05/07/2025
"সামনের চাকা ঘোরে না"
মটরবাইকের তখন এত দাপট ছিল না। মানুষ তখনও সাইকেলের ঘন্টিতে জীবনকে গুছিয়ে নিত। “আশা” নামের একটি এনজিওতে চাকরি করতাম—আমার নাম মিঠুন।
শুধু শাখা ব্যবস্থাপকদের জন্য একটা মটরবাইক থাকতো, বাকিদের জন্য ছিল ক্রিং ক্রিং বাইসাইকেল।
আমারও ছিলো—ওটাই ছিলো আমার পঙ্খীরাজ। ওটাকে নিয়েই সকাল-সন্ধ্যা উড়ে বেড়াতাম। কখনো অফিসের কাজে, কখনো নিজের কাজে।
অফিস থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে মোড় ঘুরে একটু এগোলেই ডানদিকে একটা পুকুর পড়তো। পুকুরের ওপারে শান বাঁধানো ঘাট।
সেখানে প্রায় প্রতিদিন এক কিশোরী আমাকে দেখা মাত্রই উচ্চ স্বরে বলে উঠতো,
“সামনের চাকা ঘোরে না...”
এই মেয়েটি কি আমার জন্যই এখানে অপেক্ষা করে?
প্রতিদিন, আমি তো এমন কেউ না—যার জন্য কেউ অপেক্ষা করবে।
তবুও মেয়েটির কণ্ঠে কিছু একটা ছিল—একটা বিষণ্ণ টান, একটা মায়াময় আহ্বান।
বাঁ দিকের রাস্তা বাদ দিয়ে যেদিন সোজা রাস্তায় চলতাম, তখনও রেহাই ছিল না।
হাফ কিলো গেলেই আরেকটা বাড়ির সামনে এলেই এক কিশোরী মায়মায় কন্ঠে চেঁচিয় উঠতো,
“আশা ভালোবাসা...”
এই মেয়েটাকে আমি অবশ্য কিছুটা চিনতাম।
বিস্ময়ের কথা হলো—এটাও নিয়মিত।
এই মেয়েটার বাসায় কি আর কেউ থাকে না?
প্রতিদিন, একই সময়, একই কথা!
তাদের এমন আবেগীয় আচরণ আমার মনে যে ছাপ ফেলতো না তা নয়;
আমি তখন এসব ভাববার সময় পাই না। চাকরি, ভাড়া বাসা, ভাঙা সাইকেল, পরিবারের প্রতি নিজের দায়ীত্ব এসবই তখন প্রাধান্য পায়।
তবু, আজ এত বছর পর, এখনো আমার কানে বাজে সেই মেয়েটার গলা,
“সামনের চাকা ঘোরে না…”
বরিশাল জোন ছেড়ে তখন খুলনা জোনে বদলি হয়েছি।
এক বিকেলে, অফিসের পাশের বাসার এক দিদিমা পথ আটকে দাঁড়ালেন।
ফোকলা দাঁত দেখিয়ে হাসলেন—তার প্রতিবেশী একটা মেয়ের গল্প শুনালেন।
গরীব ঘরের, কষ্ট করে পড়াশোনা করছে, অনেক পাত্র আসছে, কিন্তু কেউই পছন্দসই না।
“একটা শিক্ষিত ছেলের হাতে মেয়েটাকে তুলে দিতে চায় ওর মা”—এই কথা বলতে বলতে, একপ্রকার প্রস্তাবই দিলেন।
মেয়েটাকে আমি এর আগে কয়েকবার দেখেছি।
হিজাবে মুখ ঢেকে স্কুলে যায়—মাথা নিচু, চোখ মাটিতে।
সেই দিদিমার গল্প শুনে কেন যেন মেয়েটাকে মনে হলো কাছের কেউ—অচেনা ভালোবাসার মতো।
তখনও জানতাম না—এই মেয়েটির নাম মুনমুন।
এই মেয়েটাই একদিন আমার জীবনের গল্প হয়ে যাবে।
তার মায়ের আগ্রহে তাদের বাসায় আসা-যাওয়া বাড়ে।
একদিন আমি সরাসরি মুনমুনকে বলি,
“তোমার মা-বাবা আগ্রহী। তুমি কী বলো?”
