30/04/2025
বইয়ের নাম - দেববাহনিকা
প্রকাশনা - স্বপ্ন প্রকাশন
লেখিকা - সঞ্চারী ভট্টাচার্য্য
প্রচ্ছদ - বৃষ্টি
মূল্য - ৩০০ /-
স্বপ্ন প্রকাশনীর হাত ধরে পাঠকমণ্ডলীর হাতে এসে পৌঁছাতে চলেছে এক অভিনব গ্রন্থ — "দেববাহনিকা", লেখিকা সঞ্চারী ভট্টাচার্যের হৃদয়-সঞ্জাত আরাধনার ফল। এই বইয়ের পাতায় পাতায় বুনে রাখা হয়েছে সেই বিস্ময়ের গাথা, যেখানে দেবতা বা দেবী আর তাঁদের বাহন আলাদা করে চিন্তাই করা যায় না। যেন দেবতার মহিমা, তাঁর শক্তির প্রকাশ, তাঁর ব্যক্তিত্বের আবাহন — সবকিছুর সঙ্গেই অবিচ্ছেদ্য হয়ে জড়িয়ে আছে বাহনের অস্তিত্ব। বাহন ছাড়া দেবতা যে অসম্পূর্ণ, দেবী যে অধরা — সেই অদৃশ্য অথচ দৃঢ় সত্যটিকেই নতুন আলোয় আবিষ্কার করিয়েছেন সঞ্চারী তাঁর নতুন এই গ্রন্থে।
"দেববাহনিকা" শব্দটি মূলত সংস্কৃত উৎসারিত এক গভীর দার্শনিক সংজ্ঞার বাহক। 'দেব' অর্থাৎ দেবতা, সেই নিত্যসত্তা যিনি বিশ্বচেতনার বিভিন্ন শক্তিরূপে অধিষ্ঠিত; এবং 'বাহনিকা' শব্দটি এসেছে 'বাহন' ধাতুর লঘুপ্রত্যয়িক রূপান্তর থেকে, যার অর্থ পরিবাহিকা, বা যিনি শক্তির প্রবাহ ঘটান। সুতরাং, দেববাহনিকা নির্দেশ করে সেই সত্ত্বাকে, যিনি দেবতার ইচ্ছাশক্তির বাহন হয়ে মহাজাগতিক ক্রিয়াকর্মে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। এখানে বাহন কোনো জড় বস্তু নয়, বরং দেবশক্তির প্রতীকময় সম্প্রসারণ, যিনি দেবতার অভীষ্ট কার্যসিদ্ধিতে অবিচ্ছিন্ন সহচর। দেবতা ও বাহনের মধ্যে সম্পর্ক কেবলমাত্র বাহ্যিক গমনাগমনের নয়; বরং এক পরস্পরনির্ভর, আধ্যাত্মিক সহাবস্থানের সূক্ষ্ম সম্বন্ধ। দেবতার নির্দিষ্ট শক্তির বিশেষতঃ প্রতিরূপ হয়ে বাহন নিজস্ব অস্তিত্বে দেবতাকে পূর্ণতা প্রদান করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেববাহনিকা এক গভীর রহস্যের দ্বারোদ্ঘাটন করে, যেখানে বাহনের মাধ্যমে দেবতার মহিমা বহমান হয়, কর্ম সম্পাদিত হয়, এবং শক্তির প্রকাশ ঘটে। দেব ও বাহনের অখণ্ড ঐক্যই প্রকৃত দেববাহনিক ভাবনার মূলে নিহিত।
শাশ্বত ভারতীয় ভাবনায়, দেবতা একা নন — তাঁর সাথে আছে এক বিশ্বস্ত সঙ্গী, বাহন। যে বাহনের মাধ্যমে দেবতা প্রকৃতির, মানবচিত্তের, শক্তি ও বোধের নানা দিকের প্রতীকী প্রকাশ ঘটান। কখনও সিংহের মতো তেজস্বী, কখনও কচ্ছপের মতো ধীর-স্থির, কখনও আবার অবধারিত গরুর মতো নির্ভীক ও নিরীহ। বাহনের চরিত্র, গতি, রূপ — সমস্ত কিছু দিয়েই দেবতার এক একটি দিককে উদ্ভাসিত করা হয়েছে। এই গভীর অর্থবহ সম্পর্কই হয়ে উঠেছে "দেববাহনিকা"-র মর্মমূলে সঞ্চারিত প্রাণশক্তি।
"দেববাহনিকা" পড়তে পড়তে পাঠক অনুভব করবেন, কতখানি সূক্ষ্মতা, কী অপরিমেয় জটিলতা ও রহস্য লুকিয়ে আছে বাহন ও দেবতার মধ্যকার এই অনন্য সখ্যতায়। বাহন শুধু বাহক নয়, বাহন স্বয়ং এক অর্থপূর্ণ সত্তা — দেবতার মনোভঙ্গির, শক্তির এবং কর্মক্ষমতার প্রকাশক। যেমন — দুর্গামায়ের সিংহ তাঁর অপরাজেয় শক্তির, অব্যর্থ সাহসের, ভয়-অবজ্ঞার প্রতীক। আবার সরস্বতীর রাজহাঁস জ্ঞানের নির্মল প্রবাহের, শুদ্ধতার, এবং সূক্ষ্ম বিবেচনার আধার। গণেশের ইঁদুর অদম্য কৌতূহলের, ক্ষুদ্র শক্তিরও মহান কাজে ব্যবহারের নিদর্শন।
