10/04/2025
লোগাঙ গণহত্যা
লেখা : ইমতিয়াজ মাহমুদ
(১)
আজ ১০ই এপ্রিল, বাংলাদেশের পাহাড়গুলিতে চলছে বিজু উৎসবের প্রস্তুতি। রাঙামাটিতে গত কয়েক বছর ধরে বিজু উপলক্ষ্যে মেলা হয়- মেলা চলছে। ছোটখাটো নানারকম অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে ত্রিপুরা থেকে একজন নৃত্যশিল্পী এসেছেন বাংলাদেশ, রাঙামাটি দীঘিনালা খাগড়াছড়িতে নেচে গেয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে একটা উৎসব আড়ম্বরের আগমনী সুর- হয়তো কোথাও কোথাও বিজুপেক্কো ডাকাও শুরু করে দিয়েছে। এরকমই উৎসবের আগমনিত সুর ভেসে বেড়াচ্ছিল ১৯৯২ সনের এপ্রিলের দশ তারিখে।
কিন্তু সেবছর পাহাড়ের মানুষ বিজুতে আর উৎসব আনন্দের মেজাজে থাকতে পারেনি- সেবারের বিজু ছিল কেবল কান্নার। সেবার এপ্রিলের দশ তারিখে সেটেলার বাঙালী এবং সরকারী কয়েকটা বাহিনীর লোকেরা মিলে খাগড়াছড়ি জেলার পানছরির লোগাং গ্রামে হামলা করে অসংখ্য আদিবাসী মানুষকে বল্লমে গেঁথে, আগুনে পুড়িয়ে, গুলি করে, কুপিয়ে হত্যা করে। জ্বালিয়ে দেয় একটি গ্রুচ্ছগ্রামের প্রায় সকল ঘরবাড়ী, পুড়ে যায় দরিদ্র পাহাড়ি আদিবাসীদের যা কিছু সম্বল ছিল সব। যারা প্রাণে বেচেছিল ওরা প্রায় সকলেই সেবার পালিয়ে যায় সীমান্ত অতিক্রম ক্রে ভারতে, সেখানে শরণার্থী হিসাবে ছিল ওরা ১৯৯৭ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত।
(২)
কি হয়েছিল সেদিন লোগাংএ? এটা নিয়ে আমি আগেও কয়েকবার লিখেছি। প্রতিবার বিস্তারিত লিখতে গিয়ে মন খারাপ হয়, ইমোশনাল হয়ে পড়ি, গ্লানিতে মাথা নিচু হয়ে আসে। কেবল মনে হয় আমার এই প্রিয় মাতৃভূমিতে আমাদের পাহাড়ে একটি মাত্র দিনে তিন চারশ মানুষকে এইভাবে এইভাবে হত্যা করা হয়েছে- যারা হত্যা করেছে ওরা আমার মতোই বাঙালী, ওদের একটা অংশ আমাদের সরকারের চাকরী করে। ওদের কারো একটুও সাজা হয়নি, ওদের চাকুরীতে কোন অসুবিধা হয়নি। নিশ্চিন্ত আরামে ওরা জীবন কাটিয়ে গেছে এই দেশে। এমনকি হত্যাকারীদের কাউকে আমরা নিন্দাও করি না। বাঙালী হিসাবে আমি কি লজ্জিত হবো না? লিখতে ভালো লাগে না, তথাপি সংক্ষেপে বলি।
লোগাং ছিল একটা গুচ্ছগ্রাম। সেখানে চাকমা ও ত্রিপুরা আদিবাসীরা বাস করতো, কয়েকঘর অন্য আদিবাসীও ছিল। লোগাং নদীর পারে বলে গ্রামটার নামও লোগাং। গুচ্ছ গ্রাম থেকে কাছেই আরেকটা পাহাড়ে দুইজন পাহাড়ি মেয়ে গিয়েছিল গরু চড়াতে বা অন্য কোন কাজে, সেখানে ওদেরকে ধর্ষণের চেষ্টা করে কয়েকজন সেটেলার যুবক। পাহাড়ি মেয়েরা আত্মরক্ষার জন্যে হাতের দা দিয়ে ওদেরকে আঘাত করে। সেই আঘাতে গুরুতর আহত নিপীড়ক সেটেলার যুবকদের মধ্যে একজন পড়ে হাসপাতালে মারা যায়। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে সন্ধ্যার দিকে গুচ্ছগ্রামে হামলা করে সেটেলার, বিডিআর, ভিডিপি ও অন্যান্য বাহিনীর লোকজন। গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে ওরা।
গ্রামটিকে ঘিরে গ্রামের কাঁচা ঘরগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন থেকে বাঁচতে পাহাড়ি লোকজন যখন দৌড়ে বেরিয়ে আসে তখন অপেক্ষমাণ হন্তারকরা ওদেরকে হত্যা করতে থাকে। যাদের হাতে বন্দুক ছিল ওরা গুলি করতে থাকে, অন্যরা বল্লম, দা সড়কি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রান্ত পাহাড়ি মানুষের জন্যে পালিয়ে যাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। আবার এতজন সশস্ত্র আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে লড়াই করাও ওদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারাতে থাকে নারী, শিশু, যুবক বয়োবৃদ্ধ সব মানুষ। কেউ কেউ মারা যায় ঘরের মধ্যে আগুনে পুড়ে। যারা কোনক্রমে পালাতে পেরেছিল প্রাণ হাতে নিয়ে, ওরা সীমানা পার হয়ে রাতের অন্ধকারে ভারতে চলে যায়- রিফিউজি ক্যাম্পে ওরা থাকতো।
(৩)
