20/08/2025
হীরক দেশের রাজা। স্বৈরশাসক, কৌতুকপ্রবণ, উৎপীড়ক। এমন একটি জটিল চরিত্রে উৎপল দত্ত ছাড়া আর কাউকে কি ভাবা যায়? সত্যজিৎ রায় অন্তত আর কাউকে ভাবতে পারেননি।
কারণ উৎপল দত্তের মতো জবরদস্ত অভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্রের ভুবনে সে সময় আর তেমন কেউ ছিলেন না। ‘হীরক রাজার দেশে’র রাজা, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’এর মগনলাল মেঘরাজ, ‘আগন্তুক’ এর মনোমোহন মিত্র, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিয়া, ‘অমানুষ’ এর মহিম ঘোষাল, ‘দো আনজানে’র চিত্র পরিচালক, ‘জনঅরণ্যে’র বিশুদা এমনি কত চরিত্রেই না অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি।
বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে যেমন ছিলেন অপরিহার্য তেমনি তিনি ছিলেন মঞ্চের শক্তিমান অভিনেতা, নির্দেশক, নাট্যকার।
উৎপল দত্তর জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ বরিশালে। মৃত্যু ১৯৯৩ সালের ১৯ অগাস্ট কলকাতায়। শিলংয়ে তার শৈশব কেটেছে। পরবর্তীতে লেখাপড়া করেছেন কলকাতায়। সেন্ট জেভিয়ার্সের মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি।
ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ছিলেন। সে সময়ই শেক্সপিয়রের সৃষ্টিকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। ইংরেজি নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমেই তার অভিনয়জীবন শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য শেক্সপিয়ারিয়ান্স’ নাট্যদল। এ দলের প্রথম প্রযোজনা ছিল ‘রিচার্ড থার্ড’। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন উৎপল দত্ত। তার অভিনয় দেখে শিল্পী দম্পতি জিওফ্রি কেন্ডাল এবং লরা কেন্ডাল মুগ্ধ হন। একসঙ্গে তারা নাট্যদল নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদশর্ন করেন শেক্সপিয়রের বিভিন্ন নাটক। ‘ওথেলো’সহ বিভিন্ন নাটকে তার অভিনয় সর্বভারতীয় খ্যাতি এনে দেয়।
দেশবিভাগের পর এই দম্পতি ভারত ছেড়ে গেলে উৎপল দত্ত তার নাট্যদলের নাম রাখেন ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’।এই দল শেক্সপিয়রের নাটকের পাশাপাশি ইবসেন, বার্নার্ড শ, রবীন্দ্রনাথ, কনস্তানতিন সিমোনভ, ব্রেশ্ট, গোর্কির নাটক মঞ্চায়ন করে। পরবর্তিতে নাট্যদলটি বাংলা নাটকের দিকে ঝোঁকে। উৎপল দত্ত শেক্সপিয়র ও ব্রেশ্টের অনেক নাটক বাংলায় অনুবাদ করেন। অবশ্য এর পাশাপাশি তিনি পেশাদারী মঞ্চেও অভিনয় করতেন। তিনি মিনার্ভাতে অভিনয় করতেন। পরবর্তীতে পেশাদারী মঞ্চ ছেড়ে গণনাট্য, পথনাটক, যাত্রা, গ্রাম থিয়েটার ও শিল্প ধারার চলচ্চিত্রে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন।
আজীবন বামপন্থী ও মার্কসবাদী উৎপল দত্ত গণনাট্য সংঘের সক্রিয় সদস্য হিসেবে পঞ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে নাটক প্রদর্শনে অংশ নেন। শুধু অভিনেতা হিসেবেই নয় নির্দেশক ও নাট্যকার হিসেবেও তিনি ছিলেন অনবদ্য। তার লেখা সফল মঞ্চ নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘মে দিবস’, ‘মানুষের অধিকার’, ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’, ‘মাও সে তুং’, ‘পুরুষোত্তম’, ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’, ‘অজেয় ভিয়েতনাম’, ‘লাল দুর্গ’, ‘মহাবিদ্রোহ’, ‘সূর্য শিকার’,‘কল্লোল’ ‘জনতার আফিম’,‘রক্তাক্ত ইন্দোনেশিয়া’ ‘টিনের তলোয়ার’‘লেনিন কোথায়’, ‘তিতুমির’ ‘আজকের শাহজাহান’, ইত্যাদি। নাটকের মধ্যে মূলত তিনি সাম্যবাদী আদর্শ তুলে ধরেন এবং গণবিপ্লবের জন্য প্রেরণা সৃষ্টি করেন। তিনি ‘ব্রেশ্ট সোসাইটি’ গঠন করেন। বিখ্যাত অনেক বিদেশি নাটক বাংলায় রূপান্তর করেন। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি ছিলেন পশ্চিম বাংলার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।
