05/02/2023
আজকের দিনের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক 👇👇👇
আজ ৫ ই ফেব্রুয়ারি২০২৩, মাঘী পূর্ণিমা তিথি। বীর চিলা রায়ের ৫১৪ তম জন্ম মহোৎসব। এখানে "ভারত গৌরব বীর চিলা রায়" এর সংক্ষিপ্ত তথ্য তুলে ধরা হল।
পঞ্চদশ শতকের শেষ এবং ষোড়শ শতকের প্রারম্ভকাল-এর মধ্যবর্তী সময়ে (১৪৯০-১৫১০) সমগ্র উত্তর ভারত সহ বিস্তৃত কামতাপুরে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান ছিল। তার মূলে ছিল গৌরবঙ্গের আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ! তার আক্রমণে হিন্দু ধর্ম রক্ষাকারী কামতারাজা নীলাম্বর পরাজিত ও নিহত হন! এই রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পশ্চিম কামরুপ ও কামতা অঞ্চলে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হল। এই সাম্রাজ্যের নির্মাতা- পুরুষ ছিলেন "বীর চিলা রায়"। তিনি সিংহাসনে আসীন কোন রাজা বা সম্রাট ছিলেন না বটে, কিন্তু ভারতবর্ষের যখন উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম সব দিকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান ছিল, ঠিক সেই সময়ে বীরযোদ্ধা চিলা রায়ের আবির্ভাব এবং এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের গঠন ভারত ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়।
ঐ সময়ে নিম্ন অসমের সঙ্কোশ এবং চম্পা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত চিকনা পর্বতের মহাপরাক্রমশালী ক্ষত্রিয় রাজা মহারাজা বিশ্বসিংহের চার পুত্রের সুযোগ্য পুত্রদ্বয় ছিলেন ইতিহাসখ্যাত মহারাজা মল্লধ্বজ বা নরনারায়ণ এবং মহাবীর শুক্লধ্বজ বা চিলা রায়। চিলের মতো ছোঁ মেরে তিনি আকস্মিকভাবে শত্রুদের পর্যুদস্ত করতেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল চিলা রায়।
চিলা রায় ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে জন্ম গ্রহণ করেন। মাতা গৌড়ের কন্যা পদ্মাবতী দেবীর সযত্ন লালন পালনে কুমার শুক্লধ্বজ বা চিলা রায় বাল্যকাল থেকেই খুবই পরাক্রমশালী ও তেজস্বী ছিলেন। মল্লধ্বজ বা নরনারায়ণ এবং চিলা রায় উভয়েই কাশীতে সন্যাসী ব্রহ্মানন্দের আশ্রয়ে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ভারতীয় শাস্ত্রাদিতে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।
১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব সিংহ পরলোকগমন করলে কাশী থেকে প্রত্যাবর্তন করে কুমার মল্লধ্বজ "নর নারায়ণ" নামে কামতা রাজ্যের সিংহাসনে বসেন এবং শুক্লধ্বজ " সংগ্রাম সিংহ" উপাধি গ্রহণ করে রাজ্যের "দেওয়ান" পদে নিযুক্ত হন। দেওয়ান অর্থাৎ চিলা রায় ছিলেন মহারাজা নরনারায়ণের একাধারে কুটনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী এবং সমরকুশলী প্রধান সেনাপতি। যুদ্ধ পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে কূটকৌশল প্রয়োগেও চিলা রায় অদ্বিতীয় ছিলেন। তাঁর পরাক্রমে অহোমরাজ বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। বীর চিলা রায় ক্রমান্বয়ে কাছার রাজ্য, মনিপুর রাজ্য, জয়ন্তিয়া রাজ্য, ত্রিপুরা রাজ্য, শ্রীহট্ট রাজ্য, খৈয়াম বা খাসিয়া রাজ্য এবং ডিমরুয়া রাজ্য জয় করে ঐ রাজ্যগুলিকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। এইরূপে মহাবীর চিলা রায় তাঁর সমরাভিযান দ্বারা এক বিরাট সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মপ্রাণ, বিদগ্ধ পণ্ডিত মহারাজ নরনারায়ণ এক বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের অধিকারী হতে পারতেন না, যদি চিলা রায়ের মতো বীর যোদ্ধা ও সমর কুশলী সেনাপতি তাঁর না থাকতো।
চিলা রায় শুধু একজন বীর যোদ্ধাই ছিলেন শুধু তা নয়, তাঁর অসাধারণ মানবিক গুণও ছিল। তিনি দেব- দ্বিজে ভক্তিমান ছিলেন। বৈদিক সনাতন ধর্মের ধারক ও বাহক ছিলেন তিনি। সাধু, সন্ত, সন্যাসী, ভক্ত ও বিদ্বজ্জনের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা, সাধারণ ও দরিদ্র মানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। ব্রাহ্মণ ও গো- জাতির রক্ষায় তিনি সদা তৎপর ছিলেন। এগুলি ছিল তাঁর ক্ষাত্রোচিত গুণ।
ঐতিহাসিক টয়েনবি আধুনিক বিশ্ব-ইতিহাসে তিন বীরের নাম উল্লেখ করেছেন (১) নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (২) ছত্রপতি শিবাজি এবং (৩) বীর চিলা রায়। আমাদের গর্ব যে- এই তিন বীরের মধ্যে দুজনেই ভারতীয়। ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়নের মধ্যে ছিল উচ্চাকাঙ্খা ও ক্ষমতা লোলুপতা। কিন্তু আমাদের ভারতীয় বীররুপে খ্যাত শিবাজি এবং চিলা রায় দ্বয় ছিলেন- ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে ত্যাগ ও সেবার আদর্শে জাতীয় কর্মযজ্ঞে বৃত হয়ে ভারতমাতার নিস্কাম ও নিরহংকার সেবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। এজন্যই তাঁরা ভারতবাসীর কাছে চির নমস্য হয়ে থাকবেন। ছত্রপতি শিবাজির জীবনে যেমন ছিল সন্ত রামদাসজীর মতো ঋষিতুল্য পুরুষের প্রভাব আর অন্যদিকে বীর চিলা রায়ের জীবনে ছিল ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক মহাপুরুষ শ্রী শঙ্করদেবের মতো মহামানবের সান্নিধ্য।
সমসাময়িক মহাবীর চিলা রায়, মহারাজ নরনারায়ণ এবং মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের মিলন তৎকালীন কামতা রাজ্যের ইতিহাসে "মণিকাঞ্চন যোগ" বলা যায়। এখানে ঋষিশক্তির সঙ্গে ক্ষাত্র শক্তির মিলন হয়েছিল,যা ভারত ইতিহাসে বিরলতম ঘটনা! কারণ, যে রাজন্য শক্তি বা ক্ষাত্র শক্তি ঋষি শক্তির দ্বারা প্রভাবিত থাকে না সে শক্তি কখনোই গণশক্তির অভিমূখী হতে পারে না। মহাভারতের যুগের পর দিল্লিকে কেন্দ্র করে অনুরূপ মণিকাঞ্চন যোগ ঘটেছিল বিক্রমাদিত্যের রাজ্যত্বকালে এবং পরবর্তীকালে ছত্রপতি শিবাজির রাজত্বকালে। (তথ্য সুত্র : "ভারত গৌরব বীর চিলা রায়"- প্রমোদ রঞ্জন রায়)