মেয়েটি চোখ নামিয়ে বলে,
“আমি কিছু জানি না। আমার মা জানে। তার কথাই আমার কথা।”
এই বাক্যটা তখন মনে হয়েছিলো ভদ্রতা।
কিন্তু আজ বুঝি—ওটা ছিল সতর্কবার্তা।
যে মেয়েরা নিজের সিদ্ধান্ত নিতে জানে না, তারা পরবর্তী জীবনকেও নিজের করে নিতে পারে না।
তবুও বয়সের ভুল, আবেগের ঢেউ—সব মিলিয়ে মুনমুনকে বিয়ে করলাম।
বিয়ের পর নতুন চাকরি, নতুন পোস্টিং—রওশনপুর, তেতুলিয়া।
ঠাণ্ডা জায়গা, ঠাণ্ডা মানুষ। কিন্তু একদিন সব গরম হয়ে উঠলো জোনাকি নামের এক মেয়ের চোখের জ্বালায়।
জোনাকি ছিল আগুন।
হাতে ফুল, চোখে জল, মুখে একটাই কথা—“আপনার জন্য আমি জীবন দিতে পারি।”
আমি বিবাহিত—ওকে জানালাম, তাও থেমে যায় না।
ওর দাদীকে পাঠায়, বান্ধবীকে পাঠায়।
প্রতিদিন ছুটে আসে, আবেগতাড়িত হয়ে কান্নাকাটি করে।
শেষমেশ অফিসে জানিয়ে অন্য ব্রাঞ্চে চলে যেতে হয়।
জোনাকি এখন হয়তো কারো স্ত্রী। তার সন্তান স্কুলে যায়।
কিন্তু আমার মনে এখনো দগদগে হয়ে আছে—একজন নারী সত্যি চাইলে কী ভয়ানক রকম চাইতে পারে!
মুনমুনের এমন উদাসীনতা আমাকে মনের অগোচরে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই দিনগুলোতে। কিশোর বয়সে কেউ না কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করতো।
জোনাকি কেমন বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কাঁদতো।
ওরা কি আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলো?
আমার মা একদিন বলেছিলেন,
“আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি না, আমি দেখতে পাচ্ছি— তুই সুখী হবি না বাবা। মেয়েটার চোখে-মুখে কোন মায়া নেই।”
আজ মা নেই; কিন্তু তার কথাগুলো মনে পড়ে।
মুনমুন কিছুটা Asexual।
পুরুষ বলতে তার কিছুই আসে যায় না।
আর আমার মতো পুরুষ—যে প্রেম করে বিয়ে করেছে—তার কাছে ভালোবাসা না পাওয়া মানে শাস্তি, আজীবনের শাস্তি!
মুনমুন যেন আজও তার মায়ের নাড়ি থেকে আলাদা হয়নি।
মায়ের পরমর্শ ছাড়া কিছুই করতে পারে না।
মাঝে মাঝে মনে হতো—
ও কি বেডরুমে যাওয়ার আগেও মায়ের অনুমতি নেয়?
সন্তান নেয়ার প্রয়োজন না হলে ও সে সুযোগটিও দিত কিনা কে জানে!
আমরা কখনো সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করতে পারিনি।
ওর মা-ই চাপ দিয়েছিলেন:
“পুরুষ মানুষকে সন্তান দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়!”
হ্যা, আমি এখন বাচ্চাদের মায়ায় বন্দী।
দাম্পত্য জীবনের স্বাধীনতা উপভোগ করার সুযোগ কখনো পাই নি।
আমি এখন আর কারো স্বামী নই; সন্তানের বাবার ভুমিকায় সংসারের ঘানি টানছি।
একপ্রকার জোর করেই আমাকে ওর পাশে যেতে হয়।
ভালোবাসা, ছোঁয়া, খুনসুটি—সবই তার কাছে অযথা!
নারীর ভালোবাসা যে কি সেটা আমার কাছে চিরকালের জন্য অধরাই থেকে গেলো।
বিবাহিত জীবনের প্রায় দুই দশক পুর্তি হতে চলল ও আজ অবধি ভালোবেসে আমাকে একটা কিস দিয়েছে কিনা মনে পড়ে না।
খুব ইচ্ছে হয় ওর ঠোঁট দুটো নিয়ে খেলা করতে। ও বলে এসব তার ভালো লাগে না।
আমিতো ধুমপান করি না; আমার মুখে গন্ধ আছে বলেও আজ পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করে নি। তাহলে ও এমন করে কেন?
আমিওতো রক্তে মাংসে পুরুষ,
আমার কি ইচ্ছে হতে পারেনা স্ত্রীর সাথে খুনসুটি করা, একান্তে সময় কাটানো।
কিন্তু ওর যে কত অযুহাত;
গরম লাগে,
শীত লাগে,
আমি নামাজ পড়বো,
আমি রোজা রাখছি,
বাচ্চারা হয়তো জেগে আছে,
বাচ্চাদের স্কুল খোলা; সকালে অনেক কাজ আছে,
সবশেষে বলে, “এসব আমার ভালো লাগে না। চাইলে বাইরে গিয়ে নিজের ব্যবস্থা করো।”
আমি চুপ করে যাই। শুনেছি, অনেক নারী শত চেষ্টা করেও তার স্বামীকে অন্য কারো দিকে যেতে দেয় না।
আর ও কিনা স্বেচ্ছায় আমায় ঠেলে দিচ্ছে অচেনা এক শূন্যতার দিকে!
