Mahi's Vlog

Mahi's Vlog Contact information, map and directions, contact form, opening hours, services, ratings, photos, videos and announcements from Mahi's Vlog, Bangaon.

31/10/2025

#রক্তের_গন্ধ
#মধুমিতা_অধিকারী
#অন্তিম_পর্ব

রাত প্রায় এগারোটা।
কলকাতার এক প্রাচীন হাসপাতাল—সেন্ট হেলেনা মেন্টাল ইনস্টিটিউট।
বাইরের গেটের সামনে পুরনো গাছগুলো কুয়াশায় ডুবে আছে, মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটায় শোঁ শোঁ শব্দ ওঠে।
হাসপাতালের ভেতরে, করিডোরগুলো নিস্তব্ধ—শুধু কখনও সখনও কোথাও থেকে আসে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, তারপর আবার সব চুপ।

নতুন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. মায়া বন্দ্যোপাধ্যায়—
আজ তার প্রথম দিন, কিন্তু হাসপাতালের সবাই যেন তার আগমনে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি বোধ করছে।
নার্স লীলা বলল,
“ম্যাডাম, আপনার রুমটা এখানে, ৩২১ নম্বর। আগে যে ডাক্তার ছিলেন—ড. রায়—উনি…”
বাক্যটা শেষ না করে গিলল, তারপর মৃদু কণ্ঠে বলল, “উনি মারা গেছেন।”

মায়া একবার শুধু তাকাল, মুখে হালকা হাসি।
“হ্যাঁ, আমি জানি। আমি তার ফাইলগুলো পড়েছি।”

লীলা কেঁপে উঠল।
“ফাইল? কিন্তু সেগুলো তো… নিষিদ্ধ।”

মায়া চুপ করে তার চোখের দিকে তাকাল—একটা স্থির দৃষ্টি, যেন ভেতরটা ছিন্ন করে ফেলছে।
“কোনও কিছুই নিষিদ্ধ না, লীলা। শুধু মানুষ ভয় পায় দেখতে।”

********

৩২১ নম্বর রুমটা একেবারে হাসপাতালের শেষপ্রান্তে।
ভেতরে ঢুকে মায়া আলতো করে আলো জ্বালাল।
ঘরটা একদম নিরব, এক পাশে টেবিল, দেয়ালে অদ্ভুত কিছু ছবির ফ্রেম—পুরনো ডাক্তারদের ছবি, যারা নাকি এই হাসপাতালেই রহস্যজনকভাবে মারা গিয়েছিলেন।

মায়া জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল।
বৃষ্টি পড়ছে।
দূরের রাস্তার আলোয় মাঝে মাঝে ভেসে উঠছে একটা অন্ধকার অবয়ব—কেউ যেন দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

তার ঠোঁটের কোণে হাসি খেলল।
“তুমি আবারও এসেছো, মীরা?”

আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দুলে উঠল।
প্রতিফলনটা বলল, “আমি কখনও যাইনি, মায়া। আমি তো তুই-ই।”

মায়া চোখ বন্ধ করল।
তার ভিতর থেকে উঠে এল সেই পুরনো কণ্ঠস্বর,

“তুই যত ভালো হোস না কেন, আমি ততটাই অন্ধকার।”

******

পরদিন সকালে হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ড. নন্দন বসু মায়াকে ডাকলেন।
“ড. মায়া, আমাদের এক রোগীর অবস্থা খারাপ। তার নাম অদিতি চক্রবর্তী। গত এক বছর ধরে সে কাউকে বিশ্বাস করে না। সবসময় বলে কেউ ওকে দেখছে, কেউ ওর মন চুরি করে নিচ্ছে।”

মায়া ধীরে বলল, “মন চুরি… interesting.”

নন্দন বললেন, “তাকে একটু হিপনোসিস থেরাপি দিন, তবে সাবধানে। ওর মানসিক অবস্থা খুব ভঙ্গুর।”

মায়া হাসল, “আমি তো ভঙ্গুরদের নিয়েই কাজ করি, ডাক্তার।”

*******

রুম ৪০২।
অদিতি কোণে বসে ছিল, চুল এলোমেলো, চোখে গভীর দাগ।
মায়া ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।

“অদিতি?”

মেয়ে ধীরে তাকাল, গলায় কাঁপুনি,
“তুমি… তুমি ওর মতো দেখাচ্ছো…”

মায়া চুপ করে বলল, “কার মতো?”

অদিতি কাঁপা গলায় বলল,
“ওই… ও মহিলা… যিনি রাতে আমার স্বপ্নে আসেন। রক্তে ভেজা পোশাক পরে বলেন—‘আমি তোমার মন চাই…’।”

মায়ার ঠোঁটে ঠাণ্ডা হাসি ফুটে উঠল।
“তাহলে দেখা হবে আমাদের, স্বপ্নে।”

সে ধীরে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল,

বলো, অদিতি… কাকে দেখছো?”

অদিতির চোখ ফাঁকা হয়ে গেল।
তার গলা থেকে বেরিয়ে এল চাপা চিৎকার,
“তুমি… তুমি দুজন!”

আলো ঝাপসা হয়ে গেল।
ঘরজুড়ে অন্ধকার।

পরের মুহূর্তে—
মায়া দাঁড়িয়ে, হাতে একটা রক্তমাখা স্ক্যালপেল,
আর অদিতি নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে, ঠোঁটে একটা থেমে যাওয়া হাসি।

রাত সাড়ে তিনটা।
হাসপাতালের গার্ড ধূমপান করছিল, হঠাৎ দেখল পেছনের করিডোরে আলো জ্বলছে।
সে গিয়ে দেখে—রুম ৪০২-এর দরজা আধখোলা।
ভেতরে বিছানায় নেই অদিতি।
শুধু দেয়ালে রক্তে লেখা—
“She is awake.”

পরদিন সকালে মায়া কফি হাতে সুপারের ঘরে ঢুকল।
ড. বসু মুখ কষে বললেন,
“অদিতি নিখোঁজ। তোমার সেশনের পর থেকেই।”

মায়া নির্বিকার গলায় বলল,
“মানুষ কখনও কখনও নিজেকে খুঁজে পেতে হারিয়ে যায়, ডাক্তার।”

“তুমি কী বলতে চাইছো?”

মায়া ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলল,
“আপনাদের হাসপাতালের দেওয়ালে অনেক আত্মা আটকে আছে, নন্দন। তারা কাউকে দরকার, যিনি তাদের কথা শোনেন। আমি শুধু… শ্রোতা।”

ড. বসু থমকে গেলেন।
তার চোখে ভয়ের রেখা।
“তুমি অদ্ভুত, ড. মায়া।”

মায়া ধীরে হেসে উত্তর দিল,
“না, ডাক্তার। আমি বাস্তব।”

******

সেই রাতে নার্স লীলা ক্লিনিকের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখে—
একটা বেড খালি, কিন্তু মাথার বালিশের নিচে পড়ে আছে একটা ছোট্ট টেপ রেকর্ডার।
কৌতূহলবশত সে টেপটা চালাল।

রেকর্ডারে মায়ার কণ্ঠ—

“আজকের রোগী ছিল চমৎকার। ওর ভিতরে অনেক স্তর লুকানো ছিল। যখন আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম, মীরা ওর ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। এখন অদিতি আর আমি এক। মীরা খুব খুশি।”

লীলা কাঁপতে লাগল।
“মীরা… কে মীরা?”

ঠিক তখনই আলো নিভে গেল।
পেছনে হালকা কণ্ঠে কেউ ফিসফিস করে বলল,
“আমি।”

লীলা ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই তার গলার ওপর ঠাণ্ডা কিছু ছোঁয়া গেল—
একটা স্ক্যালপেল।

শেষ যে শব্দটা সে শুনল—

“তুমি খুব বেশি শুনে ফেলেছো।”

*******

পরদিন সকালে হাসপাতালের নিউজ রিপোর্টে ছাপা হলো—

“সেন্ট হেলেনা হাসপাতালের নার্সের রহস্যময় মৃত্যু। আত্মহত্যা না খুন, জানা যায়নি।”

ড. মায়া টেবিলের পাশে বসে খবরের কাগজ ভাঁজ করলেন।
চায়ের কাপের ধোঁয়া ধীরে ধীরে উড়ে উঠছে।
আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি বলল,
“তুমি আবার শুরু করেছো, মায়া?”

মায়া শান্ত গলায় উত্তর দিল,
“আমি না, তুই করেছিস, মীরা।”

প্রতিফলনটা হেসে উঠল।
“আমরা দুজনেই তো একই।”

আয়নায় সেই হাসি লালচে রঙে রঙিন হয়ে উঠল—
আর পেছনের দেয়ালে ফুটে উঠল রক্তের দাগে লেখা নতুন বাক্য—

“Next Patient: Dr. Nandan Basu.”

******

সেন্ট হেলেনা হাসপাতালের আকাশে তখন ঘন মেঘ।
বিকেলের সূর্য অস্ত যাচ্ছে, করিডোরের দেয়ালে পড়া আলোটা রক্তের মতো লালচে।
ড. নন্দন বসু একা দাঁড়িয়ে ছিলেন অফিসের জানালার পাশে,
হাতে মায়ার ফাইল — সেই একই ফাইল, যা কেউ দেখতে সাহস করত না।

ভেতরে লেখা ছিল,

“Project Mirror: Subject Maya–Meera.
এক শরীরে দুই মন, এক আলোর সঙ্গে এক অন্ধকার।”

নন্দন ফাইল বন্ধ করলেন, মুখে এক ফোঁটা ঘাম।
“তাহলে সবটাই সত্যি… মায়া আর মীরা… দুজন নয়, এক জন।”

*****

হাসপাতালের ভেতর আজ অদ্ভুত নিরবতা।
রাত নেমে এসেছে, রোগীদের কক্ষের আলো একে একে নিভছে।
দূরে কোথাও একটা পুরনো পিয়ানো বাজছে — করিডোর জুড়ে সেই সুরটা যেন কাঁদছে।

ড. বসু ধীরে পায়ে হেঁটে চললেন থেরাপি উইং-এর দিকে।
৪০২ নম্বর ঘরটা তালাবন্ধ।
কিন্তু ভেতর থেকে একটা ফিসফিস শব্দ আসছে—

“তুমি আসবে জানতাম, ডাক্তার।”

তিনি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।
রুমে শুধু একটা টেবিল, তাতে জ্বালানো মোমবাতি।
মোমের আলোয় দেখা গেল—মায়া বসে আছে সাদা কোট পরে, মুখে ঠাণ্ডা হাসি।

বসু: “তুমি জানো আমি কী দেখেছি তোমার ফাইলে?”

