30/04/2025
আজ শুভ অক্ষয় তৃতীয়া। এর নাম অক্ষয় কারণ এই দিনে এমন কিছু কাজ হয়েছিল যা ইতিহাসে অমর অক্ষয় হয়ে আছে। বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের তৃতীয়া তিথিতে এই দিনটি উদ্যাপন করা হয়। "অক্ষয়" শব্দের অর্থ "অক্ষয়" বা "শেষহীন"।
দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণ।একদম সামান্য পরিবার থেকে ভারতের বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক হয়েছেন।ছোটবেলায় মথুরায় সুদামা নামে শ্রীকৃষ্ণের এক বন্ধু ছিলেন। সুদামা অতিশয় সৎ, নির্লোভ, সচ্চরিত্র নিষ্ঠাবান ভক্ত ব্রাহ্মণ এবং অত্যন্ত অন্তর্মুখী।নিজে অতি দরিদ্র হলেও মুখফুটে কষ্টের কথা কাউকে বলতেন না,ছেলেমেয়েকে দুবেলা দুমুঠো খাবার দিতে পারতেন না। ছোটবেলার প্রাণের বন্ধু শ্রীকৃষ্ণকেঅত্যন্ত ভালোবাসতেন তিনি।বড় হয়ে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকার রাজা হলেন; তাঁর খ্যাতি সর্বত্র।এদিকে সুদামার অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগল, এমন অবস্থা যে দু'বেলা ঠিকমত খাবারও জোটেনা। একদিন সুদামার স্ত্রী তাঁকে বললেন,
"তোমার বন্ধু কৃষ্ণ তো দ্বারকার রাজা, তাঁর কাছে গেলে হয়তো কিছু সাহায্য পাওয়া যেত, তাতে আমাদের অভাব অনেকটা ঘুচত!"
কিন্তু সৎ, নির্লোভ সুদামা স্বভাবসুলভ লজ্জায় তাতে রাজী হলেন না! বললেন, "আরে এই অবস্থায় কী করে ওর কাছে যাই?" কিন্তু স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে ও অনেক দিন পর বন্ধুর সঙ্গেও দেখা হবে এই ভেবে সুদামা যেতে রাজি হলেন শেষমেষ।যাবার সময় তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণকে উপহার দেওয়ার জন্য কিছু চিড়ার খুদ সুদামার চাদরে বেঁধে দিলেন! এত বড় রাজা তাকে কিনা সামান্য চিড়ের খুদ উপহার! কি করে দেবেন তিনি!কিন্তু এছাড়া কীই বা ঘরে আছে?
সুদামা দ্বারকার পথে রওনা হলেন।দ্বারকায় পৌঁছে সুদামা অনেক কষ্টে শ্রীকৃষ্ণের মহলে গিয়ে পৌঁছলেন। অনেকেই তার দীনহীন অবস্থা দেখে তাকে উপহাস করতে লাগলো। তিনি প্রহরী কে বললেন ,শ্রীকৃষ্ণকে গিয়ে বলো যে তার সাথে দেখা করবার জন্য তার বাল্যবন্ধু সুদামা এসেছে। দ্বাররক্ষীরা তো প্রথমে আমলই দিলো না কিন্তু পরে অনুনয় বিনয় করলে তারা ভিতরে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে খবর দিল যে দুয়ারে একজন অতি দরিদ্র ব্রাহ্মণ এসেছে। তার সারা গায়ে ধূলোর পলেস্তারা পড়া, পাগুলো সব ফেটে চৌচির। তার দারিদ্র্য দেখে দ্বারকার ধূলোও আশ্চর্য হয়ে গেছে। সে বলছে তার নাম সুদামা, আর বলছে সে নাকি আপনার বন্ধু।
