03/08/2025
‘আমার বয়স যখন ৪ বছর,তখন ২৬ বছরের এক সুদর্শন লোকের সাথে আমার বিয়ে হয়। অথচ আমি আজও জানি না,সে কে? কি তার পরিচয়। কিংবা সে দেখতেই বা কেমন?’
তৃতীকার এহেন কথা শুনে, তার পাশে বসে থাকা মেয়েটি বিস্ময়ের চাহনিতে তার দিকে তাকায়। দুজনের পরিচয়টা খুব বেশিক্ষণের নয়। তারা এক বড় কর্পোরেট অফিসে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। শিক্ষাগত যোগ্যতায় তৃতীকা তার পাশে বসে থাকা মেয়েটির চেয়ে বেজায় ছোট। সবে মাত্র এইচএসসি পাশ করে, ভার্সিটিতে উঠেছে সে। আর তার পাশে বসে—গল্প আলাপ শোনা মেয়েটার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট।
ইন্টারভিউ এর জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছিল বিধায়, দুজনে টুকটাক পরিচিত হতে শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে ক্রমশই তাদের গল্প আলাপ দীর্ঘ হতে শুরু করে। তৃতীকার পাশে বসে থাকা মেয়েটার নাম ছিমরান। আর তৃতীকার পুরো নাম ❝তৃতীকা তালুকদার❞।
বয়সে আর সবার চেয়ে ছোট হলেও, তার কাঁধে দায়িত্বের ভারটা অনেক বেশি। তাই তো এই অল্প বয়সেই,একটা ভালো চাকরির খোঁজে মস্তবড় এই ঢাকা শহরে একা একাই ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। মেয়েটা দেখতে ভারী ফর্সা। গোলগাল মিষ্টি চেহেরা। কোমড় পর্যন্ত লম্বা সিল্কি চুল,তবে কিছুটা এলোমেলো। অতিরিক্ত মোটা কিংবা চিকন নয়। শারিরীক গঠনে একদম আদর্শ।তবুও মনে হবে, বহুদিন ঠিকঠাক ভাবে খাওয়া-দাওয়া না করায় ও অযত্নে-অবহেলায় তার অবস্থা খুবই করূন।
তৃতীকার পরণে সাধারণ একটা সাদা রাঙা কুর্তি।সাধারণ হলেও বেশ পরিপাটি। কাঁধের একপাশে সাদা ওড়ানাটা ঝুলিয়ে দিয়েছে। তবে এসবের মাঝেও তার চোখেমুখে অদ্ভুত এক চিন্তার ছাপ বিদ্যমান। দেখতেও অনেক বেশি ক্লান্ত ও হতাশায় নিমজ্জিত লাগছে। এছাড়া আশেপাশের সকল লোকজনও যেন তার থেকে অনেকটা ভিন্ন। সকলের গায়েই নানান সব নামীদামী পোশাক। কত স্টাইলিশ ভঙ্গিতে চলাফেরা। অথচ সে কত সাধারণ।না চাইতেও এক তীব্র হতাশা ও বিব্রতবোধ কাজ করছে নিজের মাঝে। তবে ছিমরান মেয়েটা খানিকটা ভিন্ন লেগেছে তার কাছে। আর সবার মতো মর্ডান,স্টাইলিশ হলেও হুট করেই তার সাথে গল্প জুড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা, তার বেশ ভালো লেগেছে।
আর এভাবেই একটা পর্যায়ে গিয়ে তৃতীকা তার নিজের সম্পর্কে নানান গল্প আলাপ করতে শুরু করে। ছিমরান তৃতীকার দিকে চেয়ে অবাক সুরে বলে ওঠে,
❝সিরিয়াসলি? তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?❞
তৃতীকা কিঞ্চিৎ মৃদু হেসে ফেলে।আলতোভাবে মাথা নাড়িয়ে বলে,
❝না! আমি মজা করছি না। ছোট বেলা থেকেই এমনটা শুনে আসছি।❞
—❝কে বলেছে তোমায় এসব?তোমার বাবা মা?❞
—❝আমার বাবা মা বেঁচে নেই। আমার সবে মাত্র বুঝ হতে শুরু করেছে।ঐ সময় তখন এক ভয়ং*কর মহামা*রী রোগ, গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। ওহ হ্যাঁ,বলে রাখা ভালো। আমি কিন্তু গ্রামের মেয়ে। গ্রামেই আমার জন্ম, ওখানেই আমার বেড়ে ওঠা।
তো ঐ সময়, আমাদের গ্রামজুড়ে প্রায়ই নানান রোগব্যাধি দিয়ে ছেয়ে থাকত। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের জ্ঞান স্বল্পতা ও ঠিকঠাক স্বাস্থ্যবিধী মেনে চলতো না বিধায়—এই সমস্যা সময়ের সাথে সাথে অত্যধিক পরিমানে বেড়ে যায়।
তবে ঐ সময়ে হঠাৎ দেশি-বিদেশি কিছু স্বাস্থ্যসেবা কর্মী আমাদের গ্রামে আসে। শুনেছি তাদের সাথে নাকি আরো কিছু ব্যবসায়িক লোকও আসে। তার মাঝে একজন ছিল, আমার সেই স্বা...স্বামী!"
