05/08/2025
৫ আগস্ট: পুলিশ হত্যা দিবস, একটি জাতীয় ট্র্যাজেডি
ইতিহাসের পাতায় প্রতিটি দিনের একটি নিজস্ব পরিচয় থাকে। কোনো দিন আসে মুক্তির বার্তা নিয়ে, কোনো দিন আবার রেখে যায় গভীর ক্ষতচিহ্ন। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট বাংলাদেশের জন্য এমনই একটি রক্তাক্ত অধ্যায়, যা নিছক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন নয়, বরং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও আইনের শাসনের ওপর এক পাশবিক আক্রমণের দিন। এই দিনটিকে যারা 'গণঅভ্যুত্থান' বা 'বিজয়' হিসেবে উদযাপন করতে চায়, তাদের অবশ্যই আয়নায় সেইসব কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের মুখচ্ছবি দেখতে হবে, যাদেরকে পরিকল্পিতভাবে এবং নৃশংসতম উপায়ে হত্যা করা হয়েছিল। ৫ই আগস্ট তাই নিছক একটি তারিখ নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘পুলিশ হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া এক জাতীয় ট্র্যাজেডি।
তারা শত্রু ছিলেন না, রাষ্ট্রের রক্ষক ছিলেন
বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী নন; তারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথবদ্ধ কর্মচারী। তাদের একমাত্র দায়িত্ব দেশের আইনকানুন সমুন্নত রাখা, নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। ৫ আগস্ট তারিখে যে পুলিশ সদস্যরা নিহত হয়েছেন, তারা তাদের পবিত্র দায়িত্ব পালন করছিলেন। তারা কোনো অন্যায় করেননি, বরং রাস্তায় সৃষ্ট হওয়া নৈরাজ্য ও সহিংসতা থেকে সরকারি সম্পত্তি এবং সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন। একটি রাষ্ট্রের প্রতীকী রক্ষকদের ওপর এমন পরিকল্পিত আক্রমণ প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ওপরই আক্রমণ। কর্তব্যরত অবস্থায় তাদের হত্যা করা কোনো বিচ্ছিন্ন ক্ষোভের প্রকাশ হতে পারে না, এটি সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত
৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলাগুলো কোনো স্বতঃস্ফূর্ত গণরোষের ফল ছিল না। এগুলো ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও নির্দেশের ফসল। দেশের বিভিন্ন স্থানে একযোগে পুলিশ স্টেশন, পুলিশ বক্স এবং পুলিশ লাইন্সে হামলা চালানো হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্রে দেখা গেছে, হামলাকারীরা সংগঠিত ছিল এবং তাদের লক্ষ্য ছিল পুলিশ সদস্যদের টার্গেট করে হত্যা করা। নিরস্ত্র বা কোণঠাসা পুলিশ সদস্যদের ঘিরে ধরে পিটিয়ে, কুপিয়ে এবং পুড়িয়ে মারার যে দৃশ্য বিশ্ববাসী দেখেছে, তা কোনোভাবেই একটি গণ-আন্দোলনের চরিত্র হতে পারে না। এটি একটি প্রশিক্ষিত গোষ্ঠীর ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড, যার উদ্দেশ্য ছিল আইনশৃঙ্খলার কাঠামোকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দিয়ে দেশে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা।
হত্যার নৃশংসতা মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে
যেকোনো মৃত্যুই দুঃখজনক, কিন্তু ৫ আগস্ট পুলিশ সদস্যদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। তাদের মৃত্যুর পর লাশের ওপর উল্লাস করা, মৃতদেহকে অপমান করা এবং সেই পাশবিকতার ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে যে, হামলাকারীদের উদ্দেশ্য কেবল হত্যা ছিল না, বরং পুলিশ বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং সমাজে চরম আতঙ্ক তৈরি করাও ছিল। এই ধরনের নৃশংসতা কেবল আইনের লঙ্ঘন নয়, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। যে ‘আন্দোলন’ তার প্রতিপক্ষকে নিরস্ত্র অবস্থায় পেয়ে এমন পাশবিক আচরণ করতে পারে, তার নৈতিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলাই স্বাভাবিক। এই সদস্যরা কারও সন্তান, কারও স্বামী বা কারও বাবা ছিলেন। তাদের পরিবারগুলো কোনোদিন এই ভয়াবহ স্মৃতি থেকে মুক্তি পাবে না।
গুজব ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণার শিকার পুলিশ
এই হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে চলা পরিকল্পিত গুজব ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণার মাধ্যমে। পুলিশ বাহিনীকে ‘দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী’, ‘জুলুমকারী’ ইত্যাদি অভিধায় আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণদের মনে তীব্র ঘৃণা তৈরি করা হয়। এই পরিকল্পিত ডিহিউম্যানাইজেশন বা অমানবিকীকরণের ফলেই পুলিশ সদস্যদের রক্তকে ‘বৈধ’ করে তোলার একটি সামাজিক ছাড়পত্র তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। যখন একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে তার মানবিক পরিচয় মুছে দিয়ে কেবল ‘প্রতীকী শত্রু’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তখন তাদের ওপর যেকোনো আক্রমণ সহজ হয়ে যায়। ৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ছিল এই ঘৃণার রাজনীতিরই চূড়ান্ত পরিণতি।
ন্যায়বিচার ও জাতীয় স্বীকৃতি অপরিহার্য
৫ আগস্ট নিহত পুলিশ সদস্যরা কোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে প্রাণ হারাননি; তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের এই আত্মত্যাগ যদি যথাযথ স্বীকৃতি না পায়, তবে ভবিষ্যতে আর কেউ রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবন বাজি রাখতে এগিয়ে আসবে না।
তাই, এই দিনটিকে ‘পুলিশ হত্যা দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া আজ সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে আমরা কেবল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাব না, বরং রাষ্ট্র ও তার রক্ষকদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে আকারহীন করার একটি শক্তিশালী বার্তা দেব। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
রাজনৈতিক বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের মনে রাখতে হবে, পুলিশের উর্দি পরা মানুষগুলো আমাদেরই ভাই, আমাদেরই সন্তান। রাষ্ট্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তাদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানানো আমাদের জাতীয় কর্তব্য। ৫ আগস্ট হোক সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার শপথের দিন।
লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
#পুলিশ_হত্যা_দিবস #৫আগস্ট
#রাষ্ট্রের_জন্য_আত্মত্যাগ #আগস্টের_কালো_দিবস