সঞ্চারী ভট্টাচার্য যেন শব্দের তুলিতে একেকটি বাহনের চরিত্র এমনভাবে এঁকেছেন যে, পাঠকের মনে তারা রক্তমাংসের জীবন্ত সত্তায় রূপান্তরিত হয়। শুধু পৌরাণিক বর্ণনা নয়, প্রত্যেক বাহনের পিছনের গল্প, তার জন্মকথা, তার দেবতার সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার রহস্য, তার ধর্মীয় ও দার্শনিক তাৎপর্য — এই গ্রন্থে মেলে ধরে এক অনুপম ভাবনার জগত। পাঠক জানবেন, কেন মা লক্ষ্মী পদ্মের উপর স্থিত, কেন কার্তিকের বাহন ময়ূর, কেন শিবের সঙ্গী নিরীহ নন্দী।
পৌরাণিক কাহিনীগুলি "দেববাহনিকা"-তে এত সূক্ষ্ম আর গল্পরসপূর্ণভাবে জড়ানো হয়েছে যে পাঠকের মনে হবে, কোনো সেকাল পেরিয়ে আসা গাঁথা, যা এখনও বাতাসে মৃদুস্বরে ফিসফিসিয়ে চলে। শৈলপুত্রী দেবীর বাহন ষাঁড়ের আখ্যান থেকে শুরু করে, মহাকালী ও তাঁর বিভীষিকাময় গাধার বাহন পর্যন্ত — প্রতিটি আখ্যান নিজস্ব ঐশ্বর্যময় রঙে উজ্জ্বল। সঞ্চারী অতি নিপুণ হাতে এই প্রাচীন আখ্যানগুলিকে টেনে এনেছেন আধুনিক পাঠকের মননে, তবু বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধা বা লঘুতার ছোঁয়া না রেখে।
এই গ্রন্থের এক বিশেষ গুণ হলো — এখানে বাহনদের মনস্তত্ত্বও অনুপমভাবে অনুসন্ধান করা হয়েছে। বাহনদের মনে কি চলে? বাহন কি কেবল আদেশ পালনের জন্য? নাকি তাঁদেরও নিজস্ব সাধনা আছে? তাঁদের নিজস্ব বলিদান? লেখিকা দেখিয়েছেন — বাহনরাও যেন এক একটি শাক্ত-সত্তা, যাঁরা দেবতার শক্তিকে স্থিতি দেন, প্রকাশের আঙ্গিক তৈরি করেন। এই মর্মে সঞ্চারীর রচনা একধরনের গভীর দার্শনিক স্তরে পৌঁছে যায়, যেখানে দেবতা ও বাহন একে অপরের প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে।
গঙ্গার বাহন মকর, যাকে আধুনিক মনন প্রথমে কল্পনার জন্তু ভেবে হয়তো উড়িয়ে দিত। কিন্তু "দেববাহনিকা"য় সঞ্চারী তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন — মকর আসলে স্রোতের নিচের সেই গভীরতাকে বোঝায়, যে গভীরতা অদৃশ্য হলেও সমগ্র প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। গঙ্গা যেমন বাহ্যিকভাবে শান্ত, অথচ অন্তর্লীনভাবে দুর্দান্ত — মকর সেই অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।
কিন্তু এই বই কেবল প্রাচীন পুরাণের পুনরুচ্চারণ নয়। এখানে পাঠক খুঁজে পাবেন এক আধুনিক মননের দৃষ্টিভঙ্গি, যা বাহনদের কেবল পৌরাণিক চরিত্রের সীমায় আবদ্ধ রাখে না, বরং তাদের অস্তিত্বকে বিশ্লেষণ করে সময়ের পরিক্রমায়। সঞ্চারী প্রশ্ন তুলেছেন — আজকের জগতে, যেখানে মানুষ যান্ত্রিক গতির বাহনে আবিষ্ট, সেখানে কি দেবতার বাহনের ধারণা আমাদের জীবনবোধে আর কোনো প্রভাব ফেলে? না কি, বাহনেরাও হারিয়ে গেছে এক বিস্মৃত অতীতের গর্ভে? আবার তিনি নিজেই জবাবও দিয়েছেন — বাহনেরা আজও আছে, আমাদের মানসভূমিতে, প্রতীক হয়ে — কখনও সাহসের, কখনও জ্ঞানের, কখনও ধৈর্যের, কখনও নিরব প্রেমের।