মায়া: “সব দেখেছো, কিন্তু কিছুই বোঝোনি।”

বসু: “তুমি খুন করেছো, মায়া। অদিতি, নার্স লীলা, এমনকি আগের ডাক্তাররাও। তুমি তাদের মস্তিষ্ক নিয়ে খেলা করেছো।”

মায়া ধীরে বলল,
“আমি কারও খুন করিনি, ডাক্তার। আমি শুধু তাদের মুক্তি দিয়েছি। তারা সবাই নিজেদের দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল।”

বসু: “আর তুমি ন্যায়বিচার করছো ভাবছো?”

মায়া হেসে বলল,
“আমি ডাক্তার। চিকিৎসা করছি।”

তার কণ্ঠ নিচু হয়ে গেল,
“তুমি কি জানো, তোমার ভিতরেও এক দানব আছে?”

বসু থমকে গেলেন। “তুমি কী বলছো?”

“তুমি প্রতিদিন হাসো, চিকিৎসা করো, অথচ রাতে ওষুধ খাও যাতে নিজের ভিতরের কণ্ঠস্বর বন্ধ থাকে। তাই না?”

ড. বসু হঠাৎ রেগে উঠলেন,
“চুপ করো! তুমি কিছু জানো না আমার সম্পর্কে!”

মায়া ধীরে উঠে দাঁড়াল, তার চোখে এখন মায়ার মমতা নয়—
মীরার নিষ্ঠুরতা।
সে ফিসফিস করে বলল,
“সবাই ভেতরে ভাঙা, নন্দন। কেউ সেটা মুখে বলে না। আমি শুধু সেই ফাটলটা খুলে দিই।”

**********

মোমবাতির আলো দুলে উঠল।
পাশের দেয়ালে হঠাৎ দেখা গেল প্রজেকশন—অদিতি, লীলা, অর্ণব, দেবাশীষ—সবার মুখ একে একে ভেসে উঠছে।
তাদের চোখ থেকে ঝরে পড়ছে রক্ত, যেন তারা এখনো বেঁচে আছে।

বসু পিছিয়ে গেলেন।
“এটা কী করে সম্ভব…”

মায়া বলল,
“এটাই বাস্তব। মৃতরা মরে না, তারা শুধু অন্যরূপে বেঁচে থাকে।”

তার কণ্ঠ বদলে গেল—আরেকটা গলা ভেসে এল, একই মুখ, কিন্তু অন্য স্বর।
মীরা: “তুমি এবার আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে, ডাক্তার।”

বসু বন্দুক বের করলেন,
“থামো! আমি জানি তুমি দুই সত্তা, কিন্তু আজ এই পাগলামির শেষ।”

মীরা হাসল, চোখ জ্বলজ্বল করছে।
“শেষ? না, এটা শুরু।”

সে এক পা এগিয়ে এল, বন্দুকের নল ধরল নিজের কপালে।
“মারো, ডাক্তার। যদি পারো।”

বসুর হাত কাঁপছে। ঘামের বিন্দু পড়ছে গালে।
কিন্তু বন্দুকের ট্রিগার চাপতে পারছেন না।
তার মাথার ভেতর বাজছে কণ্ঠস্বর—
“তুইও আমার মতো… তুইও বিকারগ্রস্ত…”

বসু বন্দুক ফেলে দিলেন।
চিৎকার করে বললেন,
“তুমি আমাকে কী করছো!”

মীরা এগিয়ে এসে বলল,
“শুধু সত্য দেখাচ্ছি। তুমিও ভেঙে গেছো, নন্দন। আর আমি সেই ভাঙনের দিকটা দেখতে ভালোবাসি।”

********

হঠাৎ বাতাস নিভে গেল। মোমবাতি নিভে অন্ধকার ছেয়ে গেল ঘরজুড়ে।
তারপর এক চিৎকার—
একটা গুলির শব্দ।

কয়েক মিনিট পর দরজাটা খুলে গেল।
ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ড. মায়া।
তার কোটে রক্তের দাগ, কিন্তু মুখ শান্ত, একেবারে নিরাসক্ত।

রুমের ভেতরে পড়ে আছে ড. বসুর দেহ।
বুকের মাঝখানে গুলির ক্ষত।
কিন্তু বন্দুকটা পড়ে আছে মায়ার হাতে, তার আঙুলের ছাপ নেই কোথাও।

সে নিচু হয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আমি তো তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম, ডাক্তার।”

তারপর হাসল,
“তুমি নিজেই নিজেকে মেরে ফেললে।”

*******

সকালের পত্রিকা চিৎকার করছে—

“সেন্ট হেলেনা হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট আত্মহত্যা করেছেন। রহস্য ঘনাচ্ছে।”

ড. মায়া জানালার পাশে বসে কফি খাচ্ছেন।
বাইরে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে।
তিনি ফাইল খুললেন—নতুন রোগী যোগ হয়েছে।

নাম: রোহিত সেন
বয়স: ৩০
পেশা: পুলিশ অফিসার
মন্তব্য: “Investigator of S.H. Case”

মায়া মৃদু হাসলেন।
নতুন খেলা শুরু হলো, মীরা।”

আয়নায় প্রতিফলনটা জবাব দিল,
“তুমি জানো, এবার কে জিতবে?”

মায়া চুপ করে বলল,
“জয়-পরাজয় বলে কিছু নেই, মীরা। আছে শুধু… রক্তের গন্ধ।”

******

রাত।
হাসপাতালের ছাদে বাতাস বইছে।
মায়া ধীরে হাঁটছেন। হাতে সেই পুরনো টেপ রেকর্ডার।

তিনি সেটি চালালেন—

“এটাই আমার শেষ রেকর্ডিং। আমি মায়া। কিংবা মীরা।
আমি পাগল নই, আমি শুধু অন্য দিকটা দেখতে পারি।
মানুষ যা লুকিয়ে রাখে, আমি সেটাই প্রকাশ করি।
কেউ বলে এটা অপরাধ, আমি বলি—এটা মুক্তি।”

তিনি থামলেন, দূরে শহরের আলো দেখলেন।
তার ঠোঁটে একটা শান্ত হাসি, তারপর টেপটা নিচে ছুঁড়ে ফেললেন।

ক্যামেরা (ভাবনায়) নিচে নামল—
রাস্তায় পড়ে টেপটা ঘুরছে ধীরে ধীরে,
ভেতর থেকে এখনো বাজছে শেষ শব্দটা—

“আমি এখন বিশ্রাম নেবো না… আমি শুধু অন্য মুখে ফিরে আসব।”

__________ সমাপ্ত_________

31/10/2025

রাত তখন প্রায় তিনটা। কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা তখন নিস্তব্ধ, দূরে কোথাও হাওয়া বইছে ধীরে ধীরে—কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ ভেসে আসছে ফাঁকা অলিগলি পেরিয়ে।
একটা পুরনো গলির শেষে ভাঙা বাড়ি। ছাদের ধারে লোহার জানালায় পুরনো কাকের বাসা, জানালার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক লাল আলো বেরিয়ে আসছে—যেন ভিতরে কেউ আছে।

ভিতরে এক লোক বসে আছে কাঠের টেবিলের পাশে, টেবিলের ওপরে পড়ে আছে কিছু পুরনো ছবি, কয়েকটা কাটার ছুরি, একটা রক্তে ভেজা কাপড়। লোকটার নাম অর্ণব সেন। পেশায় ফরেনসিক ফটোগ্রাফার, পুলিশের সঙ্গে কাজ করে—কিন্তু তার চোখের মধ্যে আজ অন্য কিছু জ্বলছে, এক ধরণের পৈশাচিক আনন্দ।

সে একটা ছবি হাতে নিয়ে তাকালো—একজন মহিলার হাসিমুখ, নাম মায়া। চোখের কোণে একটু দুঃখের ছাপ, তবু এক অদ্ভুত কোমলতা। অর্ণব ছবিটা হাতে নিয়ে বলল নিচু গলায়,
“তুমি হাসছো… অথচ তুমি জানো না তোমার হাসিটা কতোটা নিষ্ঠুর ছিল।”

তারপর সে ছবি টেনে নিয়ে ছুরির ধার দিয়ে মাঝখানটা কেটে ফেলল।
রক্ত? না, ছবি থেকে নয়—তার নিজের আঙুলে কেটে গেল সামান্য, কিন্তু সে যেন সেটা উপভোগ করছিল। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি।

*****

অর্ণবের বাড়ি শহরের এক কোণে—পুরনো উত্তর কলকাতার গলি, যেখানে এখনো পুরনো ঘর, নকশা করা জানালা, কাঠের দরজা। বাইরে থেকে শান্ত, কিন্তু ভিতরে যেন জমে থাকা ধোঁয়া, অন্ধকার, আর কিছু গোপন ফিসফাস।

তার ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে বিশাল এক বোর্ড—যেখানে সারি সারি ছবি পিন দিয়ে আটকানো।
সব ছবির কেন্দ্রে একটাই নাম—“মায়া বন্দ্যোপাধ্যায়”।
তার পাশে লেখা, “She started it.”

