30/07/2025
ইয়াছিন মজুমদার ও আকলিমা আকতার দম্পতির পাঁচ মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছায়রা ও সায়মা যমজ দুই বোন। বয়স মাত্র ১০ বছর। রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী তারা। সবার ছোট হওয়ায় পরিবারের সবচেয়ে আদরের এই দুই মেয়ের দিন এখন কাটছে হাসপাতালে, যন্ত্রণায় কাতরাছে ।
গত সোমবার মাইলস্টোন স্কুলের একটি ভবনে ভেঙে পড়ে একটি যুদ্ধবিমান। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয় যমজ সারিনাহ ও সাইবাহ (আসল নাম)। পাশাপাশি আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীও আহত হয়। বর্তমানে তারা ভর্তি রয়েছে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। চিকিৎসকের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, সারিনাহর শরীরের ৩০ শতাংশ ও সাইবাহর ১৫ শতাংশ পুড়েছে।
হাসপাতালের বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে থাকা দুই বোন মায়ের কাছে বারবার বাড়ি যাওয়ার আবদার জানাচ্ছে। ভয় আর যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারছে না। সারাক্ষণ বুক ধড়ফড় করে, অজানা আতঙ্কে থাকে। তাদের মা-বাবা হাসপাতালেই দিনরাত পার করছেন। মা আকলিমা কাছেই একটি টুলে বসে থাকেন, সময় হলে খাবার খাওয়ান। বাবা ইয়াছিন ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান, মেয়েদের সেবা-যত্নে ব্যস্ত থাকেন।
ইয়াছিন জানান, সিঙ্গাপুর থেকে আসা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাদের মেয়েদের দেখেছেন, বিভিন্ন পরীক্ষা দিয়েছেন। তবে কবে নাগাদ মেয়েরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে, সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিতভাবে কিছু বলা হয়নি।
মেয়ে দুটির পিঠ, মুখ, হাত-পা পুড়ে গেছে। সারিনাহ ও সাইবাহর পুরো শরীর ব্যান্ডেজে মোড়ানো। ড্রেসিংয়ের সময় প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাঁদতে থাকে তারা। ঘটনার দিন সম্পর্কে মেয়েরা কিছু বলতে চায় না। শুধু বলে, "ভয় লাগে"।
এই বেদনাদায়ক ঘটনার সময় মা আকলিমা ছিলেন ঘটনাস্থলের কাছেই। তিনি বলেন, মেয়েদের স্কুল ছুটি হয় দুপুর ১টায়। ছুটি হওয়ার ঠিক আগেই তিনি স্কুলের গেটের কাছাকাছি পৌঁছান। তখনই শুনতে পান একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে কালো ধোঁয়া ও আগুন। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ ছুটোছুটি শুরু করে।
তিনি বলেন, ‘চারদিকে শুধু আগুন আর ধোঁয়া। বাচ্চাদের দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হচ্ছিল। কেউ জামাকাপড়হীন, কারও শরীরে চামড়া পর্যন্ত ছিল না। আমি আমার দুই মেয়েকে খুঁজে বেড়াই। কোথাও পাই না। কখনো এদিক, কখনো ওদিক দৌড়াই।’
ঘটনার পর আকলিমাকে খুঁজে পেতে পরিবারের দুই ঘণ্টা লেগে যায়। তিনি নিজেই পরে বড় মেয়েকে ফোন করে খবর দেন। পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন, আহত শিক্ষার্থীদের উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। প্রথমে সেখানে গিয়ে তারা মেয়েদের পায়নি। পরে সাইবাহকে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়, এরপর পাওয়া যায় সারিনাহকেও।
দুর্ঘটনার দিন ইয়াছিন ঢাকায় ছিলেন না, ছিলেন চট্টগ্রামে। ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ঢাকায় রওনা দেন। মেজ মেয়ে ফোন করে তাঁকে জানায়—স্কুলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে, মা-বোনদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এই যমজ বোনের জন্ম ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি। পরিবারটি উত্তরা দিয়াবাড়িতে বাস করে। ইয়াছিন-আকলিমা দম্পতির অন্য তিন মেয়ের মধ্যে দুইজন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এবং একজন এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় আছে।
সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দেখে হতাশ হয়ে পড়েছেন বাবা ইয়াছিন। তিনি বলেন, ‘মেয়েরা ভয় পায়, রাতে ঘুমায় না, শুধু বাড়ি ফিরতে চায়। এখনো তারা সেই দিনের কথা মনে করে কেঁদে ওঠে।’ তবে চিকিৎসকেরা আশাবাদী—সময়মতো চিকিৎসা ও সেবাযত্ন পেলে দুই বোন সুস্থ হয়ে উঠবে।
স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং বিমানবাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল হাসপাতালে এসে মেয়েদের খোঁজ নিয়েছে। বাবা-মা শুধু চায়, তাদের আদরের মেয়েরা যেন আবার আগের মতো সুস্থভাবে স্কুলে যেতে পারে, হাসতে পারে, খেলতে পারে।