"দেববাহনিকা"-য় রয়েছে অপদেবী ও অপদেবতার বাহন নিয়েও গভীর অনুসন্ধান। এইসব অল্প পরিচিত বাহনদের কথা, যাঁরা ভয়ের, ত্যাগের, বা অশুভ শক্তির প্রতীক — তাঁরা যেন এক অন্ধকারলোকের প্রতিনিধি, যা দেবতাদের গৌরবময় আলোকপথের বিপরীত মেরু। যেমন, চামুণ্ডা দেবীর বাহন শ্বাপদপিণ্ড বা কুকুর — ত্যাগ, মৃত্যু ও সময়ের নিষ্ঠুরতার প্রতীক। এসব বাহনদের গল্পও সঞ্চারী তুলে এনেছেন সযত্নে, দুঃসাহসিক অধ্যাবসায়ে।
সঞ্চারী ভট্টাচার্যের ভাষা এখানে কখনও দীপ্ত, কখনও কোমল, কখনও অগ্নিতুল্য, আবার কখনও শিশিরবিন্দুর মতো স্বচ্ছ। তিনি গল্প বলেন, ব্যাখ্যা দেন, প্রশ্ন করেন, আবার পাঠককে ভাবনার আবর্তে টেনে নেন। বইটি যেন কোনো এক অদৃশ্য যাত্রার সহচর, যেখানে পাঠক নিজেকেও খুঁজে পেতে পারে বাহন ও দেবতার অনুপম সম্বন্ধে।
গ্রন্থটির নকশা, তার অলংকরণ, সবকিছুতেই রয়েছে এক ঐন্দ্রজালিক ছোঁয়া। প্রতিটি অধ্যায়ে ব্যবহৃত চিত্রাবলী যেন এক একটি মন্ত্রপাঠ — চোখ বুজলেও যেন তাদের বর্ণময়তা অনুভব করা যায়। নামের ব্যাখ্যা, পৌরাণিক তুলনা, কাহিনির বিশ্লেষণ — সব মিলে "দেববাহনিকা" হয়ে উঠেছে দেবতা ও বাহনের রহস্যময় ভুবনের এক অমূল্য দলিল।
স্বপ্ন প্রকাশনীও এই বইয়ের প্রকাশনায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বইটি কেবল একটি পৌরাণিক গবেষণাগ্রন্থ নয়; এটি আবেগের, সংস্কৃতির, ইতিহাসের এবং চিরন্তন ভারতীয় মননের এক আশ্চর্য মেলবন্ধন। যারা পুরাণ ভালোবাসেন, যারা দেবদেবীর দর্শন বোঝার গভীরে যেতে চান, অথবা যারা নিছক ভালো লেখালিখির অনুরাগী — সবার জন্য এই বই হবে এক অপরিহার্য সংগ্রহ।
সঞ্চারী ভট্টাচার্য তাঁর অনুপম কলমের ছোঁয়ায় প্রমাণ করেছেন — বাহন শুধু বাহন নয়, বাহন হল ধর্মের, সংস্কৃতির, জীবনদর্শনের এক প্রতীকি বাহক। দেবতা যেমন বাহন ছাড়া চলেন না, তেমনি বাহনরাও দেবতার এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা। "দেববাহনিকা" পাঠ শেষে পাঠক অনুভব করবেন — এই জগতের প্রতিটি গতি, প্রতিটি প্রত্যয়, প্রতিটি শক্তি কোথাও না কোথাও কোনো এক বাহনের উপর নির্ভরশীল। বাহনহীন দেবতা কেবল এক তাত্ত্বিক ধারণা — বাস্তব অভিজ্ঞান নয়।
এই ভাবেই "দেববাহনিকা" হয়ে উঠেছে এক গাথা — বাহকের ও বহনের, বিশ্বাসের ও বিস্ময়ের, দেবতার ও ভক্তির। সেই গাথা, যা বারবার পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেবে — আমাদের সমস্ত যাত্রা, সমস্ত সাধনা, সমস্ত অর্জন — সবই কোথাও না কোথাও এক অব্যক্ত বাহনের উপর নির্ভর করে।
এ এক অনির্বচনীয় মাধুর্যের অভিজ্ঞতা। একবার হাতে নিলে, শেষ না করে নামানো কঠিন।