কিন্তু কী শুরু করেছিল মায়া?
এটা জানে শুধু অর্ণব।

দুই বছর আগের স্মৃতি…

অর্ণব তখন ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে নতুন যোগ দিয়েছে। কাজের মধ্যে অদ্ভুত এক নেশা ছিল তার—মৃতদেহের ছবি তোলা, ক্ষতচিহ্ন বোঝা, খুনের দৃশ্য পুনর্গঠন করা।
অনেকে ওকে একটু “অদ্ভুত” বলত। সহকর্মীরা বলত, “অর্ণব মৃতদেহের দিকে যেভাবে তাকায়, তাতে ওর ভিতরে কিছু একটা আছে…”

একদিন পুলিশ ডেকে পাঠাল তাকে—একটা খুনের কেস, যেখানে এক তরুণীকে পাওয়া গেছে ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায়।
দরজা ভেতর থেকে লক করা, জানালা বন্ধ, কিন্তু শরীরের ক্ষতগুলো দেখে স্পষ্ট—এটা আত্মহত্যা নয়।

অর্ণব প্রথমবার সেই রাতেই দেখা পেল মায়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

******

মায়া তখন ক্রাইম ব্রাঞ্চের মনোবিজ্ঞানী, খুনের তদন্তে অপরাধীর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের কাজ করত।
স্মার্ট, আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু চোখের গভীরে কেমন এক ঠাণ্ডা ভাব।
অর্ণব প্রথম দেখা থেকেই বুঝল—এই নারী সাধারণ নয়।

সে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কীভাবে বুঝলেন এটা আত্মহত্যা নয়?”
মায়া হেসে বলেছিল,
“আত্মহত্যা করা মেয়েরা সাধারণত আয়নায় তাকিয়ে থাকে শেষবার… এখানে আয়না ঢাকা ছিল। কেউ চায় না তাকে এই অবস্থায় কেউ দেখুক—শুধু খুনি ছাড়া।”

তার ঠোঁটে সেই কথা বলার সময় যে হাসিটা ফুটেছিল, সেটা অর্ণবের মনে গেঁথে গিয়েছিল।
সেই হাসিই পরে তার ভিতরে কিছু একটা খুলে দিল—একটা মানসিক দরজা।

পরের কয়েক সপ্তাহে তারা একসঙ্গে কাজ করতে লাগল।
খুনের কেস, অদ্ভুত ছবি, দগ্ধ দেহ—সবকিছুতেই তারা যেন একে অপরকে বুঝতে পারত।

কিন্তু একটা রাত ছিল যেদিন সবকিছু বদলে গেল।

এক মদ্যপ খুনি ধরা পড়েছিল, জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে আচমকা হেসে উঠেছিল আর মায়াকে বলেছিল,
“আপনার চোখে আমি নিজের মতো কিছু দেখি। আপনিও কি কাউকে মেরেছেন?”

ঘরে উপস্থিত সবাই চুপ, কিন্তু মায়ার মুখে কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না।
শুধু ঠান্ডা গলায় বলেছিল,
“হ্যাঁ, আমি প্রতিদিন নিজের একটা অংশ মেরে ফেলি।”
অর্ণব সেই রাতে মায়াকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়েছিল।
বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তা, গাড়ির হেডলাইটের আলো, আর পিছনের সিটে বসে থাকা মায়া—চুল ভিজে গিয়েছিল, মুখে ছায়া।

হঠাৎ সে বলল,
“অর্ণব, তুমি কি জানো, মানুষের ভিতরে একটা অন্ধকার থাকে?
যেটা একবার বেরিয়ে এলে, আর থামে না।”

অর্ণব সেই রাতে কোনো উত্তর দেয়নি।
কিন্তু সেই অন্ধকারটা, ধীরে ধীরে, ওর ভিতরেও জন্ম নিতে শুরু করল।

দুই মাস পর।
এক সকালে খবর এল—মায়া নিখোঁজ।

কেউ জানে না কোথায় গেছে।
তদন্তে বেরোল, ওর মোবাইলের শেষ লোকেশন ছিল হুগলির পুরনো মানসিক হাসপাতালের ধারে।
অর্ণব পাগলের মতো খুঁজেছে।
দিন রাত ঘুরেছে সেই হাসপাতালের ধ্বংসাবশেষে, যেখানে বাতাসে কেবল ছত্রাকের গন্ধ আর শুকনো রক্তের দাগ।

কিন্তু মায়া নেই।

তবে, একদিন এক অচেনা খামে অর্ণবের অফিসে একটা ফটো আসে—
একটা আয়নার মধ্যে নিজের প্রতিবিম্বে তাকিয়ে থাকা মায়া।
ছবির নিচে লেখা—
“Find me if you can.”

******

সেই দিন থেকে অর্ণবের মনস্তত্ত্ব বদলে গেল।
সে শুরু করল নিজের অনুসন্ধান—অন্যরকম এক যাত্রা।
প্রথমে সে পুলিশ কেসের ছবিতে কিছু কোড খুঁজতে লাগল।
প্রতিটি কেসের ছবিতে অদ্ভুতভাবে লুকানো অক্ষর, সংখ্যার ক্রম, আর মাঝে মাঝে একটা প্রতীক—∞ (অনন্ত চিহ্ন)।

সব ছবির শেষে একটাই লক্ষ্য—মায়া।

অর্ণবের ঘরে এখন মায়ার ছবি, মৃতদেহের ছবি, ফরেনসিক চিহ্ন, ছুরি, পিন বোর্ড—সব মিশে গেছে এক বিকৃত অবসেশনে।
সে নিজেই নিজের মনে বলত,
“মায়া মরে যায়নি। ও শুধু আমার জন্য একটা খেলা রেখে গেছে।”

*****

সেই রাতে, যেদিন আমরা প্রথমে তাকে দেখেছিলাম—অর্ণব টেবিলে বসে ছিল, সামনে লাল কাপড়, ছুরি, মায়ার ছবি।

হঠাৎ তার ফোনে মেসেজ এল—
“তুমি কি এখনো খুঁজছো?”
মেসেজের নিচে লোকেশন—শহরের বাইরে পুরনো গুদামঘর।

অর্ণব নিঃশব্দে ছুরি পকেটে রাখল, হাতে নিল ক্যামেরা।
রাতের অন্ধকারে গাড়ি ছুটে চলল সেই গন্তব্যের দিকে।

গুদামঘর পৌঁছে সে দেখল—ভেতরে আলো জ্বলছে ক্ষীণ, বাতাসে পচা কাঠের গন্ধ।
দেয়ালে পুরনো লেখা—
“The game begins again.”

ভেতরে ঢুকতেই হঠাৎ বাতি নিভে গেল।
একটা মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেল অন্ধকারে—
“তুমি খুব দেরি করে ফেলেছো, অর্ণব।”

সে চমকে চারদিকে তাকায়।
ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বালাতেই দেখা গেল—সামনে এক দেহ পড়ে আছে, রক্তে ভেজা, মুখটা অর্ধেক ছেঁড়া।
আর দেয়ালে লেখা রক্তে—
“Welcome back.”

অর্ণব ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসল,
হাসল ঠাণ্ডাভাবে,
“তুমি এখনো খেলা চালিয়ে যাচ্ছো, মায়া… তাই তো?”

*****

রাতের হাওয়ায় ভেসে এল এক অচেনা হাসি।
ছাদের ওপর থেকে কেউ তাকিয়ে আছে—চোখে কালো ছায়া।

খেলা আবার শুরু হলো।

*****

রাত তখন প্রায় আড়াইটে।
পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে গুদামঘরের ফাঁক দিয়ে। বাইরে ঝড়ের মতো হাওয়া, আকাশে মেঘ জমে আছে ঘন কালো।
ভেতরে বসে আছে অর্ণব—তার চোখ স্থির, সামনে ছড়িয়ে পড়ে আছে রক্তে ভেজা মেঝে আর মৃতদেহটা এখনো গরম।

দেয়ালে লেখা শব্দটা যেন এখনো কাঁপছে—
“Welcome back.”

পুলিশের পদধ্বনি শোনা গেল দূর থেকে।
দরজার পাশে লাইট পড়তেই এক অফিসার চিৎকার করে উঠল,
“এই যে! কে ওখানে?”

অর্ণব তাকাল না, শুধু ঠাণ্ডাভাবে বলল,
“খুনি ফিরে এসেছে।”

তার গলায় অদ্ভুত শান্তি, যেন কোনো সুর বাজছে ভিতরে।

*****

খুনের দেহটা চেনা হলো—একজন মহিলা, নাম ইন্দ্রাণী ঘোষ, যিনি অর্ণবের আগের কেসগুলির একটির সাক্ষী ছিলেন।
তার মুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ, চোখ খোলা, ঠোঁট কাঁপা অবস্থায় জমে গেছে।
পাশে একটি পুরনো ক্যামেরা পড়ে আছে—অর্ণবের মতোই মডেল।

পুলিশ অফিসার দেবাশীষ রায়, কড়া স্বরে বলল,
“অর্ণব সেন, তুমি এখানে কীভাবে?”

অর্ণব ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল,
“আমি এসেছিলাম একটা মেসেজের সূত্রে। কেউ পাঠিয়েছিল—‘তুমি কি এখনো খুঁজছো?’”

দেবাশীষ রায় কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আর কেউ দেখেছে তোমাকে এখানে আসতে?”

“না।”
“তুমি জানো এই মেয়েটা কে?”
অর্ণব তাকিয়ে বলল, “ও মায়ার সঙ্গে একসময় কাজ করত।”

ঘরটা তখন নিঃশব্দ। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। ভেতরে রক্তের গন্ধ আর লোহার মতো ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি।

******

অর্ণবকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।
দেবাশীষ টেবিলে বসে বলল,
“তুমি জানো, গত ছ’মাসে মোট তিনজন মারা গেছে—তিনজনই মায়ার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিল। এখন এই ইন্দ্রাণী চতুর্থ।”

অর্ণব নিচু গলায় বলল,
“মানে তুমি বলছো, খুনি মায়ার খোঁজে যাদের সঙ্গে ও ছিল, তাদের মারছে?”