তৃতীকা এইটুকু বলতেই থেমে যায়। আকস্মিক বিস্তৃত মুচকি হেসে ফেলে। ওর হাসিটা ছিমরানের কাছে বোধগম্য। তবে তৃতীকাকে নিয়ে আগ্রহটাও বেশ জোড়ালো। সে একটুও সময় নষ্ট না করে বলে ওঠে,
❝এরপর? এরপর কি হয়েছিলো?❞
ছিমরানের আগ্রহ দেখে তৃতীকা আবারও মুচকি হাসে। পরক্ষণেই আবারও বলতে শুরু করে,
❝ঐ ম*হামা*রীতে গ্রামের অনেক লোক মা'রা যায়। আমার বাবা-মায়েও অল্প বয়সেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। আমার পরিবার বলতে শুধু আমার বাবা মায়েই ছিল। এমনিতে গ্রামের আরো নিজের কিংবা দুঃসম্পর্কের আত্নীয় স্বজন রয়েছে। চাচা-মামা, মোটামুটি অনেকেই আছেন। এছাড়া আমার তালুকদার বংশও গ্রামের মধ্যে যথেষ্ট উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ছিল।
কিন্তু ঐ যে স্বল্প-জ্ঞান! ম*হামা*রীতে মোটামুটি আর সবার মতো আমাদেরও সবকিছু শেষ হয়ে যায়। দেশি-বিদেশি স্বাস্থ্যসেবা দলগুলো, গ্রামের উন্নয়নের পাশাপাশি, নিজেদের মতো অনেককিছুই আত্মসাৎ করে নিয়ে যায়—এই বোকা-সোকা গ্রামবাসীর কাছ থেকে।
তো মূল ঘটনায় আসি। ঐ যে কয়েকজন ব্যবসায়িক লোক এসেছিল না? তাদের মাঝে... যার সাথে আমার বিয়ে হয় আরকি। সে নাকি অত্যন্ত ভালোমানুষ ছিল সবার মাঝে। আর সকল ব্যবসায়ীর চেয়ে বয়সেও খানিক ছোট ছিল। দেখতে নাকি একদম বিদেশি রাজপুত্রের মতো। অবশ্য হবেই না কেনো, শুনেছি সে নাকি বিলেত...আই মিন, লন্ডন থেকে দেশে এসেছিল। এমনিতে বাংলাদেশী, কিন্তু...হয়তো তার বাবা মায়ের মাঝে একজন ব্রিটিশ ও একজন বাঙ্গালী ছিল।
তো সব মিলিয়েই অল্প কয়েকদিনে মাঝে লোকটি গ্রামের সবার কাছে বেশ প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠে। আর তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়, আমাদের তালুকদার বাড়িতে। বেশ ভালোই কদর ছিলো বিধায়, বাহিরের অনেক মেহমানদেরকেই আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া হতো।
আর ঐ সময় আমার তালুকদার বাড়িতে দাদা, বাবা,চাচারা মিলে মোটামুটি সকলেই একসাথে থাকত। এককথায় একটা সাজানো-গোছানো যৌথ পরিবার ছিলাম। কিন্তু মহামারীতে সর্বপ্রথম যখন তালুকদার বাড়ি হতে আমার দাদাভাই অসুস্থ হলো—তখন থেকেই যেন ধ্বং*সের সূচনা হয়।
দাদাভাইয়ের অবস্থা তখন বেজায় খারাপ। বাবা,চাচারা মিলে দূরদূরান্তর হতে ছোটাছুটি করে—নানান ডাক্তার, ঔষধ এনেও কোনো আশানুরূপ ফল পাচ্ছে না৷ এরইমাঝে দাদা ভাই এক অদ্ভুত জেদ ধরে বসে। নাতী-নাতনীদের মাঝে আমি ছিলাম তার সবচেয়ে প্রিয়। ওদিকে সেই লোকটিও অল্পদিনের মাঝেই, তার অত্যধিক পছন্দের পাত্র হয়ে যায়।
তারপর আর কি! জীবনের শেষ পর্বে, মৃ*ত্যুর দারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দাদাভাই তার শেষ আবদার হিসেবে, আমার আর সেই লোকটার বিয়ে দিতে চায়। ভাবা যায়? একটা চার বছরের অবুঝ বাচ্চার সাথে, ছাব্বিশ বছরের এক লোকের বিয়ে! ব্যাপারটা আমার কাছে হাস্যকরই বটে।❞
ছিমরানের বিস্ময় যেন কাটছেই না। সে বিস্ময়ের সাথে আবারও বলতে লাগল,
❝তারপর!তারপর! সেই লোকের সাথে তোমার সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে গেল?❞
---❝হুম! লোকটি শিক্ষিত ছিল। তারকাছে দাদাভাইের ইচ্ছেটা অদ্ভুত ঠেকলেও, বিয়েটা হয়তো তার কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন ছিল। অবশ্য হওয়াই কথা, এমন আজব বিষয়টা কি তার মতো বিদেশি শিক্ষিত লোক মালুমে নেবে?
কিন্তু গ্রামবাসী কিংবা আমার পরিবার তো আর তার মতো চিন্তাধারার ছিল না। সে দাদাভাইের কথামতো ঐ রাতেই আমাকে বিয়ে করে। দাদা ভাইয়ের জীবন তখন বাঁচা-ম'রার মাঝপথে।
চাচীদের কাছে গল্প শুনেছি, আমাকে নাকি গভীর রাতে ঘুম থেকে তুলে বিয়ে দেওয়া হয়। কাঁচা ঘুমের জন্য, আমি নাকি সে কি কান্না! তবুও, ঐ মাঝরাতে কাজি ডেকে আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। অথচ আমি জানলামও না, বুঝলামও না—আমার জীবনের সাথে কি হয়ে গেলো৷
আর ঐ রাতেই ভোর হবার আগেই দাদাভাই সবাইকে ছেড়ে দুনিয়া থেকে চলে যায়। এরপর একে একে অল্প কদিনের মাঝে আমার বাবা-মায়েও... হাহ...!❞
তৃতীকা নিজের কথা অসমাপ্ত রেখেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ওদিকে ছিমরানও খানিকটা ভারী শ্বাস ফেলে বলে,
❝তারপর কি হয়েছিলো? সেই লোকটির সাথে তোমার তো বিয়ে হয়েছিল, তবে তোমার কি তার কথা একটুও মনে নেই?❞
---❝কিভাবে মনে থাকবে? সে তো আর থাকেনি।❞
---❝মানে?❞
---❝চলে গিয়েছে। বিয়ে মানে শুধু দুটো ব্যক্তির মাঝের বন্ধন নয়৷ এখানে নানান নিয়ম-কানুন থাকে, দায়িত্ব পালন করতে হয়৷ একে অপরের দায়িত্ব নিতে হয়। অথচ আমার তখন ওসবের বুঝ নেই৷ আর তার কাছে সবই ছিল হয়তো ফেলনা। বিয়ের অল্প কিছুদিনের মাঝেই যখন বাবা মা মারা গেল,তার কদিন বাদেই নাকি হুট করে তিনি গায়েব হয়ে যায়।❞
———❝তোমার কথা ঠিক বুঝলাম না। গায়েব হয়ে যায় মানে?❞
———❝মানে, একরাতের পর তাকে আর কেউ খুঁজে পায়নি। কাউকে না জানিয়েই বাড়ি থেকে রাতের আঁধারে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। সকাল বেলায় সকলে তন্নতন্ন করেও আর,কেউ তার খোঁজ পায়না। এমনকি তাকে খুঁজতে চাচারা কয়েক শহর অব্দি তল্লাশি চালিয়েছিল, কিন্তু তেমন একটা লাভ হয়না। তিনি গায়েব তো একদমই গায়েব।❞
তৃতীকার সব কথা শুনে ছিমরানের যেন বিস্ময়ই কা*টছে না। সে অবাক স্বরে আওড়ায়,
❝সিরিয়াসলি? আমার তো এসব বিশ্বাসই হচ্ছে। কিভাবে কি?❞
তৃতীকা আবারও কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নেয়। এখনো আরো অনেক লোকজনের ইন্টারভিউ দেওয়া বাকি। মোটমুটি সকলেই অপেক্ষা করে করে, এখন অনেকটাই ক্লান্ত। এরইমাঝে ছিমরান আবারও তৃতীকার উদ্দেশ্যে বলে,
❝আচ্ছা, তোমার সেই হাজবেন্ড...আই মিন, ওনার নাম কি?❞
———❝জানি না।❞
———❝সিরিয়াসলি? নামও জানো না? এটা কোনো কথা?❞
তৃতীকা মুচকি হেসে বলতে লাগে,
❝তার নাম শুধু জানতো আমার দাদা ভাই। দাদাভাই-ই তাকে তালুকদার বাড়িতে মেহমান হিসেবে এনেছিল। কিন্তু দাদাভাই সহ গ্রামের সবাই ডাকে একনামে ডাকত—'বাবু সাহেব'। উনি খুব অল্প সময়ের জন্য গ্রামে ছিলেন, আর এই অল্প সময়ে কেউই সেভাবে তার সম্পর্কে জেনে উঠতে পারেনি। অবশ্য সেই সময়, গ্রামের দুর্দশায় কার-ই বা এতো তদারকি করার অবস্থা আছে? তাই সবাই তাকে ভালোবেসে শুরু থেকেই বাবু সাহেব বলে ডাকত। এমনিতেও বিদেশি লোক ছিল,তাই হয়তো...।❞
ছিমরান খানিকটা ভাবুক স্বরে বলে,
❝উমমম!ব্যাপারটা ভালোই কম্পলিকেটেড। আচ্ছা, যদি আবার কখনো তার সন্ধান পাও, তবে কি তুমি তখনও নিজেকে তার স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেবে? তোমার আর তার বয়সের গ্যাপটা তো যথেষ্ট।❞
ছিমরানে কথা শুনে তৃতীকা দাঁত খুলে হেসে ফেলল। তবে সে হাসিতে আওয়াজ হলো না। কিন্তু আকস্মিক দৃশ্যমান হলো বাম পাশ বরাবর চকচকে গ্যাজ দাঁত। যা ঠিকই ছিমরানের নজরে ধরা দেয়। মেয়েটিকে সবমিলিয়ে তারকাছে যথেষ্ট সুন্দরী মনে হয়েছে। যথেষ্ট বললে হয়তো ভুল হবে, অসম্ভব সুন্দরী সে।
———❝তার আমার বয়সের গ্যাপ কম করে হলেও বাইশ বছর। ভাবতে পারছেন? এতোদিনে নিশ্চিত সে এক চল্লিশ বছরের চুল পাকা কাকু-মামুদের মতো হয়ে গিয়েছে। হা হা হা।❞
তৃতীকার অকস্মাৎ হাসিতে ছিমরান ভড়কে যায়। পরক্ষণেই সেও হেসে ফেলে বলে,
❝আরেহ, এটা কেমন কথা। শুরুতেই না বললে, অনেক সুদর্শন ছিল সে। একদম বিদেশি রাজপুত্রের মতো। তবে?...শোনো মেয়ে, তোমার জামাই যদি সত্যিই লন্ডনের বাসিন্দা হয়ে থাকে তবে এতো চিন্তা করো না। ওদেশের মানুষ এদেশের মতো,এই চল্লিশ পয়তাল্লিশ বয়সেই চুল পাকা চাচা-মামদের মতো বুড়ো হয় না। ষাট বছর বয়সেও তাদের ফিটনেস, বডি দেখার মতো কারাক! কচি কচি মেয়েরা তো হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সেখানে তোমারটা তো কেবল চল্লিশ।❞
———❝হুম, সুগার ডেডি।❞
এই বলতে না বলতেই তৃতীকা আবারও শব্দহীন ভাবে,গা দুলিয়ে হেসে উঠল। ছিমরান তার হাসিতে কিছুটা ভড়কে গেলেও, পরবর্তীতে সে নিজেও না হেসে আর পারল না। তবে তাদের গল্প-আড্ডা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। নিমিষেই ভেতর হতে নাম এলো, ছিমরানের ইন্টারভিউয়ের জন্য। সে শুরুতে কিছুটা নার্ভাস ফিল করলেও, পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে তৃতীকার কাছ থেকে কুশলাদি বিনিময়ের পর, সে ইন্টারভিউ রুমের ভেতরে প্রবেশ করে।
এদিকে এবার একা একা চুপচাপ বসে থাকে তৃতীকা। প্রায় সিরিয়াসলের শেষেরদিকে তার অবস্থান। আশেপাশের লোকজনও কমে গিয়েছে। এতোক্ষণ ছিমরানের সাথে ভালোই ভালোই সময় কা*টালেও এখন আর ভালো লাগছে না। চিন্তায় কেমন যেন সেও অস্থির হয়ে উঠেছে। চারপাশে এতো কম্পিটিশন, অথচ তার এই মূহুর্তে একটা চাকরি না হলেই নয়৷ এই মস্তবড় ঢাকা শহরে একা একটা মেয়ে হয়ে, একা থাকা—তাও এমন আর্থিক সংকট নিয়ে—কিভাবে সম্ভব?
এইসব চিন্তার মাঝে সে যেন নিশ্চিত হয়েও বসেছে, এই কোম্পানিতে তার চাকরি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই আর এখানে অপেক্ষা করেও লাভ নেই। আজ সে আর ইন্টারভিউ দেবে না।
এই ভেবে সে চলে যেতে নিলেও, পরক্ষণেই ভাবতে লাগল এসব সে কি রকম পা*গলামি করছে। সে তো কখনো এতো সহজেই হাল ছেড়ে দেয় না। জব পেতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। ইন্টারভিউটা দিলে অন্তত একটা ভালো অভিজ্ঞতা হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, ইন্টারভিউ না দিলেও শেষবারের মতো ছিমরানের সাথে বিদায় তো নিতে হবে। এতোক্ষণ একসাথে গল্প করার পর এখন যদি না জানিয়েই হুট করে চলে যায়, তবে ব্যাপারটা কেমন হয়? নিত্যন্তই বাজে।
তৎক্ষণাৎ সে তার সিন্ধান্ত বদলে চুপচাপ সেখানেই বসে থাকে। প্রায় খানিকটা সময় পর ছিমরান বেরিয়ে আসে৷ চোখে-মুখে হতাশার মৃদু ছাপ। তাকে দেখেই যেন তৃতীকার চোখমুখ শুকিয়ে যায়। বুঝতে পারছে না কি করা উচিত। ছিমরান তৃতীকার কাছে এলে, সে তাকে তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করে,
❝এমন নার্ভাস কেনো দেখাচ্ছে আপনাকে? সব ঠিক আছে?❞
ছিমরান কিছুটা মলিনভাবে মুচকি হেসে বলে,
❝ইন্টারভিউ তো দিয়ে এলাম। বাট...ড্যাম সিওর, জবটা হয়তো আমি পাব না।❞
---❝কি বলছেন? এভাবে এতো সিওর হয়ে...❞
---❝আচ্ছা, আমার কথা বাদ দেও। সামনে তো তোমায় ডাকবে। সাবধানে ইন্টারভিউ দেবে, মোটেও নার্ভাস হতে যেও না।❞
---❝চিন্তা নেই, আমি আর ইন্টারভিউ দেব না।❞
তৃতীকার কথা শুনে ছিমরান বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,
❝কিহ! কিন্তু কেনো? হঠাৎ আবার কি হলো তোমার? ❞
তৃতীকা খানিকটা ঘাবড়ানো কন্ঠস্বরে বলে,
❝চাকরিই যখন পাব না, তখন ইন্টারভিউ দিয়ে আর কি করব?❞
---❝এই দেখো,আমার কথা শুনেই ঘাবড়ে গিয়েছে। যা ভেবেছিলাম তাই...❞
---❝নাহ, এমনটা নয়। আমি আগেই চলে যেতাম। কিন্তু আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। শেষবেলায় বিদায় না নিয়েই চলে যাওয়া...❞
---❝কি বলছো এসব? উফ মেয়ে,পাগলামি করো না...❞
ছিমরানের কথা শেষ হতে না হতেই,ভেতর হতে এবার তৃতীকার নাম ধরে ডাক আসে। নিমিষেই তৃতীকা যেন আরো বেশি ঘাবড়ে যায়৷ বেশি দেরি করলেও সমস্যা। ইন্টারভিউ দিতে হলে এখনই ভেতরে যেতে হবে, নয়তো এখান থেকে এক্ষুনি পালাতে হবে। আশেপাশে লোকজন না হয় কি বলবে?
