06/10/2025
[প্রবন্ধ📙 ১২৯]
কুরআন ও হাদিসের আলোকে গান-বাজনা শোনার হুকুম: একটি পর্যালোচনা......✍️ মুফতি সৈয়দ আল মুত্তাকী
☑️ ভূমিকা :
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের প্রতিটি কাজের জন্য হালাল ও হারামের সীমারেখা নির্ধারণ করেছে। মানুষের হৃদয়, আত্মা ও নৈতিকতা রক্ষায় ইসলাম এমন সব বিষয়ের প্রতি সতর্ক করেছে, যা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ করে দেয়। গান-বাজনা বা সঙ্গীত—এই বিষয়টি ইসলামের প্রাচীনকাল থেকেই ফিকহবিদ ও মুফাসসিরদের আলোচ্য ছিল। অধিকাংশ ফকীহ ও আলেম একমত হয়েছেন যে বাদ্যযন্ত্রসহ গান-বাজনা হারাম, কারণ এটি মানুষকে অশ্লীলতা, গাফেলতি ও পাপাচারের দিকে টেনে নেয়।
☑️ কুরআনের আলোকে গান-বাজনা নিষিদ্ধতা :
১️. সুরা লুকমান (৩১:৬)
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ
অনুবাদ: “মানুষের মধ্যে কেউ আছে, যে আলোচনা বা কথার খেলনা (লাহওয়াল-হাদীস) ক্রয় করে, যেন অজ্ঞতাবশত মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে।” (সূরা লুকমান: আয়াত ৬)
🔹 সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) এই আয়াত সম্পর্কে বলেন —
“لَهْوَ الْحَدِيثِ
দ্বারা বোঝানো হয়েছে — গান ও সঙ্গীত।” (তাফসির ইবনে কাসির, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৩০)
২️. সুরা আন-নাজম (৫৩:৫৯–৬১)
أَفَمِنْ هَٰذَا الْحَدِيثِ تَعْجَبُونَ، وَتَضْحَكُونَ وَلَا تَبْكُونَ، وَأَنتُمْ سَامِدُونَ
অর্থ: “তোমরা কি এ বাণী (কুরআন) দেখে আশ্চর্য হচ্ছো? হাসছো, কাঁদছো না, আর তোমরা গান-বাজনা করছো?” (সূরা আন-নাজম: ৫৯–৬১)
🔹 ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন:
“سَامِدُونَ
শব্দের অর্থ—গান ও বাদ্যযন্ত্রে মগ্ন থাকা।” (তাফসির তাবারী, ২৭/৬৩)
৩️. সুরা আল-মায়িদাহ (৫:৯০)
إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأزْلاَمُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ
অর্থ: “নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তি এবং ভাগ্য নির্ধারণের ফলা—সবই শয়তানের অপবিত্র কাজ। এগুলো থেকে বেঁচে থাকো।”
(সূরা আল-মায়িদাহ: ৯০)
★ অনেক মুফাসসির ব্যাখ্যা করেছেন, বাদ্যযন্ত্রও “শয়তানের হাতিয়ার” হিসেবে কাজ করে, যেমন মদ মানুষকে ভুলিয়ে দেয়, তেমনি গান-বাজনা মানুষকে গাফেল করে তোলে।
☑️ হাদিসে গান-বাজনা নিষিদ্ধতা :
১️. সহিহ বুখারী (হাদিস: ৫৫৯০)
لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الحِرَ وَالحَرِيرَ وَالخَمْرَ وَالمَعَازِفَ
অর্থ: “আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু লোক আসবে, যারা ব্যভিচার, রেশম, মদ এবং বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে।” (সহিহ বুখারী, হাদিস ৫৫৯০)
★ এখানে নবী ﷺ স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছেন—গান-বাজনাকে হালাল ভাবা গোমরাহির একটি চিহ্ন।
২️. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত:
إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى أُمَّتِي الْخَمْرَ وَالْمَيْسِرَ وَالْكُوبَةَ وَالْغُبَيْرَاءَ
তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, “কুবা কী?” তিনি বললেন, “বাদ্যযন্ত্র (তবলা)।”
(আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ)
৩️. ইবনে উমর (রা.) থেকে:
রাসূল ﷺ বলেছেন,
إِنَّ الغِنَاءَ يُنْبِتُ النِّفَاقَ فِي الْقَلْبِ كَمَا يُنْبِتُ الْمَاءُ الزَّرْعَ
অর্থ: “গান অন্তরে নিফাক (কপটতা) জন্ম দেয়, যেমন পানি ঘাস জন্মায়।” (বায়হাকী, শু‘আবুল ইমান, ৫১১৩)
☑️ ফিকহ ও আলেমদের ফতোয়া :
🔹 ইমাম আবু হানীফা (রহ.)