“অথবা,” দেবাশীষ বলল, “খুনি নিজেই মায়া।”

অর্ণব থমকে গেল।
তার মনে পড়ল সেই হাসি, সেই চোখ, সেই ঠান্ডা কথা—“মানুষের ভিতরে একটা অন্ধকার থাকে…”

সে বলল, “মায়া মরেনি।”

দেবাশীষ গম্ভীর গলায় বলল,
“মৃত, নিখোঁজ, কিংবা খুনি—যাই হোক না কেন, এখন তোমাকে সাসপেন্ড করা হচ্ছে তদন্ত থেকে। তুমি নিজেই সন্দেহভাজন।”

অর্ণব কিছু বলল না। শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকল। আকাশে তখন মেঘের মধ্যে এক ঝলক বিদ্যুৎ।

****

রাতের পর রাত অর্ণব ঘুমোতে পারছে না।
তার ঘরে এখন কেবল রক্তের গন্ধ, সিগারেটের ধোঁয়া আর পুরনো টেপ রেকর্ডারের আওয়াজ।

সে একটা পুরনো ফাইল খুলল—মায়ার শেষ কেস ফাইল।
সেখানে একটি নাম লেখা—ড. অদ্বৈত বসু, এক সময় মানসিক রোগের চিকিৎসক, পরে সাসপেন্ড হয়েছিলেন এক রহস্যজনক ঘটনার পর।
ফাইলে লেখা—

“Patient M: Dissociative Identity Disorder.”
“Multiple Personality — subject shows violent tendencies.”

অর্ণব কাগজটা হাতে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“Patient M… মানে মায়া?”

*****

পরের দিন সকাল।
অর্ণব চুপিচুপি চলে গেল ড. অদ্বৈতের পুরনো নার্সিংহোমে, যা এখন প্রায় ভাঙা অবস্থা।
ভেতরে ঢুকতেই হাওয়ার সঙ্গে মিশে এলো ফরমালিন আর পচা ওষুধের গন্ধ।
দেয়ালে এখনো পুরনো বোর্ড ঝুলছে—“Basus Mind Therapy.”

ভেতরের এক ঘরে পুরনো কেস ফাইল পড়ে আছে ধুলোয় ঢাকা।
অর্ণব একটার পর একটা উল্টে দেখতে লাগল। হঠাৎ একটা খামের মধ্যে পেল ছবি—একজন মেয়ে, মায়ার মতোই মুখ, কিন্তু চোখে বিকৃত চাহনি। নিচে লেখা—“Maya – Subject Two.”

আরেকটা ছবিতে অন্য চেহারা—চুল ছোট, ঠোঁটে বিকৃত হাসি।
লেখা—“Mira – Subject One.”

অর্ণব হঠাৎ বুঝল—মায়া নয়, ও দুজন!
মায়া আর মীরা – একই শরীর, দুই সত্তা!

একজন কোমল, অন্যজন নির্মম।
একজন মনোবিজ্ঞানী, অন্যজন খুনি।

*****

বাইরে তখন ঝড় উঠছে। অর্ণবের কানে যেন কণ্ঠস্বর বাজল—
“তুমি দেরি করে ফেলেছো, অর্ণব…”

সে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল—ঘরের কোণে কেউ দাঁড়িয়ে।
চুল এলোমেলো, মুখ অর্ধেক অন্ধকারে, হাতে ছুরি।
চোখে সেই চেনা ঝিলিক।

“মায়া?”
“না,” সে বলল ঠাণ্ডা গলায়, “আমি মীরা।”

অর্ণব স্তব্ধ।
“তুমি… বেঁচে আছো?”

“আমি মরিনি, অর্ণব। মায়া মারা গিয়েছে। এখন শুধু আমি আছি। আর তুমি… তুমি আমার শেষ খেলা

সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, ছুরির ফলা মৃদু আলোয় ঝলমল করছে।
অর্ণব পিছিয়ে গেল এক পা, কিন্তু মীরা হাসল,
“তুমি জানো কেন আমি তোমাকে ভালোবাসতাম, অর্ণব? কারণ তুমিও অন্ধকারে বাঁচো। তোমারও ভিতরে আমি আছি।”

অর্ণবের কণ্ঠ কাঁপল,
“তুমি খুনি… তুমি চারজনকে মেরেছো!”

মীরা হেসে বলল,
“না, অর্ণব। আমি কাউকে মারিনি। তুমি মেরেছো।”

******

অর্ণবের মনে ফ্ল্যাশব্যাক শুরু হলো—প্রতিটি খুনের দৃশ্য, প্রতিটি রক্তের দাগ।
ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, মৃতদেহ, আর তার নিজের হাত।

না, না—সে তো মায়াকে খুঁজছিল, খুন করছিল না… তাই তো?
তার মাথার মধ্যে যেন এক স্রোত বয়ে গেল, কণ্ঠ বাজল নিজের মধ্যেই—
“তুমি তাকে মারছো না, তুমি শুধু ওকে থামাচ্ছো…”

অর্ণব চেঁচিয়ে উঠল, “না!!”

কিন্তু মীরা হাসল—
“তুমি আর আমি এক হয়ে গেছি, অর্ণব। তুমি আমারই মতো।”

তারপর হঠাৎ এক ঝলক বিদ্যুৎ, আর আলো নিভে গেল।

****

সকাল।
পুলিশ গিয়ে দেখে—নার্সিংহোমে ভাঙা কাঁচ, ছড়ানো রক্ত, আর মাঝখানে পড়ে আছে দুইটা দেহ।
একটা পুরুষের—অর্ণব সেন।
আরেকটা নারীর—মায়া বন্দ্যোপাধ্যায়।

কিন্তু ডাক্তাররা যখন পোস্টমর্টেমের জন্য শরীর পরীক্ষা করে, তারা দেখে—মেয়েটির মুখে এক অদ্ভুত হাসি, আর তার হাতের মুঠোয় একটা নোট:

“খেলা শেষ নয়।”

****

তিন দিন পর।
দেবাশীষ রায় অফিসে বসে রিপোর্ট পড়ছে।
তার ডেস্কে এসে একটা খাম পড়ল।
খামের ভিতরে একটি ছবি—অর্ণব আর মায়া একসঙ্গে বসে আছে, হাসছে।
আর নিচে লেখা—
“See you soon, Inspector.”

দেবাশীষের গলা শুকিয়ে গেল।
ঘরের বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে উঠল।

দূরে, জানালার বাইরে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে—চুল খোলা, মুখে সেই হাসি।
চোখে একটাই ছায়া—মীরা।

______________________

ভোর ছুঁই ছুঁই সময়।
কলকাতার আকাশে ধোঁয়াটে কুয়াশা, রাস্তার বাতিগুলো নিভে এসেছে ধীরে ধীরে। পুলিশ সদর দফতরের করিডোরে তখন নিস্তব্ধতা।
দেবাশীষ রায়, যিনি এখন এই কেসের প্রধান তদন্তকারী, বসে আছেন নিজের চেম্বারে।
চোখের সামনে ছড়িয়ে আছে কাগজ, ছবি, মেডিকেল রিপোর্ট—সবই অর্ণব সেন আর মায়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু নিয়ে।

কিন্তু একটা বিষয় তার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে—
পোস্টমর্টেম রিপোর্টে লেখা, মায়া মারা গেছে ৪৮ ঘণ্টা আগে, অথচ অর্ণবের মৃত্যুর সময় মাত্র ১২ ঘণ্টা আগে।
মানে, মায়ার দেহ আগে মৃত ছিল।
তাহলে যাকে নার্সিংহোমে দেখা গিয়েছিল?
যে কথা বলেছিল, ছুরি তুলেছিল?
সে কে?

*****

দেবাশীষ ডেস্কে বসে টেবিলের ওপরের ছবিটা তুলে নিল।
ছবিতে মায়া আর অর্ণব—একসাথে দাঁড়িয়ে, মুখে হাসি।
ছবির পিছনে রক্তের মতো কালি দিয়ে লেখা—

“The game never ends.”

তার আঙুল ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
হঠাৎ দরজায় টোকা।

ভেতরে ঢুকল একজন তরুণ অফিসার, নাম রোহিত।
“স্যার, ফরেনসিক রিপোর্ট এসেছে।”

দেবাশীষ বলল, “কী পেল?”

রোহিত কাগজ এগিয়ে দিল, “স্যার, নার্সিংহোমে পাওয়া মহিলার ডিএনএ মিলে গেছে মায়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে… কিন্তু সমস্যা হলো—একই জায়গায় আরেকটা চুলের নমুনা পাওয়া গেছে, যেটার ডিএনএ আলাদা। তবে মুখের গঠন প্রায় মায়ার মতোই।”

দেবাশীষ মাথা নিচু করে বলল,
“মানে… দুটো নারী, এক মুখ?”

রোহিত বলল, “হয়তো যমজ, স্যার। কিন্তু মায়ার কোনো যমজ থাকার রেকর্ড নেই।”

দেবাশীষের চোখ ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে উঠল।
“হয়তো রেকর্ড মুছে দেওয়া হয়েছে।”

______________________

সেই রাতেই দেবাশীষ গেল বসুস মাইন্ড থেরাপি সেন্টারের পুরনো নথি ঘাঁটতে।
অদ্বৈত বসুর ঘর এখন ভাঙাচোরা, কিন্তু একটি আলমারি এখনো অক্ষত ছিল।
তালাটা ভেঙে খুলতেই ভিতরে পেল পুরনো রেজিস্টার—

“Case No. 37: Twins — Project ‘Mirror.’”

সে পড়তে লাগল—

“দুই বোন, জন্মের সময় আলাদা করা হয়। একজন শান্ত, একজন আক্রমণাত্মক। দুই মন, এক দেহের মতো আচরণ—যাদের নাম দেওয়া হয় ‘মায়া’ ও ‘মীরা’। উদ্দেশ্য ছিল—মানব মনের দ্বৈততা পরীক্ষা করা। কিন্তু একদিন মীরা নিজের থেরাপিস্টকে হত্যা করে। এরপর ফাইল গোপন রাখা হয়…”

দেবাশীষ চমকে উঠল।
“দুই বোন… তাহলে মায়া আর মীরা সত্যিই আলাদা?”

সে জানালার বাইরে তাকাল।
রাতের আকাশে তখন বজ্রপাত।
বিদ্যুৎ চমকে ঘরের কোণে এক ছায়া নড়ল।

“কে ওখানে?”

নীরবতা।
তারপর ফিসফিস শব্দ—
“তুমি খুব কাছাকাছি চলে এসেছো, দেবাশীষ…”

দেবাশীষ ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল—দরজার পাশে একটা সাদা কাগজ ঝুলছে।
তাতে রক্তে লেখা—
“Don’t separate what was one.”

