26/08/2025
আজকের কাহিনীটি পঞ্চভূতের (পঞ্চ তত্ত্বের) অন্যতম প্রধান, পবন দেবকে নিয়ে লেখা। এই গল্পটি অনেকগুলো রোমাঞ্চকর প্রতীক দিয়ে পরিপূর্ণ।
একবার দেবর্ষি নারদ তীর্থযাত্রায় বেরোলেন তাঁর মেঘরথে চড়ে। ভক্তিভাবে পরিপূর্ণ হয়ে শ্রী নারায়ণের নাম জপতে জপতে তিনি যাচ্ছিলেন, হঠাৎ অনুভব করলেন যে সামনে একটি বড় বাধা। ধ্যান থেকে চোখ খুলে দেখলেন এক বিশালকায় পর্বত তাঁর পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। নারদ মুনি সেই পর্বতকে প্রণাম করে বললেন, "আমি তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছি, যদি আপনি একটু রাস্তা দেন, তবে আমি চলে যেতে পারি।" সেই পর্বতের নাম ছিলো মেরু। সে নারদের কথা অত্যন্ত অহংকারভরে শুনলো এবং একইভাবে জবাব দিলো, "শুনুন দেবর্ষি, আমি কেবল বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য পথ ছেড়ে দিই, বাকি সবাই পথ পরিবর্তন করে চলে যায়।"
নারদের এই কথা খুব অদ্ভুত লাগলো, কিন্তু তিনি তো নারদ! তিনি নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, "হে পর্বত, আপনি তো জানেন আমি সর্বদা অন্য পথ দিয়ে যাতায়াত করি, কিন্তু এবারে সময়ের অভাব। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে, তাই এখান থেকেই আমাকে পথ দেওয়ার কৃপা করুন।"
মেরু আবার সেই অহংকারী স্বরে জবাব দিলো, "আপনি কোন বিশেষ ব্যক্তি? তাও যদি আপনার এতো তাড়া থাকে, তাহলে আপনি আমাকে প্রদক্ষিণ করে যেতে পারেন।" এই প্রদক্ষিণ করার কথা দেবর্ষির কাছে অপমানজনক মনে হলো। তিনি এবার মনে মনে ক্রোধ করার পরিবর্তে মেরুকে একটি উচিত শিক্ষা দেওয়ার কথা ভাবলেন। তিনি মেরুকে স্পষ্ট জিজ্ঞেস করলেন, "প্রভু, আপনি কি আমার প্রার্থনা শুনবেন না?" মেরু অহংকারের সঙ্গে বলল, "একদম না। যদি যেতে চান, তাহলে আমাকে প্রদক্ষিণ করে যান। আমি আপনাকে পথ দিতে পারবো না।" নারদ একটু হেসে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা ঠিক আছে, যদি দেবরাজ ইন্দ্র আপনাকে আমার জন্য পথ দিতে বলেন, তাহলে?" মেরু বলল, "কে ইন্দ্র? আমি পর্বত। আমার কর্তব্য হলো নিজের স্থান থেকে না নড়া। আমি কারো কথা শুনবো না।" নারদ বললেন, "আচ্ছা ঠিক আছে, মনে হয় দেবরাজের প্রতি আপনার আপত্তি আছে। কিন্তু যদি জলের দেবতা বরুণ আপনাকে পথ দিতে বলেন, তাহলে?" মেরু আবার বললো, "বললাম তো পথ দেবো না।" নারদ আবার হেসে বললেন, "ঠিক আছে, তাহলে তুমিই বলো কার কথা শুনবে?" মেরু পর্বত তখন এই সব কথায় বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো এবং বললো, "আমি কারো কথা শুনবো না।" নারদ বুঝতে পারলেন, এবার সে তাঁর ফাঁদে পড়েছে। তাই তিনি আবারও বললেন, "ভালো করে ভেবে দেখুন, আপনাকে ভগবান ব্রহ্মার দিব্যি, আপনি কি পবন দেবের কথাও শুনবেন না?" একই রাগ আর অহংকারে মেরু পর্বত চিৎকার করে বললো, "আমি আপনাকে কারো কথাতেই পথ দেবো না। আমি পবন দেবের কথাও শুনবো না।"
