29/07/2025
প্রায় ১৫০০ বছরের পুরোনো এই মূর্তিগুলি ই পাওয়া গেছিল কিছু দিন আগে সুরথেশ্বর, শিব তলার গর্ভগৃহ সংস্কারের সময়।
এর ইতিহাসটি একটু বিস্তারিত আলোচনা করি।
রাজা সুরথকে চৈত্রী বা চিত্রগুপ্তের বংশধর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে দুর্গা সপ্তশতী দেবী মাহাত্ম্য এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণে। তিনি তাঁর রাজ্য এবং সমস্ত সম্পত্তি হারিয়ে নিজের ভাগ্য ফেরাতে রাজধানী বলিপুর ত্যাগ করেন। পরে বণিক সমাধি বৈশ্যের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। যিনিও সেই মুহূর্তে সব হারিয়ে দেউলিয়া। বৈশ্য সৌভাগ্যক্রমে মেধস মুনির আশ্রমে যেতে মেধস ঋষি তাঁদের ভাগ্য ফিরে পাওয়ার জন্য তাঁদের দেবী দুর্গার পুজো করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই সুরথ নামক ধার্মিক, প্রজাবৎসল রাজা যে তাঁর প্রজাদিগকে নিজের ঔরসজাত পুত্রের ন্যায় প্রতিপালন করতেন সে উল্লেখও রয়েছে শ্রী শ্রী চণ্ডীর প্রথম অধ্যায় "মধুকৈটভ বধে”। সেইসময় কোলাবিধ্বংসী (শূকর হত্যাকারী) যবন নরপতিগণ রাজা সুরথের রাজ্য আক্রমণ করলে তখন তাঁর প্রজাবর্গ সব পূর্ব কথা বিস্মৃত হয়ে রাজার শত্রু হল।
"তস্য পালয়তঃ সম্যক্ প্রজাঃ পুত্রানিবৌরসান্। বভুবঃ শত্রবো ভূপাঃ কোলাবিধ্বংসিনস্তদা।।
শ্রী শ্রী চণ্ডী মতে, রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য দুজনে মিলে পশ্চিমবঙ্গের গড় জঙ্গলে (আজকের পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরে) মেধস মুনির আশ্রমে মাটি দিয়ে দেবী দুর্গার মূর্তি গড়ে পুজো করেছিলেন। এই গড়জঙ্গলের বোয়ালখালিতে মেধসঋষির আশ্রমের এই দুর্গাপুজোই বাংলার প্রথম বাসন্তী দুর্গোৎসব যার কথা কালিকাপুরাণ ও কামাখ্যা পুরাণেও রয়েছে, এমনটি জানিয়েছেন বর্তমান আশ্রমের সভাপতি অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ রায়চৌধুরী। এখন এই আশ্রমের প্রবেশদ্বারে লেখা রয়েছে "শ্রী শ্রী চণ্ডীতীর্থ মেধস আশ্রম”- এই বলে। দুর্গাপুজোয় এখনও সেখানে মহা ধূম করে দুর্গোৎসব হয় আর দুর্গা সেখানে শ্যামরূপা নামে পূজিতা হন।
এইরূপেই শ্রী শ্রী চণ্ডীর মাহাত্ম্য কালে কালে পরম্পরা ক্রমে প্রচলিত এবং প্রচারিত হলেও বাঙালি হয়তো ভুলে গেছে বোলপুরের সুরথ রাজার রাজধানী সুপুর এবং দুর্গাপুরের মেধস ঋষির আশ্রমকে।
নিজের সমস্ত হারানো সম্পত্তি, রাজ্যপাট ফিরে পেলে তাঁর রাজধানী বলিপুরে ফিরে আসেন সুরথ। আর এই সুরথের দুর্গাপুজোই ছিল বাংলার প্রথম দুর্গাপুজো। তবে তা অনুষ্ঠিত হয়েছিল চৈত্রমাসে। বসন্তকালের বাসন্তী পুজো নামে তা খ্যাত। রাজ্য ফিরে পেতে সুরথ আবার বোলপুরে প্রতিষ্ঠা করেন সুরথেশ্বর শিব মন্দির যেটির নবতম সংস্করণ আমরা দেখতে পাই প্রাচীন মন্দিরের ওপরেই। মন্দিরের অভ্যন্তরে গর্ভগৃহে বিশাল শিবলিঙ্গটি কালাপাহাড় দ্বারা ভাঙা হয়েছিল। জানালেন বর্তমান মন্দিরের পূজারী। এই শিবলিঙ্গ পুজো করতেন সুরথ। সুরথেশ্বর মন্দির বোলপুর-ইলামবাজার সড়কের পাশেই শিবতলায় অবস্হিত। সুরথেশ্বর মন্দির একসময় ঘন জঙ্গলাবৃত ছিল। প্রায় একশো বছর আগে গজপতিনাগ নামে এক শৈব সাধু এই মন্দিরের আংশিক সংস্কার সাধন করেন। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে রাইপুরের জমিদার বংশজ প্রমথনাথ সিংহের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাঁর অর্ধাঙ্গিনী শ্রীমতি সুভাষিনী দাসীর সহায়তায় সুরথেশ্বর মন্দির নতুন করে তৈরি হয়। মন্দির গাত্রের প্রস্তর ফলকেই লেখা
আছে।
সুপুর রাজবাড়ির সে ঠাটবাট, রাজকিয়তা বা কৌলিন্য হয়তো তেমন নেই তবে বিশাল অরণ্যময় চত্ত্বর জুড়ে ঠাকুরদালান, দুর্গাবাড়ি, ভোগঘর, সম্বলিত প্রাচীন শিবমন্দিরের টেরাকোটার ভগ্নাবশেষ আর নিলয় অলিন্দে চামচিকের আনাগোনা দেখে বেশ মাহাত্ম্য প্রতিভাত হয়। এখন সেখানে অস্থায়ী প্রাইমারি স্কুল চালায় কোনও এনজিও। রাজবাড়ির প্রধান ফটকে তেমনই লেখা দেখলাম। গেটে তালা বন্ধ ছিল রবিবারের ভোরে। পাশের গ্রামে জিজ্ঞাসা করায় এক অশীতিপর বৃদ্ধা লাঠি হাতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলেন হাতে চাবি নিয়ে। তাঁর নাম পুষ্প যিনি একসময় ছিলেন সেখানকার খাস রাঁধুনি। সুরথের রাজবাড়িতে বংশানুক্রমে যে জমিদারবাড়ির প্রতাপ প্রতিপত্তি বহুবছর ধরে টিকে ছিল ছিলেন। জানালেন পুষ্প। সুপুরে পরবর্তীকালে জমিদারত্ব দেখা যায়। সুপুরের জমিদাররা গুপ্তিপাড়া হতে আগত গোপাল মজুমদার। আমার সঙ্গে আলাপ হওয়া পুষ্পর মুখে নাম শুনলাম মজুমদারদের। রাজা সুরথের স্মৃতিতে হাটসেরান্দীর গোমস্তা চাটুজ্জেরা
বাসন্তীপুজার প্রচলন করলেন পুরনো হাটতলায়।
#শান্তিনিকেতন #বোলপুর #শিব #দুর্গা #ইতিহাস
ছবি- Apurba Bhakat Shaw