মঞ্চের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করতে থাকেন তিনি। ১৯৫০ সালে ‘বিদ্যাসাগর’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তার যাত্রা শুরু হয়। ‘মাইকেল মধুসূদন’ ছবিতে নাম ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নিজের আসন পাকা করেন।
বাণিজ্যিক ছবিতে মূলত তিনি নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি পান। পাশাপাশি শিল্প ধারার ছবিতেও অভিনয় করেন। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় মৃণাল সেন পরিচালিত ‘ভুবন সোম’। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। হিন্দি ছবিতে কমেডি চরিত্রে দারুণ জনপ্রিয়তা পান উৎপল দত্ত। কমেডি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ‘গোলমাল’(১৯৮০), ‘নরম গরম’(১৯৮২) ও ‘রঙ বিরঙ্গি’(১৯৮৭) ছবির সুবাদে তিন বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান। ‘সাহেব’(১৯৮৬) ছবিতে অভিনয়ের জন্য পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পান ফিল্মফেয়ার আসরে।
১৯৯৩ সালে সত্যজিৎ রায়ের 'আগন্তুক' ছবিতে অভিনয়ের জন্য পান বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেরা অভিনেতার পুরস্কার। থিয়েটারে অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে সংগীত নাটক অ্যাকাডেমির ফেলোশিপ পান।
হিন্দি ও বাংলা বাণিজ্যিক ছবিতেও তিনি ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ‘আগমন’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘অমানুষ’, ‘গুড্ডি’, ‘শৌখিন’, ‘বারসাত কি এক রাত’, ‘চৌরঙ্গি’, ‘শেষ অংক’, ‘ইনকিলাব’, ‘কিসিসে না কেহনা’, ‘হামারি বহু অলকা’, ‘প্রিয়তমা’, ‘আপনে পারায়ে’, ‘জুলি’, ‘দ্য গ্রেট গ্যাম্বলার’, ইত্যাদি অসংখ্য হিন্দি ও বাংলা ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন এই অভিনেতা। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘অবিচার’-এ খলচরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন তিনি। গৌতম ঘোষ পরিচজালিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি' সিনেমাতেও তার অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্ক আর গপ্পো’ , সত্যজিৎ রায়ের ‘জনঅরণ্য’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। আর ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে হীরক রাজার ভূমিকায় তার অভিনয় বাংলা চলচ্চিত্রের সম্পদ।
‘সপ্তপদী’ ছবিতে 'ওথেলো' নাটকের দৃশ্যে উত্তম কুমার অভিনীত কৃষ্ণেন্দু চরিত্রের নেপথ্য কণ্ঠ ছিল উৎপল দত্তের। কারণ ‘ওথেলো’ নাটকে সে সময় তার বিকল্প অন্য কাউকে ভাবাই যেত না।
উৎপল দত্ত ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সমর্থক। তিনি উন্মুক্ত মঞ্চ ও পথ নাটক আন্দোলনের সক্রিয় উদ্যোক্তা ছিলেন। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি ‘কল্লোল’ নামে নাটক লেখেন। নাটকটির মাধ্যমে গণবিদ্রোহকে উৎসাহিত করা হচ্ছে এই অভিযোগে কংগ্রেস সরকারের কোপানলে পড়ে তাকে জেলে যেতে হয় ১৯৬৫ সালে। বেশ কয়েক মাসের কারাবাস হয় তার। কারাবন্দী অবস্থাতেও নাটক লেখা চালিয়ে যান তিনি।
নাটককে গণমুখী করার জন্য তিনি পথনাটক শুরু করেন। যাত্রাপালার নব জাগরণ আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। গণ সচেতনতামূলক অনেক যাত্রাপালা লেখেন তিনি এবং এসব পালায় অভিনয় করেন। পঞ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামে তিনি গণ জাগরণমূলক যাত্রাপালা ও নাটকে অভিনয় করেন, নির্দেশনা দেন।
বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেন তিনি। তার পরিচালিত সিনেমার মধ্যে ‘মেঘ’(১৯৬১), ‘ঘুম ভাঙার গান’(১৯৬৫), ‘ঝড়’ (১৯৭৯), ‘বৈশাখী মেঘ’(১৯৮১), ‘ইনকিলাব কি বাদ’(১৯৮৪) উল্লেখযোগ্য।
১৯৯৩ সালের ১৯ অগাস্ট ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার।
উৎপল দত্ত উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ও মঞ্চের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তার কালজয়ী সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে।
#সংগৃহীত