18/07/2025
কুয়াশার শহরে এক রৌদ্রোজ্জ্বল প্রেম🥰❤️
আকাশে তখনো ভোরের আলোর স্পষ্ট দেখা নেই। কলকাতা শহর ঘুমিয়ে, কেবল কাকচক্ষু স্নানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে গঙ্গার ঘাটে, আর কিছু পথচারী আর ভোরের প্রথম বাসগুলো নিস্তব্ধতা ভাঙছে। এমন এক কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরেই রিয়া তার শিয়ালদহ স্টেশনে নামলো। কাঁধে ব্যাগ, চোখে তখনও ঘুমের রেশ, আর মনে এক অজানা আশঙ্কা। সে এসেছে তার ছোটবেলার বন্ধু, সায়নকে খুঁজতে। সায়ন, যে কিনা গত পাঁচ বছর ধরে তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেনি।
রিয়া আর সায়ন ছোটবেলার বন্ধু। একই পাড়ায় বড় হওয়া, একই স্কুলে পড়াশোনা। তাদের বন্ধুত্ব ছিল খুনসুটি আর অটুট ভালোবাসায় ভরা। সায়ন ছিল ডানপিটে, একটু পাগলাটে টাইপের, আর রিয়া ছিল শান্ত, বুদ্ধিমতী। রিয়া যখন কোনো অঙ্ক নিয়ে হিমশিম খেতো, সায়ন ঠিক দুষ্টুমি করে হলেও তাকে সমাধান বলে দিত। সায়ন যখন নতুন সাইকেল চালাচ্ছিল, রিয়া পিছন থেকে ধরে থাকতো। তাদের জীবনে সবকিছু স্বাভাবিকই চলছিল, যতক্ষণ না কলেজে তাদের পথ আলাদা হয়ে গেল। সায়ন জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে বাইরে পড়তে চলে গেল, আর রিয়া কলকাতাতেই থেকে গেল। প্রথম দিকে ফোন, চিঠি চলতো, কিন্তু ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমতে লাগলো, এক সময় পুরোপুরি বন্ধ। রিয়া যতবার চেষ্টা করেছে, সায়নের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
আজ পাঁচ বছর পর, রিয়া সায়নের খোঁজ পেয়েছে। এক পুরনো বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পেরেছে সায়ন এখন কলকাতায় আছে, একটি পুরনো বইয়ের দোকানে কাজ করে। কেন সায়ন তার থেকে দূরে সরে গেল, কেন যোগাযোগ রাখল না, এই প্রশ্নগুলো রিয়াকে গত পাঁচ বছর ধরে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। আজ সে সেই উত্তর খুঁজতেই এসেছে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে রিয়া একটা ট্যাক্সি নিলো। ঠিকানাটা তার মুখস্থ। পুরনো বইয়ের দোকানের সামনে যখন ট্যাক্সি থামলো, তখনো ঠিকমতো আলো ফোটেনি। দোকানটা একটা পুরনো গলির ভেতরে, চারপাশে আবছা অন্ধকার। বুক ধড়ফড় করছিল রিয়ার। ভেতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ দ্বিধা করে সে দোকানের দরজায় টোকা দিলো।
ভেতর থেকে একটা নিচু স্বর ভেসে এলো, "কে?"
রিয়া শ্বাস বন্ধ করে উত্তর দিলো, "সায়ন?"
ভেতর থেকে আর কোনো শব্দ এলো না। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর দরজাটা ধীরে ধীরে খুললো। সামনে দাঁড়িয়ে সায়ন। পুরনো দিনের সেই ডানপিটে চেহারাটা অনেকটাই বদলে গেছে। দাড়ি-গোঁফ বেড়েছে, চুল এলোমেলো, চোখে ক্লান্তি। কিন্তু সেই চেনা হাসিটা তখনও মুখের কোণায় লেগে আছে।
সায়নকে দেখে রিয়া কিছু বলতে পারলো না। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। সায়নও ওর দিকে তাকিয়ে ছিল, ওর চোখে বিস্ময় আর এক ঝলক আনন্দ।
"রিয়া? তুই এখানে?" সায়ন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।
রিয়া ভেতরে ঢুকলো। দোকানটা পুরনো বইয়ের গন্ধে ম ম করছে। ধুলো পড়া তাকে তাকে পুরনো বইয়ের স্তূপ। সায়ন ওর দিকে একটা ভাঙা চেয়ার এগিয়ে দিলো।
"বস।"
রিয়া চেয়ারে বসলো। সায়ন ওর দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না যে রিয়া সত্যিই তার সামনে।
"পাঁচ বছর... কেন সায়ন? কেন আমার সাথে যোগাযোগ করিসনি?" রিয়া প্রশ্ন করলো, ওর গলা কাঁপছিল।
সায়ন মুখ নিচু করলো। "আমি... আমি তখন খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম রিয়া। পড়াশোনা ঠিকমতো চলছিল না, বাবার ব্যবসা ডুবে গিয়েছিল। আমি চাইনি আমার সমস্যাগুলো তোর উপর চাপাতে।"
রিয়া শান্ত গলায় বললো, "আমি তোর বন্ধু ছিলাম সায়ন। বন্ধুরাই তো বিপদে পাশে থাকে।"
সায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। "আমি পারিনি রিয়া। আমার খুব লজ্জা লাগছিল। আমি ভেবেছিলাম আমি তোর যোগ্য নই।"
এই প্রথম রিয়া সায়নের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো। সেখানে জমে আছে অনেক অব্যক্ত যন্ত্রণা। সায়ন তখনও বইয়ের দোকানে কাজ করে, সামান্য রোজগার। জীবনের সমস্ত স্বপ্ন যেন ধুলোয় মিশে গেছে।
রিয়া আলতো করে সায়নের হাত ধরলো। "কষ্ট হচ্ছে তোর, তাই না?"
