26/06/2025
বাঙালি নিজেকে প্রায়ই ভুঁইফোঁড় বলে। ইংরেজ না এলে কি হত, ভাবতেও অনেক বাঙালির গায়ে কাঁটা দেয়, ইংরেজ এসেছিল বলে তারা নিয়তিকে শত শত ধন্যবাদ দেন। বখতিয়ার খিলজির আগ্রাসন না ঘটলে যে কি সর্বনাশ হয়ে যেত, সে ভেবেও অনেকে মূর্ছা গেছেন। আরব-তুর্ক-পাঠান-মোগল ধর্ষণগুলি ক্রমাগত না ঘটে গেলে বাঙালি জাতির জন্মই হত না, এরকম আমরা শুনেছি। বাঙালির তো কোনও ইতিহাস নেই, সে তুলনায় বাকিরা (যেমন উড়েরা) কত প্রাচীন। আমাদের আর কি ইতিহাস আছে? ওই বড়জোর দশম শতকে শুরু, এরকমটা অনেক সম্মানীয় বাঙালিকেই বলতে দেখেছি।
এরকম দেখে প্রায়ই মনে হয়, হলিউডের র্যান্ডম হার্ভেস্ট, যার অনুপ্রেরণায় স্মৃতিবিভ্রমের ছবিগুলো তৈরি হয়েছে বাংলাতেও (হারানো সুর, আলো আমার আলো - এ দুটো উত্তম সুচিত্রার ছবি আমরা সবাই দেখেছি), সেরকম একটা গল্প বাঙালি জাতির জীবনেও আছে। এই জাতির স্মৃতিবিভ্রম ঘটেছে, সেই স্মৃতিবিভ্রমের বদসুযোগ কেউ কেউ নিচ্ছেন, এবং ঈশ্বর গুপ্ত, বঙ্কিম বা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মত কয়েকজন এই জাতির স্মৃতিকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করেছেন।
বাঙালির স্মৃতিবিভ্রম হয়েছে কারণ আমাদের গ্রন্থাগারগুলো ধ্বংস হয়ে গেছিল মধ্যযুগে। আমাদের পূর্বসূরী প্রবল পরাক্রান্ত গঙ্গারিডাই জাতির কথা যদি গ্রীক আর রোমান ঐতিহাসিকেরা লিখে না রাখতেন আমরা জানতেই পারতাম না। তাম্রলিপ্তের মত এক সহস্র বছরের গৌরবোজ্জ্বল বন্দর। তারও ইতিহাস নেই। এই বাংলার সিঙ্গুর থেকে বিজয়সিংহ লঙ্কায় গিয়ে সাম্রাজ্যস্থাপন করলেন, সেটা আমরা জানতে পারি শ্রীলঙ্কার গ্রন্থগুলো থেকে। বাংলা ভাষার সঙ্গে সিংহলী ভাষার মিল নিয়ে গবেষণা হয়েছে, বাঙালির সঙ্গে শ্রীলঙ্কার লোকের জেনেটিক সাদৃশ্য নিয়ে গবেষণা হয়েছে, সেগুলো বাঙালি করে নি। পুণ্ড্রবর্ধনের ইতিহাস, বঙ্গের ইতিহাস বহুপ্রাচীন, বস্তুত ভারতসভ্যতা যত প্রাচীন, পুণ্ড্র তত প্রাচীন। পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে যে প্রত্নসামগ্রীগুলো পাওয়া গেছে তা ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের, এবং তখনই এ অঞ্চলে সভ্যতা বিকশিত। চন্দ্রকেতুগড়ও অত্যন্ত প্রাচীন, অনুমান করা হয়, এখানেই গঙ্গারিডাই রাজধানী ছিল।
কিন্তু বাঙালি জাতির সে ইতিহাস লিপিবদ্ধ নেই। ইতিহাস হচ্ছে শিলালিপি, তাম্রশাসন, মুদ্রা, পুঁথিপত্র। তার কতটাই বা টিকে আছে! যৎসামান্য! এ জাতি সহস্র সহস্র বছরে ইতিহাসের তুলনায় সে প্রায় কিছুই না।
এইখানে, লোককাহিনী, লোকগাথা, ছেলেভুলোনো ছড়া আর রূপকথার দিকে হাত বাড়াতে ইচ্ছে করে। আগডুম বাগডুম ছড়ায় ডোমজাতির বীরত্ব ঘোষণা শুনতে পাই। হবুচন্দ্র আর গবুচন্দ্র কিন্তু সত্যিই ছিলেন বাংলায়। তেপান্তরের মাঠও সত্যিই ছিল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কোন প্রান্তরে ছিল? সমতল, কাজেই পুরুলিয়া বাদ, সেখানে পাহাড় টাহাড় আছে। রূপকথা অনুযায়ী তেপান্তরের মাটি তেমন উর্বর নয়, সেখানে ঘন বনানী নেই, মাঝে মাঝে ঝোপঝাড় ছাড়া আর কিছু নেই। বাঁকুড়া হতে পারে, বীরভূম হতে পারে। কিন্তু তেপান্তরের মাঠ সত্যিই বাংলার কোন অঞ্চলে ছিল, সেটা কি খুঁজে বের করা যায় না? আঞ্চলিক ইতিহাসের মেথডলজি ব্যবহার করে, আঞ্চলিক ইতিহাস, মৌখিক ইতিহাসের চিরুনি তল্লাশি করে কেউ কি তেপান্তরের মাঠের ওপরে একটা রিসার্চ প্রোজেক্ট করতে পারেন না?
আমার প্রায়ই আড়াই হাজার বছর আগেকার বাংলার তেপান্তরের মাঠ, আর তাম্রলিপ্তের বন্দরে চলে যেতে ইচ্ছে করে। যদি আমরা রিসার্চ করে উপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার করে একটা ঝকঝকে থ্রিডি ফিল্ম তৈরি করতে পারি, সে ইচ্ছে পূর্ণ করাও সম্ভব। গঙ্গারিডাই রণহস্তীবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে কিভাবে ছুটে চলেছে একদিন, বড় দেখতে ইচ্ছে করে! এরকম একটা আন্তর্জাতিক মানের ছবি তৈরি করার মত পয়সা বাঙালির অবশ্য নেই। ভারতে হিন্দিভাষীর পরেই নাকি বাংলাভাষীদের সংখ্যা। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের ইন্ডাস্ট্রি যা করতে পারে, আমরা পারি না। আমাদের পয়সা নেই।
সব সমস্যার মূল বোধহয় এই। বাঙালির হাতে পয়সা এলে তার হারানো স্মৃতিও ফিরে আসতে পারে।
© তমাল দাশগুপ্ত
#পুনরুদ্ধার_কর_অতীত