12/08/2022
ইয়া বড় বাড়ি, গেটে চারটা দারোয়ান । ভেতরে গন্ডা খানেক কাজের লোক , পুরো মেঝে মার্বেল পাথরে মোড়া, দেওয়ালে পুট্টির কাজ আর রয়েছে বাগানে বড় একটা দোলনা, কয়েকটা মালী…..
এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গিয়ে দেখি পুরো উল্টো। হ্যাঁ, সূর্যকান্ত মিশ্রর কথা বলছি। কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্রর কথা। দরজায় বেল বাজাতেই ওনার স্ত্রী কমরেড ঊষা মিশ্র দরজা খুলে দিলেন। না আছে নিরাপত্তার বেষ্টনী, না আছে দরজার ভেতর থেকে কে এসেছে জিজ্ঞেস করার বালাই। মেহনতী মানুষের নেতার বাড়ি। সব সময় সকলের অবাধ প্রবেশ। একনজরে দেখে মনে হলো ৬০০-৮০০ স্কোয়ার ফুটের ছোট্ট একটা আবাসন, দুটো ছোট্ট রুম, ঘুপচি একটা রান্নাঘর, রান্নাঘরের পাশেই ফাইবারের একটা ডায়নিং টেবিল, হাজার তিনেক দাম হবে হয়তো। তাতে আবার জলের বোতলে অর্ধেক টা জায়গা ভর্তি। ঠিক যে রুম টায় কমরেড সূর্য মিশ্র বিশ্রাম নেন, সেই রুমের দরজায় সোজাসুজি ৩/৫ ফুটের একটা বাথরুম। প্রথম বিষয় হলো একজন কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক হয়েও আমি যা দেখে চমকে গেছি। নিজেকে প্রশ্ন করছি, এটা সূর্য মিশ্রর বাড়ি? রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের আমলের মন্ত্রীর বাড়ি? কিন্তু কথায় আছে না, 'নিজের চোখে দেখে তবেই বিশ্বাস করো।' নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারি না। পরনে গোলগলা একটা গেঞ্জি, আর লুঙ্গী পরে বসে ব্রাত্য বসুদের কথায় কোটিপতি সূর্য মিশ্র তখন ফ্যানের নীচে, তখন বই পড়ছেন। পুরো ঘর জুড়ে বই এর ভান্ডার। স্পিল্ট এ সি?, আচ্ছা উইন্ডো এ সি? থাক সেটা আর বললাম না। দেওয়াল থেকে রঙ খসে পড়ছে। ওনার বাবার ছবি, ওনার পুরস্কার পাওয়ার ছবি, জানালার উপরে একটা তাক বানিয়ে সেখানেই সাজিয়ে রাখা। কাঁচের অভাবে তাতে ধুলোও জমেছে। শ্রদ্ধার পাহাড়টা যেন হিমালয়ের চেয়েও উঁচু হয়ে যাচ্ছে। কথার মাঝেই প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা আপনার দেশের বাড়ি নারায়ণগড়ে তাই তো? কি যেন একটা গ্রামের নাম বললেন। আর বললেন নারায়ণগড় আমার বিধানসভা এলাকা। এখন তো আর বাড়ি যাওয়া তেমন হয়না। উনি কথা বলে যাচ্ছেন, আমি আশপাশটা একটু ভালো করে মনের মধ্যে গেঁথে নিচ্ছি। হঠাৎ চোখ পড়লো ওনার সফরসঙ্গী সেই ছোট্ট ব্রিফকেস টা। মেঝেতেই রাখা আছে। একটা কোনা ঘসা লেগে লেগে রঙ চটেছে। ভাবতেই পারেন এ আর এমন কি। বিষয় সেটা না। বিষয় সংসদের অধিবেশনে যখন লক্ষাধিক টাকার সাইড ব্যাগ নিয়ে একবারের সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে ক্যামেরা দেখে ব্যাগ লুকোতে হয়, তখন সূর্যকান্ত মিশ্রর ওই রঙচটা ব্রিফকেস টাই আমাদের কাছে অহংকার। হঠাৎ দেখি একটা বাচ্চা মেয়ে, ওই ক্লাস ৪-৫ এ পড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো দাদা চা-এ চিনি দেবে? জেঠিমা জিজ্ঞেস করছে। বললাম না, চা-টা খাবো না। কমরেড ঊষা মিশ্র এগিয়ে এসে বললেন তাহলে এই নাও বিস্কুট অন্তত খাও। জিজ্ঞেস করলাম এটা কি আপনার নাতনি? কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্রই মুচকি হেসে বললেন- না ভাইজি। ওর দাদু আমাদের দেশের বাড়িতে থাকতো, এখন ও এখানেই পড়াশুনো করে। ভাবা যায়, অন্যের