********

পরদিন সকালে দেবাশীষ এক পুরনো রেকর্ড পেল—অদ্বৈত বসুর মৃত্যু রহস্যজনক ছিল।
ফাইল বলছে—তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন নিজের ক্লিনিকে।
কিন্তু মৃত্যু আগে তিনি রেখে গিয়েছিলেন একটি ভয়েস রেকর্ডিং।

দেবাশীষ সেটি চালাল—

“যদি কেউ এই টেপ শোনে, জেনে রাখ, আমি তাদের থামাতে পারিনি। মায়া ছিল আমার সবচেয়ে সফল সাবজেক্ট, কিন্তু মীরা… মীরা ছিল আমার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সৃষ্টি। সে শুধু আলাদা মানুষ নয়, সে আলাদা মন। এবং তারা একে অপরকে ছাড়া টিকতে পারে না…”

“একজন ভালোবাসে, অন্যজন হত্যা করে। কিন্তু যখন তারা এক হয়, তখন সৃষ্টি হয়—পাগলামির ঈশ্বর।”

রেকর্ডিং হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।

দেবাশীষের বুক ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
“পাগলামির ঈশ্বর…”

********

সেই রাতে আবার ফোন বেজে উঠল।
এক অচেনা নম্বর।

“কে?” দেবাশীষ জিজ্ঞেস করল।
ওপাশ থেকে একটা মেয়ের গলা—নরম, কিন্তু ঠাণ্ডা।
“তুমি অনেক দূর চলে গেছো, দেবাশীষ। এখন ফিরতে পারবে না।”

“তুমি কে?”

“আমি মায়া।”

“অসম্ভব। মায়া মৃত।”

হালকা হাসির শব্দ এল।
“মৃতরা সবসময়ই বেঁচে থাকে, যখন কেউ তাদের বিশ্বাস করে।”

ফোন কেটে গেল।
দেবাশীষ স্ক্রিনে তাকাল—লোকেশন ট্রেস করা গেছে শহরের বাইরে একটা পুরনো থিয়েটারে।

____________________

রাত এগারোটা।
পুরনো রয়াল থিয়েটার, যা দশ বছর ধরে বন্ধ পড়ে আছে।
দেবাশীষ একা ঢুকল হাতে টর্চ নিয়ে।
মঞ্চের পর্দা ছিঁড়ে পড়েছে, চেয়ারে ধুলো, ছাদের ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকছে।

মঞ্চের মাঝখানে একটিমাত্র চেয়ার।
তার ওপর বসে আছে এক মেয়ে—সাদা পোশাক, চুল খোলা, চোখে ছায়া।

“তুমি মায়া?”

সে বলল ধীরে,
“তুমি কেন মনে করো আমি মায়া?”

দেবাশীষ বলল, “কারণ তুমি ওর মতোই দেখতে।”

সে হাসল, “আমি মীরা। কিন্তু কখনও কখনও মায়াও হয়ে যাই। তুমি কি জানো, মানুষের মন এক আয়না? কখনো তাতে প্রতিফলন থাকে, কখনো বাস্তব।”

দেবাশীষ বন্দুক তুলল, “তুমি অর্ণবকে মেরেছো?”

মীরা হেসে বলল,
“না, অর্ণব নিজেকেই মেরেছিল। ও ভেবেছিল মায়াকে বাঁচাবে। কিন্তু মায়া ছিল আমার ভেতরেই।”

তার গলা নেমে এল ফিসফিসে,
“তুমি জানো, দেবাশীষ, আমিও তোমাকে পছন্দ করি। কারণ তুমি সত্যটা খুঁজছো, অথচ জানো না, তুমি নিজেও ওদের মতো।”

দেবাশীষ স্তব্ধ। “মানে?”

মীরা বলল,
“তোমার মাথায় যে আওয়াজটা বাজে, সেটা কি তুমি শুনো না? যে তোমাকে বলে—সব শেষ করো?”

দেবাশীষের হাত কেঁপে উঠল।
মাথার মধ্যে কণ্ঠ বাজল সত্যিই—
“ট্রিগার টানো…”

সে আতঙ্কে বন্দুক ফেলে দিল।

“তুমি কী করছো আমার সঙ্গে?”

মীরা ধীরে এগিয়ে এল, চোখে অদ্ভুত দীপ্তি,
“আমি কিছু করছি না, দেবাশীষ। আমি শুধু তোমার ভিতরের মীরাকে জাগাচ্ছি।”

******

পরের মুহূর্তে হঠাৎ থিয়েটার অন্ধকার।
বিদ্যুৎ চলে গেল।
চোখের সামনে শুধুই কালো।

তারপর মঞ্চের ওপরে একের পর এক লাল আলো জ্বলতে লাগল—স্পটলাইট।
দেয়ালে প্রজেকশন—অর্ণব, মায়া, মীরা—তিনজনের মুখ একটার পর একটা ভেসে উঠছে।
সঙ্গে একটা ভয়েস—

“সবাই একই, শুধু নাম আলাদা। সবখুন একই হাতে, শুধু হাতটা বদলে যায়…”

দেবাশীষের কানে যেন বিস্ফোরণ ঘটল।
সে চিৎকার করল, “থামো!”

কিন্তু আলো নিভে গেল।
তারপর নিস্তব্ধতা।

******

ভোরবেলা থিয়েটারে পুলিশ ঢুকে দেখে—মঞ্চে পড়ে আছে দেবাশীষ রায়ের শরীর।
চারপাশে রক্ত, কিন্তু শরীরে কোনও গভীর ক্ষত নেই।
চোখ খোলা, মুখে অদ্ভুত হাসি।

তার হাতে একটা নোট—

“অন্ধকারের ভিতরেই সত্য আছে।”

আর পাশে, দেয়ালে রক্তে লেখা—
“Next is you.”

*******

সেইদিন বিকেলে শহরের এক হাসপাতালে একজন মহিলা ভর্তি হলেন—
চুল ছোট, চোখে গভীর কালো ঘের, কিন্তু মুখে অদ্ভুত শান্ত ভাব।
ডাক্তারের রেজিস্টারে নাম লেখা হলো—
“ড. মায়া বন্দ্যোপাধ্যায় (Clinical Psychologist)”

তিনি মৃদু হেসে বললেন,
“আমি নতুন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগ দিচ্ছি… কেসগুলো নিয়ে কাজ শুরু করতে চাই।”

আর ঠিক তখনই করিডোরের কোণে এক নার্স ফিসফিস করে বলল,
“ও তো অনেকদিন আগেই মারা গেছে না?”

ডাক্তার হেসে তাকালেন—
“মরা মানেই তো শেষ নয়।”

তার চোখে তখন সেই পুরনো, ভয়ঙ্কর ঝিলিক—
মীরা আবার ফিরে এসেছে।

চলবে..........

#রক্তের_গন্ধ
#মধুমিতা_অধিকারী
#সূচনা_পর্ব

( অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

31/10/2025

রাতটা ছিল প্রচণ্ড ঠান্ডা।
কলকাতার উত্তর দিকের পুরনো এক গলি—নালন্দা লেন, যেখানে দিনের আলোও যেন ঢুকতে ভয় পায়। সারাদিনেই গলিটা নিস্তব্ধ থাকে, কিন্তু রাত নামলে সেখানে এক অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়—কখনো পায়ের আওয়াজ, কখনো হালকা হাসির সুর।

আর সেই গলির মাঝখানে এক পুরনো দোতলা ভাঙাচোরা বাড়ি—“রঞ্জন ভিলা”।
লোকেরা বলে, ওখানে একসময় এক সাইকিয়াট্রিস্ট থাকতেন—ডা. রঞ্জন সেন।
তার মানসিক হাসপাতালটাই ছিল বাড়ির ভেতরেই।
তবে এক রাতে ভয়ংকর কিছু ঘটেছিল, আর তার পর থেকেই বাড়িটা পরিত্যক্ত।

_______________________

রাত ন’টা বাজে।
একটা ট্যাক্সি এসে থামল ওই গলির মুখে। ট্যাক্সি থেকে নামল একজন ছেলে—মাঝ বয়সী, কালো ওভারকোট, চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা।
তার নাম অরণ্য সেন।

সে একজন ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট, মেন্টাল ক্রাইম নিয়ে কাজ করে। পুলিশ প্রায়ই ডাকে কোনো অদ্ভুত খুনের কেসে, যেখানে খুনির মন বোঝাই সবচেয়ে কঠিন।

আজও তাকে ডেকেছে কলকাতা পুলিশ।
কারণ এই “রঞ্জন ভিলা” থেকে গতরাতে একজন মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে—বয়স পঁচিশের কাছাকাছি, কোনো পরিচয়পত্র নেই।
আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো—
মেয়েটার মুখে একটা আয়না গুঁজে দেওয়া ছিল।

*********

ভিলার ভেতরে ঢুকেই অরণ্যর মনে হলো, এই বাড়িটা যেন তাকে গিলে ফেলছে।
বাতাসে ধুলো, দেয়ালে ছত্রাক, আর অদ্ভুত একটা গন্ধ—জীর্ণ ওষুধ, পুরনো রক্ত আর পচা মাংসের গন্ধ মিশে আছে।

ইন্সপেক্টর রুদ্র বলল,
—“দেখুন অরণ্যদা, মেয়েটার নাম-পরিচয় কিছু পাইনি। শুধু এই আয়নাটা... মুখে গুঁজে দেওয়া! মনে হয় কোনো প্রতীকী বার্তা।”

অরণ্য নিচু হয়ে আয়নাটা হাতে নিল।
ছোট, গোল আয়না। পেছনে কিছু লেখা—
“I am not what you see.”

অরণ্যের কপালে ঘাম জমল।
সে বলল,
—“এই লাইনটা মানসিক বিভ্রমের ভাষা। কেউ নিজের সত্তা থেকে পালাচ্ছে।”

রুদ্র অবাক হয়ে তাকাল,
—“মানে খুনি পাগল?”

