06/24/2025
#চোখ_যে_কথা_বলে_না
পর্ব ২: ডায়েরির পাতায় আঁকা মুখ
---
নীল আজ প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে কলেজের ক্যান্টিনের এক কোণে।
সামনের চা ঠান্ডা হয়ে গেছে,
তার চোখ বারবার চলে যাচ্ছে গেটের দিকে।
আরু আসার কথা ছিল।
তিনদিন ধরে সে আসেনি ক্লাসে।
ফোন নম্বর কলেজের ফর্মে থাকলেও—অফ।
ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক সবই ঘর খালি।
নীলের বুকের ভেতর একটা চিনচিনে অনুভব জমে উঠছে।
আরু কি কোথাও পালিয়েছে?
না কি…
না, সে ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে।
কিন্তু উদ্বেগ তাকে ছাড়ে না।
সে উঠে পড়ে সিদ্ধান্ত নেয়—আরুর বাসায় যাবে।
---
আরু একবার বলেছিল—
"আমি রোড নম্বর ১১/বি’র এক ছাদঘরেই থাকি।
চুপচাপ, কারও আসা-যাওয়া নেই।"
নীল তখন খুব পাত্তা দেয়নি কথাটাকে।
ভেবেছিল, মেয়ে একটু রহস্যজট মেখে চলতেই ভালোবাসে।
কিন্তু আজ সেই কথাই পথ দেখাচ্ছে তাকে।
---
ভরদুপুর।
রোড ১১/বি, পুরোনো একটা দোতলা বাড়ি।
নীল কলিং বেল বাজায়।
উপর থেকে একজন বৃদ্ধা উঁকি দেন।
নীল বলেন,
"আমি আরুর বন্ধু। ওকে খুঁজছি। তিন দিন কলেজে আসছে না।"
বৃদ্ধা মুখ ভার করে বলেন—
"মা, ও মেয়ে তো একরকম চলে গেছে।
রুম ভাড়া নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ঠিকমতো কিছু বলেও গেল না।
কাল সকালে দেখি দরজা খোলা।
তাড়াহুড়ো করে চলে গেছে বুঝলাম।
তুমি চাইলে ঘরে একবার দেখে নিতে পারো।"
নীল চমকে ওঠে।
চলে গেছে?
কোথায়? কেন? কাকে ভয় পেয়ে?
সে ওপরে ওঠে।
---
ঘরটা ছোট।
একটা জানালা, এক কোণে টেবিল, একটা বইয়ের তাক।
তিন চারটে কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
তবে সবচেয়ে চোখে পড়ে একটা পুরনো রঙচটে যাওয়া স্কেচবুক।
নীল সেটা তুলে নেয়।
ভেতরের পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে বুক ধীরে ধীরে হিম হয়ে আসে।
প্রথম পাতায় একটা চেহারা আঁকা—
মেয়েটি আরু।
কিন্তু চোখে একটা আতঙ্ক।
নিচে ছোট করে লেখা:
> "যখন কেউ তোমার ভালোবাসাকে পণ করে তোলে,
তখন পালানোই বাঁচার উপায় হয়।"
---
দ্বিতীয় পাতায় একটা ছেলের মুখ।
অর্ধেক অন্ধকারে ঢাকা।
আরও পাতায় একটার পর একটা মুখ, চোখ, হাতের রেখা—
সব মিলিয়ে যেন একটি থ্রিলার সিনেমার ফ্রেম ফ্রেম গল্প।
কিন্তু এক পাতায় থেমে যায় তার হাত।
একটা মুখ আঁকা—পুরুষের।
চোখে হালকা কাটা দাগ।
নিচে লেখা—
> “ও যদি আমায় খুঁজে পায়, আমি বাঁচব না।”
নীলের গলা শুকিয়ে আসে।
তার মাথায় ঘুরতে থাকে সেই সন্ধ্যার কথা—
যখন লাইব্রেরির পেছনে দুই অচেনা লোক ফিসফিস করছিল আরুকে নিয়ে।
তাদের মধ্যে একজনের চোখে দাগ ছিল?
সে নিশ্চিত না,
তবে আজ আরু আর নেই।
---
নীল পুরো স্কেচবুক পড়ে।
শেষ পাতায় ছোট করে একটিই বাক্য—
> “নীল, আমি জানি তুমি এই ডায়েরি পাবে।
তুমি আমাকে খুঁজতে চাইবে,
কিন্তু প্লিজ, চোখের ভাষার বাইরেও কিছু বোঝার চেষ্টা করো।
আমি যেখানেই যাই, তোমার ছবির মাঝে থাকব।
আমাকে আঁকো না—
আমায় বোঝার চেষ্টা করো।”
নীলের গায়ে কাঁটা দেয়।
আরু জানত সে একদিন এটাই খুঁজবে।
কিন্তু কী বোঝাতে চাইছিল সে?
কি এমন আছে তার অতীতে,
যা তাকে আজও তাড়া করে বেড়াচ্ছে?
আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—
সে কি নীলকে সত্যিই ভালোবেসেছিল,
নাকি শুধু একজন "নিরাপদ আশ্রয়" বানিয়ে রেখেছিল?
---
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নীল চোখের কোণে একটা ছোট্ট লাল খাম দেখে।
তাতে তার নাম লেখা—“নীল”
সে হাত কাঁপিয়ে খামটা খোলে।
ভেতরে ছোট্ট একটা কাগজে লেখা:
> “আমি যদি বেঁচে থাকি,
তাহলে ফিরে আসব ঠিক…
কিন্তু তুমি যদি আগে আমাকে খুঁজে পাও,
তাহলে সাবধান থেকো…
কারণ আমি শুধু আরু নই,
আমি একটা গল্প—
যা কেউ শেষ হতে দেয় না।”
---
নীল জানে,
সে এবার থামবে না।
তার ভালোবাসা হয়তো সত্যি ছিল,
হয়তো মিথ্যে।
কিন্তু এই রহস্য, এই অসমাপ্ত কথা তাকে ডেকে চলেছে।
আর ভালোবাসা যদি সত্যিই ছিল—
তাহলে সে চোখের ভাষার বাইরেও আরুকে খুঁজে পাবে।
ছবির ভেতর, শব্দের নিচে, ভয় আর ভালোবাসার মাঝখানে।
---
[চলবে]