সন্তানকে নিজের বাড়িতে রেখে তার পড়াশুনোর দায়িত্ব নিয়েছেন কেউ? এই সমাজে তো না-ই। শ্রদ্ধার পাহাড়টা যেন উচ্চতা বাড়িয়ে পর্বতে পরিণত হচ্ছে। আজ এতদিন পর এতগুলো কথা বলার হঠাৎ কেন প্রয়োজন নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু ঠান্ডা ঘরে বসে চুরির টাকায় যখন চলাফেরা করা মন্ত্রী-বিধায়করা সাংবাদিক সম্মেলন করে, তখন আজীবন সুখের ডাক্তারির চাকরি ছেড়ে পার্টির হোলটাইমার হয়ে মাসে কয়েক হাজার টাকার ভাতাতেই ঘর চালান সূর্য মিশ্র-রামচন্দ্র ডোমরা। আর তাঁদের বিরুদ্ধেই যখন সেই সাংবাদিক সম্মেলন থেকে দুর্নীতির আঙুল তোলা হয়, তখন প্রতিবাদ বারবারই কলম বেছে নেয়। সেই পাঞ্জাবিতেই দুর্নীতির কালি ছেটানো হয়, জেলা সফরে গিয়ে যে মানুষটাকে পরপর তিনদিন একই পাঞ্জাবীতে বিভিন্ন পার্টি প্রোগ্রামে বক্তব্য রাখতে দেখা যায়। ঠিক তখন যেন বুক ঠুকে বারবার বলতে ইচ্ছে হয় – উনিই আমাদের নেতা। আমাদের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক। সম্পত্তি বলতে দেশের বাড়িতে প্রায় ১০ কাঠা জায়গা পৈতৃক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত, ২০১১ সালে যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৭-৮ লাখ টাকা। ২০১১ সালে নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া তার স্থাবর ও অস্থাবর (উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির পরিমাণ ধরে) সম্পত্তির পরিমাণ সর্বসাকুল্যে ১৫ লক্ষ+ টাকা।। কলকাতা কর্পোরেশনের সামনে যখন দাঁড়িয়ে থাকে তৃণমূলের পৌরপিতাদের কোটি টাকার গাড়ি, তখন সুর্য মিশ্রর মত মানুষের মোটর সাইকেল / চারচাকা নেই একটাও।
চিকিৎসাকে পেশা হিসাবে বেছে নিলে হয়তো সৎ পথেই কয়েক কোটি টাকা উপার্জনের যোগ্যতা তাঁর ছিল, আছেও। কিন্তু ওই ৬০০-৮০০ স্কোয়ার ফুটের ঘরই সূর্য মিশ্রদের, কমিউনিস্টদের নিজস্ব ১৬ আনা। তৃণমূল আমলে তৃণমূলের মন্ত্রীদের সম্পত্তির পরিমাণ বাদই দিন বরং, বর্তমানে যেকোনো পঞ্চায়েতের এইটা পাঁচ বছরের তৃণমূলী পঞ্চায়েত সদস্যর সম্পত্তির পরিমাণও কয়েক কোটি টাকা, তখন এই কমরেড সূর্য মিশ্রর মত মানুষগুলোই শ্রদ্ধা করবো নাতো কাকে করবো?? আগামী প্রজন্ম এনাদের নাম শুনে বেড়ে উঠুক, এনাদের জানুক, চিনুক। সমাজসেবা ও আত্মত্যাগের বই এর প্রথম পাতাতেই এনাদের নাম লেখা হোক। যাঁদের নিজেকে সৎ প্রমাণ করতে হোর্ডিং দিতে হয় না, যাঁদের টাকা গার্লফ্রেণ্ডের নামে ফ্ল্যাট কিনে মজুত রাখতে হয় না। যাঁদের দুর্নীতি থেকে বাঁচতে সকালসন্ধ্যা হাসপাতালে গিয়ে মিথ্যা অসুস্থ সাজতে হয় না। যাঁদের ইডি- সি বি আই- সি আই ডির ভয়ে রাত জাগতে হয় না। চুরির দায়ে জেলে গিয়ে যাঁদের পাঁঠার মাংস খেতে হয় না। কর্মসূচীতে গিয়ে মুড়ি-চানাচুরেই যাঁরা জীবন পার করে দিতে পারেন, তাঁরা আমাদের নেতা। আমাদের গর্ব। লাল সেলাম কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্র। তাই বারবার বলতে ইচ্ছে করে-
কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্র বুদ্ধ বাবুর মন্ত্রীসভার সদস্য, কোনো চোর-চিটিংবাজদের না। কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্র মেহনতী মানুষের পার্টির নেতা। বালি-খাদান, কয়লা খাদান গরু পাচারের ব্যানার্জি পরিবারের না...
ঋণ : ✍️ Sabir Laskar