05/07/2025
সাল ২০০০ কি ২০০২। স্থান সুটিয়া।
একটি মেয়ে বিয়েবাড়িতে ফুচকা খেতে গিয়ে বলে বসলো: ‘ ইসস । কি বাজে খেতে..।’
কি এতো বড় আস্পদা। ব্যাস, বাইক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো বাচাল মেয়েটিকে সবক শেখাতে। টেনে নিয়ে গেলো কিশোরীটিকে পাশের ধান জমিতে..🔴
আরেকটি ঘটনা, স্বামী-স্ত্রী রিকশা করে যাচ্ছেন । রিক্শাওয়ালার সাথে ভাড়া নিয়ে সামান্য মতান্তর হচ্ছে। ব্যস, বাইক বাহিনী হাজির । প্রথমেই, দম্পতিকে প্রশ্ন, তারা কি বিবাহিত? হলে প্রমাণ কি? প্রমাণ নেই, অতঃএব ধর্ষণ । ভদ্রমহিলার যোনিতে ঢুকিয়ে দেয়া হলো বরফ টুকরো । তাঁর নগ্ন দেহের ছবি তোলা হলো । পরে এছবি দেদার বিকোবে।
কারুর টু শব্দটি করার সাহস ছিল না..!💥
পুলিশ অভিযোগ নিতো না। হইহই করে বাড়ছিল হায়নার দল । দাদার অভয় বাণী, যে মেয়েকে ইচ্ছে, তাকে তুলে নিয়ে আয় । নিয়ে চল সুখ সাধুর ভিটেতে। সেখানে মজুত অফুরন্ত মদ ও ক্যামেরা । গ্রামে যেকোন বিবাদ- সম্পর্ক জনিত, জমি বা অর্থকরী সংক্রান্ত- নিদান একটাই, ধর্ষণ । অনেক সময় লাঞ্ছিতা মেয়েটিকে তারা বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে যেত । মেয়েটির মা'কে বলে যেত, মেয়েটিকে তাদের মনে ধরেছে । যেন সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে ।পরের দিন আবার নিয়ে যাবে ।
এই নরক গুলজারের নাম সুটিয়া। উত্তর চব্বিশ পরগনার একদম প্রান্তিক গ্রাম । একঘণ্টা হাঁটলেই বাংলাদেশ সীমান্ত । সুটিয়ার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ইচ্ছামতী, যমুনা । একাত্তরের পর থেকে ওপার বাংলা থেকে এসেছে মানুষের ঢল । প্রতি বছর বর্ষাতে সুটিয়া ভেসে যায় । সরকারি , বেসরকারি রিলিফ ফান্ড আসে । এই রিলিফ ফান্ডের দখলদারি নিয়েই উত্থান সুশান্ত চৌধুরী, বীরেশ্বর ঢালি 'দের ।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং লোকাল লুম্পেনকে পাশে নিয়ে এরা দখল করলেন সুটিয়ার ত্রাণ তহবিল । হুমকি, মারধোর, বাইক বাহিনী । নতুন সহস্রাব্দের শুরু থেকে সুটিয়ার নতুন পরিচয় -ধর্ষণ নগরী। দুহাজার থেকে দুহাজার তিন অবধি শুধু পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী ধর্ষণের সংখ্যাটি ছিল তেত্রিশ । স্থানীয়দের মতে, আসল সংখ্যাটি ঢের বেশি ।
ডেনমার্ক নামক কারাগারটি ভেঙে ফেলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন হ্যামলেট । বরুণ বিশ্বাস সুটিয়ার হ্যামলেট । বা আরো বড়ো কিছু । ফরিদপুর থেকে এসছিল তাঁর পরিবার । শরীরে দুর্মর বাঙাল রক্ত । নইলে ডব্লিউ বি সি এস পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হয়েও কেউ সে চাকরি ছেড়ে দেয়?
