13/09/2025
উনিশ শতকে ঢাকাবাসীর বিনোদন
উনিশ শতকে ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে বিনোদনের ছিল নানা আয়োজন। ইংরেজ আমলে রচিত Principal Heads of the History and Statistics of The Dacca Division (১৮৬৮) বইতে তৎকালীন ঢাকাবাসীর অবসরের রূপ-রস আস্বাদনের এক বিস্তৃত চিত্র পাওয়া যায়।
⛵ নৌ-বিহার ও চাঁদের আলোয় নৌকাবাইচ
ঢাকার প্রাচীনতম আনন্দের অন্যতম মাধ্যম ছিল নৌকাবিহার। ধারণা করা হয়, এ অভ্যাস শুরু হয় নবাবদের আমল থেকে। তারা নিজেদের মনোরম রুচি অনুযায়ী জমকালো রাজকীয় নৌকা রাখতেন। নবাবদের অনুকরণে বণিক, তাঁতি ও শহরের অন্যান্য ধনী ব্যক্তিরাও সাজসজ্জায় ভরপুর নৌকা রাখতেন। নৌকার মাঝিদের পোশাক হতো বিচিত্র, আর নদী ভরে উঠত বর্ণিল আনন্দে। বিশেষত পূর্ণিমার রাতে “মুনলাইট রেগাটা” বা চাঁদের আলোয় নৌকাবাইচ ছিল ঢাকাবাসীর অন্যতম প্রধান বিনোদন। তবে ১৯শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়, এবং কেবল বিশেষ অনুষ্ঠান বা বিদেশি অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্যই আয়োজন করা হতো।
🪁 ঘুড়ি ও খেলার আসর
শীত ও বসন্তকালে ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানো ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। রঙিন কাগজ আর হালকা বাঁশের কাঠামোয় তৈরি ঘুড়িতে লেজ বা ঝালর থাকত না। সুতো কেটে অন্যের ঘুড়ি নামিয়ে দেওয়া ছিল প্রধান কৌশল। তরুণ থেকে প্রৌঢ়, সবারই এতে সমান উৎসাহ থাকত। তবে রাস্তাঘাটে ঘুড়ি ওড়ানো অনেক সময় গাড়ি চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাত, ফলে প্রশাসন মাঝে মাঝে এ খেলা নিষিদ্ধ করত।
ছেলেদের আরেক জনপ্রিয় খেলা ছিল কাদামাটি দিয়ে বানানো গুলি বা কাঁচগোলার মতো খেলনা ছুঁড়ে খেলা। এছাড়া “ফ্রেঞ্চ অ্যান্ড ইংলিশ” নামে আরেক ধরনের খেলাও চলত, যেখানে হাত ধরাধরি করে প্রতিপক্ষকে একটি নির্দিষ্ট রেখার ওপারে টেনে নেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য।
🐓 🐑 🐦 পশুপাখির লড়াই ও বাজি
হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভেড়ার লড়াই, বুলবুলি, দোয়েল বা মুনিয়া পাখির লড়াই জনপ্রিয় ছিল। এসব খেলায় মোটা অঙ্কের টাকা-পয়সা বাজি ধরা হতো। মুসলমানদের মধ্যেও মোরগের লড়াই ব্যাপক প্রচলিত ছিল।
💃 নাট্য ও নৃত্য
বৈষ্ণব সম্প্রদায় নাচ-গান, বিশেষ করে লীলা বা কৃষ্ণলীলা নাটকের আসর বসাত। নবাবি আমল থেকে আসা নৃত্যানুষ্ঠান বা নাচ ছিল হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ আনন্দের মাধ্যম। আতশবাজি, গান-বাজনা আর রঙিন আলোকসজ্জায় এমন আসর জমে উঠত।
🎶 বাদ্যযন্ত্র ও সংগীত
হিন্দুদের মধ্যে “ভেলা” নামক এক ধরনের বেহালা ছিল সাধারণ বাদ্যযন্ত্র, যদিও ইউরোপীয় বেহালা বাজারে সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল। মুসলমানরা বেশি পছন্দ করত সেতার বা তিন তারবিশিষ্ট গিটার সদৃশ বাদ্যযন্ত্র।
🦌 🎣 🐟 শিকার, মাছ ধরা ও অন্য আনন্দ
মুসলমানদের মধ্যে শিকার প্রিয় ছিল, যদিও বইয়ের লেখকের ভাষায় তা ছিল “অপটু শিকার”—জঙ্গলে হঠাৎ সুযোগ পেলেই পশুপাখি হত্যা। মাছ ধরা ছিল সর্বজনীন বিনোদন, যদিও তা দক্ষতার অভাবে সীমিত আনন্দ দিত।
🎲 🃏 🥥 পাশা, তাস ও ভাগ্যের খেলা
অন্দরমহলে বা আড্ডায় তাস, পাশা, কৌড়ি, এমনকি ডিম বা নারিকেল দিয়ে ভাগ্যের খেলা চলত। এগুলো ছিল একধরনের জুয়ার মতো বিনোদন।
🏏ইউরোপীয় খেলাধুলার আগমন
১৯শ শতকের শেষ ভাগে ইংরেজ বাসিন্দাদের প্রভাবে কিছু তরুণ ক্রিকেট খেলার চেষ্টা শুরু করলেও ঢাকার মানুষ তখনও ইউরোপীয় ক্রীড়া-সংস্কৃতিকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেনি। খেলার উৎসাহ থাকলেও তা ছিল সীমিত ও প্রায় অনাড়ম্বর।
উপসংহার
ঢাকার ১৯শ শতকের বিনোদনচর্চা থেকে স্পষ্ট হয় যে, নবাবি ঐতিহ্য, বৈষ্ণব ভক্তি, স্থানীয় আচার এবং ইউরোপীয় প্রভাব মিলেমিশে গড়ে উঠেছিল এক বিচিত্র রূপ। নদীমাতৃক ঢাকার সাংস্কৃতিক আনন্দে নৌবিহার ও চাঁদের আলোয় রেগাটার মহিমা আজ আর নেই, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তা আজও অম্লান।
তবে ঔপনিবেশিক লেখক ঢাকাবাসীর বিনোদনকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শুধু ঘুড়ি ওড়ানো, পাখির লড়াই বা নৌ-বিহারের মতো আমোদপ্রমোদকে হালকা চোখেই দেখেননি; তিনি বাঙালিদের জাতিগতভাবে অপমান করতেও কুণ্ঠিত হননি। বইটিতে বলা হয়েছে—
“এ সকল খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদ যেহেতু সাহস বা ধৈর্যের প্রয়োজন করে না, কিংবা শারীরিক পরিশ্রমও সামান্য, তাই এগুলো এই জেলার অধিবাসীদের আলস্যপ্রবণ ও উদ্যমহীন স্বভাবের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। সমগ্রভাবে তারা মানবজাতির সবচেয়ে অধঃপতিত অংশ, অর্থাৎ ‘বাঙালি এশিয়াটিক’-এর গড় প্রতিনিধি।”
এই মন্তব্য আসলে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনের নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার কৌশলের অংশ। বাঙালিদের নিকৃষ্ট, দুর্বল ও শাসনযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে ইউরোপীয়রা নিজেদের আধিপত্যকে স্বাভাবিক ও অপরিহার্য করে তুলতে চেয়েছিল। এমনকি ক্রিকেটের প্রসঙ্গে লেখক বলেন, ঢাকার তরুণেরা ইউরোপীয় খেলার আসল “স্পিরিট” ধরতে পারছে না—এটিও সেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন।