04/12/2025
আজকে বিদেশ জীবন এর ১ বছর পূর্ণ করলাম। অনুভতি টক ঝাল মিষ্টি। বাইরে আসার সিদ্ধান্তটা আমার জন্য খুব সহজ ছিল না। তবে ইচ্ছে ছিল নিজের চেষ্টায় সব করা মেয়েটি একদিন বিদেশ বিভুইয়ে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা টাও লাইফে এড করতে পারলে খারাপ হতো না। তবে আমার এই সাহসের পিছনে আমার শক্তি ছিল আমার পরিবার এবং আমার একা হওয়া। মানুষ একা থাকতে ভয় পায় আর আমি তার উল্টো। একা হওয়াটা বরং কিছু সিদ্ধান্তকে আরো সহজ করে দেয়। অন্যদিকে আমার ভাই, যে না থাকলে এই পথটা আরো দুশ্চিন্তার হতো। সবমিলিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছেই সব হয় এই বিশ্বাসে পথ চলা আর চলতে চলতে একটা বছর। বেশ কিছু বিষয় এক বছরের অভিজ্ঞতার পাতায় যোগ হয়েছে তা শেয়ার করলাম আমার মতো করে। অনেক কিছু সময় সল্পতার কারণে হয়তো লিখে উঠতে পারি নি।
১. দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে যাদের থাকে তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বা সদ্য গ্র্যাজুয়েট শেষ করে যদি আসা যায় সবকিছু অনেক বেশি সহজ মনে হবে । কম বয়সে আপনার সাহস,শক্তি, ইচ্ছে সবই বেশ ভালোই থাকে। এছাড়া, আপনি যদি তাড়াতাড়ি আসেন আপনার বাবা মা তখন অনেকটা সুস্থ ও সবল থাকে যার কারণে আপনি লাইফ সেটেল্ড এ মনোযোগী হতে পারবেন। কিন্তু একটা নির্দিস্ট সময় পর আসলে সবসময় বাবা মার জন্য টেনশন কাজ করতে থাকে। পরিবারের প্রত্যেক মানুষের সুস্থতার কাছে কিছুই মেটার করে না। এছাড়া, যেহেতু সবাইকেই কম বেশি শূন্য থেকেই শুরু করতে হয় তাই তাড়াতাড়ি আসা সমীচীন। তবে সময়টা যেহেতু নির্ধারণ করেন ঈশ্বর এতো কিছু না ভেবে সামনের পথে আগানোই ভালো।
২. নিরাপত্তার কথা যদি আসে এটার অনুভতি খুবই ভালো। আপনি কি পোশাক পড়লেন, রাত কয়টার দিকে রাস্তায় হাটছেন এটা নিয়ে খুব বেশি একটা ভাবতে হয়নি। আমার এক কলিগ আমার আগে এসেছিল। আমি তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম মেয়েদের সেইফটি নিয়ে। ওনার কথার সারমর্ম ছিল তুমি যদি ভালো থাকতে চাও বিদেশে কারো সাধ্য নেই তোমাকে টলানোর। সো তোমার নিরাপত্তা নির্ভর করছে তোমার নিজের উপর। এন্ড এটাই সঠিক। তবে এখানেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে থাকে সরকারের আদরে পালিত কিছু মানুষ দ্বারা। তাদেরকে বলা হয় হোমলেস। সরকার তাদের পিছনে ভালো অংকের টাকা বিনিয়োগ করেন প্রায় প্রতি মাসেই। আমাদের দেশের টোকাই, ছিনতাইকারী আর তাদের মধ্যে একটাই পার্থক্য, এই দেশের হোমলেস রা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটায় নেশাগ্রস্ত অবস্থায়। অন্যদিকে, আমাদের দেশের টোকাই, ছিনতাইকারীরা অপকর্ম করে নেশা করার জন্য।
৩. একাকিত্ব আপনাকে গ্রাস করতে পারে। এই বিদেশ লাইফ টাই এমন। বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি,রাস্তার মোড়ের দোকানে চা খাওয়া, হুটহাট বের হওয়া, চিল করা এসব ভীষন মিস করি। তবে পজিটিভ দিক হলো যেহেতু আমি বরাবরই স্বাধীনচেতা স্বভাব এর, যেখানে যেমন সেখানে তেমন , আমার আশেপাশে কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, তা নিয়ে আমি কখনোই চিন্তিত না। সুস্থ থাকা আর যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকায় আমার সব। আর এই এক বছর যাদের সাথে আমার থাকা খাওয়া আমার ফিল হতো না আমি ঘরের বাইরে ছিলাম।
৪. আর একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছে সেটা হলো কুকুর, বিড়ালের প্রতি বিদেশিদের ভালোবাসা। তারা এতটাই পেট নির্ভর তাদের জন্য এতো এতো ডলার খরচ করতেও একবার এর বেশি কখনোই চিন্তা করতে দেখি নি। আমার দেশের মানুষের যদি এটলিস্ট মানুষের জন্য এই মমত্ববোধ টা থাকতো।
৫. এক শ্রেনী আছে যারা আজকে থেকে অনেক বছর আগে বা তিন চার বছর আগেও যারা এসেছে তাদের সময়টা অনেকটা অনুকূলে ছিল। অনেকে আজ সেটেল্ড বা প্রতিষ্ঠিত বলতে পারেন। আর এক শ্রেনী হলাম আমরা, যাদের আগামী দিনগুলো নিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না কারণ নিয়মকানুন বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
৬. খুব অল্প বয়স থেকে সবাই ইনডিপেনডেন্ট এটা খুব ইমপ্রেসিব। ধরুন ১৩/১৪ বছর থেকে ইনকাম করা শুরু। বাবা মা ছেলে মেয়ে খেতে যাচ্ছে, শপিং এ যাচ্ছে যে যার বিল দিচ্ছে। নো ডিপেন্ডেনসি। খুব অল্প বয়সে বাবা মা থেকে ছেলেমেয়েরা আলাদা হয়ে যায়। এটা একটু অন্যরকম।
৭. প্রোফেশানাল দিক থেকে আমি একটু কম সন্তুষ্টি অনুভব করেছি এই একটা বছর। সবাইকেই তাঁর ট্র্যাকের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হয়। এটাই খুব স্বাভাবিক এখানে। যদিও শুরুতে এটাই বিদেশের চাকরির ট্রেনড। সবাইকে এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তবে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে দেশের মতো আপনার পছন্দের সেকটর গুলোতে প্রতিযোগিতামূলক এক্সামের সিস্টেম থাকলে বেশ ভালো হতো। ভবিষ্যতে হয়তো ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।
৮. চিকিৎসাসেবা কেন এতো সময়সাপেক্ষ এটা কোনভাবেই উন্নত দেশের সাথে মিলাতে পারি নি এই এক বছরে। বিশ্বের ১৩ নম্বর শক্তিশালী দেশ হলেও তাদের চিকিৎসাখাতের দিকে আরো বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন। ৩৬৫ দিন আপনাকে সুস্থ থাকতে হবে এটাই যেন আপনার দায়িত্ব। এমনটাই ভাবতে আপনাকে বাধ্য করা হবে।
৯. কানাডা একটি ওভাররেটেড কানট্রি নিঃসন্দেহে। এদেশের মানুষরা খুব একটা ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড না। এটা করতে হবে সেটা করতে হবে, এসব চিন্তা খুব একটা করেই না। সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা কাজ করে উইকেন্ডে হালকা ঘুরাঘুরিই জীবনের সব।
১০. অন্যান্য প্রভিনসের মতো এখানেও ভালো একটা সংখ্যার বাঙালি কমিউনিটি আছে। আমার যতটুকু মনে হয়েছে বাঙালিরা একটু জাজমেন্টাল এবং সেনসেটিভ প্রকৃতির। খুব দ্রুত রিয়েক্ট করে। যদিও এটা শুধু এই প্রভিনসের প্রেক্ষাপট না । পৃথিবীর যেখানেই যান না কেন এমন বাঙালি থাকবেই কম বেশি। তবে সবাইকে একই কাতারে ফেলা যাবে না । আমি নিজেই গুটিকয়েক মানুষের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ শুরু থেকে এখন পর্যন্ত। কারন শুরুর সময়টায় তাদেরকে আমি পাশে পেয়েছি যখন খুব দরকার হয় নতুন একটা দেশে আপনি যখন প্রথম আসবেন। অনেকেই আবার খুব আন্তরিক এবং সাহায্যপরায়ন।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে ভবিষ্যত নিয়ে কম ভাবনার মানুষ। যেটা আমার হাতেই নেই সেটা নিয়ে ভেবে বর্তমান নষ্ট করার আমি কে। কে আমাকে নিয়ে কি বললো, আর কি ভাবলো এটা নিয়ে বরাবরই কম চিন্তা করি। রাতে ঘুমিয়ে সকাল দেখতে পারাটাই জীবনের বড় পাওয়া। আর এভাবেই কাটছে জীবন, কাটুক না আরও কিছু সময়। 😊