আমার স্বপ্ন ছিলো আমার স্ত্রী হবে রোমান্টিক,
প্রচুর বই পড়বে, গুনগুন করে গান করবে, তার খোপায় বনফুল গুজে দিবো। একসাথে কন্ঠ মিলিয়ে কবিতা পড়ব।
এরকম কত কি স্বপ্ন!
অথচ ও তার মা’র থেকে যেটা শিখেছে তা হলো স্বামীরা শুধু টাকার মেশিন, স্ত্রীরা শুধু রান্না করবে। সংসারে কোন প্রকার অভাব থাকা চলবে না। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম।
এর বাইরে আর কোন জগৎ নাই।
আমার শাশুড়ি এখন আমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে টক্সিক মানুষ।
কারণ আমি তার প্রতিচ্ছবি মুনমুনের মধ্যে স্পষ্ট দেখতে পাই।
তার বদমেজাজ, ধৈর্যহীনতা, সবকিছুতে বেশীবোঝা আর অল্পতেই অস্থির হওয়ার অভ্যাস ওর মধ্যে প্রকট। যেন ঠিক ওর মায়ের কার্বনকপি।
ওর জন্য আমার জীবনে কত নির্ঘুম রাত কেটেছে তার হিসেব নেই।
নিয়মিত নামাজ না পড়লেও কিছুটা ধার্মিক ও আদর্শ মেনে চলি আমি।
তাই সুযোগ থাকা স্বত্তেও কখনো বিকল্প চিন্তা করিনি।
ধৈর্য্ ধরে অপেক্ষা করি সেই দিনটির জন্য।
ভাবি জীবন আর ক’দিনের, চল্লিশতো পেরিয়েই গেলো।
ওর সাথে রাতের বনিবনা না হলে কিছুতেই আমার আর ঘুম আসে না।
অথচ পাশে বসে মুহুর্তে কিভাবে ঘুমের রাজ্যে চলে যায় ও!
রাত গভীর হয়; মনের অজান্তে হাতে তুলে নেই স্মার্ট ফোন।
ফেসবুক-মেসেঞ্জারে তখন নক করে অজানা অচেনা কিছু নারী।
তাদের স্বামীরাও কি স্ত্রীকে জাগিয়ে রেখে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে?
মুনমুনের প্রতিনিয়ত উদাসীনতা আমাকে তাদের প্রতি দুর্বল করে।
আকর্ষণ অনুভব করি। কিন্তু ওদিকে পা বাড়াই না।
সবাই সবকিছু পারে না।
স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাই,
সন্তানদের পবিত্র মুখের দিকে তাকাই।
যে নারীরা তাকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে রেখেছে তারা অনেক দুরে!
কাছাকাছি থাকলে কি তাদের ডাকে এখনই সাড়া দিতাম? আঁতৎকে উঠি; আমি কি সুযোগের অভাবে সৎ?
বিছানা ছেড়ে বেসিনের কাছে যাই,
চোখেমুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দেই।
তারপর জানালায় গিয়ে দাঁড়াই।
সমস্ত পৃথিবী ঘুমিয়ে, আকাশের তারাগুলোও যেন ঘুমে ক্লান্ত। আমার চোখে ঘুম নেই।
নির্ঘুম রাত যে কত কষ্টের ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।
আমি এখন কি করা উচিত? ওয়াশরুমে যাবো? অযু করবো? তাহাজ্জুদ নামায পড়বো?
আজও একটা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে অবসন্ন মনে রাস্তায় বেড়িয়েছি।
সকালের ফাঁকা রাস্তায় হেঁটে চলেছি মৃদুমন্দা হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে।
হঠাৎ দেখি—একজন লোক বাইসাইকেল ঠেলছে। সাইকেলে না উঠে ঠেলছে। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে।
—“কি হলো ভাই? সাতসকালে ঠেলছেন কেন?”
—“সামনের চাকা ঘোরে না ভাই। বেয়ারিং মনে হয় গেছে।”
আমি থমকে দাঁড়িয়ে যাই।
মাথার ভেতর শুধু একটা কথাই ঘুরতে থাকে,
“দাম্পত্য জীবনটা আসলে বাইসাইকেলের মত।
দুই চাকা—একটা না ঘুরলেই জীবন ঠেলতে হয়…”
মনে পড়ে যায় সেই কিশোরীর কথা, যে প্রায় প্রতিদিনই সুর করে চেঁচিয়ে বলতো, “সামনের চাকা ঘোরে না!”