31/10/2025
#রক্তের_গন্ধ
#মধুমিতা_অধিকারী
#অন্তিম_পর্ব
রাত প্রায় এগারোটা।
কলকাতার এক প্রাচীন হাসপাতাল—সেন্ট হেলেনা মেন্টাল ইনস্টিটিউট।
বাইরের গেটের সামনে পুরনো গাছগুলো কুয়াশায় ডুবে আছে, মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটায় শোঁ শোঁ শব্দ ওঠে।
হাসপাতালের ভেতরে, করিডোরগুলো নিস্তব্ধ—শুধু কখনও সখনও কোথাও থেকে আসে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, তারপর আবার সব চুপ।
নতুন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. মায়া বন্দ্যোপাধ্যায়—
আজ তার প্রথম দিন, কিন্তু হাসপাতালের সবাই যেন তার আগমনে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি বোধ করছে।
নার্স লীলা বলল,
“ম্যাডাম, আপনার রুমটা এখানে, ৩২১ নম্বর। আগে যে ডাক্তার ছিলেন—ড. রায়—উনি…”
বাক্যটা শেষ না করে গিলল, তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, “উনি মারা গেছেন।”
মায়া একবার শুধু তাকাল, মুখে হালকা হাসি।
“হ্যাঁ, আমি জানি। আমি তার ফাইলগুলো পড়েছি।”
লীলা কেঁপে উঠল।
“ফাইল? কিন্তু সেগুলো তো… নিষিদ্ধ।”
মায়া চুপ করে তার চোখের দিকে তাকাল—একটা স্থির দৃষ্টি, যেন ভেতরটা ছিন্ন করে ফেলছে।
“কোনও কিছুই নিষিদ্ধ না, লীলা। শুধু মানুষ ভয় পায় দেখতে।”
********
৩২১ নম্বর রুমটা একেবারে হাসপাতালের শেষপ্রান্তে।
ভেতরে ঢুকে মায়া আলতো করে আলো জ্বালাল।
ঘরটা একদম নিরব, এক পাশে টেবিল, দেয়ালে অদ্ভুত কিছু ছবির ফ্রেম—পুরনো ডাক্তারদের ছবি, যারা নাকি এই হাসপাতালেই রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছিলেন।
মায়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল।
বৃষ্টি পড়ছে।
দূরের রাস্তার আলোয় মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে একটা অন্ধকার অবয়ব—কেউ যেন দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
তার ঠোঁটের কোণে হাসি খেলল।
“তুমি আবারও এসেছো, মীরা?”
আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দুলে উঠল।
প্রতিফলনটা বলল, “আমি কখনও যাইনি, মায়া। আমি তো তুই-ই।”
মায়া চোখ বন্ধ করল।
তার ভিতর থেকে উঠে এল সেই পুরনো কণ্ঠস্বর,
“তুই যত ভালো হোস না কেন, আমি ততটাই অন্ধকার।”
******
পরদিন সকালে হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ড. নন্দন বসু মায়াকে ডাকলেন।
“ড. মায়া, আমাদের এক রোগীর অবস্থা খারাপ। তার নাম অদিতি চক্রবর্তী। গত এক বছর ধরে সে কাউকে বিশ্বাস করে না। সবসময় বলে কেউ ওকে দেখছে, কেউ ওর মন চুরি করে নিচ্ছে।”
মায়া ধীরে বলল, “মন চুরি… interesting.”
নন্দন বললেন, “তাকে একটু হিপনোসিস থেরাপি দিন, তবে সাবধানে। ওর মানসিক অবস্থা খুব ভঙ্গুর।”
মায়া হাসল, “আমি তো ভঙ্গুরদের নিয়েই কাজ করি, ডাক্তার।”
*******
রুম ৪০২।
অদিতি কোণে বসে ছিল, চুল এলোমেলো, চোখে গভীর দাগ।
মায়া ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।
“অদিতি?”
মেয়ে ধীরে তাকাল, গলায় কাঁপুনি,
“তুমি… তুমি ওর মতো দেখাচ্ছো…”
মায়া চুপ করে বলল, “কার মতো?”