অরণ্য ধীরে বলল,
—“পাগল নয়... সচেতন পাগল। মানে, সে জানে সে কে, কিন্তু চায় কেউ যেন সেটা জানতে না পারে।”

*****

রাত বাড়ছে।
অরণ্য ভিলার উপরের ঘরে ঢুকল—পুরনো অফিসরুম, টেবিল, ফাইল, নোটবুক সব ছড়ানো।
একটা ডায়েরি পড়ে আছে টেবিলে। কাভারে লেখা—
“রঞ্জন সেন, ১৯৯৮”

সে পাতা উল্টাল—
এক জায়গায় লেখা—

“মানুষের ভেতরে দুই সত্তা থাকে।
এক, যাকে সমাজ দেখে।
দুই, যাকে সে নিজেও ভয় পায়।”

আরও কয়েকটা পাতায় নোট—রোগীর নাম, মানসিক অসঙ্গতি, ভয়ঙ্কর চিকিৎসার নোট...
এক জায়গায় থেমে গেল অরণ্যের চোখ—

“রোগী: অরণ্য সেন”
ডায়াগনোসিস: Split Personality Disorder
Observation: Subject denies treatment. Becomes violent under emotional trigger.”

অরণ্যের হাত কেঁপে উঠল।
—“এটা কীভাবে সম্ভব! আমি... আমি তো সেই সময় দশ বছর বয়সী ছিলাম!”

সে নিজেই নিজের ফাইল দেখছে, অথচ মনে করতে পারছে না কখন সে এই জায়গায় এসেছিল।

____________________

রুদ্র ফিরে এল।
—“কি পেলেন?”

অরণ্য ডায়েরিটা লুকিয়ে ফেলল,
—“কিছু পুরনো রেকর্ড... কাজে আসতে পারে।”

কিন্তু তার মাথায় তখন ঘুরছে একটাই প্রশ্ন—
সে কি সত্যিই কোনোদিন এই বাড়িতে ছিল?
তার স্মৃতিতে যেন একটা ফাঁকা জায়গা আছে, যেখানে আলো ঢোকে না।

সেই রাতেই হোটেলে ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল অরণ্য।
নিজের চোখে তাকাল অনেকক্ষণ।
তার মনে হচ্ছিল—আয়নায় যে মুখটা সে দেখছে, সেটা ঠিক তার নয়।
চোখের ভেতর এক অচেনা হাসি, এক ঠান্ডা কণ্ঠ যেন ফিসফিস করছে—

“তুই আবার ফিরে এসেছিস, অরণ্য?
এখানে কারো মুখ ভেসে থাকে না... শুধু প্রতিবিম্ব।”

সে ভয় পেয়ে আলো নিভিয়ে দিল।
কিন্তু আয়নার ভেতর থেকে শব্দটা থামল না—
হালকা হাসির শব্দ, যেন কেউ ভিতর থেকে তাকে দেখছে।

___________________

পরদিন ভোরে খবর এল—
আরও এক খুন হয়েছে।
একজন যুবক, তার মুখেও গুঁজে দেওয়া একটা আয়না।

অরণ্য দৌড়ে গেল ঘটনাস্থলে।
দেখে চমকে উঠল—যুবকের নাম রুদ্র চক্রবর্তী।
তার সঙ্গী, সেই ইন্সপেক্টর!

তার শরীরে কোনো আঘাত নেই, কিন্তু মুখে সেই আয়না,
আর তার পেছনে রক্তে লেখা—
“He finally saw himself.”

অরণ্যর বুকের ভেতর ধকধক করছে।
মাথার ভেতর কণ্ঠটা আবার শোনা গেল—

“তুই বুঝলি না এখনো?
খুনি তোকে খুঁজছে না, তুই নিজেকেই খুঁজছিস।”

সে চিৎকার করে উঠল,
—“চুপ! তুই কে?”

কিন্তু কণ্ঠটা হাসল—

“তুই-ই আমি, অরণ্য...”

*******

অরণ্য পুলিশের চোখে সন্দেহভাজন হয়ে গেল।
সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইল, কিন্তু তার নিজের স্মৃতিই এখন ফাঁকা।
গতরাত সে কোথায় ছিল? সে জানে না।
তবে তার হাতের আঙুলে রক্তের দাগ!

হঠাৎ সে টের পেল, রঞ্জন ভিলার ঘর থেকে পাওয়া ডায়েরিটা হারিয়ে গেছে।
কেউ সেটা নিয়ে গেছে, অথবা... হয়তো সে নিজেই লুকিয়েছে।

রাতে আবার সে গেল রঞ্জন ভিলায়।
অন্ধকারে টর্চ জ্বালাতেই দেয়ালে দেখা গেল একটা পুরনো পেইন্টিং—
একজন ডাক্তার, চশমা পরা, পাশে দাঁড়িয়ে এক ছোট ছেলেটি—চোখে ভয়ের ছাপ।

নিচে লেখা—
“ডা. রঞ্জন সেন with Patient A.S.”

অরণ্যর বুক কেঁপে উঠল—
A.S. মানে... অরণ্য সেন!

তাহলে কি সে-ই সেই রোগী?
যে একদিন এই বাড়িতে চিকিৎসাধীন ছিল,
আর এখন... সেই বাড়ির ভেতরে খুন করছে নিজেরই অচেনা সত্তা?

*******

ঘড়িতে তখন রাত তিনটে।
বাতাসে কুয়াশা, চাঁদ ঢাকা।
অরণ্য বসে আছে ডা. রঞ্জনের পুরনো অফিসরুমে।
তার হাতে রিভলভার, সামনে সেই আয়নাটা রাখা।

সে নিজের প্রতিবিম্বে তাকাল।
প্রতিবিম্বের মুখে ঠান্ডা হাসি—

“তুইই খুনি, অরণ্য।
আমি নয়, তুই!”

অরণ্যর চোখে জল এসে গেল।
—“আমি পারব না, আমি কাউকে মারিনি।”

“মেরেছিস! তুই সবসময় থেকে গেছে আমার ভেতরে। আমি সেই অন্ধকার, যাকে তুই মানতে চাসনি।”

অরণ্য আয়নার দিকে বন্দুক তুলল—
“তুই মিথ্যে বলছিস!”

ট্রিগার টিপে দিল—
কাঁচ ভেঙে গেল, কিন্তু আয়নার পেছনে কিছু লেখা দেখা গেল—
“Patient Terminated: Split achieved successfully.”

অরণ্য ধীরে ধীরে চেয়ারে হেলান দিল।
তার মুখে রক্ত ঝরছে, ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি।

বাইরে ভোরের প্রথম আলো পড়ছে।
রঞ্জন ভিলার দেয়ালে একটা ছায়া নড়ছে—
একজন মানুষ, যে আয়নায় নেই, কিন্তু বাস্তবে আছে।

_____________________

রুদ্র চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর থানায় যেন শোকের ছায়া।
অরণ্যকে সেই রাতেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল।
কিন্তু প্রমাণের অভাবে ছাড়া দেওয়া হয়।

তবুও সবাই জানে —
“এই খুনগুলোর সঙ্গে অরণ্যের কিছু না কিছু সম্পর্ক আছেই।”

অরণ্য পুলিশ ক্যান্টিনের কোণার টেবিলে বসে আছে, সামনে ঠান্ডা কফির কাপ।
চোখের নিচে ঘুমহীনতার ছাপ।
মাথার ভেতর যেন ক্রমাগত কেউ কথা বলছে, ফিসফিস করছে।

“তুই যা দেখছিস, সবটাই তোর মাথার ভেতর।
কিন্তু বাস্তবও তো তোর মস্তিষ্কের তৈরি, তাই না অরণ্য?”

সে চোখ বন্ধ করল।
হঠাৎ চোখ খুলে দেখল —
তার সামনে বসে আছে একটা মেয়ে।

গাঢ় নীল শাড়ি, লম্বা চুল, মুখে শান্ত ভাব।
“আপনি অরণ্য সেন, তাই তো?”

অরণ্য মাথা নাড়ল।
“আপনি?”

আমি ঈরা চ্যাটার্জি। আমি ডা. রঞ্জন সেনের মেয়ে।”

অরণ্যর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

********

ঈরা বলল ধীরে,
“বাবা মারা যাওয়ার পর এই ভিলাটা আমিই দেখাশোনা করি। কিন্তু সাম্প্রতিক যেসব ঘটনা ঘটছে—মৃতদেহ, আয়না, এসব... সব যেন বাবার পুরনো চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে জড়িত।”

অরণ্য অবাক,
“চিকিৎসা পদ্ধতি মানে?”

ঈরা গভীর শ্বাস নিল,
বাবা মানুষকে ‘মাইন্ড রিফ্লেকশন থেরাপি’ নামের একটা প্রজেক্টে রাখতেন। যেখানে রোগীকে তার নিজের সবচেয়ে অন্ধকার সত্তার মুখোমুখি করানো হত—আয়নার মাধ্যমে। তারা নিজেদের ভেতরের ভয়, রাগ, অপরাধবোধ দেখতে পেত। কিন্তু অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ত।”

অরণ্যর বুকের ভেতরটা মোচড় দিল।
“আমি কি... আমি কি ছিলাম তাদের একজন?”

ঈরা মাথা নিচু করল।
“হয়তো... আপনি ছিলেন ‘Subject A.S.’। আমি আপনার নাম শুনেছি বাবার নোটে। কিন্তু আপনি কেমন করে ফিরে এলেন, সেটা আমি জানি না।”

অরণ্য তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে—
তার চোখে একটা অদ্ভুত দুঃখ, আবার রহস্যও।
ঈরা বলল,
“আমি বাবার সব নথি গোপন রেখেছিলাম। কেউ যেন ব্যবহার না করে... কিন্তু কিছুদিন আগে সেই ফাইলগুলো চুরি গেছে।”

অরণ্য কাঁপা গলায় বলল,
“চুরি? কারা নিয়েছে?”

