15/10/2025
ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা অমিতা, তখন গুরুপল্লীর বাসিন্দা তাঁর লেখায় আছে, ‘বাড়ির জানলা দিয়ে কতদিন দেখেছি মাঠের মধ্যে দিয়ে মোহর ছুটছে গুরুদেবের কাছে। রাস্তা দিয়ে যেত না, পাছে দেরি হয়ে যায়। মাঠের কাছে একটা বনপুলকের গাছ ছিল। বসন্তে ফুল ফুটলে গন্ধে চারদিক ভরে উঠত। তার তলা দিয়ে মোহর দৌড়োচ্ছে, ....'
রবীন্দ্রনাথ সেদিন কাছে ডেকে পরম স্নেহে জিজ্ঞেস করেছিলেন গান জানিস? শান্তিনিকেতনের আকাশে ঘন কালো মেঘের বিকেলে এক পশলা বৃষ্টিতে দুই বান্ধবী ঠিক করেছে ঝড়ে আম কুড়োবে। বৃষ্টির বেগটা বেশ বেড়েছে, হয়ত একটু পরে থামবে,দুই বান্ধবী দৌড়ে গেল মাটির বাড়ি 'শ্যামলী'র দিকে। তখন নজরে পড়লেন তিনি। লিখতে লিখতে তার মধ্যে ডুবে আছেন। শুধু যেন ঝড় বৃষ্টির দিকে তাকিয়েছেন, কিন্তু কিছু দেখছেন না।
গান শুনতে চাইলেন 'শ্যামলী'তে লিখতে থাকা মানুষটা। খুশিতে ডগমগ কন্যাটি সাথে সাথে গান শুনিয়ে দিলেন। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান শুনতে চেয়েছেন তাতেই ডগমগ । গুরুদেব কে শুনিয়েছিলেন সদ্য শেখা একখানা গান। রবীন্দ্রনাথ খুশি হয়ে নাম জিজ্ঞেস করলেন,কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে কন্যাটি ভাল নাম বলতেন, বললেন তাঁর নাম অণিমা মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাবার নাম জেনে বললেন তুমি আমাদের সত্যচরণের মেয়ে।তাই মাঝে মাঝে গান শুনিয়ে যেয়ো আমাকে।
কালবৈশাখীর এক বিকেলের এক টুকরো ঘটনা অনেকটা পাল্টে দিল মেয়েটির জীবন।ছুটে চলে গেল গুরুপল্লীর দিকে, ততক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে বন্ধুটি ডাকছে পেছন থেকে এই মোহর আম কুড়োবি না?
বন্ধুর ডাক শুনে কন্যাটি তখন ভাবছে কেন তাঁর ডাক নামটা রবীন্দ্রনাথ কে বললেন না।আবার ভাবতে লাগলেন ভাগ্যিস বলেন নি। 'অণিমা' বলেছেন বলেই উনি নাম পাল্টে 'কণিকা' করে দিয়েছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথের কথা কিংবা শুধু সুর নয় তাঁর দেওয়া নামটা বয়ে নিয়ে নিয়ে পথ চলেছেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁর জীবন রবি -কণিকাতেই ভরে উঠেছিল,সেই ভরে ওঠার সূচনা যেন হয়েছিল সেই কালবৈশাখীর সন্ধ্যায়।
প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন " পঞ্চাশের দশকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে আমাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র ও রাজেশ্বরী দত্ত। শুধু গুণ নয় রূপের জন্যও এই তিনজন কে বলা যায় থ্রি গ্ৰেসেস।" সুনীলের কথায় কণিকা রাজেশ্বরী থাকতেন অন্তরালে কিন্তু সুচিত্রা জনসভায়, মিছিলে অংশগ্ৰহন করে মাতিয়ে রাখতেন জনসাধারণ কে।
এইচ এম ভি'র উদ্যোগে ১৯৬২ সালে শিল্পীদের নিয়ে জনসাধারণের মনে উদ্দীপনা জাগাতে লরিতে বসে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গান গাওয়া হয়। যথা সময়ে শিল্পীরা এসেছেন। সমস্যা দেখা দেয় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে। তিনি কিভাবে লরিতে উঠবেন!কেউ পিছন থেকে ঠেলে,কেউ ওপর থেকে হাত ধরে টানে কিন্তু মোহর বন্দ্যোপাধ্যায় লরিতে আর উঠতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত কেউ একজন একটা টুল তার উপরে একটা মোড়া পেতে জোর করে ঠেলে তাঁকে লরির উপরে উঠিয়ে দিলেন। খুব হাসাহাসির ব্যাপার, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় লজ্জায় একশা। হঠাৎ অন্য লরির দিকে তাকিয়ে মোহর দেখলেন সুচিত্রা মিত্র এসে দাঁড়িয়েছেন। এবং চোখের পলকে কারও সাহায্য ছাড়াই লরিতে উঠে পড়লেন।
আজীবন যিনি মনে করেছেন, রবীন্দ্রনাথের গান তিনি গাইতেন না, নিবেদন করতেন। যেন রবীন্দ্রনাথই তাঁকে দিয়ে গানগুলি গাইয়ে নিচ্ছেন এমনই মনে হত তাঁর।শান্তিনিকেতনের ইতিহাসের যে পর্বে মোহরের জন্ম হয়েছিল, তা ছিল রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের শান্তিনিকেতন পর্ব। তখন তিনি তাকে ‘বিশ্বভারতী’তে বদলে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিলেন। আজ শান্তিনিকেতনে সবার প্রিয় 'মোহরদি' অর্থাৎ কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিবসে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।।
সংকলনে ✍🏻 অরুণাভ সেন।।
#সংগৃহীত
পুস্তক ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার, আনন্দধারা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্ধেক জীবন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,শান্তিনিকেতনের আকবরী মোহর, সুদেষ্ণা বসু, আনন্দবাজার কম
ছবি,পরিমল গোস্বামী, সৌজন্য আনন্দবাজার পত্রিকা