অদিতি কাঁপা গলায় বলল,
“ওই… ও মহিলা… যিনি রাতে আমার স্বপ্নে আসেন। রক্তে ভেজা পোশাক পরে বলেন—‘আমি তোমার মন চাই…’।”
মায়ার ঠোঁটে ঠাণ্ডা হাসি ফুটে উঠল।
“তাহলে দেখা হবে আমাদের, স্বপ্নে।”
সে ধীরে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল,
বলো, অদিতি… কাকে দেখছো?”
অদিতির চোখ ফাঁকা হয়ে গেল।
তার গলা থেকে বেরিয়ে এল চাপা চিৎকার,
“তুমি… তুমি দুজন!”
আলো ঝাপসা হয়ে গেল।
ঘরজুড়ে অন্ধকার।
পরের মুহূর্তে—
মায়া দাঁড়িয়ে, হাতে একটা রক্তমাখা স্ক্যালপেল,
আর অদিতি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে, ঠোঁটে একটা থেমে যাওয়া হাসি।
রাত সাড়ে তিনটা।
হাসপাতালের গার্ড ধূমপান করছিল, হঠাৎ দেখল পেছনের করিডোরে আলো জ্বলছে।
সে গিয়ে দেখে—রুম ৪০২-এর দরজা আধখোলা।
ভেতরে বিছানায় নেই অদিতি।
শুধু দেয়ালে রক্তে লেখা—
“She is awake.”
পরদিন সকালে মায়া কফি হাতে সুপারের ঘরে ঢুকল।
ড. বসু মুখ কষে বললেন,
“অদিতি নিখোঁজ। তোমার সেশনের পর থেকেই।”
মায়া নির্বিকার গলায় বলল,
“মানুষ কখনও কখনও নিজেকে খুঁজে পেতে হারিয়ে যায়, ডাক্তার।”
“তুমি কী বলতে চাইছো?”
মায়া ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলল,
“আপনাদের হাসপাতালের দেওয়ালে অনেক আত্মা আটকে আছে, নন্দন। তারা কাউকে দরকার, যিনি তাদের কথা শোনেন। আমি শুধু… শ্রোতা।”
ড. বসু থমকে গেলেন।
তার চোখে ভয়ের রেখা।
“তুমি অদ্ভুত, ড. মায়া।”
মায়া ধীরে হেসে উত্তর দিল,
“না, ডাক্তার। আমি বাস্তব।”
******
সেই রাতে নার্স লীলা ক্লিনিকের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখে—
একটা বেড খালি, কিন্তু মাথার বালিশের নিচে পড়ে আছে একটা ছোট্ট টেপ রেকর্ডার।
কৌতূহলবশত সে টেপটা চালাল।
রেকর্ডারে মায়ার কণ্ঠ—
“আজকের রোগী ছিল চমৎকার। ওর ভিতরে অনেক স্তর লুকানো ছিল। যখন আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম, মীরা ওর ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। এখন অদিতি আর আমি এক। মীরা খুব খুশি।”
লীলা কাঁপতে লাগল।
“মীরা… কে মীরা?”
ঠিক তখনই আলো নিভে গেল।
পেছনে হালকা কণ্ঠে কেউ ফিসফিস করে বলল,
“আমি।”
লীলা ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই তার গলার ওপর ঠাণ্ডা কিছু ছোঁয়া গেল—
একটা স্ক্যালপেল।
শেষ যে শব্দটা সে শুনল—
“তুমি খুব বেশি শুনে ফেলেছো।”
*******
পরদিন সকালে হাসপাতালের নিউজ রিপোর্টে ছাপা হলো—
“সেন্ট হেলেনা হাসপাতালের নার্সের রহস্যময় মৃত্যু। আত্মহত্যা না খুন, জানা যায়নি।”
ড. মায়া টেবিলের পাশে বসে খবরের কাগজ ভাঁজ করলেন।
চায়ের কাপের ধোঁয়া ধীরে ধীরে উড়ে উঠছে।
আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি বলল,
“তুমি আবার শুরু করেছো, মায়া?”
মায়া শান্ত গলায় উত্তর দিল,
“আমি না, তুই করেছিস, মীরা।”
প্রতিফলনটা হেসে উঠল।
“আমরা দুজনেই তো একই।”
আয়নায় সেই হাসি লালচে রঙে রঙিন হয়ে উঠল—
আর পেছনের দেয়ালে ফুটে উঠল রক্তের দাগে লেখা নতুন বাক্য—
“Next Patient: Dr. Nandan Basu.”
******
সেন্ট হেলেনা হাসপাতালের আকাশে তখন ঘন মেঘ।
বিকেলের সূর্য অস্ত যাচ্ছে, করিডোরের দেয়ালে পড়া আলোটা রক্তের মতো লালচে।
ড. নন্দন বসু একা দাঁড়িয়ে ছিলেন অফিসের জানালার পাশে,
হাতে মায়ার ফাইল — সেই একই ফাইল, যা কেউ দেখতে সাহস করত না।
ভেতরে লেখা ছিল,
“Project Mirror: Subject Maya–Meera.
এক শরীরে দুই মন, এক আলোর সঙ্গে এক অন্ধকার।”
নন্দন ফাইল বন্ধ করলেন, মুখে এক ফোঁটা ঘাম।
“তাহলে সবটাই সত্যি… মায়া আর মীরা… দুজন নয়, এক জন।”
*****
হাসপাতালের ভেতর আজ অদ্ভুত নিরবতা।
রাত নেমে এসেছে, রোগীদের কক্ষের আলো একে একে নিভছে।
দূরে কোথাও একটা পুরনো পিয়ানো বাজছে — করিডোর জুড়ে সেই সুরটা যেন কাঁদছে।
ড. বসু ধীরে পায়ে হেঁটে চললেন থেরাপি উইং-এর দিকে।
৪০২ নম্বর ঘরটা তালাবন্ধ।
কিন্তু ভেতর থেকে একটা ফিসফিস শব্দ আসছে—
“তুমি আসবে জানতাম, ডাক্তার।”
তিনি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।
রুমে শুধু একটা টেবিল, তাতে জ্বালানো মোমবাতি।
মোমের আলোয় দেখা গেল—মায়া বসে আছে সাদা কোট পরে, মুখে ঠাণ্ডা হাসি।
বসু: “তুমি জানো আমি কী দেখেছি তোমার ফাইলে?”
মায়া: “সব দেখেছো, কিন্তু কিছুই বোঝোনি।”
বসু: “তুমি খুন করেছো, মায়া। অদিতি, নার্স লীলা, এমনকি আগের ডাক্তাররাও। তুমি তাদের মস্তিষ্ক নিয়ে খেলা করেছো।”
মায়া ধীরে বলল,
“আমি কারও খুন করিনি, ডাক্তার। আমি শুধু তাদের মুক্তি দিয়েছি। তারা সবাই নিজেদের দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল।”
বসু: “আর তুমি ন্যায়বিচার করছো ভাবছো?”
মায়া হেসে বলল,
“আমি ডাক্তার। চিকিৎসা করছি।”
তার কণ্ঠ নিচু হয়ে গেল,
“তুমি কি জানো, তোমার ভিতরেও এক দানব আছে?”
বসু থমকে গেলেন। “তুমি কী বলছো?”
“তুমি প্রতিদিন হাসো, চিকিৎসা করো, অথচ রাতে ওষুধ খাও যাতে নিজের ভিতরের কণ্ঠস্বর বন্ধ থাকে। তাই না?”
ড. বসু হঠাৎ রেগে উঠলেন,
“চুপ করো! তুমি কিছু জানো না আমার সম্পর্কে!”
মায়া ধীরে উঠে দাঁড়াল, তার চোখে এখন মায়ার মমতা নয়—
মীরার নিষ্ঠুরতা।
সে ফিসফিস করে বলল,
“সবাই ভেতরে ভাঙা, নন্দন। কেউ সেটা মুখে বলে না। আমি শুধু সেই ফাটলটা খুলে দিই।”
**********
মোমবাতির আলো দুলে উঠল।
পাশের দেয়ালে হঠাৎ দেখা গেল প্রজেকশন—অদিতি, লীলা, অর্ণব, দেবাশীষ—সবার মুখ একে একে ভেসে উঠছে।
তাদের চোখ থেকে ঝরে পড়ছে রক্ত, যেন তারা এখনো বেঁচে আছে।
বসু পিছিয়ে গেলেন।
“এটা কী করে সম্ভব…”
মায়া বলল,
“এটাই বাস্তব। মৃতরা মরে না, তারা শুধু অন্যরূপে বেঁচে থাকে।”
তার কণ্ঠ বদলে গেল—আরেকটা গলা ভেসে এল, একই মুখ, কিন্তু অন্য স্বর।
মীরা: “তুমি এবার আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে, ডাক্তার।”
বসু বন্দুক বের করলেন,
“থামো! আমি জানি তুমি দুই সত্তা, কিন্তু আজ এই পাগলামির শেষ।”
মীরা হাসল, চোখ জ্বলজ্বল করছে।
“শেষ? না, এটা শুরু।”
সে এক পা এগিয়ে এল, বন্দুকের নল ধরল নিজের কপালে।
“মারো, ডাক্তার। যদি পারো।”
বসুর হাত কাঁপছে। ঘামের বিন্দু পড়ছে গালে।
কিন্তু বন্দুকের ট্রিগার চাপতে পারছেন না।
তার মাথার ভেতর বাজছে কণ্ঠস্বর—
“তুইও আমার মতো… তুইও বিকারগ্রস্ত…”
বসু বন্দুক ফেলে দিলেন।
চিৎকার করে বললেন,
“তুমি আমাকে কী করছো!”
মীরা এগিয়ে এসে বলল,
“শুধু সত্য দেখাচ্ছি। তুমিও ভেঙে গেছো, নন্দন। আর আমি সেই ভাঙনের দিকটা দেখতে ভালোবাসি।”
********
হঠাৎ বাতাস নিভে গেল। মোমবাতি নিভে অন্ধকার ছেয়ে গেল ঘরজুড়ে।
তারপর এক চিৎকার—
একটা গুলির শব্দ।
কয়েক মিনিট পর দরজাটা খুলে গেল।
ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ড. মায়া।
তার কোটে রক্তের দাগ, কিন্তু মুখ শান্ত, একেবারে নিরাসক্ত।
রুমের ভেতরে পড়ে আছে ড. বসুর দেহ।
বুকের মাঝখানে গুলির ক্ষত।
কিন্তু বন্দুকটা পড়ে আছে মায়ার হাতে, তার আঙুলের ছাপ নেই কোথাও।
সে নিচু হয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আমি তো তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, ডাক্তার।”
তারপর হাসল,
“তুমি নিজেই নিজেকে মেরে ফেললে।”
*******
সকালের পত্রিকা চিৎকার করছে—
“সেন্ট হেলেনা হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট আত্মহত্যা করেছেন। রহস্য ঘনাচ্ছে।”
ড. মায়া জানালার পাশে বসে কফি খাচ্ছেন।
বাইরে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।
তিনি ফাইল খুললেন—নতুন রোগী যোগ হয়েছে।
নাম: রোহিত সেন
বয়স: ৩০
পেশা: পুলিশ অফিসার
মন্তব্য: “Investigator of S.H. Case”
মায়া মৃদু হাসলেন।
নতুন খেলা শুরু হলো, মীরা।”
আয়নায় প্রতিফলনটা জবাব দিল,
“তুমি জানো, এবার কে জিতবে?”
মায়া চুপ করে বলল,
“জয়-পরাজয় বলে কিছু নেই, মীরা। আছে শুধু… রক্তের গন্ধ।”
******
রাত।
হাসপাতালের ছাদে বাতাস বইছে।
মায়া ধীরে হাঁটছেন। হাতে সেই পুরনো টেপ রেকর্ডার।
তিনি সেটি চালালেন—
“এটাই আমার শেষ রেকর্ডিং। আমি মায়া। কিংবা মীরা।
আমি পাগল নই, আমি শুধু অন্য দিকটা দেখতে পারি।
মানুষ যা লুকিয়ে রাখে, আমি সেটাই প্রকাশ করি।
কেউ বলে এটা অপরাধ, আমি বলি—এটা মুক্তি।”
তিনি থামলেন, দূরে শহরের আলো দেখলেন।
তার ঠোঁটে একটা শান্ত হাসি, তারপর টেপটা নিচে ছুঁড়ে ফেললেন।
ক্যামেরা (ভাবনায়) নিচে নামল—
রাস্তায় পড়ে টেপটা ঘুরছে ধীরে ধীরে,
ভেতর থেকে এখনো বাজছে শেষ শব্দটা—
“আমি এখন বিশ্রাম নেবো না… আমি শুধু অন্য মুখে ফিরে আসব।”
__________ সমাপ্ত_________