ঈরা নিচু গলায় বলল,
“একজন রোগী... যে এখনও বেঁচে আছে। আর সে-ই এখন খুনি।”

******

ঈরা অরণ্যকে নিয়ে গেল রঞ্জন ভিলার বেসমেন্টে।
সেখানে ছিল পুরনো রেকর্ডরুম—ধুলো, ছেঁড়া নথি, ওষুধের বোতল, আর দেয়ালে ঝোলানো কয়েকটা আয়না।
প্রতিটি আয়নার সামনে একটা চেয়ার।

ঈরা বলল,
“এগুলোই ছিল বাবার থেরাপি রুম। রোগী বসত আয়নার সামনে, আর বাবা তাকে নিজের ভয় দেখাতেন। বাবার মতে, যদি কেউ নিজের ভেতরের অন্ধকারকে চিনতে পারে, সে সুস্থ হতে পারে।”

অরণ্য তাকিয়ে রইল আয়নাগুলোর দিকে।
তার মনে পড়ল—একটা বাচ্চা ছেলে কাঁদছে, ডা. রঞ্জন তার সামনে বসে বলছেন—

“তুই ভয় পাবি না অরণ্য, আয়নায় তাকিয়ে থাক... তোর ভেতরের দানবকে চিনে নে।”

অরণ্য হাঁফ ছাড়ল।
“ঈরা, আমার মনে হয় আমি সেই রোগীই ছিলাম। কিন্তু... আমি খুনি নই।”

ঈরা ধীরে বলল,
“হয়তো তুমিই খুনি নও। কিন্তু তোমার ভেতরের যে অন্য সত্তা আছে, সে-ই খুনি।”

অরণ্যের চোখে বিস্ময়।
“মানে, আমার ‘অল্টার পার্সোনালিটি’?”

ঈরা মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ। Split personality disorder। বাবা তোমার থেরাপি বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কারণ তোমার আরেক সত্তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।”

******

সেই রাতেই অরণ্য একা বসেছিল তার ফ্ল্যাটে।
দরজা বন্ধ, জানালায় পর্দা।
হঠাৎ টেবিলের ওপর রাখা আয়নাটা নিজে থেকে কাঁপতে লাগল।

সে কাছে গেল।
আয়নায় নিজের মুখ দেখল, কিন্তু প্রতিবিম্বের ঠোঁট নড়ছে—

“তুই বিশ্বাস করলি মেয়েটাকে? ঈরাকে?”

অরণ্য পেছনে ঘুরল। কেউ নেই।
আয়নার ভেতর থেকে আবার কণ্ঠ—

“ঈরা তোকে ব্যবহার করছে, অরণ্য। সে-ই আসল খুনি।”

অরণ্য মাথা নাড়ল, “না, না...”

“হ্যাঁ। ঈরা জানে, তুই কে ছিলি। তোর ভেতরের আমি-কে জাগিয়ে তুলতে চায় সে।”

অরণ্য ভয় পেয়ে আয়নাটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলল।
ভাঙা টুকরোগুলোর প্রতিটায় সে দেখল নিজের মুখ —
কখনো হাসছে, কখনো কাঁদছে, কখনো রক্তে ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকেই।

********

পরদিন ভোরে ঈরা ফোন করল, কাঁপা গলায় বলল,
“অরণ্য, তাড়াতাড়ি এসো! কেউ বাবার রুমে ঢুকে গেছে।”

অরণ্য ছুটে গেল রঞ্জন ভিলায়।
দরজার ভিতরে একটাই দৃশ্য —
দেয়ালে রক্তে লেখা নাম—
“ঈরা”

আর নিচে পড়ে আছে একটা আয়না।
তাতে ঈরার মুখ প্রতিফলিত হচ্ছে, কিন্তু তার চোখ বন্ধ।
সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, নিঃশ্বাস খুব হালকা।

অরণ্য তাকে বাঁচাতে দৌড়ালো, কিন্তু আয়নার প্রতিফলনে আবার সেই ভয়ংকর মুখ—
তার নিজেরই অন্য সত্তা, রক্তাক্ত ঠোঁটে হাসছে।

“দেখলি তো, আমি এসেছি।”

ঈরা মৃদু গলায় বলল,
“অরণ্য... আমি জানি, ও তোর ভেতরেই আছে। তাকে আটকাও... না হলে সবাই মরবে।”

******

ঈরা সুস্থ হওয়ার পর দু’জন ঠিক করল রঞ্জন সেনের পুরনো ল্যাবটা খোলা হবে।
সেখানে হয়তো উত্তর আছে।
তারা মেঝের নিচে এক লোহার দরজা পেল, খুলে ঢুকতেই বাতাসে ছত্রাক আর রাসায়নিকের গন্ধ।

ভেতরে ফাইল, রেকর্ডার, ক্যামেরা সব ছড়ানো।
একটা পুরনো রেকর্ড প্লেয়ার চালাতেই রঞ্জন সেনের কণ্ঠ বাজল—

“আজ ২১শে জুলাই, ২০০১। রোগী ‘A.S.’ এখনো ভ্রান্তি আর বাস্তবের সীমা আলাদা করতে পারে না।
আমি বাধ্য হচ্ছি তাকে নতুন থেরাপির আওতায় আনতে। যদি এ ব্যর্থ হয়... Split সম্পূর্ণ হবে।”

ঈরা থেমে গেল।
“মানে, তুমি তখনই বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলে। তোমার আরেক সত্তা তৈরি হয়েছিল।”

অরণ্যর চোখ জলে ভরে গেল।
“তাহলে সেই সত্তা কি এখনো বেঁচে আছে?”

ঈরা গম্ভীর স্বরে বলল,
“হ্যাঁ, হয়তো সে-ই এই খুনগুলো করছে।”

হঠাৎ পেছন থেকে শব্দ—
কেউ ধীরে ধীরে হাততালি দিচ্ছে।

অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল এক মানুষ—
চুলে পাক, চোখে উন্মাদ হাসি।
“বাহ! আমার ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট এখনো চলছে।”

অরণ্য থমকে গেল—
“ডা. রঞ্জন সেন!”

ঈরা চমকে উঠল—
“বাবা! তুমি... তুমি তো মারা গিয়েছিলে?”

রঞ্জন ঠান্ডা স্বরে বলল,
“মরা? না, আমি কখনো মরি না। আমি আমার সৃষ্টি হয়ে বেঁচে আছি—অরণ্যের ভেতরে।”

******

অরণ্যর মাথা ঘুরছে।
সে চিৎকার করে উঠল, “তুমি আমার মাথায় ঢুকেছিলে! আমার ভেতরে কে?”

রঞ্জন এগিয়ে এসে বলল,
“তুই-ই তো আমি, অরণ্য। আমি তোকে তৈরি করেছি। তুই সেই নিখুঁত মন, যেখানে যুক্তি আর উন্মাদনা একসাথে থাকে।”

ঈরা কাঁদছে, “না বাবা, তুমি যা করেছিলে তা চিকিৎসা ছিল না, সেটা নির্যাতন ছিল!”

রঞ্জন ঠান্ডা হাসল,
“মানুষের মনের অন্ধকার যদি আলাদা না করো, সে কখনো সুস্থ হবে না। অরণ্য, তুই আমার প্রমাণ।”

অরণ্যর চোখের ভেতর তখন এক অদ্ভুত বদল।
সে রিভলভার তুলল—
“তুমি আমাকে নষ্ট করেছো... এখন আমি মুক্ত হবো।”

রঞ্জন বলল,
“তুই পারবি না, কারণ তুই এখনো আমার নিয়ন্ত্রণে।”

অরণ্য বন্দুক তাক করল তার মাথায়, কিন্তু আঙুল কাঁপছে।
ঈরা চিৎকার করল,
“অরণ্য! ওকে মারো না, তুই ওর মতো হয়ে যাবি!”

অরণ্য চোখ বন্ধ করল, ট্রিগার টিপল—
একটা গুলির শব্দ, তারপর নিস্তব্ধতা।

******

যখন ঈরা চোখ খুলল, দেখল রঞ্জন মেঝেতে পড়ে আছে, মাথা থেকে রক্ত ঝরছে।
অরণ্য মেঝেতে বসে কাঁদছে, মুখে ফিসফিস করছে,
“আমি ওকে মেরেছি... কিন্তু এখন আমি কে?”

ঈরা এগিয়ে এসে আয়নাটা তুলল।
তাতে অরণ্যের মুখ দেখা যাচ্ছে—
একটা শান্ত মুখ, কিন্তু পেছনে দেখা যাচ্ছে আরেকটা ছায়া।

সে ছায়াটা ধীরে ধীরে আয়নার ভেতর হাসল।

তুই ভাবছিস খেলা শেষ?
এখন আসল শুরু।”

আয়নাটা হঠাৎ ফেটে গেল, ঘরটা অন্ধকারে ডুবে গেল।

______________________

ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে।
অরণ্য চোখ খুলল—চারপাশে সাদা দেয়াল, অক্সিজেনের শব্দ, পাশে ঈরা বসে আছে।

“তুমি তিন দিন ধরে অচেতন,” ঈরা বলল কাঁপা গলায়।
“পুলিশ রঞ্জন সেনের দেহ পেয়েছে। সবাই বলছে তুমি খুনি।”

অরণ্য চুপ।
তার চোখ ফাঁকা—না ঘুমন্ত, না জাগ্রত।
“ঈরা... আমি জানি না আমি কী করেছি।”

ঈরা হাত ধরল,
“তুমি অসুস্থ। তোমার মস্তিষ্ক এখনো অতীত আর বর্তমান আলাদা করতে পারছে না। আমি তোমাকে সাহায্য করব, ঠিক আছে?”

অরণ্য মাথা নাড়ল।
“ঈরা, আমি কিছু দেখতে পাই মাঝে মাঝে… আয়নায়… যেন আমি নই, আরেকজন তাকিয়ে আছে।”

ঈরা বলল, “তুমি বিভ্রম দেখছো, অরণ্য। ওটা তোমার মস্তিষ্কের ভেতর জমে থাকা দমন করা স্মৃতি।”

কিন্তু অরণ্যের মনে হচ্ছিল, কেউ যেন হাসপাতালের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
কালো কোট, সাদা দস্তানা, মুখে পরিচিত হাসি…

“তুই বেঁচে আছিস, তাই না অরণ্য?”