এটা শুনে দেবর্ষি নারদ জোরে হেসে উঠলেন। মেরু শীঘ্রই বুঝতে পারলো যে সে ফাঁদে পড়ে গেছে। আশা করি আপনারা সবাই জানেন যে পবন দেব হলেন পর্বতের রাজা এবং সব পর্বত তাঁর অধীনে। নিজের রাজার বিরুদ্ধেই ভগবান ব্রহ্মার দিব্যি দেওয়ার পর মেরু নিজের ভুল বুঝতে পারলো, কিন্তু অহংকার কখনো ভুল স্বীকার করতে পারে না। সে ভুলকেই সঠিক মনে করে এবং এখান থেকেই পতনের শুরু হয়। মেরু দেবর্ষি নারদকে বললো, "আপনি আমাকে ধর্ম সংকটে ফেলে দিয়েছেন, কিন্তু যা-ই হোক আর যে যা-ই বলুক, দেবর্ষি, আপনাকে পথ দেবো না মানে দেবো না।"
দেবর্ষি নারদ সেখান থেকে সোজা পবন দেবের কাছে গেলেন। তিনি বললেন, "গতকাল পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। মেরু পর্বত রাস্তায় ছিলো। আমি আপনার কথাও বললাম যে আপনি আমার বন্ধু, আপনি ওকে বলে দিলেই ও পথ ছেড়ে দেবে। কিন্তু সে খুব অহংকারী হয়ে গেছে। যখন আমি ওর কাছে পথ চাইলাম, সে বললো, 'পবন দেব কে? যে তাঁর কথাতে পথ দেবো?'" এটা শুনে পবন দেব ধীরে ধীরে ক্রোধিত হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন, "আচ্ছা, আমি এখনই ওই অহংকারী পর্বতকে উচিত শিক্ষা দিচ্ছি।"
পবন দেব মেরু পর্বতকে দণ্ড দেওয়ার জন্য তাঁর পুরো বেগে বইতে লাগলেন। মেরু পর্বতে থাকা জীবজন্তুরা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এদিক ওদিক পালাতে লাগলো। পর্বত কাঁপতে লাগলো, সমস্ত গাছপালা নষ্ট হতে লাগলো। পবন দেব ঠিক করলেন যে এর অহংকারে ভরা মাথা কেটে শান্ত হবেন। এত বড় পর্বতকে চোখের পলকে নষ্ট করা অসম্ভব ছিলো। তাই পবন দেব নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন। এই সংঘর্ষের সময় এমন একটা পরিস্থিতিও এলো যখন মেরু পুরোপুরিভাবে হেরে যেতে বসেছিলো।
তখনই হঠাৎ তার ভাগ্য দেখুন, ওদিক থেকে ঘুরতে ঘুরতে তার পুরোনো বন্ধু, ভগবান শ্রীবিষ্ণুর বাহন গরুড় এসে পৌঁছালেন। গরুড় নিজের মিত্রধর্ম পালন করলেন এবং মেরু পর্বতকে সাহায্য করলেন। গরুড় দেব পুরো ক্ষমতার সঙ্গে মেরু পর্বতকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। এই যুদ্ধ পুরো এক বছর পর্যন্ত চলতে লাগলো। একদিন শ্রী হরি বিষ্ণুর কোনো এক জায়গায় যাওয়ার ছিলো, তাই তিনি গরুড়কে ডাকলেন। গরুড়ের কাছে মিত্রধর্মের চেয়ে কর্তব্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো এবং তিনি তাঁর কর্তব্য পালনের জন্য চলে গেলেন। মেরু একা হয়ে পড়লো এবং বারবার যুদ্ধরত মেরু পবন দেবের আক্রমণ সহ্য করতে পারলো না। পবন দেবের শেষ আঘাতে তার মস্তক বিহীন হয়ে ভূমিতে পড়লো এবং তার অহংকারের পতন ঘটলো।
এই কাহিনীর সারসংক্ষেপ
এই কাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সার হলো—রাগ বা আবেগপ্রবণ হয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেওয়া থেকে দূরে থাকা উচিত। যখন আমরা রাগের মধ্যে থাকি, তখন আমাদের ক্রোধে মন ভরে থাকে এবং আমাদের ভাবনা-চিন্তা করার ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়।
মেরু যদি নিজের ভাবনা-চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতো, তাহলে কখনোই এই সামান্য কারণে ভগবান ব্রহ্মার নামে প্রতিজ্ঞা করতো না। মেরু যদি স্বাভাবিক বুদ্ধি ও বিবেকের সঙ্গে থাকতো, তাহলে দেবর্ষি নারদের অনুরোধ শুনে তার ক্রোধ এলেও, এই ক্রোধের পরিণতি যে তার পতন ঘটাবে, তা সে বিচার করতো।
এই কাহিনী আমাদের এটাও শেখায় যে জীবনে কখনোই অপরের উস্কানিতে নিজের শক্তি এবং জ্ঞানের অপব্যবহার করা উচিত নয়।
SB Bubai