04/10/2025
বন্ধুত্ব। এমন একটা শব্দ যার আকর্ষণ অমোঘ। বড়োরা বলেন আজকালকার দিনে ভালো বন্ধু কেবল ভাগ্যবানেরই জোটে। সেদিক থেকে নিজেকে ভাগ্যবানই বলব। জীবনে ভালো বন্ধু কিছু কম পাই নি। বরং মাঝে মাঝে মনে হয় এতো ভালো বন্ধু পাওয়ার যোগ্যতা আমার আছে কি?
আজ থেকে ষোল বছর আগের কথা। বিয়ের পর সেটা ছিল আমাদের দ্বিতীয় বেড়াতে যাওয়া। যাচ্ছিলাম বিশাখাপত্তনম থেকে জগদলপুর। সেই বিখ্যাত কিরন্ডুল প্যাসেঞ্জার ট্রেনে। অনেকগুলো টানেল পেরিয়ে আরাকু ভ্যালি ছুঁয়ে সে বিকেলে পৌঁছবে জগদলপুর। প্যাসেঞ্জার ট্রেন হওয়ায় ভীষণ ভীড়। আমরা গেছিলাম ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে। তারা স্টেশনে পৌঁছে জানিয়ে দিল সীট জোগাড় করতে হবে নিজের দায়িত্বে। ট্রেনে সাংঘাতিক ভীড়। এমনকি লাগেজ রাখার জায়গাতেও ঠেলাঠেলি করে বসে সবাই। যাই হোক কোনোমতে দুটো সীট পেলাম। ট্রেন যেন মুড়ির টিনের মতো। ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে কি করে যেন সব খাপে খাপে বসে গেলাম। তারপর দেখি, আমাদের মুখোমুখি বসে আছে আমাদেরই মতো এক নতুন দম্পতি। প্রথমে কিছুক্ষণ তাকানো, হাসি পেরিয়ে আলাপ হলো মনিকার সঙ্গে। হিন্দি আর ইংরেজি মিশিয়ে। সে যাচ্ছে তার বাপের বাড়ি। জগদলপুরে। শ্বশুরবাড়ি বিশাখাপত্তনম থেকে রেলপথে ঘন্টা দুয়েক দূরে বোব্বিলি। ওর বর অর্জুন। উনি তেলেগুতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। তবে তাতেও কিছু যায় আসে না। ওনার কিছু বলার থাকলে উনি বলছেন তেলেগুতে। আর মনিকা সেটা অনুবাদ করছে হিন্দি বা ইংরাজিতে। তারপর যেমন হয়। একসাথে গল্প করতে করতে কেটে গেল বারোটা ঘন্টা। অসংখ্য টানেল পেরিয়ে একটা রোমাঞ্চকর ট্রেন সফর শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম জগদলপুর। সেদিন সন্ধ্যায় কোন সিডিউল ছিল না। মনিকা বাড়ির গাড়ি নিয়ে এলো। সারা সন্ধ্যে ওদের সাথে ঘুরলাম জগদলপুর শহর। পরদিন আমাদের প্যাকড প্রোগ্রাম। ফিরতে রাত হল। মনিকার সঙ্গে আর দেখা হলো না। আমরা পরদিন সকাল সকাল রওনা হলাম আরাকু ভ্যালির পথে। এবার গাড়ীতে।
আর দেখা হয় নি আমাদের। মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। ওর ভাইয়ের বিয়েতে নেমন্তন্ন হয়েছে আমাদের। আমার মেয়ের অন্নপ্রাশনে ওদের। কিন্তু কোন না কোন কারণে আসা বা যাওয়া হয়ে ওঠে নি। ফোনও যে নিয়মিত হয় তা নয়। প্রথম প্রথম আমরা চিঠি লিখতাম। সেই সব লম্বা লম্বা চিঠি আমাদের এনে দেয় অনেক কাছাকাছি। তারপর পোস্ট অফিস বাদ সাধলো। আমাদের চিঠি আর পৌঁছয় না। কিন্তু ততোদিনে বন্ধুত্বের ভিতটা শক্ত হয়ে গেছে। মাঝের বছরগুলোতে আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মনিকা হারিয়েছে ওর মা বাবা এমনকি অনাগত সন্তানকেও। আমার মা ও ছেড়ে চলে গেছে আমাকে। সেই সব হাহাকারের মুহূর্তে আমরা পাশে থেকেছি দুজন দুজনের।
এবছর পঞ্চমীর দিন কোলকাতা এসে কয়েক ঘণ্টার জন্য আমার বাড়ি এসেছিল আমার বন্ধু। আর আজ আমি আবার একবার কিরন্ডলু প্যাসেঞ্জারে। ট্রেনটা অনেক বদলে গেছে। আগের সেই লড়াই করে সীট জোগাড় পেরিয়ে আমরা চেপে বসেছি ঝকঝকে ভিস্টাডোমে। সহযাত্রীরা নানান ভাষাভাষী। আগের বারের মতোই। তফাৎ একটাই। সবাই মোবাইলে ব্যস্ত। মুহুর্তকে মুঠো বন্দী করার নেশায়। বন্ধুত্বের সুযোগ এখন আর নেই।