12/02/2025
বিশ্ববীর চিলা রায়ের বীরত্ব ও গর্বিত রাজবংশী জাতি
----------কৃ-----------
👉ভারতবর্ষের ইতিহাসে বীরত্ব, সাহসিকতা ও কৌশলের এক উজ্জ্বল নাম হল বিশ্ববীর চিলা রায়। তিনি শুধু একজন মহান যোদ্ধা ছিলেন না, বরং এক কূটনীতিক, দক্ষ সেনানায়ক ও প্রজাপ্রেমী শাসকও ছিলেন। ষোড়শ শতকের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে কামতাপুর রাজ্যের অস্থির সময়ে, চিলা রায় তাঁর অসাধারণ সামরিক কৌশল এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে রাজবংশী জাতির গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। তাঁর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধাভিযান, ন্যায়পরায়ণ শাসননীতি এবং সংস্কৃতি ও ধর্ম রক্ষার ব্রত আজও রাজবংশী সমাজ ও ভারতীয় ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।১৫০০ সালের দিকে কামতাপুর রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত অস্থির ছিল। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আক্রমণে কামতা রাজ্যের তৎকালীন শাসক নীলাম্বর নিহত হন এবং হিন্দু রাজবংশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে রাজবংশী বীর মহারাজ বিশ্বসিংহ কামতাপুরের পুনর্গঠনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং কামতা রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন।বিশ্বসিংহের পুত্র মহারাজা নরনারায়ণ ও মহাবীর চিলা রায় এই সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্তরসূরী হন। রাজবংশী ইতিহাসে চিলা রায়ের নাম এক বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত, কারণ তিনি শুধুমাত্র একজন সেনাপতি নন, বরং একজন চৌখস কৌশলী, যিনি রাজ্যের সম্প্রসারণ ও সুরক্ষার জন্য অসামান্য অবদান রেখেছিলেন।১৫১০ খ্রিস্টাব্দে মাঘী পূর্ণিমার দিনে মহাবীর চিলা রায়ের জন্ম হয়। তাঁর পিতা ছিলেন মহারাজ বিশ্বসিংহ এবং মাতা ছিলেন পদ্মাবতী দেবী। বাল্যকাল থেকেই চিলা রায় পরাক্রম, সাহস ও কৌশলের দিক থেকে অতুলনীয় ছিলেন। কাশীতে তিনি ব্রহ্মানন্দ সন্ন্যাসীর কাছে শিক্ষালাভ করেন এবং ভারতীয় শাস্ত্র ও সামরিক কৌশলে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
🔥মহারাজ নরনারায়ণের শাসনকালে চিলা রায় "সংগ্রাম সিংহ" উপাধি গ্রহণ করে সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কামতা রাজ্যের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করেন এবং একাধিক রাজ্যকে জয় করেন। তাঁর সামরিক নীতিতে ছিল দ্রুতগামী আক্রমণ ও শত্রুকে স্তব্ধ করে দেওয়ার দক্ষতা, যা তাঁকে "চিলা রায়" নামে পরিচিত করে। অসমের অহোম রাজ্যের শক্তিশালী প্রতিরোধ সত্ত্বেও চিলা রায় তাঁদের পরাজিত করেন এবং বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। কাছার, মনিপুর, জয়ন্তিয়া, ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট, খাসিয়া ইত্যাদি একের পর এক রাজ্য জয়ে সাফল্য অর্জন করেন এবং কামতা সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান।মোগল সম্রাট আকবরের সময়েও চিলা রায় তাঁর কৌশল ও বীরত্বের মাধ্যমে রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষা করেন। চিলা রায় শুধু একজন সেনাপতি নন, বরং একজন ধর্মপ্রাণ, দয়ালু ও প্রজাবৎসল শাসকও ছিলেন। তিনি বৈদিক সনাতন ধর্মের রক্ষক ছিলেন এবং সাধু, সন্ত ও ব্রাহ্মণদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের সান্নিধ্যে এসে তিনি কামতা রাজ্যের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ঘটান।চিলা রায়ের মানবিক গুণাবলীর কথা না বললেই নয়।চিলা রায়ের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর মানবিক গুণাবলী। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা,সম্মান করতেন এবং তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। সাধারণ মানুষের কল্যাণের বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। দরিদ্র ও নিপীড়িতদের সাহায্য করার জন্য তিনি নানান উদ্যোগ নেন। ব্রাহ্মণ ও গোরক্ষার ক্ষেত্রে তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি তিনজন মহাবীরের কথা উল্লেখ করেছেন— নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, ছত্রপতি শিবাজি এবং বিশ্ববীর চিলা রায়। শিবাজির মতোই চিলা রায় নিছক সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করেননি; বরং তিনি হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্ম রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। চিলা রায় ও মহারাজ নরনারায়ণের যুগকে কামতা রাজ্যের "সোনালি যুগ" বলা হয়। তাঁদের শাসনকালে কামতা রাজ্য শুধুমাত্র সামরিক দিক থেকে নয়, বরং অর্থনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
💥বিশ্ববীর চিলা রায়ের বীরত্ব, দেশপ্রেম, সামরিক প্রতিভা ও কূটনৈতিক দক্ষতা তাঁকে ভারতীয় ইতিহাসে অমর করে তুলেছে। রাজবংশী জাতির জন্য তিনি গর্বের প্রতীক এবং তাঁর স্মৃতি আজও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অনুপ্রেরণা জোগায়। ভারতীয় ইতিহাসে তাঁর স্থান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, এবং তাঁর বীরত্বের গাথা রাজবংশী জাতিকে গৌরবান্বিত করবে চিরকাল। আজকের এই পূণ্য লগ্নে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও পদযুগলে প্রণাম জানাই। --কলমে ✍️ হরেকৃষ্ণ বর্মন
শিক্ষক
লিলাবতী মহাবিদ্যালয়