10/04/2025
হানিফ মিয়া: ৪ মিলিয়ন লাইকসের আড়ালে বিতর্কিত কনটেন্ট ও বিশ্বনাথের সম্মানের প্রশ্ন
তার পরিচয় হানিফ মিয়া, সিলেটের বিশ্বনাথ থানার দশঘর ইউনিয়নের বাসিন্দা। বর্তমানে তিনি লন্ডনে বসবাস করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকে তিনি ৪ মিলিয়নেরও বেশি লাইক অর্জন করে অনলাইনে ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন। অল্প সময়ে এই পরিমাণে জনপ্রিয়তা পাওয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। অনেক তরুণ যেখানে এখনও স্বপ্ন দেখেন টিকটকে পরিচিত হওয়ার, সেখানে হানিফ মিয়া তার নিজস্ব ধারার কনটেন্ট দিয়ে লক্ষ লক্ষ দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এই জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে একাধিক বিতর্ক এবং তীব্র সমালোচনা।
হানিফের টিকটক কনটেন্টের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার নিজের স্ত্রীকে নিয়ে করা ভিডিও। অধিকাংশ ভিডিওতেই দেখা যায়, তিনি তার স্ত্রীকে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করছেন। কখনও স্ত্রীকে ব্যঙ্গ করে কথা বলা, কখনও অপমানজনক মন্তব্য, আবার কখনও নাটকীয় ও কুরুচিপূর্ণ আচরণ—এসবই তার ভিডিওর মূল আকর্ষণ। এসব ভিডিওতে প্রায়ই ব্যবহৃত হয় হুডি ভাষা, যা অনেকেই “ননসেন্স” এবং সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে অভিহিত করছেন।
স্থানীয়ভাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এই বিষয়টি। বিশ্বনাথ উপজেলার দশঘর ইউনিয়নের বাসিন্দারা বলছেন, এসব ভিডিও কেবল হানিফ মিয়ার নয়, পুরো এলাকার মর্যাদা ও সংস্কৃতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাদের ভাষায়, “একজন ব্যক্তি যদি ভাইরাল হওয়ার জন্য নিজের স্ত্রীকে এমনভাবে তুলে ধরেন, তাহলে সেটা কেবল ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, বরং সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি।”
অনেকেই বলছেন, এই ধরনের ভিডিওর ফলে তারা এখন পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করেন। একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়া মাত্রই যেখানে দশজন মানুষ ‘হানিফ কোথাকার?’ জানতে চায়, সেখানে বিশ্বনাথের নাম শুনেই অনেকেই ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেন। কেউ কেউ মন্তব্য করছেন, “ওর ভিডিওর কারণে আমাদের এলাকার মানুষজনকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। এটা কষ্টদায়ক।” অনেকে মনে করেন, এই ধরনের আচরণে পুরো গ্রাম, ইউনিয়ন এমনকি দেশের বাইরের প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতিচ্ছবিও বিকৃত হচ্ছে।
এদিকে অনেকেই হানিফের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। বরং জানা যাচ্ছে, তার পরিবারের সদস্য এবং গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি তাকে এই ধরনের কনটেন্ট তৈরিতে উৎসাহ দিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, “ওর ভিডিওতে ওর পাশের লোকজন, এমনকি পরিবারের সদস্যরাও সহযোগিতা করে। এই কনটেন্ট বানানো একা সম্ভব নয়।” এ থেকেই অনেকে মনে করছেন, তার পরিবার এবং স্থানীয়দের একাংশ এই বিষয়টিকে ‘গর্বের বিষয়’ বলেই মনে করছেন।
আবার, এলাকার কিছু মানুষ হানিফের এই “উপস্থাপনায়” খুশি। তাদের বক্তব্য, “সে আমাদের গ্রামকে ভাইরাল করে ফেলেছে। সবাই এখন দশঘর ইউনিয়নের নাম জানে। এটা তো খারাপ না!” এই ধরনের মন্তব্য সামাজিক দ্বন্দ্বকেও উস্কে দিচ্ছে। একজনের জন্য যখন পুরো সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়, তখন সেই ভাইরালিটির পেছনের ‘মূল্য’ হয় অনেক বেশি।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কনটেন্ট তৈরি ও ছড়িয়ে পড়া খুবই সহজ, কিন্তু সেই কনটেন্ট কতটা দায়িত্বশীল—সেই প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ব্যবহার করে, আপত্তিকর ভাষা ও নাটকীয় আচরণের মাধ্যমে যদি লক্ষ লক্ষ মানুষের মনোযোগ পেতে চান, তবে সেটা কেবল বিনোদনের বিষয় নয়; বরং এটি সমাজে ভুল বার্তা প্রেরণ করছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পারিবারিক শিক্ষা। অনেকে বলছেন, হানিফ মিয়া বর্তমানে লন্ডনে থাকলেও তার আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ। এতে করে অনেকের কণ্ঠে উঠে আসছে এমন প্রশ্ন: “লন্ডন গেলেই কি মানুষ ভালো হয়ে যায়?” তাদের মতে, “শুধু বিদেশে বসবাস করলেই মানুষ সভ্য ও সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে না। এর জন্য প্রয়োজন হয় পরিবার থেকে আসা নৈতিক শিক্ষা ও সংস্কার।”
এই পরিস্থিতিতে একটি প্রবাদ ফের আলোচনায় এসেছে—“লাঙ্গল টু লন্ডন।” প্রশ্ন উঠেছে, এই কথাটি কি সত্যি? হানিফ মিয়ার কর্মকাণ্ড অনেককেই বাধ্য করছে এই প্রবাদের যথার্থতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে। যখন একজন মানুষ নিজের পরিবার ও সমাজের সম্মান বিসর্জন দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করেন, তখন বিদেশে যাওয়ার কৃতিত্বও অর্থহীন হয়ে যায়।
৪ মিলিয়ন লাইক নিশ্চয়ই একটি বড় সংখ্যা। কিন্তু সেই লাইক যদি মানুষের অপমান, পারিবারিক অসম্মান এবং সামাজিক অবমাননার বিনিময়ে অর্জিত হয়, তবে তা কতটা মূল্যবান? সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা যদি নৈতিকতা ও সম্মানবোধকে বিসর্জন দেয়, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। হানিফ মিয়া হয়তো লাইকসের পাহাড় গড়েছেন, কিন্তু সেই পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে একটি এলাকার সম্মান, সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়। আর সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—লাইক না কি লজ্জা, কোনটা বড়?