---❝আচ্ছা আপু, আমি নিচে যাচ্ছি। আপনার জন্য ওয়েট করব। পরে না হয়...❞
এই বলেই তৃতীকা ছুটতে নিলে, ছিমরান প্রচন্ড আশ্চর্য হয়ে তাকে খপ করে ধরে ফেলে। পরক্ষণেই ছিমরানকে কিছুটা আস্বস্ত করতে, দ্রুত স্বরে ফিসফিসয়ে বলতে লাগে,
❝এই মেয়ে! এসব কি রকমের পা*গলামি করছো? চারপাশের মানুষজন তোমায় দেখছে! আচ্ছা শোনো! ঘাবড়ানোর কিছু নেই। চুপচাপ ভেতরে যাবে, তাদেরকে তোমার সিভি দেখাবে আর একদম স্বাভাবিক ভাবে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবে। দেখবে জবটা তোমারই হয়ে গিয়েছে।❞
---❝না আপু, সরি। প্লিজ তুমি আমায় জোর করো না।❞
---❝আরে,আরেহ্! ভেতরে জানো এই কোম্পানির বস বসে আছেন। দেখতে কি হেব্বি সুন্দর! তোমার গল্পের ঐ বিদেশী রাজপুত্রের মতো। যদিও শুনেছি তার বয়স কিছুটা বেশি, কিন্তু দেখে তা বোঝার উপায় নেই।অন্তত তাকে দেখতে হলেও একবার ইন্টারভিউটা দিয়ে আসো মেয়ে। ❞
---❝কি আজব,আমি তাকে দেখে কি করব?❞
---❝কি করবে?...আ...এমনও তো হতে পারে। উনিই তোমার হারিয়ে যাওয়া বর। যাও গিয়ে দেখো, চিনতে পারো কিনা! আবার তার রূপের ঝলকে পা*গল হয়ে ইন্টারভিউে গড়মিল করে করো না। আমার তো মনে হয়, আমি সহ সব মেয়ের ইন্টারভিউ বাজে হয়েছে এই কারণেই, হা হা।❞
এহেন পরিস্থিতিতে ছিমরানের এমন হাস্যরসিকতা একদমই অপ্রাসঙ্গিক। তৃতীকা কি বলবে নিজেও বুঝতে পারল না৷ শেষমেশ একরাশ হতাশা নিয়েই এগিয়ে গেল ইন্টারভিউ রুমের দিকে।
_________
---❝আসসালামু আলাইকুম।❞
ভেতরে প্রবেশ মাত্রই তৃতীকা নরম স্বরে সালাম দেয়। বিশাল বড় কাঁচ-ঘেরা এক রুমে, তিনজন প্রফেশনাল স্টাইলের বেশভূষায় সজ্জিত ব্যক্তি রয়েছেন। একজন বাংলাদেশী, হালকা চুলপাকা মধ্যবয়সী লোক। অন্যজন যথেষ্ট ইয়াং। তবে ঠিক মাঝবরাবর গম্ভীরমুখে বসে থাকা লোকটিকে তৃতীকা ঠিকমতো আন্দাজ করতে পারল না। পায়ের উপর পা তুলে, চুপচাপ বসে রয়েছে সে। চুলগুলো খানিকটা কালচে বাদামি রঙের। তবে সেগুলো যথেষ্ট পরিপাটি করে জেল দিয়ে সেট করা। পরণে নেভী ব্লু কালারের সুট, কালো বুট-টাই। তবে মুখটা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে রাখায় তা ঠিকমতো দেখতে পেলো না তৃতীকা৷ তবে গালভরা নিখুঁত ভাবে ছাঁটাই করা,ছোট ছোট দাড়িগোঁফ দৃশ্যমান।
সবমিলিয়ে শুরুতেই যেন এই লোকটিই তার নার্ভাস হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াল। তবুও সে নিজেকে সামলে নেয়। দু'জন লোক সালামের জবাব দিলেও, মাঝে থাকা সেই গম্ভীরমুখো ব্যক্তিটি দিলেন না। এতে তৃতীকা কিছুটা অবাক হয়ে ভাবল, লোকটি ভিন্ন ধর্মী কিনা। বিদেশি-বিদেশি একটা ভাব রয়েছে৷ হতেও পারে ধর্মীয় দিক হতে সে আলাদা। কিন্তু মুসলিম হলে তার ধর্মীয় শিক্ষার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এই ভাবনাতেই তার আবার লোকটির উপর কিছুটা রাগও হলো।