সুদামার নাম শোনা মাত্র শ্রীকৃষ্ণ নিজের সিংহাসন থেকে নেমে এলেন আর খালি পায়ে দুয়ারের দিকে ছুটে চললেন। সেখানে গিয়ে সুদামাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হে বন্ধু, তুমি তো এসেছো কিন্তু অনেক কষ্ট ভোগ করার পর এসেছো। দ্বারকায় তোমার শুভাগমন হোক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সুদামাকে নিজে গিয়ে তার নিজের ঘরে খাটে বসালেন। তার পা দুখানা নিজ হাতে ধুইয়ে দিলেন এবং স্নান করিয়ে পরবার জন্য রেশমী বস্ত্র দিলেন। শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মিনী স্বয়ং তাকে পাখার বাতাস করতে লাগলেন এবং তাকে বহুবিধ সুস্বাদু খাবার দিলেন ভোজনের জন্য।খেতে খেতে সুদামার বারবার মনে পড়ছিল তিনি তো আজ সুস্বাদু সব খাবার খাচ্ছেন,কিন্তু বৌ ছেলেমেয়েদের আজকেও চালের খুদ খেয়েই কাটাতে হচ্ছে বাড়িতে।তার বিচলিত মন শ্রীকৃষ্ণের নজর এড়ালোনা।
বহুক্ষণ নিজেদের মধ্যে বাল্যকালের স্মৃতি রোমন্থন করার পর শ্রীকৃষ্ণ বললেন বন্ধু, বৌদি আমার জন্য কি পাঠিয়েছে? সুদামা প্রথমে একেবারে সঙ্কুচিত হয়ে পড়লেন এই ভেবে যে কিভাবে এত আদর আপ্যায়ন পেয়ে বন্ধুকে কেবল চিড়ের খুঁদ উপহার দেবেন!কিন্তু শেষকালে শ্রীকৃষ্ণ পোটলা কেড়ে নিয়ে নিজেই সেই চিঁড়ে বের করে ফেললেন। সেই চার মুষ্টি চিঁড়ে খুব তৃপ্তি করে খেলেন।
তারপর তাঁরা অনেকক্ষণ গল্প করলেন,কেটে গেল কয়েকদিন। অনেকদিন পরে বন্ধুর সাক্ষাত পেয়ে এতই আনন্দ হচ্ছিল যে সুদামা তাঁর দারিদ্র্যের কথা শ্রীকৃষ্ণকে আর বলতে পারলেন না! কৃষ্ণের থেকে সাহায্য চাওয়ার কথা মনেও এল না আর।অন্তর্মুখী সুদামার অন্তরের কথা অন্তরেই রয়ে গেল।
তারপর এল বিদায় নেবার পালা! শ্রীকৃষ্ণ বললেন, "আবার আসবি তো?" সুদামা বললেন, "আসব!" তারপর সুদামা বাড়ীর পথে রওনা দিলেন! বাড়ীর কাছে পৌঁছে দেখলেন, একি!! কোথায় গেলো সেই কুটির?? তার কুঁড়েঘরের জায়গায় বিশাল এক অট্টালিকা! ঘরে ধনসম্পদের অভাব নেই! কী তাজ্জব ব্যাপার!! এ কি করে সম্ভব হলো?? তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে এইসব ভাবছেন, এমন সময়ে তার স্ত্রী তাকে বারান্দা থেকে দেখতে পেয়ে নিচে নেমে বাইরে এসে সুদামাকে বললেন, " তুমি বাড়ী থেকে বেরুলে আর আমি সবে পুজোয় বসেছি, হঠাৎ দেখি সব কিরকম পাল্টে গেলো! দেখছ? শ্রীকৃষ্ণের লোকেরা এসে আমাদের সব অভাব দূর করে দিল!"
সুদামা আরো অবাক হয়ে বললেন, "আরে! তা কি করে হয়? আমি তো ওকে আমার দূরবস্থা সম্বন্ধে কিছুই বলিনি!"
তাঁর স্ত্রী বললেন, "তাকে কি কিছু বলতে হয়? তার কাছে গেলে তিনিই সব ঠিক করে দেন! তোমার বন্ধু হলেও তুমি তাকে চিনতে পারোনি, কিন্তু আমি চিনতে পেরেছি। তার শরণাপন্ন হলেই দরিদ্রের,শোষিতের সকল কষ্টের সমাধান হয়। তিনি আর কেউ নন, তিনি শোষিতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ,ধর্মের ত্রাতা শ্রীকৃষ্ণ।
সুদামা এই চান্দ্রমাসের বা বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের ৩য় দিনে শ্রীকৃষ্ণের কাছে গিয়েছিলেন আর রচিত হয়েছিল বন্ধুত্বের এই অমর অক্ষয় কাহিনী।
শ্রীকৃষ্ণ আজকের এই অক্ষয় দিনে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন কিভাবে অর্থবিত্ত বা সামাজিক শ্রেণী নয়,আন্তরিকতাই বন্ধুত্বের একমাত্র ভিত্তি,দিয়েছিলেন নিজের অতীতকে ভুলে না যাবার শিক্ষা।আর তাই মানুষ বিশ্বাস করে এই অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে কোন শুভ কাজ করলে তা অমর অক্ষয় হয়ে থাকে।
শুভ অক্ষয় তৃতীয়া 🖤🌸