গান-বাজনা শোনা ফাসিকদের কাজ এবং এটি কবীরা গুনাহ। (আল-মাবসূত, ২৪/২৫)
🔹 ইমাম শাফেয়ী (রহ.)
“গান-বাদ্যে লিপ্ত ব্যক্তি আহমক; সর্বপ্রকার বীণা, ঢাক, তবলা—সবই হারাম।” (তাফসীরে কুরতুবী, ১৪/৫৪)
🔹 ইমাম মালেক (রহ.)
“যদি কেউ গান-বাজনাকে হালাল মনে করে, তবে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।” (আল-জামিউল কাবীর, ২/৩৫)
🔹 ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.)
“বাদ্য ছাড়া গান মাকরূহে তাহরীমী, আর বাদ্যসহ গান স্পষ্ট হারাম।” (আহসানুল ফাতাওয়া, ৮/৩৮৮)
🔸 ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.)
“الغِنَاءُ بَرِيدُ الزِّنَا”
অর্থ: “গান হলো ব্যভিচারের দূত।” তিনি বলেন—“গান মানুষের অন্তরকে দুর্বল করে, কুরআনের মহব্বতকে দূর করে দেয়।” (ইগাছাতুল লাহফান, ১/১৯৯)
🔸 ইমাম কুরতুবী (রহ.)
“বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার ব্যাপারে উম্মাহর ইমামগণ একমত। যারা এর বিরোধিতা করে, তারা ভুল করছে।”(তাফসীরে কুরতুবী, ১৪/৫৫)
🔸 ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.)
“গান-বাজনা মানুষকে শিরক, যুলুম ও অশ্লীলতার দিকে ঠেলে দেয়।” 📚 (মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া, ১০/৪১৭)
☑️ সারসংক্ষেপ :
গান-বাজনা কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং এটি ধীরে ধীরে মানুষের আত্মিক শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। আলেমদের মতে,
কুরআনের ভালোবাসা ও গানের আসক্তি এক হৃদয়ে একসাথে থাকতে পারে না।
অতএব, একজন মুমিনের উচিত —
🔹 গান-বাজনা থেকে দূরে থাকা,
🔹 কুরআন তিলাওয়াত, যিকির ও নামাজে মনোযোগী হওয়া,
🔹 এবং নিজের অন্তরকে আল্লাহর স্মরণে জাগ্রত রাখা।
এভাবে মানুষ আধ্যাত্মিক প্রশান্তি অর্জন করবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে অটল থাকতে পারবে।
☑️ উপসংহার :
ইসলাম চায়, মানুষ যেন আত্মার পবিত্রতা ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ রাখে। গান-বাজনা সেই পবিত্রতাকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। তাই আলেমদের সর্বসম্মত ফতোয়া— বাদ্যযন্ত্রসহ গান-বাজনা হারাম। যিনি আল্লাহর নিকট ঘনিষ্ঠ হতে চান, তাঁর জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত হলো কুরআনের তিলাওয়াত ও যিকিরুল্লাহ।