তবে দেরি না করে, সে স্বাভাবিক ভাবে টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। মধ্যবয়স্ক লোকটি তাকে বসতে বলতে, সে চুপচাপ বসে পড়ে।
আবার বাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন ও কমবয়সী লোকটি তার কাছে সিভি আর ফাইল দেখতে চাইলে, তৃতীকা সেসব সেই লোকটির কাছে এগিয়ে দেয়। এবং লোকটি পরক্ষণেই তা মাঝবরাবর গম্ভীরমুখে বসে থাকা ব্যক্তিটির হাতের কাছে এগিয়ে দেয়।
এরইমাঝে তৃতীকার নজর পড়ে ডেস্কের উপর থাকা সোনালী রাঙা নেইম-প্লেটের উপর। কালো রঙের প্রলেপে সুন্দর করে লেখা, ❝ARC ❞।
তবে তার এই মনভুলানো সময়টুকুর মাঝেই কেউ প্রচন্ড গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
❝ হোয়াটস্ ইউর নেইম?❞
তৃতীকা নিমিষেই অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে। তবে নিজেকে দ্রুত সামলে নেবার চেষ্টা অস্ফুটস্বরে আওড়ায়,
❝তৃতীকা❞
তার এমন জবাবে লোকটি যেন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়। নিমিষেই ফর্সা ত্বকের কপালটা কুঁচকে যায় কিঞ্চিৎ। শক্ত চোয়াল আরো বেশি দৃঢ় হয়। অনেকক্ষণ ধরে ইন্টারভিউ নিচ্ছে সে। অথচ মনের মতো মানুষ পেয়েছে খুব অল্পই। বেশিরভাগই থেকেছে নার্ভাস। যে ব্যাপারটা নিয়ে AR এখন ভালোই বিরক্ত৷
তার এই অব্যক্ত অভিব্যক্তিতে পাশ হতে সেই দুজন লোকও কিছুটা ঘাবড়ে যায়। তবে সবকিছু স্বাভাবিক রেখে লোকটি আবারও তৃতীকার উদ্দেশ্যে বলে,
❝ফুল নেইম!❞
হালকা ধমক স্বরে বলা কন্ঠে, তৃতীকা আরো বেশি ভড়কে ওঠে। ঠোঁট চেপে কোনো মতে সামলে নিয়ে বলে,
❝আ...তৃতীকা তালুকদার।❞
এতোক্ষণ সেই গম্ভীরমুখের ব্যক্তিটি তথা ❝আধির রায়ান চৌধুরী❞ চুপচাপ মাথা নিচু করে ফাইল দেখতে থাকলেও—তৃতীকার কণ্ঠস্বরে এবার তিনি কিছুটা অদ্ভুত ভাবে মাথা উঁচিয়ে তৃতীকার দিকে তাকায়। তার অদ্ভুত চাহনিতে তৃতীকা কিছুটা অবাক হয়। লোকটি দেখতে ভারী সুদর্শন। এখন বুঝতে পারছে, ছিমরান কেনো তখন ওসব বলছিল। তবে সাদা চামড়ার এই বিদেশিদের মতো দেখতে হলেও, ব্যক্তিটির চোখজোড়া বেশ আকর্ষণীয়। কেমন অদ্ভুত বাদামী রাঙা চোখজোড়া তার।
তৃতীকা বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। তবে সে চোখ নামিয়ে নিতে গিয়েও, থমকে যায়।লোকটি এখনো তার দিকে অদ্ভুত ভাবে চেয়ে রয়েছে। নিমিষেই অদ্ভুত এক শিহরণে সে কম্পিত হয়। হাতজোড়া শক্ত করে, ডেস্কের নিচে—আড়ালে হাঁটুর জামার অংশ চেপে ধরে। কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে মনে মনে আওড়ায়,
❝হায় আল্লাহ, এসব কি হচ্ছে?❞
চলবে______
পর্ব—\১\
গল্প— অতৃপ্ত_চাহনা
লেখনীতে— তুরঙ্গন
গল্পের পরবর্তী পার্ট পড়তে আমাদের পে*জটি ফ*লো করুন