সায়ন কোনো উত্তর দিলো না, শুধু ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। রিয়ার মনে হলো, এই পাঁচ বছরে সায়ন কতটা একা ছিল।
সেই দিন থেকে রিয়া প্রতিদিন ভোরের কুয়াশায় সায়নের দোকানে আসতো। সায়ন প্রথম প্রথম কথা বলতে চাইতো না, কিন্তু রিয়ার ধৈর্য আর ভালোবাসার কাছে হার মানলো। রিয়া তাকে জোর করত নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে। সে সায়নকে বইয়ের ব্যবসাটাকে নতুন করে শুরু করার কথা বলল। সায়নের বই সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান ছিল। রিয়া তাকে সাহায্য করলো নতুন বই আনার, দোকানটাকে নতুন করে সাজানোর।
ধীরে ধীরে বইয়ের দোকানটা নতুন জীবন পেতে লাগলো। সায়নও নতুন করে বাঁচার তাগিদ অনুভব করলো। সে আবার হাসতে শুরু করলো, প্রাণ খুলে কথা বলতে শুরু করলো। রিয়া তাকে তার পুরনো স্বপ্নগুলো মনে করিয়ে দিত।
একদিন, সন্ধ্যায়, দোকান বন্ধ করার আগে সায়ন রিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, "কেন রিয়া? কেন তুই আমার জন্য এত কিছু করছিস? যখন আমি কিছুই ছিলাম না, তখন তো কেউ আমার পাশে ছিল না।"
রিয়া সায়নের দিকে তাকিয়ে হাসলো। "আমি তোকে ভালোবাসি সায়ন। সবসময় বাসতাম। শুধু বন্ধু হিসেবে নয়, তার থেকেও বেশি।"
সায়ন অবাক হয়ে রিয়ার দিকে তাকালো। এই প্রথম রিয়া তার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করলো। সায়ন উঠে রিয়ার হাত ধরলো। "আমিও তোকে ভালোবাসি রিয়া। কিন্তু আমি ভাবিনি আমি তোর যোগ্য।"
রিয়া সায়নের হাতটা ধরে বললো, "ভালোবাসার কোনো যোগ্যতার মাপকাঠি হয় না সায়ন। ভালোবাসা মানে বিশ্বাস, ধৈর্য আর একে অপরের পাশে থাকা।"
সেই রাতে কলকাতা শহর যেন তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রইল। কুয়াশা কেটে গিয়ে তারা তখন ভোরের আলোর দিকে তাকিয়ে ছিল, নতুন করে শুরু করার স্বপ্নে বিভোর। সায়নের বইয়ের দোকান শুধু একটি ব্যবসা রইলো না, সেটি হয়ে উঠলো তাদের ভালোবাসার সাক্ষী, যেখানে পুরনো বইয়ের পাতায় নতুন করে লেখা হচ্ছিল এক রোমান্টিক প্রেমের গল্প। যে গল্পে শুধু হারানো প্রেম ফিরে আসে না, বরং কঠিন সময়ের মোকাবিলা করে একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকারও ছিল।
এরপর রিয়া আর সায়নের জীবন নতুন ছন্দে চলতে লাগলো। সায়নের বইয়ের দোকানটি ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করলো। পুরনো বইয়ের পাশাপাশি নতুন বইয়ের সম্ভারও বাড়তে লাগলো। রিয়ার বুদ্ধি ও সায়নের বইপ্রেমের মিশ্রণ দোকানটিকে একটি ভিন্ন মাত্রা দিলো। শুধু বই কেনাবেচা নয়, সেটি হয়ে উঠলো জ্ঞানচর্চার একটি কেন্দ্র।
তাদের ভালোবাসা আরও গভীর হলো। রিয়া সায়নের পাশে ছায়ার মতো থাকতো, সব বিপদে তাকে সাহস দিত। আর সায়ন রিয়ার প্রতিটি ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিত, তার ছোট ছোট স্বপ্নগুলোকে পূরণ করার চেষ্টা করত। তারা দু'জনেই বুঝেছিল, ভালোবাসা মানে শুধু প্রথম আকর্ষণ নয়, ভালোবাসা মানে ধৈর্য, বিশ্বাস, বোঝাপড়া এবং একে অপরের প্রতি অটুট শ্রদ্ধা। কুয়াশার শহরে তাদের রৌদ্রোজ্জ্বল প্রেম এক নতুন দিগন্তে পা রাখলো।
#রোমান্টিক_গল্প