অরণ্য চোখ বুজল, কিন্তু কণ্ঠটা থামল না।

********

ঈরা পরদিন সকালে তাকে একটা পুরনো অ্যালবাম দেখাল—
“এই ছবিগুলো আমার বাবার সঙ্গে তোমার ছোটবেলার। তুমি আসলে এখানেই ছিলে প্রায় এক বছর।”

ছবি দেখেই অরণ্যের হাত কেঁপে উঠল।
একটা ছবিতে সে—ছোট্ট, ভীত মুখে বসে আছে আয়নার সামনে।
ডা. রঞ্জন পেছনে দাঁড়িয়ে বলছেন—

“তুই দেখবি নিজেকে, তুই চিনবি নিজের শত্রুকে।”

অরণ্য গলা শুকিয়ে গেল।
“ঈরা… আমি মনে করতে পারছি কিছু কিছু। এক রাতে আমি চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। কেউ আমার মাথায় ইনজেকশন দিয়েছিল।”

ঈরা বলল,
বাবা তোমার ওপর ট্রায়াল চালাতেন। তুমি ছিলে একমাত্র রোগী যাকে তিনি ‘ডুয়াল সেলফ থেরাপি’ দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এক মানুষ থেকে দুই মনের জন্ম দিতে।”

অরণ্য স্তব্ধ।
“তাহলে... আমার ভিতরের অন্য মানুষটা, সে-ই খুনি?”

ঈরা ধীরে বলল,
“হয়তো। কিন্তু এখন তোমার দরকার থেরাপি—নিজের অবচেতনে প্রবেশ করে তাকে খুঁজে বের করা। না হলে সে তোমাকে পুরোপুরি দখল করবে।”

******

ঈরা অরণ্যকে নিয়ে গেল এক অদ্ভুত ঘরে—
চারদিক আয়নায় ঢাকা, মাঝখানে একটা চেয়ার।
আলো নরম লালচে, ঘরে গন্ধ ক্লোরোফর্মের মতো।

ঈরা বলল,
“এটা ‘মাইন্ড রিট্রেস থেরাপি’। তুমি চোখ বন্ধ করবে, আমি তোমাকে ঘুমে নিয়ে যাব।
যেখানে তোমার অবচেতন খুনির মুখটা দেখাবে।”

অরণ্য বসে পড়ল।
ঈরা ধীরে ধীরে তার চোখে ইনফ্রা লাইট ফেলল।
অরণ্যের নিঃশ্বাস ধীর হয়ে এলো, তারপর সে যেন অন্য জগতে ঢুকে গেল।

******

চারপাশ অন্ধকার।
শুধু আলো একটা রাস্তার বাতির নিচে।
অরণ্য দেখল সে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরনো শহরে—নালন্দা লেন, কিন্তু রক্তে ভেজা।
প্রতিটি দেয়ালে লেখা “I AM YOU.”

দূরে এক মানুষ হাঁটছে—
চেনা কণ্ঠ, চেনা চলন।
অরণ্য দৌড়ে গেল—
দেখল তার নিজেরই মুখ, কিন্তু চোখে শূন্যতা।

“তুই কে?” অরণ্য চিৎকার করল।

অন্য অরণ্য হেসে বলল,
“আমি তোর সেই অংশ, যাকে তুই মেরে ফেলেছিলি আয়নার সামনে।”

“আমি কাউকে মারিনি!”

মেরেছিস, রুদ্র, মেয়েটা, তোরই হাতে।
তুই ভাবছিস আমি করেছি, কিন্তু তুই-ই আমি।”

অরণ্যের বুক কেঁপে উঠল।
“আমি এসব করিনি!”

অন্য অরণ্য আয়নার দিকে তাকাল।
“তুই মনে করিস না? ছোটবেলায় তুই তোর বাবাকে খুন করতে চেয়েছিলি—ডা. রঞ্জনকে। কারণ সে তোকে আয়নায় বাঁধতে চেয়েছিল।”

চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে গেল।
একটার পর একটা দৃশ্য ভেসে উঠছে—
রক্ত, চিৎকার, শিশুর কাঁদা, আর একজন মানুষ ইনজেকশন দিচ্ছে।

*****

অরণ্য চিৎকার করে উঠে বসল।
ঈরা তার সামনে—
“তুমি ঠিক আছো?”

অরণ্য হাঁপাচ্ছে, ঘামে ভিজে গেছে।
“আমি দেখেছি… ঈরা, আমি দেখেছি কে খুনি।”

“কে?”

“আমি।”

ঈরা স্তব্ধ।
“মানে?”

“আমি আর আমি নই। আমার ভেতরের অন্য অরণ্য—সে-ই খুনি। কিন্তু আমি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।”

ঈরা বলল,
“তাহলে আমাদের তাকে আলাদা করতে হবে। না হলে সে তোমাকে মেরে ফেলবে।”

অরণ্যর চোখে ভয়।
“ঈরা, আমি যদি সত্যিই তাকে মেরে ফেলি, তাহলে আমি কি বাঁচব?”

ঈরা শান্ত গলায় বলল,
“যে বাঁচে, সে সবসময় নিজের ছায়াকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচে। কিন্তু তোর ছায়াটা এখন তোর রক্ত চায়।”

******

সেই রাতে ঈরা ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু অরণ্য পারল না।
সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
আয়নায় দেখা যাচ্ছে ঘরের আলো নিভে যাচ্ছে, কিন্তু তার প্রতিবিম্ব অন্ধকারে উজ্জ্বল।

“তুই ভেবেছিস ঈরা তোকে বাঁচাবে?”

অরণ্য চমকে উঠল।
“তুই আবার কেন এলি?”

“কারণ আমি এখন মুক্ত। তুই যতই ঘুমো, আমি ততই জেগে উঠি।”

“আমি তোকে মারব!”

“তুই নিজেকেই মারবি?”

প্রতিবিম্ব হেসে উঠল, আর আয়না হঠাৎ তরল হয়ে গেল।
অরণ্যর হাত তার ভেতরে ঢুকে গেল, যেন আয়নার ভেতর এক অচেনা দুনিয়া।
সে চিৎকার করল, কিন্তু সেই হাত তাকে টেনে নিল ভিতরে।

*****

সবকিছু উল্টে গেছে।
এখানে ঈরার মুখ বিকৃত, হাসি ভয়ংকর।
ডা. রঞ্জন এখনও বেঁচে, এবং তিনি অরণ্যর মাথায় যন্ত্র লাগাচ্ছেন।

“দেখলি, আমি বলেছিলাম। মানুষকে নিজের ভয় চিনতে হয়।”

অরণ্য চেঁচিয়ে উঠল,
“তুমি আমার জীবন নষ্ট করেছো!”

রঞ্জন হাসল,
“না অরণ্য, আমি তোকে সৃষ্টি করেছি।”

হঠাৎ রক্তে লেখা একটা লাইন দেখা গেল দেয়ালে—
“TO KILL ONE SELF IS TO BE REBORN.”

অরণ্যর কানে গুঞ্জন—

“তুই যদি সত্যিই মুক্তি চাস, আয়নার ভেতরের নিজেকে শেষ কর।”

সে রিভলভার তুলল।
প্রতিবিম্ব হাসছে, বলছে,

“চালিয়ে দে ট্রিগার, কিন্তু মনে রাখ—আমি মরলে তুইও মরবি।”

অরণ্য ফিসফিস করে বলল,
“মৃত্যু যদি মুক্তি হয়, আমি তৈরি।”

ট্রিগার টিপল।
একটা বিস্ফোরণ, আর চারপাশ অন্ধকার।

*****

একটা আলো ধীরে ধীরে জ্বলল।
ঈরা হাসপাতালের করিডরে দাঁড়িয়ে, হাতে মেডিক্যাল রিপোর্ট।
অরণ্য বিছানায় নিস্তব্ধ।
মেশিনে ফ্ল্যাট লাইন।

ঈরার চোখ বেয়ে অশ্রু পড়ল।
সে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি পারলে, অরণ্য। তুমি অবশেষে নিজেকে মুক্ত করলে।”

কিন্তু ঘরের কোণে রাখা আয়নাটা হঠাৎ কেঁপে উঠল।
একটা ছায়া ফুটে উঠল তাতে—
অরণ্যের মুখ, ঠোঁটে হালকা হাসি।

“আমি তো বলেছিলাম, আমি মরি না... আমি তো তোরই ভেতরে আছি, ঈরা।”

ঈরার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
তার চোখে প্রতিফলিত হলো সেই একই অরণ্য—
কিন্তু এবার সে আয়নার ভেতর থেকে নয়, বাস্তবেই সামনে দাঁড়িয়ে।

*****

এক বছর পর।
“রঞ্জন মেন্টাল ইনস্টিটিউট”-এর নতুন প্রধান ডা. ঈরা সেন।
তিনি নতুন এক থেরাপি শুরু করেছেন—
‘Mirror Personality Reconstruction’

রোগীরা বসে থাকে আয়নার সামনে,
ঈরা বলে,
“নিজের ছায়াকে চিনো। ওটাই তোমার আসল তুমি।”

একদিন এক নার্স চুপিচুপি দেখল—ঈরা নিজের ঘরে আয়নার সামনে বসে কারও সঙ্গে কথা বলছে।

“আজ আবার দেখা হলো, তাই না অরণ্য?”

“সব ঠিক আছে, ঈরা। এবার তুই আমার মতো হয়ে যাচ্ছিস।”

ঈরা ঠোঁটে হাসি টানল, চোখের কোণে অশ্রু।
আয়নায় তার পাশে অরণ্য দাঁড়িয়ে,
আর দুজনের মুখে একই হাসি।

_________ সমাপ্ত_______

#মনস্তাপ
#মধুমিতা_অধিকারী

( অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ⚠️⚠️ আচ্ছা #মনস্তাপ গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো????🤧 আপনারা অনেকেই ছোট গল্প পড়তে ভালোবাসেন তাদের জন্য এই গল্পটা বিশেষ করে লেখা ❤যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই লাইক কমেন্ট ও শেয়ার করতে ভুলবেন না আর এত সুন্দর গল্প পেতে আমাকে অবশ্যই ফলো করে রাখবেন গল্পটি যদি আপনাদের পছন্দ হয় মন্তব্য জানাতে একদমই ভুলবেন না। আপনাদের সারা আমাকে অনুপ্রাণিত করে ধন্যবাদ🙏)

Address

Bangaon

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Mahi's Vlog posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share