দিব্যি তো ছিলেন মিত্র ইনষ্টিটিউশনে, বাংলার শিক্ষক হয়ে। পারতেন কলকাতায় শিফট করতে, এই পাপ নগরী থেকে দূরে থাকতে । আমি-আপনি তাই-ই করতাম । কিন্ত তিনি যে মাস্টারদা..♥️🌻
নিজের উদ্যোগে তৈরি করলেন ধর্ষণ বিরোধী মঞ্চ । পাশে পেলেন কতগুলো উত্সাহী ছেলেমেয়েকে। সরকারের উপর মহলে লিখলেন একটার পর একটা চিঠি । ধর্ষিতা মেয়েদের বিয়ে দিলেন । নেকড়ের পাল'রা কামড়াতে এলে গড়ে তুললেন পাল্টা প্রতিরোধ।রাতের পর রাত বাইকে টহল দিতেন গোটা গ্রাম । তাঁর বাইকের আওয়াজে গোটা গাঁ নিশ্চিন্তে ঘুমোত। লালকমলের আগে নীলকমল জাগে ।
যে ঘরে মাস্টারদা থাকতেন, তাতে একটা খাট আছে। গদি নেই, প্ল্যস্টিক পাতা । এলাকার ছাত্রছাত্রীদের বই, খাতা, পেন, পেন্সিল কিনে দিতেন । যথেষ্ট রোজগার করলেও টাকাপয়সা কিস্যু জমতো না ।রোজ ঘন্টা দুয়েকের জার্নি করতেন রাতটা গ্রামে কাটাবেন বলে । জবা ফুল বড্ড প্রিয় ছিল মানুষটার ।
ওঁর একটার পর একটা চিঠি শেষমেষ সরকারের টনক নড়িয়ে দেয়। সিআইডি তদন্ত হলে গ্রেপ্তার হয় সুশান্ত, বীরেশ্বর সহ আরো অনেকে । মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় এদের । গোটা গাঁ নিশ্চিন্তে হাফ ফেলে । কিন্ত তিনি বরুণ বিশ্বাস, তাঁর লড়াই এতেই শেষ নয় ।
মাস্টারদা লক্ষ্য করছিলেন, প্রতি বছর গ্রামে বন্যা হয় । কারণ কি? জানা গেল, ভাটার সময় কেটে নেয়া হয় মাটি । মাটি-মাফিয়ারা সেই মাটি পাঠিয়ে দিচ্ছে চড়া দামে । ফলে বর্ষাকালে অবশ্যম্ভাবী বন্যা । নতুন বাঁধ, নতুন রিলিফ ফান্ড , নতুন ঠিকাদার-একটা বিরাট, সংঘটিত অপরাধ চক্র । এর বিরুদ্ধে বরুণ শুরু করলেন তাঁর ক্রুসেড ।
দুহাজার বারো,পাঁচ জুলাই । ঠিক আট বছরের আগের ঘটনা । বৃহস্পতি বার। সন্ধ্যের মুখে বনগাঁ লোকাল থামলো গোবরডাঙা স্টেশনে । নামলেন মাস্টারদা । তিন নম্বর থেকে এক নম্বর প্লাটফর্মের দিকে হাঁটা দিলেন । স্টেশনের বাইরে বাইক রাখা । বাকিটা আমরা সবাই সিনেমার পর্দায় দেখেছি । একটি গুলি তাঁর পাঁজর ভেদ করে চলে গ্যাছে । রক্তাক্ত শরীরে মাটিতে পড়ে আছেন বরুণ বিশ্বাস । একটু পরে তিনি মারা যাবেন । অস্তে যাবে সুটিয়ার মুক্তি সূর্য...💔
পরের দিন মানে ছয় জুলাই । ভারী বর্ষা । সব ভুলে স্থানীয় মাঠে জমায়েত হয়েছিল হাজার, হাজার মানুষের । সবাই মাস্টারদাকে চোখের জলে শেষ বিদায় জানাতে চায় । তীব্র ক্রোধে ফুঁসতে থাকা স্থানীয় মহিলারা হাতে তুলে নিয়েছিলেন হাতা, খুন্তি, ঝাঁটা । ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি ।
কেন মারা গেলেন বরুণ? জেলে বসে সুশান্তই কি মারল? নাকি মাটি-মাফিয়া? নাকি আরো কোন বড়ো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র? আমাদের দেশে এসব প্রশ্নের উত্তর হয়না, আমরা জানি । বরুণ-হত্যার পরে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে, ঠিকই । কিন্ত আজ ঘটনার আট বছর বাদেও দোষীরা সাজা পান নি । বনগাঁ মহকুমা আদালতে আজও সে মামলা চলছে ।
তবে ট্রাজেডির এটাই শেষ অঙ্ক নয় । গতবছর শিক্ষক দিবসের দিনে, সুটিয়াতে মাস্টারদার আবক্ষ মূর্তিতে মালা দেননি কেউ। শেষ যেবার কলেজ স্ট্রিটে গেছিলাম, দেখেছিলাম মিত্র ইনস্টিটিউশণের সামনে তাঁর ছবিটি নেই । যদিও ভরসার কথা, স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্ররা তাদের প্রিয় স্যারকে ভোলেননি । সারাবছরই বিভিন্ন সামাজিক কাজের মাধ্যমে মাস্টারদাকে স্মরণ করেন তাঁরা।
জানি, আমরা খুব নগণ্য, সাধারন মানুষ । জীবনযুদ্ধে ধ্বসত । সর্বক্ষণ ভয়-ভয় করে আমাদের । হেরে যাওয়ার ভয়, পিছিয়ে যাওয়ার ভয় । তবু এতোটাও স্মৃতিভ্রষ্ট হবো কি আমরা? মহাকালের কাছে কি উত্তর দেব ? বরং এই অন্ধকার সময়ে বরুণ'কে স্মরণ করাই হয়ে উঠুক আমাদের একমাত্র প্রতিরোধের রাজনীতি ।
কারণ, ❝ বরুণ বিশ্বাস মানে প্রতিবাদের সুর,
বরুণ বিশ্বাস মানে মফস্বলের পায়ে পায়ে
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অপরাজিত ঘোড়ার ক্ষুর....।❞🔥
আজকের সমাজে এমন বরুণ বিশ্বাস দেরই যে আরো বেশি করে দরকার.. প্রয়াণ দিবসে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি..🌷🙏
কলমে ✒️©Hindol Palit
© এক যে ছিলো নেতা