কতজন পাহাড়ি মানুষকে ওরা হত্যা করেছিল সেদিন? একদম সঠিক সংখ্যাটা কেউ বলতে পারে না, নানাভাবে হিসাব করেছে অনেকেই, খুঁজে পাওয়া লাশ, বেঁচে থাকা আত্মীয় স্বজনের প্রদত্ত তথ্যআর একদম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না যাদেরকে এই সব মিলিয়ে কম করে হলেও চারশ আদিবাসী মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। প্রকৃত সংখ্যাটা আরও বেশীও হতে পারে। ঘটনার পর থেকেই ঘটনাস্থলটি ঘিরে রেখেছিল মিলিটারিরা- অনেকদিন সেই এলাকায় কাউকে যেতে দেয়নি ওরা। ঢাকার সাংবাদিকদের খাগড়াছড়িতেই যেতে দিচ্ছিল না- শহরের বাইরেই আটকে দিতো।
বাঙালীদের মধ্যে খুব বেশী মানুষ যে সেখানে যেতে চেয়েছিল তাও না। সারা হোসেন ও আনু মুহম্মদ সহ একদল বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী ঘটনার দুদিন পর সেখানে যেতে চেয়েছিলেন, ওদরকে ঘটনাস্থলের আশেপাশেই ঘেষতে দেয়নি মিলিটারি, খাগড়াছড়ির বাইরেই আটকে দিয়েছিল। সেই দলে, যতটুকু মনে পড়ে, হাসান আরিফ ছিলেন, এবং (সম্ভবত) বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানও ছিলেন। আজকের সিপিবির সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স গিয়েছিলেন- তিনি তখন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আনু মুহাম্মদ সেই ঘটনা অনেকবার প্রেসের কাছে বলেছেন- খুঁজলেই পেয়ে যাবেন।
সেসময় দেশে প্রদাহ্নমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনা ছিলেন বিরোধী দলের নেতা। শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন কয়েকদিন পর। ঘটনাস্থলে তাকে যেতে দেওয়া হয়েছিল কিনা মনে নেই, তবে তিনি একটা জনসভা করেছিলেন আশেপাশেই কোথাও। সেই জনসভায় শেখ হাসিনার সাথে ছিলেন সদ্য প্রয়াত মতিয়া চৌধুরী ও আইভি রহমান। সেই জনসভায় সেদিন শেখ হাসিনা কেঁদেছিলেন। এই কথাটা আজ আমাকে বলতেই হয়, সেদিনের পানছরি সফরটা সম্ভবত শেখ হাসিনাকে পাহাড়ের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
(৪)
সেইবার পাহাড়ে বিজু হয়নি। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও নানাভাবে প্রতিবাদ ও স্মরণ এইসব কর্মসূচী হয়েছে। মানুষ কেঁদেছে, স্মরণ করেছে মৃতদের, বিচার চেয়েছে, প্রতিকার চেয়েছে। প্রতিকার পায়নি- বিচার তো এখনো হয়নি। আমার জীবদ্দশায় হবে বলে মনেও হয় না।
বিচার হবে কি করে? সেই ঘটনার কথা বললেও এখন হেনস্থা হতে হয়। বাসন্তী চাকমার কথা মনে আছে আপনাদের? আওয়ামী লীগ থেকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি হয়েছিলেন তিনি। বাসন্তী চাকমা কৈশোরে আদিবাসীদের উপর এইরকম একটা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে পরিবারের সাথে দেশ ছেড়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পার্লামেন্টে তাঁর প্রথম বক্তৃতায় বাসন্তী সেই স্মৃতির কথা বলেছিলেন। এইজন্যে বাসন্তী চাকমার বিরুদ্ধে পাহাড়ের সেটেলাররা চূড়ান্ত রকমের বিশোদ্গার ও বিক্ষোভ করতে থাকে। কারা সেইসব সেটালারদেরকে আশকারা দিয়েছিল সেকথা আমি বলছি না। বাসন্তী চাকমাকে বাধ্য করেছিল ওরা ওর বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে।
বাসন্তী, প্রিয় বোন আমার, তিনি এখন কোথায় কি বয়স্থায় আছেন জানি না। আজকে এই লোগাং দিবসে এই পোস্ট লিখতে গিয়ে আমি এই সুযোগে তাকে আমি একটা সালাম জানিয়ে রাখি। তাঁর জন্যেই আমাদের জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণীতে অন্তত একটা বক্তৃতা চিরদিনের জন্যে লেখা হয়ে থাকবে যেখানে সেটেলার ও মিলিটারিদের অত্যাচার নির্যাতন আর আদিবাসী মানুষের কষ্টের কথা উল্লেখ করা আছে।
(৫)
লোগাং হত্যাকাণ্ড। আহা লোগাং! চাকমা ভাষায় লোগাং কথাটার অর্থ রক্তের নদী- বাংলা করলে আপনি রক্তগঙ্গা বলতে পারেন। লোগাং নদীটা খুবই ছোট ক্ষীণ একটা নদী- এটার নাম রক্তগঙ্গা হয়েছে কেননা এই নদীটির পানির রঙ লাল, রক্তের মতো। লোগাং নদীটিকে আমরা বাঙালীরা একদিন আসলেই রক্তগঙ্গায় পরিণত করেছিলাম। জীবদ্দশায় আমি হয়তো এই বিচার দেখে যেতে পারবো না- বাকি জীবন আমাকে এই গ্লানি নিয়েই বাঁচতে হবে যে আমি হচ্ছি সেই কওমের একজন যারা সেদিন নদীটিকে পাহাড়ি মানুষের রক্তে প্লাবিত করেছিল।
এবং আমার কওমের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকজন এই ঘটনা নিয়ে একটুও লজ্জিত নয়।