাথেই থাকতে হয়। যদিও প্রশ্ন থেকে যায়, প্রথম আলো সবসময় ভালর সাথে থাকে কিনা? কিংবা কখনোই ভালর সাথে থাকে কিনা?
৩। প্রথম আলো ভালর সাথে আছে কি নাই, সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। আমরা কিছুটা আলোচনা করতে পারি ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ টার্মটি নিয়ে। আমার মনে হয়, প্রথম আলোর এই স্লোগান ‘বদলে যাও, বদলে দাও’-এর মতই এই টার্ম ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ একটি বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী টার্ম।
৪। ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ এই শব্দবন্ধের ভেতর নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নাই। ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ করতে গিয়ে কি আমরা রাষ্ট্রের খোলনলচে সব পাল্টে ফেলবো? নাকি নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় সংস্কার করবো?
৫। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে বলা যায়, তিপ্পান্ন বছর আগে যে রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি হয়েছে, দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষিতে এবং এই দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা ও মূলনীতির বাহিরে গিয়ে রাষ্ট্রশাসনের প্রেক্ষিতে এর সংস্কার জরুরী হয়ে পড়েছে। এদিকটা নিয়ে না রাষ্ট্র পরিচালকগণ কিংবা রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবিগণ কেউ মনযোগ দিয়েছেন বলে মনে হয় না।
৬। বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং ইতিপূর্বে সংঘটিত কিছু আন্দোলনের সময় আমরা ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ দাবিটি সামনে আসতে দেখি। সবক’টি আন্দোলনেই ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ দাবিটিও তাদেরই তোলা। কিন্তু আন্দোলনের সময় এবং আন্দোলন পরবর্তী সময়ে তারা কিভাবে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ করছেন? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
৭। যে কথাটি আমি প্রথম থেকেই বলে আসছি, কোটাপ্রথা সংস্কার কিংবা মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিলুপ্তির দাবিতে যে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, তা আসলে কোনভাবেই কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল না। এই আন্দোলনটি ছিলই মূলত একটি গণঅভ্যুত্থানের পরিবেশ তৈরি করা এবং সেই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন। সে হিসাবে ধরে নেওয়া যায় যে, এই আন্দোলন এবং তৎপরবর্তী সকল ঘটনা সবকিছুই পূর্বপরিকল্পিত।
৮। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যে ধ্বংসযজ্ঞ আমরা অবলোকন করলাম, তার কোন বিহিতব্যবস্থার কথা আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত সরকার এখন পর্যন্ত বলে নাই। আন্দোলনকর্মীদের একটি অংশ এখনো রাস্তায় আছে। তারা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং বিভিন্ন জায়গার দেওয়ালে তাদের আন্দোলন সম্পর্কিত চিত্রকর্ম করছে।
৯। আন্দোলনের সরকার এসে একে একে রাষ্ট্রের সব নীতিনির্ধারণী জায়গার প্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করছে। এমনকি একজন উপদেষ্টার উস্কানিতে কিছু সংখ্যক আন্দোনকারী অনেকটা গুন্ডাব্যবস্থায় সুপ্রীম কোর্ট ঘেরাও করে প্রধান বিচারপতি ও অ্যাপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করেছে। ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ ধারণা নিয়ে সরকার গঠন করে রাষ্ট্রের অন্যতম বিভাগে আঘাত কোনভাবেই রাষ্ট্র সংস্কার হতে পারে না।
১০। পাঁচ নম্বর পয়েন্টেই আমি বলেছি, রাষ্ট্র সংস্কার জরুরী হয়ে পড়েছে। তবে রাষ্ট্রের কোন জায়গায় সংস্কার করবেন, সেটা নির্ধারণ করাটা সবার আগে জরুরী। ৪ আগস্ট ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ রূপান্তরের রূপরেখা নামক যে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, সেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি কাউন্সিল গঠন করবে। সেই প্রস্তাব এবং বর্তমান কর্মকাণ্ড দেখে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এই আন্দোলনের পরিকল্পনার সাথে জড়িত পক্ষগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানকে অস্বীকার করে নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, যা আমাদের সকলের জন্য অশনিসংকেত।
১১। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেভাবে ‘মাইক্রোক্রেডিট’-এর মূলা ঝুলিয়ে দরিদ্রকে আরো দরিদ্র করে তুলেছিলেন। ঠিক তেমনই ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ মূলা ঝুলিয়ে বাঙালিকে আবার বোকা বানিয়ে বাংলাদেশকে বাংলাস্তান কিংবা অন্য কোনকিছু করার পায়তারা করা হচ্ছে কিনা?
১২। বাংলাদেশে সংঘটিত সকল অপশাসন, স্বৈরশাসন ইত্যাদি সমস্যার সমাধানে আমাদের স্পেসিফিক হতে হবে। এই কাজ রাজনীতিবিদদের কাজ। তাদের কাজ তাদেরকেই করতে দিতে হবে। যদি কোন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তার উচ্চাশা ও প্রতিহিংসার বদলা নেওয়ার জন্য ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ বিলাপ করে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তাহলে বুঝে নিতে হবে, ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ তার উদ্দেশ্য না, তার উদ্দেশ্য অন্যকিছু।
১৩। বর্তমান সরকার এখন পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির ওপর আক্রমণ এবং তাঁর ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির ওপর আঘাতের ব্যাপারে টুঁ শব্দটিও করেন নাই। উপরোন্তু শেখ হাসিনা পরবর্তী সকল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের নিষিদ্ধ ঘোষিত একাত্তরের দালাল জামায়াতে ইসলামির নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি আমাদের আশংকাগ্রস্ত করে তোলে, এই সরকার আদৌ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে কিনা?
১৪। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য একটি সুষম শাসনব্যবস্থা অতীব জরুরী। এ কাজে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তারা এগিয়ে না আসলে, তাদেরকে ঠেলে সেখানেই নিয়ে আসতে হবে। এই কাজ জাতীয় সংসদে হতে হবে এবং জাতীয় সংসদের মাধ্যমেই শাসনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একটি সুষম শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। আর এইসব কাজের জন্য বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সরব উপস্থিতি প্রয়োজন, যারা মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে এবং সমানভাবে জামায়াতকে ও এর সকল অঙ্গ সংগঠনকে স্বাধীন বাংলাদেশের শত্রু হিসাবে বিবেচনা করে।
তাহারা এবং তাহাদের রাষ্ট্র সংস্কার | লেখা: আগস্ট ১২, ২০২৪
- Milon Syed
Editor, The AkaalBodhon